চারু মজুমদারের (সি এম) রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গীসমূহ কীভাবে গড়ে উঠেছিল সে বিষয়ে আলোকপাত করে এমন ছোট ছোট ঘটনার প্রামাণ্য ছবি প্রদীপ বসু আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সি এম ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের এক সংগঠক আর ১৯৪৮-এ জঙ্গী কৃষক আন্দোলন পরিচালনার কারণে জলপাইগুড়ি জেলা কমিটি কর্তৃক তিনি সমালোচিত হন এবং তাঁকে ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে বদলি করে দেওয়া হয়। পরের বছর জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপ চালানোর জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর তিন বছর কারাদণ্ড হয়। মুক্তির পর যে জেলা কমিটি তাঁর সমালোচনা করেছিল সেই কমিটিরই তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন।
অল্পদিন পরই তিনি তাঁর নিজের জেলা দার্জিলিং ফিরে যান ও কৃষক ফ্রন্টের কাজে মনোনিবেশ করেন। এখানেও আবার তাঁকে সাসপেনশনের মুখে পড়তে হয়। এবার জেলা সম্পাদকের আমলাতান্ত্রিক কাজের সমালোচনা করার জন্য তাঁর এই শাস্তি। কিন্তু তাঁর কাজের পরিচয়কে উপেক্ষা করতে না পেরে এবং পার্টি কর্মী ও উত্তরবঙ্গের শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে তাঁর প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা দেখে রাজ্য কমিটিকে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং তাঁর সাসপেনশনের আদেশ বাতিল হয়ে যায়।
'৫০-এর দশকের মধ্যভাগে পার্টির মধ্যে তীব্র আন্তঃপার্টি বিতর্ক দেখা দিলে সি এম শিলিগুড়ি মহকুমায় দুমাসব্যাপী এক শিক্ষাশিবির সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দেন; এরই পরবর্তী ক্রিয়া হিসেবে তিনি সমস্ত পার্টি মিটিং-এ সংক্ষিপ্ত তত্ত্বগত আলোচনা চালানোর রেওয়াজ গড়ে তোলেন।
সর্বক্ষণের কর্মীদের (হোলটাইমার) ভাতা দেওয়ার তিনি বিরোধী ছিলেন। তিনি চাইতেন, হোলটাইমার কর্মীরা জনগণের মধ্যে থাকবেন এবং নিজেদের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য জনগণের ওপরই নির্ভর করবেন। তাঁকে অনুসরণ করে শিলিগুড়িতে পুরনো প্রথাকে বিদায় দেওয়া হয়। ১৯৬৩-র উপনির্বাচনে শিলিগুড়ি কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তিনি ভারতের চীন আক্রমণের নিন্দা করেন এবং প্রকাশ্য জনসভাগুলিতে সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি প্রচার করেন। ১৯৬৪-তে সিপিআই(এম)-এর গড়ে ওঠার পর্বে পার্টি কংগ্রেসের খসড়া কর্মসূচীকে তিনি শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করেন। পরিমল দাশগুপ্ত একটা বিকল্প দলিল হাজির করেছিলেন – কেউই যার সপক্ষে এসে দাঁড়ায়নি।
প্রদীপ বসু আমাদের সামনে আরও কিছু প্রায় অজানা তথ্য হাজির করেছেন – যেমন কানু সান্যালের সঙ্গে একেবারে ১৯৬৬-র গোড়ার দিকেই সি এম-এর আংশিক রাজনৈতিক মতপার্থক্য দেখা দেওয়ার কথা। পার্টির মধ্যে স্বীকৃতিলাভ করেনি এমন বিভিন্ন মঞ্চ চালিত তত্ত্বগত সংগ্রামের বর্ণনাও কম তথ্যবহুল নয়। যেমন ছিল চিন্তাগ্রুপ (অমূল্য সেন, সুপ্রকাশ রায় ও অন্যান্যদের দ্বারা প্রকাশিত তাত্ত্বিক পত্রিকাকে ঘিরে যা গঠিত হয়েছিল), ইনস্টিটিউট অফ মার্কসিজম-লেনিনিজম (১৯৬৪-র ২২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত – যা এস আর সি, অসিত সেন ও সরোজ দত্ত কর্তৃক চালিত হত এবং যেটা একটা ছোট পাঠাগার, অধ্যয়ন কেন্দ্র, মতাদর্শগত চর্চা ও প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে কাজ করত) ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত