“১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর বাবা যখন জেল থেকে ফিরলেন তারপর থেকেই তাঁর মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখলাম। তিনি যেন একটা নতুন কিছু খুঁজছেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হল। তারপর তিনি সারাদিন বাড়িতে ইজিচেয়ারে বসে পড়তেন, লিখতেন। মাঝে মাঝেই গ্রামে যেতেন। বাড়িতে নতুন লোকেদের নিয়ে বৈঠকও করতেন যাঁদের অধিকাংশই ছাত্র ও যুবক। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলাম, তিনি ভারতবর্ষকে আমূল পাল্টে ফেলার এক দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখছেন। তিনি বলতেন যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং মাও সেতুঙের চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগেই সেটা সম্ভব। তার জন্য তিনি নতুন মানুষের সন্ধানে ছিলেন – যারা শুধু মৃত্যুভয় ত্যাগ করবে না, নিজেকে একেবারে পাল্টে কৃষক ও শ্রমিকের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারবে। তারপর আমার চেনা দশজন যুবক কাকুরা একদিন তাদের সমস্ত পরিচিত পরিবেশ, বাড়ি এবং নিজেদের পড়াশোনা ও কেরিয়ার ছেড়ে গ্রামে চলে গেল বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে। আমি এই নতুন মানুষদের বুঝতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখলাম।
১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান ঘটলো। এরপর কমরেড বাবুলালের শহীদ হওয়ার খবরে বাবার মধ্যে প্রচণ্ড একটা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম – একই সঙ্গে এক প্রিয় কমরেডের জ্ন্য গৌরব ও শোক। তিনি সেদিন দুপুরে পায়চারি করতে করতে কমরেড বাবুলালের ওপর তাঁর লেখাটি আমাকে ডিকটেশন দিলেন। তারপর একদিন কমরেড পঞ্চাদ্রি কৃষ্ণমূর্তি আমাদের বাড়িতে এলেন, দুদিন থাকলেন। লড়াই আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। এল ১৯৬৯ সাল। বাবা অস্থির হয়ে পড়ছেন। আমি, মা বুঝতে পারছি উনি আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যেতে চাইছেন। কিন্তু যে লোকটার দিনের মধ্যে কয়েকবার ভয়ঙ্কর বুকের ব্যথা হয়, অনেক সময় তার জন্য পেথিডিন ইনজেকশনও নিতে হয় এবং বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হয়, তার সেল্টার যোগাড় করা মুশকিল। এ সত্ত্বেও বাবা কলকাতায় যেতেন মাঝে মাঝে। ১৮ জুন সেই যে গেলেন, অনেকদিন আর কোনো খবর পেলাম না। বুঝলাম উনি ওনার প্রিয় কমরেডদের সাথে একসাথে লড়াই করার জন্য বাড়ি ছেড়েছেন। তখন আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি, আমার বোন অষ্টম এবং ভাই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
তারপর একদিন পুলিশ বাড়ি সার্চ করতে এলো। আমার মা আমাদের বললেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারে, তোমরা ভেঙ্গে পোড়ো না।” ওরা আমাদের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে নিয়ে গেল। যখনই পুলিশ সার্চ করতে আসতো মা তখনই তাদের কাছে ওয়ারেন্ট চাইতেন এবং তাদের পকেটের রিভালবার বাইরে রেখে তবে ঢুকতে দিতেন।
১৯৭০ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে আমরা কয়েকবার পার্টির নির্দেশে অত্যন্ত গোপনে বাবার সাথে দেখা করি। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারীতে এইভাবে তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়।
