আধুনিক যুগের প্রতিটি বড় বড় বিপ্লবে যে সাহিত্য সর্বহারার দাবিকে ভাষা দিয়েছে, যেমন বাবেফ ও অন্যান্যদের রচনা, আমরা এখানে তার উল্লেখ করছি না।

সামন্ত সমাজ যখন উচ্ছেদ হচ্ছে তখনকার সর্বব্যাপী আলোড়নের কালে নিজেদের লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য সর্বহারার প্রথম প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টাগুলো অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হয়, কারণ সর্বহারা তখন পর্যন্ত সুবিকশিত হয়নি, তার মুক্তির অনুকূল অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন অনুপস্থিত। তেমন অবস্থা গড়ে উঠতে তখনও বাকি, আসন্ন বুর্জোয়া যুগেই কেবল তা গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল। সর্বহারার এই প্রথম অভিযানসমূহের সঙ্গী ছিল যে বিপ্লবী সাহিত্য তার প্রতিক্রিয়াশীল একটা চরিত্র থাকা ছিল অনিবার্য। সে সাহিত্য প্রচার করত সর্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন, স্থূল ধরনের সামাজিক সমতা।

প্রকৃতপক্ষে যাকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ বলা চলে, অর্থাৎ সাঁ-সিমোঁ, ফুরিয়ে, ওয়েন ইত্যাদির মতবাদ জন্ম নিল সর্বহারা এবং বুর্জোয়ার সংগ্রামের সেই অপরিণত যুগে, যার বর্ণনা আগে দেওয়া হয়েছে (প্রথম অধ্যায় 'বুর্জোয়া ও সর্বহারা' দ্রষ্টব্য)।

এই জাতীয় মতের প্রতিষ্ঠাতারা শ্রেণীবিরোধ এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিধ্বংসী উপাদানগুলোর ক্রিয়াটা দেখেছিলেন। কিন্তু সর্বহারা তখনও তার শৈশবে; এঁদের চোখে বোধ হল এই শ্রেণীর নিজস্ব ঐতিহাসিক উদ্যম এবং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন নেই।

শ্রেণীবিরোধ বাড়ে যন্ত্রশিল্প প্রসারের সঙ্গে সমান তালে; সেদিনের অর্থনৈতিক অবস্থা তাই তখনও এঁদের সামনে সর্বহারার মুক্তির বৈষয়িক শর্তগুলো তুলে ধরেনি। সুতরাং এরা খুঁজতে লাগলেন সে শর্ত সৃষ্টি করার মতো নতুন সমাজবিজ্ঞান, নতুন সামাজিক নিয়ম।

তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্ভাবন-ক্রিয়াকে আনতে হল ঐতিহাসিক ক্রিয়ার স্থানে। মুক্তির ইতিহাস-সৃষ্ট শর্তের বদলে কল্পিত শর্ত, সর্বহারার স্বতঃস্ফূর্ত শ্রেণী সংগঠনের বদলে উদ্ভাবকদের নিজেদের বানানো এক সমাজ-সংগঠন। তাঁদের কাছে মনে হল ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাঁদেরই সামাজিক পরিকল্পনার প্রচার ও বাস্তব রূপায়ণ।

পরিকল্পনা প্রস্তুত করার সময় সর্বাধিক নিগৃহীত শ্রেণী হিসাবে প্রধানত শ্রমিকশ্রেণীর. স্বার্থ রক্ষার চেতনা তাঁদের ছিল। তাঁদের কাছে সর্বহারার অস্তিত্বই ছিল কেবল সর্বাধিক নিগৃহীত শ্রেণী হিসাবে।

শ্রেণীসংগ্রামের অপরিণত অবস্থা এবং তাঁদের নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার দরুন এই ধরনের সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন যে তাঁরা সকল শ্রেণীবিরোধের বহু ঊর্ধ্বে। তাঁরা চেয়েছিলেন সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীদের অবস্থাও উন্নত করতে। সেইজন্য সাধারণত শ্রেণীনির্বিশেষে গোটা সমাজের কাছে আবেদন জানানো; এমনকি তুলনায় শাসকশ্রেণীর কাছেই আবেদন-নিবেদন ছিল এঁদের পছন্দ। কেননা, এঁদের ব্যবস্থাটা একবার বুঝতে পারলে লোকে কেমন করে না দেখে পারবে না যে এইটাই সমাজের সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা?

