স্বীয় ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডের অভিজাতদের কাছে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে পুস্তিকা লেখা একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসের ফরাসি বিপ্লবে এবং ইংল্যান্ডে সংস্কার আন্দোলনে
লোকের সহানুভূতি উদ্রেকের জন্য অভিজাতরা বাধ্য হল বাহ্যত নিজেদের স্বার্থ ভুলে কেবল শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থেই বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ খাড়া করতে। এইভাবেই অভিজাতরা প্রতিশোধ নিতে লাগল তাদের নতুন প্রভুদের উপহাস করে, তাদের কানে কানে আসন্ন প্রলয়ের ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়ে।
এইভাবে উদয় হয় সামন্ত সমাজতন্ত্রের : তার অর্ধেক বিলাপ আর অর্ধেক উপহাস; অর্ধেক অতীতের প্রতিধ্বনি এবং অর্ধেক ভবিষ্যতের আতঙ্ক; মাঝে মাঝে এদের তিক্ত, সব্যঙ্গ ও সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা বুর্জোয়াদের মর্মে গিয়ে বিঁধত ; অথচ আধুনিক ইতিহাসের অগ্রগমনকে উপলব্ধির একান্ত অক্ষমতায় মোট ফলটা হত হাস্যকর।
জনগণকে দলে টানার জন্য অভিজাতবর্গ নিশান হিসাবে তুলে ধরত মজুরের ভিক্ষার থলিটাকে। লোকেরা কিন্তু যতবারই দলে ভিড়েছে ততবারই এদের পিছন দিকটায় সামন্ত দরবারী আভিজাতিক চিহ্ন দেখে হো হো করে অশ্রদ্ধার হাসি হেসে তাদের পরিত্যাগ করেছে।
এ প্রহসনটা দেখায় ফরাসি লেজিটিমিস্টদের একাংশ এবং 'নবীন ইংল্যান্ড' গোষ্ঠী।
বুর্জোয়া শোষণ থেকে তাদের শোষণ পদ্ধতি অন্য ধরনের ছিল এটা দেখাতে গিয়ে সামন্তপন্থীরা মনে রাখে না যে সম্পূর্ণ পৃথক পরিস্থিতি ও অবস্থায় তাদের শোষণ চলত, যা আজকের দিনে অচল হয়ে পড়েছে। তাদের আমলে আজকালকার সর্বহারার অস্তিত্বই ছিল না দেখাতে গিয়ে তারা ভুলে যায় যে তাদের নিজস্ব সমাজেরই অনিবার্য সন্তান হল আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণী।
তাছাড়া অন্য সব ব্যাপারে নিজেদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়াশীল রূপটা এরা এত কম গোপন করে যে বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে এদের প্রধান অভিযোগ দাঁড়ায় এই যে, বুর্জোয়া রাজত্বে এমন এক শ্রেণী গড়ে উঠছে, সমাজের পুরনো ব্যবস্থাকে আগাগোড়া নির্মূল করতেই যার জন্ম।
বুর্জোয়াশ্রেণী সর্বহারা সৃষ্টি করছে তার জন্য তত নয়, বিপ্লবী সর্বহারা সৃষ্টি করছে এটাই হল এদের অভিযোগ।
সুতরাং রাজনীতির কার্যক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে দমনের সকল ব্যবস্থায় এরা যোগ দেয়; আর সাধারণ জীবনযাত্রায় বড় বড় বুলি সত্ত্বেও যন্ত্রশিল্পরূপ গাছের সোনার ফুল কুড়িয়ে নিতে এদের আপত্তি নেই; পশম, বীটচিনি, অথবা আলুর মদের
জমিদারের সঙ্গে পুরোহিত যেমন সর্বদাই হাত মিলিয়ে চলেছে, তেমনি সামন্ত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জুটেছে পাদরিদের সমাজতন্ত্র।
খৃস্টানী কৃচ্ছ্রসাধনাকে সমাজতন্ত্রী রং দেওয়ার চেয়ে সহজ কিছু নেই। খৃস্টান ধর্ম ব্যক্তিগত মালিকানা, বিবাহ ও রাষ্ট্রকে ধিক্কার দেয়নি কি? তার বদলে দয়া ও দারিদ্র, ব্রহ্মচর্য ও ইন্দ্রিয়দমন, মঠব্যবস্থা ও গির্জার প্রচার করেনি কি তারা? যে পুণ্য বারিতে পুরোহিতরা অভিজাতদের হৃদয়জ্বালাকে পবিত্র করে থাকে তারই নাম খৃস্টান সমাজতন্ত্র।
বুর্জোয়াদের হাতে একমাত্র সামন্ত অভিজাত শ্রেণীরই সর্বনাশ হয়নি, তারাই একমাত্র শ্রেণী নয় আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের আবহাওয়ায় যাদের অস্তিত্ব-শর্ত শুকিয়ে গিয়ে মরতে বসেছে। আধুনিক বুর্জোয়াদের অগ্রদূত ছিল মধ্যযুগের নাগরিক দল এবং ছোট ছোট মালিক চাষি। শিল্প বাণিজ্যে যে সব দেশের বিকাশ অতি সামান্য, সেখানে উঠতি বুর্জোয়াদের পাশাপাশি এখনও এই দুই শ্রেণী দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে।