আমি ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে প্রি-মেডিক্যাল পড়তে কলকাতা গেলাম। ১৭ জুলাই সকালে হঠাৎ-ই দুজন পুলিশ আমার সাথে দেখা করতে হস্টেলে এলো এবং বাবার গ্রেপ্তারের খবর দিয়ে আমাকে লালবাজারে যেতে বলল। হস্টেলে আমার পরিচয় আর গোপন থাকল না। কংগ্রেসী সিনিয়র মেয়েরা আমাকে ডেকে নানাভাবে ব্যঙ্গ করতে লাগল। আমি ১১টা নাগাদ লালবাজারে গেলাম। সেন্ট্রাল লক-আপে বাবার সাথে দেখা হল। আমি সেখানে কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখতে পেলাম না। বাবা হেসেই কথা বললেন। তাঁকে খুব অসুস্থ মনে হল না – এর থেকে অনেক বেশি অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে আমরা দেখেছি। আমরা দুজনেই বুঝলাম যে এই সরকার তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না, সুতরাং শেষ মুহূর্তের প্রতীক্ষা। পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমার মা-ভাইবোন এলো। আমরা দু-তিনবার লক-আপে বাবার সাথে দেখা করলাম। মাকে বাবা বললেন, তোমরা আর কদিন থাকবে, এবার শিলিগুড়ি চলে যাও। ২৫ জুলাই শেষবার আমাদের সাথে তাঁর দেখা হল। ২৮ জুলাই সকাল ৮টা নাগাদ আবার পুলিশ এলো। আমাকে বলল যে আপনার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পিজিতে আছেন, উনি আপনাকে দেখতে চাইছেন। আমার প্রথমেই মনে হল এটা হতে পারে না, আমার বাবা কখনই পুলিশের কাছে এই অনুরোধ করতে পারেন না।
পিজিতে পৌঁছে দেখি অসংখ্য পুলিশ, আর এখানে ওখানে গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষ। আমি কেবিনের দরজা থেকে দেখলাম উনি শুয়ে আছেন, ওঁর শরীর সাদা চাদরে ঢাকা, মাথায় বালিশ নেই। বুঝলাম, সব শেষ। কিন্তু আমার একটুও কান্না এলো না। আমার বাবা বিপ্লবের জন্য শহীদ হয়েছেন, সেই গৌরববোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমি শুধু ওনার বুকের ওপর ছোট্ট সাদা কাগজে লেখা 'কজ অফ ডেথ'টা মুখস্ত করলাম : 'ইস্কিমিক হার্ট ডিজিস উইথ কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেলিওর'। কত বয়স্ক নার্স এসে ওনাকে প্রণাম করে গেলেন। আমার মনে হল উনি শুধু আমার বাবাই নন, আরও অসংখ্য মানুষের পিতৃতুল্য। আমার মনে এলো ওঁর একটা কথা – 'মানুষ নিজের জন্যই বিপ্লবে সামিল হয়'। মা-রা সেদিনই কলকাতায় পৌঁছালো এবং রাতে কড়া পুলিশ প্রহরায় তাঁর শরীরটা কেওড়াতলা শ্মশানে পুড়ে গেল। আমি জানতাম এ শুধু আমাদের পারিবারিক শোক নয়, এতে সামিল আছেন আরও অসংখ্য মানুষ। আমি জানতাম, এতে বিপ্লবের গতি স্তব্ধ হবে না, কারণ কোনো একজন মানুষ বিপ্লবের জন্য অপরিহার্য নয়। কিন্তু আমি তখনও বিশ্বাস করতাম, এখনও করি, বিপ্লব অনিবার্য।
আমি এখন বুঝতে পারি, বাবার মৃত্যুর সময়ে সরকার ও পুলিশ আমাদের দাবার ঘুঁটি করেছিল। যেখানে অসংখ্য অন্য মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যারা বছরের পর বছর জানতেই পারেনি তাদের প্রিয়জন জেলে আছেন না শহীদ হয়েছেন, সেখানে সরকার দেখালো চারু মজুমদারের ক্ষেত্রে তারা কত বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল এবং কত মহানুভবতার সাথে আমাদের তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এইভাবে ওরা বাবার মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দেখাতে চেয়েছিল।
এরপর অনেকদিন কেটে গিয়েছে। ১৯৯৮ সালে আমার বাবা সহ '৭০ দশকের সমস্ত বীর শহীদদের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু সেখানে এবং তারপর সুপ্রীম কোর্টেও মামলা খারিজ হয়ে যায়। এই সরকারের কাছে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না। আমাদের অন্তরের গভীর শোক ও ঘৃণাকে বৃহত্তর গণআন্দোলনে পরিণত করেই একমাত্র এদের বাধ্য করা যায়। এখনও অসংখ্য মানুষ আমার সাথে বিভিন্ন কারণে দেখা হলে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মৃত্যুর পর আমার কাছে যে অসংখ্য চিঠি এসেছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশের এক তরুণ কমরেডের লেখা শেষ কথাটাই মনে পড়ছে : 'কোনো মৃত্যুর উদ্দেশ্যই বৃথা যায় না – আপনার বাবার এই কথাটাই শেষ সম্বল'।”–