সেইজন্য সকল রাজনৈতিক, বিশেষত সকল বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে এঁরা বর্জন করলেন; এঁদের অভিলাষ হল শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধন; চেষ্টা হল দৃষ্টান্তের জোরে, এবং যার ভাগ্যে ব্যর্থতাই অনিবার্য এমন ছোটখাট পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন সামাজিক শাস্ত্রের (Gospel) পথ প্রশস্ত করতে।

ভবিষ্যৎ সমাজের এ ধরনের উদ্ভট ছবি আঁকা হয় এমন সময়ে যখন সর্বহারা অতি অপরিণত অব্স্থার মধ্যে ছিল, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে তাদের ধারণাও ছিল উদ্ভট; সমাজের ব্যাপক পুনর্গঠন সম্বন্ধে এ শ্রেণীর প্রাথমিক স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্খার সঙ্গে এ ধরনের ছবির মিল দেখা যায়।

কিন্তু সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট এই সব লেখার মধ্যে সমালোচনামূলক একটা দিকও আছে। বর্তমান সমাজের প্রত্যেকটি নীতিকে এরা আক্রমণ করল। তাই শ্রমিকশ্রেণীর জ্ঞানলাভের পক্ষে অনেক অমূল্য তথ্যে তা পরিপূর্ণ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ফারাকের অবসান ঘটানো, পরিবার প্রথা, ব্যক্তিবিশেষের লাভের জন্য শিল্প পরিচালনা ও মজুরি-শ্রমের উচ্ছেদ, সামাজিক সম্প্রীতির ঘোষণা, রাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন এনে উৎপাদনে তার তদারকিকে বাড়িয়ে তোলা ইত্যাদি যেসব ব্যবহারিক প্রস্তাব এই সমস্ত লেখার মধ্যে আছে তাদের সবকটাই শ্রেণীবিরোধের অবসানের দিকেই কেবল অঙ্গুলি নির্দেশ করে, অথচ সে বিরোধ সেদিন সবেমাত্র মাথা তুলছিল, এই সব লেখার মধ্যে ধরা পড়েছিল তাদের আদি অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট রূপটুকু। প্রস্তাবগুলোর প্রকৃতি তাই নিতান্তই ইউটোপীয়।

সমালোচনামূলক-ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের যা তাৎপর্য তার সঙ্গে ঐতিহাসিক বিকাশের সম্বন্ধটা বিপরীতমুখী। আধুনিক শ্রেণীসংগ্রাম যতই বিকশিত হয়ে সুনির্দিষ্ট রূপ নিতে থাকে, ঠিক ততই সংগ্রাম পরিহারের এই উদ্ভট ব্যাপরটা, শ্রেণীসংগ্রামের বিরুদ্ধে এইসব উদ্ভট আক্রমণ তাদের সকল ব্যবহারিক মূল্য ও তাত্ত্বিক যুক্তি হারায়। সেইজন্যই, এই সমস্ত মতবাদের প্রবর্তকেরা অনেক দিক দিয়ে বিপ্লবী হলেও তাঁদের শিষ্যরা প্রতিক্ষেত্রে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীতেই পরিণত হয়েছেন। সর্বহারার প্রগতিশীল ঐতিহাসিক বিকাশের বিপরীতে তাঁরা নিজ নিজ গুরুর আদি মতগুলোকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাই তাঁদের অবিচল চেষ্টা যেন শ্রেণীসংগ্রাম নিস্তেজ হয়ে পড়ে, যেন শ্রেণীবিরোধ আপসে মিটে যায়। তাঁরা এখনও তাঁদের সামাজিক ইউটোপীয়ার পরীক্ষামূলক রূপায়ণের স্বপ্ন দেখেন; বিচ্ছিন্ন 'ফালানস্টের' প্রতিষ্ঠা, 'হোম কলোনি' স্থাপন, 'ছোট আইকেরিয়া' 'ফালানস্টের' (phalansteres) হল ফুরিয়ের কল্পিত সমাজতন্ত্রী উপনিবেশ; কাবে তাঁর ইউটোপীয়া এবং পরবর্তী অামেরিকাস্থিত কমিউনিস্ট উপনিবেশকে অাইকেরিয়া নাম দেন। (১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা) -- [প্যারা] ওয়েন তাঁর অাদর্শ কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলোকে 'হোম কলোনি' বলতেন; ফুরিয়ের কল্পিত সর্বভোগ্য প্রাসাদের নাম 'ফালানস্টের'। যে ইউটোপীয় কল্পরাজ্যের কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠান কাবে বর্ণনা করেছিলেন, তারই নাম 'অাইকেরিয়া'। (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা) প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, নব জেরুজালেমের অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসাবে; – আর এই আকাশকুসুম বাস্তবায়িত করার জন্য আবেদন জানায় বুর্জোয়া শ্রেণীর সহানুভূতি ও টাকার থলির কাছে। আগে যে প্রতিক্রিয়াপন্থী বা রক্ষণশীল সমাজতন্ত্রীদের বর্ণনা করা হয়েছে এরা ধীরে ধীরে নেমে যায় সেই স্তরে; তফাৎ শুধু তাদের আরও প্রণালীবদ্ধ পাণ্ডিত্যে, এবং সমাজবিদ্যার অলৌকিক মাহাত্ম্যে অন্ধ ও সংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসে।

শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত রাজনৈতিক প্রচেষ্টার এঁরা তাই তীব্র বিরোধী : এঁদের মতে সে প্রচেষ্টা কেবলমাত্র নতুন সামাজিক শাস্ত্রে চরম অনাস্থা থেকেই উৎসারিত হতে পারে।

ইংল্যান্ডে ওয়েনপন্থীরা এবং ফ্রান্সে ফুরিয়েভক্তরা যথাক্রমে চার্টিস্ট ও সংস্কারবাদীদের বিরোধী।