পরিসরের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে লেখক দুটি পৃথক ও সুস্পষ্ট ধারা হিসেবে বিভাজিত করেছেন। যথা : “বিতর্কপন্থী” ধারা ও “অ্যাকশনপন্থী” ধারা। শেষোক্তটির “প্রকাশ ঘটে চারু মজুমদারের দলিল, আলোচনা, চিঠিপত্র ও কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে” এবং তাঁর সতীর্থদের মাধ্যমে যাঁরা “তত্ত্বগত বিতর্ক সম্পর্কে আস্থা হারিয়েছিলেন” ও সেই কারণে “জঙ্গী রাজনৈতিক অ্যাকশন বিশেষত কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ার কাজেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে ঢেলে দিয়েছেন ...।” অন্য সমস্ত ৠ।ডিক্যাল/বিপ্লবী ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীগুলি কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের মডেল গড়ে তোলার প্রয়াস না চালিয়ে তাদের প্রচেষ্টাকে “কেন্দ্রীভূত করেছিল পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদী তত্ত্বগত বিতর্ক চালানোর কাজে।”
বইটির দ্বিতীয় অংশে এই দুই ধারার “কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যকে” সবিস্তারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় লেখক তাঁর সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলিকে তুলে ধরেছেন। আর নিশ্চিতভাবেই এই উপসংহারে এসে পৌঁছেছেন যে অ্যাকশনপন্থীদের মধ্যে ছিল তত্ত্বের ঘাটতি এবং বিতর্কপন্থীদের ছিল অনুশীলনে না যাওয়ার দুর্বলতা। সিপিআই(এমএল) প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথমোক্ত ধারার ওপর ভিত্তি করে (কারণ দীর্ঘকালীন আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চালাতে চালাতে “মাওবাদীরা” অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল) আর এর মধ্যেই পরবর্তীকালের বিপর্যয়ের মূল নিহিত ছিল। বসু বইটির একেবারে শেষের দিকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “মজুমদারের নেতৃত্ব তাঁর তত্ত্বগত শ্রেষ্ঠত্ব, মতাদর্শগত পরিপক্কতা অথবা অন্যদের চেয়ে তাঁর আগে চিন্তা করার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। বিপরীতে, তাঁর নেতৃত্ব ছিল অ্যাকশন নির্ভর। নকশালবাড়ির অভ্যুত্থানের পর “মতাদর্শবিহীন, তাত্ত্বিকতাহীন, অভিজ্ঞতাবাদের” ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলেও “গোড়া থেকেই নকশালপন্থীদের মধ্যে তত্ত্বের প্রশ্নে মতপার্থক্য ছিল” আর সেটাই “তাঁদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণ।”
পণ্ডিতি কেতায় কূটতর্কের মাধ্যমে সহজ যে উপসংহারটি টানা হয়েছে তা হল : নকশালবাড়ি আন্দোলনের ব্যর্থতা ছিল অবধারিত কেননা তা মতাদর্শগতভাবে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই গড়ে উঠেছিল এমন একজনের নেতৃত্বে যিনি অ্যাকশনপন্থী হিসেবে মহৎ হলেও তাত্ত্বিক দিক থেকে ছিলেন (বিতর্কপন্থীদের থেকে) নিকৃষ্টতর।”
প্রথমত, সি এম-এর নেতৃত্ব নিছক নকশালবাড়ির অভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল – বসুর ধাঁচে এমন সিদ্ধান্ত টানাটা একেবারেই হাস্যকর। এভাবে দেখলে তো সে নেতৃত্ব ১৯৬৭-র আগস্টের পর আর স্থায়ীত্বই পেত না – কারণ নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান তার আগেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সকলেই জানে যে পশ্চিমবঙ্গ সমেত অন্যান্য রাজ্যের নেতৃস্থানীয় কর্মীরা শেষপর্যন্ত সি এম-কেই নেতা হিসেবে বেছেছেন ১৯৬৯-র এপ্রিল মাসে যা চূড়ান্ত হয়, ১৯৭০-এর মে-তে (যখন প্রথম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়) অর্থাৎ তাঁর ধারণাগুলিকে পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা চালানোর মাধ্যমে এবং দু-তিন বছর ধরে সেগুলির প্রকৃত ফলাফলের দিকে নজর রেখেই।
