সি এম-এর বিরুদ্ধে আনীত এইসব নিতান্ত একপেশে ও অনৈতিহাসিক অভিযোগগুলির স্পষ্ট বিপরীতে দাঁড়িয়ে সিপিঅাই(এমএল) কমরেড চারু মজুমদারের অবদান ও উত্তরাধিকারকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরই নির্ভর করে থাকে।
১৯৮৪-র ২৮ জুলাই দেশব্রতীর বিশেষ সংখ্যায় বিনোদ মিশ্র লিখেছিলেন, “আমার মতে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে চারু মজুমদারই প্রথম ব্যক্তি যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, ব্যাপক কৃষক সাধারণের ওপর নির্ভর করে, তাঁদের বিপ্লবী রাজনীতিতে জাগিয়ে তুলে ও গেরিলা যুদ্ধের মারফৎ সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়েই একমাত্র ভারতবর্ষের মুক্তি সম্ভব। ভারতীয় বিপ্লবের এই মৌলিক দিশা তিনি শুধু ঘোষণা করেছিলেন তাই নয়, তাকে রূপায়িত করার জন্য একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলে সর্বাত্মক বিপ্লবী সংগ্রামে সর্বাধিক দৃঢ় নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। “ভারতীয় কমিউনিস্টরা যখন কিষাণসভা, ট্রেড ইউনিয়ন ও নির্বাচনী লড়াইয়ের দৈনন্দিন খুঁটিনাটিতে অাটকে থেকে সংশোধনবাদের পাঁকে ডুবতে বসেছিলেন তখন চারু মজুমদারের কণ্ঠেই শোনা গিয়েছিল ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের মুক্তির বজ্রনির্ঘোষ। এমনকি তাঁর ভুলগুলির মধ্যে দিয়েও তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন প্রকৃত কমিউনিস্ট হওয়ার তাৎপর্য কি। তাঁরই চোখ দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলাম এক মুক্ত, জনগণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের – এক সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষের অার নতুন প্রাণোচ্ছ্বল শক্তিতে ভরপুর হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন পেয়েছিল এক নবজীবন।
“সংশোধনবাদী লাইন ও চিন্তা এবং কাজের রীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে গেঁড়ে-বসা সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদঙ চিন্তাধারাকে ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একাত্ম করার প্রথম সচেতন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
“প্রচেষ্টাটাই যেহেতু প্রথম, তাই বহু অস্পূর্ণতাই থেকে যায়, ঘটে যায় বহু গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সর্বোপরি এক বিপ্লবী জোয়ার ও প্রাথমিক কিছু সাফল্যের মুখে ভুলে যাওয়া হয় যে একটা দেশ বা জাতির জীবন মাপাই হয়ে থাকে দশকের হিসাবে – একটি মানুষের জীবনের মতো বছরের হিসাবে নয়।”
উদ্ধৃত শেষ লাইনটিতে ভি এম আমাদের দেশ ১৯৭৫-এর মধ্যে মুক্তি অর্জন করবে – এই কল্পিত বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন – বিপ্লবী পরিস্থিতির অতি মূল্যায়ন ও অধৈর্য্যপনা থেকে যে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল এবং যা অতি বামপন্থী প্রবণতার জন্ম দিতে সহায়ক হয়েছিল। অনুচ্ছেদটিতে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সমালোচনামূলক আত্তিকরণের দৃষ্টিভঙ্গীই ফুটে উঠেছে – যা কমরেড মিশ্র সি এম-এর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পার্টি পুনর্গঠনের পর সিপিআই(এমএল)-এর ইতিহাসকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে যা আমাদের দিশা প্রদান করেছিল। এভাবেই অতীতের মূল্যায়ন-এ (রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট, তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস, ১৯৮২) তিনি লিখেছেন :
“সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে মেলানোর প্রশ্নটিকেই প্রথমে ধরা যাক। সাধারণভাবে এই কথাটিকে এক সর্বরোগহর-দাওয়াই হিসেবে বারবার আউড়ে গেলে মার্কসবাদী বাস্তব কর্মীর জন্য তা কোনোই তাৎপর্য বহন করে না। ইতিহাসের তথ্য এ কথাই বলে যে অগ্রগতির পথে সমস্ত গণআন্দোলন নতুন নতুন রূপ গ্রহণ করে; লাগাতার চলতে থাকে পুরাতনকে বর্জন করে নতুনের সৃষ্টি আর ঘটতে থাকে নতুন ও পুরানো রূপের রূপান্তর বা নতুন নতুন বিন্যাস। কমিউনিস্ট হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল উপযুক্ত সংগ্রামের রূপ গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। লেনিন বলেছেন, বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসের প্রয়োজনকে নীতিগতভাবে বিন্দুমাত্র অস্বীকার না করেও আমাদের এমন সব সংগ্রামের রূপের বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ঘটতে পারে এবং এই অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হয়েছে।”
লেনিনবাদী এই তাত্ত্বিক কাঠামো থেকে শুরু করে তিনি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতির প্রতি এবং সিপিএম-এর শিক্ষাসমূহের যা প্রকৃত বৈশিষ্ট্য তার প্রতি দৃষ্টি অাকর্ষণ করেন :
“বীরত্বপূর্ণ নকশালবাড়ি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়া-সংশোধনবাদের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর এবং প্রায় দুবছর ধরে গণআন্দোলন গড়ে তোলার বিপ্লবী অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করার পর ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা এমনই একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। সংগ্রামের নতুন রূপের জন্য তাঁরা ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রীকাকুলাম সংগ্রামের উত্তাপের মধ্যে সূত্রায়িত হল গণসমর্থনের ওপর ভিত্তিশীল 'খতম' – যার উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা আর জনগণকে ধাপে ধাপে সংগ্রামে সামিল করা – এই দুটি দিককে মেলানো। চারু মজুমদারের লাইনের এই মূল দিশা – গণসংগ্রামের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপকে মেলানো (এক এক সময়ে এক একটি দিক প্রধান হতে পারে) – এটাই নকশালবাড়ির আগেথেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক লাইনে বিধৃত আছে।”