বসু বহু কসরৎ করে বিজ্ঞাপিত করেছেন, রাজনৈতিক, রণনীতিগত ও সাংগঠনিক প্রশ্নে মজুমদারের বিশ্লেষণগুলি ছিল “সরলতার দোষে দুষ্ট ও ভাসাভাসা।” আমাদের আবার বলতে হচ্ছে, আরও অনেকেই অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। এই সব বিদগ্ধ বিশ্লেষকদের মধ্যে যেখানটায় মিল দেখা যায় তা হল এরা সকলেই মার্কসবাদী তত্ত্বকে এক ধরনের অভিজাতসুলভ উচ্চমার্গীয় দৃষ্টিতে বিচার করেন। তত্ত্বগত কাজের রূপ ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে অধ্যয়ন করার প্রশ্নে এদের সকলের মধ্যেই ঐতিহাসিক ও দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব আছে। তত্ত্ব সম্পর্কিত কাজ পৃথক পৃথক পরিস্থিতির দাবির সাথে সঙ্গতি রেখেই এক এক রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। সুতরাং ধারণাসৃষ্টি ও তার প্রয়োগ ঘটানোর মধ্যে যে জীবন্ত দ্বিমুখী, গতিময় সম্পর্ক আছে তা আয়ত্ত করতেও তাঁরা ব্যর্থ হন। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার দিকে আমরা যদি একঝলক দৃষ্টি ফেরাই তাহলে বিষয়টি আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি আনকোরা নতুন তত্ত্বের ভিত্তি রচনার কাজটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মার্কস ও এঙ্গেলসকে কমিউনিস্ট ইস্তাহারের মতো 'অ্যাকশনপন্থী' দলিল প্রণয়নের সাথে সাথে জার্মান মতাদর্শ, ক্যাপিটাল, অ্যান্টি ডুরিং ইত্যাদির মতো 'ভারী' বিষয়কেও রচনা করতে হয়েছিল। তারপর সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটলে ও সম্পূর্ণ বিচিত্র পরিস্থিতিতে (পশ্চাদপদ পুঁজিবাদ সহ) মার্কসবাদকে প্রয়োগের প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা তার সার্বিক সম্প্রসারণ ও সামগ্রিক বিকাশের দাবি জানায়। আর এ কারণেই লেনিন ও তাঁর সহযোগীদের বিশাল বিশাল গ্রন্থ রচনা করতে হয়।
বুনিয়াদী বিষয়সমূহ স্থাপিত হয়ে যাওয়ার ফলে, মাও তাঁর সমগ্র মনোযোগকে নিবদ্ধ রেখেছিলেন চীনা পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যের সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বজনীন সত্যকে সংযুক্ত করার কাজে। চীনের পরিস্থিতি, দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী যুদ্ধের শর্তসমূহ এবং যে গ্রামীণ পরিবেশে চীনা কমিউনিস্টদের কাজ করতে হয়েছিল – প্রধানত সেগুলিই তাঁর রচনাবলীর চরিত্র ও ক্ষেত্রকে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ইউরোপীয় ঐতিহ্যের থেকে বিষয়গুলি এতটাই আলাদা ছিল যে বিভিন্ন মহল থেকে তাঁকে এক মহান বিপ্লবী বলে গণ্য করা হলেও তাঁকে প্রথম-সৃষ্টিকারী কোনো তাত্ত্বিক বলে ভাবা হয় না। এটাও লক্ষ্যণীয় যে মাও-এর গোড়ার দিকের রচনাগুলি, বলতে গেলে সবই ছিল অ্যাকশনপন্থী। তাঁর অপেক্ষাকৃত পরিণত 'তাত্ত্বিক' বিশ্লেষণগুলির অধিকাংশই ১৯৩৯ সাল নাগাদ প্রণীত হয়েছে – যখন অভিজ্ঞতার এক সামগ্রিক সারসংকলনের সময় ও সুযোগ দুই-ই ছিল নাগালের মধ্যে।
আমাদের দেশে সি এম-এর আটটি দলিল আকারে ভারতীয় বিপ্লবের পথপ্রদর্শক কর্মসূচীটি ইতিহাসের এমন এক বিরলতম মুহূর্তে রচিত হয় যখন মার্কসের ভাষা অনুযায়ী, বিপ্লবী কাজে একটা পদক্ষেপ গ্রহণ এক ডজন কর্মসূচীর খসড়া তৈরির থেকেও ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, ১৯৬৫ সালের আগেই পার্টির সংকীর্ণ গণ্ডির ভেতর রাজনৈতিক বিতর্ক চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যাওয়ায় ব্যাপক জনগণকে সামিল না করে তাকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যতক্ষণ না বিপ্লবী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কৃষক জনগণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ততক্ষণ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াই শুরুই করা যাবে না – এই মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে সি এম বিষয়টিকে অত্যন্ত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
এক কথায় বলতে গেলে, তখন ছিল ব্যতিক্রমী সময় আর সে কারণেই তিনি “কমিউনিস্ট পার্টির চিরাচরিত আলাপ-আলোচনার পদ্ধতিকে অনুসরণ করেননি” – বসু যে দিকটিকে চিহ্নিত করেছেন (সি এম-এর তাত্ত্বিক শূন্যগর্ভতা হিসেবে)। উদারহণস্বরূপ, বিতর্কপন্থী 'পিডিজি'র বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তিনি “বিপ্লবী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ বিষয়ে লেনিনের বিখ্যাত রচনা সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।”তিনি তাহলে কী করেছিলেন ? সমকালীন ভারতে লেনিনীয় মানদণ্ড অনুযায়ী বিপ্লবী সঙ্কটের নির্দিষ্ট প্রকাশগুলিকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন : পাশবিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে দাঁড়িয়েও দেশজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের ক্রমবর্ধমান জঙ্গী মেজাজ – যা দেখিয়ে দেয় যে জনগণ পুরনো অবস্থায় বেঁচে থাকতে আর একেবারেই রাজি নয়; এবং খাদ্যসংকট সমাধানে ও কংগ্রেস দলের মাধ্যমে স্থিতিশীল সরকার টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতা।
বৃহৎ বেসরকারী পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সোভিয়েত সাহায্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সম্পর্কে (উদারহণস্বরূপ, ইস্পাত ও পেট্রোলিয়াম শিল্প), ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর সম্পূর্ণ মুৎসুদ্দি চরিত্র সম্বন্ধে এবং এক সুবিস্তৃত মতাদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রশ্নকে তিনি একই রকম প্রাঞ্জল ভাষায় (বসুর কথায় “স্বতঃসিদ্ধের” মতো), স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণভাবে সূত্রবদ্ধ করেছেন। যার ফলে, ১৯৬৫ সাল থেকেই সি এম-এর রচনাগুলি বিপ্লবী কর্মীবাহিনী ও বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় ক্যাডারকে – যাঁরা সি এম লেখনী ধরার আগে থেকেই কঠিন তাত্ত্বিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন – আকৃষ্ট করতে শুরু করে।
সি এম এবং অন্যদের অ্যাকশনপন্থী-বিতর্কপন্থী এমন বিভাজন অভিসন্ধিমূলক ও কৃত্রিম। এটা এই সরল সত্যটিকেই অস্পষ্ট করে দেয় যে তাঁদের সকলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, পার্টি সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে তাঁদের সাধ্যমতো ও নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী একই অভিন্ন লক্ষ্যে সংগ্রাম চালাচ্ছিলেন। আর এ কারণেই তাঁরা সাগ্রহে এমন একজন সতীর্থ কমরেডের নেতৃত্ব স্বীকার করে নেন যিনি তত্ত্বে ও অনুশীলনে নিজেকে সবথেকে অগ্রণী হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। আর অবশ্যই তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞার ফলেই নকশালবাড়ি ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে আন্দোলনের বিস্তার ঘটে এবং সিপিআই(এমএল)-এর জন্ম হয়।
এ সবকিছু থেকে কি এই অর্থ দাঁড়ায় যে সি এম-এর নেতৃত্ব ছিল ত্রুটিহীন ? কোনো মতেই না। এআইসিসিসিআর এবং সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে কি তত্ত্বগত ঘাটতি ও বিতর্ক ছিল না? হ্যাঁ, ছিল, কয়েকটি তো ছিল রীতিমতো সাংঘাতিক। নতুন পার্টির জন্ম দেওয়ার আগে যদি সর্বসম্মতিতে বা প্রায় সর্বসম্মতিতে পৌঁছানো যেত তাহলে কি আরও ভালো হত না? সত্যিই ভালো হত। কিন্তু একমাত্র সমস্যাটা হল যে বিপ্লবকে সম্পন্ন করা (অথবা প্রচেষ্টা চালানো) ও বিপ্লবী পার্টির প্রতিষ্ঠা তো গ্রন্থশালায় হয় না কিম্বা আদর্শ গবেষণাগারের পরিবেশেও হয় না, হয় তো কেবল শ্রেণীসংগ্রামের বিস্তীর্ণ দুনিয়ায়, বিকাশের আঁকা-বাঁকা ধারায় – প্রায়শই কাজ চালাতে গিয়ে বিপ্লবীদের যার মুখোমুখি হতে হয়; যেগুলি চরিতার্থ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ীগত প্রস্তুতি ও বস্তুগত অবস্থারও হয়তো কোনো কোনো দিকে ঘাটতিও থেকে যায়। এই সমস্ত সন্ধিক্ষণে, যেমন নভেম্বর বিপ্লবে, সর্বদাই পেটিবুর্জোয়া তর্কবাগীশ ও মার্কসবাদের মধ্যকার সর্বহারা বিপ্লবী প্রবণতাগুলির মধ্যে তীব্র বিতর্কের উদ্ভব ঘটে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতারাও সবকটি অথবা নিদেনপক্ষে কয়েকটি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে একসাথে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের আদি মার্কসবাদী ভাবনার বিপরীতে একটি মাত্র দেশে – তাও আবার পিছিয়ে পড়া রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য বলশেভিকদের প্রচেষ্টাকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। তাঁদের জবাবে লেনিন “আমাদের বিপ্লব”(১৯২১) রচনায় লেখেন, “তাঁরা সকলেই নিজেদের মার্কসবাদী বলে অভিহিত করেন, কিন্তু মার্কসবাদ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা পণ্ডিতিসূলভ। মার্কসের যেটা নির্ধারক অর্থাৎ তার বিপ্লবী দ্বান্দ্বিকতাকেই তাঁরা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন” এবং বলেন যে “'স্বাভাবিক' সম্পর্কে তাঁদের ধারণা একেবারেই ছকে বাঁধা ও সংকীর্ণ।” সুতরাং বিশেষ পরিস্থিতিতে “কী রূপের দিক থেকে, কী বিকাশের পর্যায়ের দিক থেকে” তারতম্য ও অভিনবত্ব দেখা দেওয়াটা যে “অনিবার্য” সে বিষয়ে তাঁরা পুরোপুরি অজ্ঞ থেকে গেছেন।”
লেনিন দেখিয়েছেন, ১৯১৭ ও তার পরবর্তীকালে রাশিয়া ঠিক এমনই এক অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছিল যখন বিপ্লবী মার্কসবাদীরা নেহাৎ পাঠ্য বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, তাদের অবশ্যই সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদকে প্রয়োগ করার হিম্মত দেখাতে হবে এবং নেপোলিয়নের মতো সক্রিয়তা দেখাতে হবে, যিনি বলেছিলেন : “প্রথমে নিদারুণ এক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড় আর তার পর দেখ কী ঘটছে।”
ভারতে সি এম-ই হলেন প্রথম সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তি যিনি মার্কসবাদের এই “বিপ্লবী দ্বান্দ্বিকতাকে” আয়ত্ত করেছিলেন এবং বলশেভিক স্পিরিটকে আত্মস্থ করেছিলেন। বিষয়ীগত প্রস্তুতির আদর্শ স্তরটিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে ঘাটতি রয়েছে সে সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থেকেও তিনি বিপ্লবী কর্মীবাহিনী ও সংশোধনবাদ বিরোধী অগ্রণী যোদ্ধাদের দ্রুত পেকে ওঠা বিপ্লবী পরিস্থিতির ডাকে তত্ত্বে ও প্রয়োগে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এআইসিসিসিআর-এ যোগদানকারী বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির কেউ কেউ যখন তত্ত্বগত বিতর্কের পুরোপুরি নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি নতুন পার্টি গঠনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিলেন তখন সি এম তার জবাবে বলেছিলেন যে এটা ভাববাদী ও বিশুদ্ধতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। তিনি বলেছিলেন, বিপ্লব যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন আমাদের অবশ্যই বর্তমান যা বোঝাপড়া তার ওপর ভিত্তি করেই বিপ্লবী পার্টি গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যে সব প্রশ্নের সমাধান হয়নি সেগুলিকে নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে ও আন্তঃপার্টি বিতর্কের মধ্য দিয়েই মীমাংসা করতে হবে।
নির্দিষ্ট অবস্থায় এটিই একমাত্র সঠিক বিপ্লবী অবস্থান হতে পারত – যা ভারতের ১৯০৫-কে বিপ্লবী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ঐতিহ্যের জননীকে সার্থক করে তুলেছিল। আমাদের মধ্যে যাঁরা এটিকে ১৯৬৯ সালে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলেন (যেমন এমসিসি) – সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও যারা পরবর্তী বছরগুলিতে এই ঐতিহাসিক সাফল্যকে নাকচ বা অস্বীকার করলেন এবং প্রাক-পার্টি স্তরের দিকে পিছু হঠলেন, ভারতে একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হননি। আমাদের আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের বিচ্যুতিগুলি প্রসঙ্গে এটা বলা চলে, সেগুলিকে ইতিবাচকভাবে কাটিয়ে ওঠা গেছে এবং চিন্তা ও অনুশীলনে সত্যিকার ও স্থায়ী অগ্রগতিও ঘটানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যারা যাবতীয় দোষ সি এম-এর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন প্রথমদিকের সেই সব 'শুদ্ধিকরণপন্থীরা' এই সাফল্য অর্জন করেননি, এটা অর্জিত হয়েছে একটি ছোট 'অ্যাকশনপন্থীদের' গ্রুপের দ্বারা যারা আমাদের চমৎকার বিপ্লবী ঐতিহ্যগুলিকে বজায় রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিল।
আমাদের মূল বিষয়টিতে ফিরে আসা যাক। বসুর বিবরণী থেকে এটা স্পষ্ট যে সি এম সবসময়ই জনগণেরই একজন হয়ে থাকতে – একজন সচেতন, স্বাধীনমন কিন্তু তৃণমূলস্তরে সংগ্রামরত সুশৃঙ্খল সৈনিক হয়েই থাকাটা পছন্দ করতেন। কিন্তু পরিস্থিতি দাবি করলে, অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে এবং তাঁর অত্যন্ত দুরূহ শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কখনোই পার্টির সর্বোচ্চ অবস্থানের দায়িত্ব গ্রহণে পিছপা হতেন না। তাঁর ভুলগুলিকে নিয়ে আলোচনা ও সেগুলিকে শুধরে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ভারতে বিপ্লবী পার্টি গঠনের জন্য যে মজবুত মতাদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি সি এম এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধারা রচনা করেছেন তাকে খাটো করে দেখাটা অতি অবশ্যই ভুল হবে।
মার্কসবাদ যদি আপ্তবাক্য না হয়ে কাজের দিশা হয়ে থাকে, যদি ধ্রুপদী রচনাগুলিকে তোতাপাখির মতো কপচে যাওয়ার দক্ষতাটাই একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের মানদণ্ড না হয় বরং কোথা থেকে কীভাবে শুরু করতে হবে সেই বিষয়ে প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টি ও নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়ার সামর্থটাই বিচার্য হয়, যদি একজন মহান মার্কসবাদী তিনিই হন যাঁর দৃষ্টি ও কর্মে তত্ত্ব জনগণের আয়ত্তাধীন বস্তুগত শক্তি হয়ে ওঠে তাহলে সি এম-কে অবশ্যই এক সর্বোত্তম মার্কসবাদী হিসেবে সম্মান জানাতে হবে। এঙ্গেলস মার্কস সম্পর্কে যে অর্থে বলেছিলেন যে, সর্বোপরি, তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী সেই অর্থে সি এম যে একজন 'অ্যাকশনপন্থী' ছিলেন সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।