আধুনিক সভ্যতা যে সব দেশে সম্পূর্ণ বিকশিত সেখানে আবার পেটি বুর্জোয়ার নতুন এক শ্রেণী উদ্ভব হয়েছে, সর্বহারা ও বুর্জোয়ার মাঝখানে এরা দোলায়িত, বুর্জোয়া সমাজের আনুষঙ্গিক একটা অংশ হিসাবে বারবার পুনরায় জীবিত উঠছে এরা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত বিভিন্ন লোক কিন্তু প্রতিযোগিতার চাপে ক্রমাগতই সর্বহারার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, বর্তমান যন্ত্রশিল্পের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে এরা এমনকি এও দেখে যে সময় এগিয়ে আসছে যখন আধুনিক সমাজের স্বাধীন স্তর হিসাবে এদের অস্তিত্ব একেবারে লোপ পাবে; শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে এদের স্থান দখল করবে তদারককারী কর্মচারি, গোমস্তা, অথবা দোকান কর্মচারি।
ফ্রান্সের মতো দেশে, যেখানে চাষিরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অনেক বেশি, সেখানে যে লেখকেরা বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে মজুরের দলে যোগ দিয়েছে তারা যে বুর্জোয়া রাজত্বের সমালোচনায় কৃষক ও পেটি বুর্জোয়া মানদণ্ডের আশ্রয় নেবে, এই মধ্যবর্তী শ্রেণীদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে দাঁড়াবে তা স্বাভাবিক। পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের উদয় হয় এইভাবে। এ দলের নেতা হলেন সিসমন্দি, শুধু ফ্রান্সে নয়, ইংল্যান্ডেও।
আধুনিক উৎপাদন পরিস্থিতির অভ্যন্তরস্থ স্ববিরোধগুলোকে সমাজতন্ত্রের এই দলটি অতি তীক্ষ্ণভাবে উদ্ঘাটন করে দেখিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ভণ্ড কৈফিয়তের স্বরূপ ফাঁস করেছে এরা। তারা অবিসংবাদিতরূপে প্রমাণ করেছে যন্ত্র ও শ্রমবিভাগের মারাত্মক ফলাফল; অল্প কয়েকজনের হাতে পুঁজি ও জমির কেন্দ্রীভবন; অতি উৎপাদন ও সংকট; পেটি বুর্জোয়া ও চাষির অনিবার্য সর্বনাশ, সর্বহারার দুর্দশা ও উৎপাদনে অরাজকতা, ধন বণ্টনের তীব্র অসমতা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে পরস্পরের ধ্বংসাত্মক শিল্প লড়াই, সাবেকী নৈতিক বন্ধন, পুরনো পারিবারিক সম্বন্ধ এবং পুরাতন জাতিসত্তার ভাঙনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে তারা।
ইতিবাচক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু সমাজতন্ত্রের এই রূপটি হয় উৎপাদন ও বিনিময়ের পুরনো উপায় ও সেই সঙ্গে সাবেকী সম্পত্তি-সম্পর্ক ও পুরাতন সমাজ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট, নয় সচেষ্ট উৎপাদন ও বিনিময়ের নতুন উপায়কে সম্পত্তি সম্পর্কের সেই পুরনো কাঠামোর মধ্যেই আটকে রাখতে, যা এই সব নতুন উপায়ের চাপে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, হওয়া অনিবার্য। উভয় ক্ষেত্রেই তা প্রতিক্রিয়াশীল ও ইউটোপীয়।
এর শেষ কথা হল : শিল্পোৎপাদনের জন্য সংঘবদ্ধ গিল্ড প্রতিষ্ঠান, কৃষিকার্যে গোষ্ঠীসুলভ সম্পর্ক।
শেষপর্যন্ত যখন ইতিহাসের কঠোর সত্যে আত্মবিভ্রান্তির সমস্ত নেশা কেটে যায় তখন সমাজতন্ত্রের এ রূপটার অবসান হয় একটা শোচনীয় নাকিকান্নায়।
ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল ক্ষমতাধর বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে এবং এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিব্যক্তি হিসাবে। জার্মানিতে সে সাহিত্যের আমদানি হল যখন সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেখানকার বুর্জোয়ারা সবেমাত্র লড়াই শুরু করেছে।
জার্মান দার্শনিকরা, হবু দার্শনিকরা, সৌখিন ভাবুকেরা (beaux esprits) সাগ্রহে এ সাহিত্য নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করল। তারা শুধু এই কথাটুকু ভুলে গেল যে ফ্রান্স থেকে এ ধরনের লেখা জার্মানিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি সমাজ পরিস্থিতিও চলে আসেনি। জার্মানির সামাজিক অবস্থার সংস্পর্শে এসে এই ফরাসি সাহিত্যের সমস্ত প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক তাৎপর্য হারিয়ে গেল, তার চেহারা হল নিছক সাহিত্যিক। তাই আঠারো শতকের জার্মান দার্শনিকদের কাছে প্রথম ফরাসি বিপ্লবের দাবিগুলো মনে হল সাধারণভাবে 'ব্যবহারিক প্রজ্ঞার' (Practical Reason) দাবি মাত্র, এবং বিপ্লবী ফরাসি বুর্জোয়া শ্রেণীর অভিপ্রায় ঘোষণার তাৎপর্য দাঁড়াল বিশুদ্ধ অভিপ্রায়, অনিবার্য অভিপ্রায়, সাধারণভাবে যথার্থ মানবিক অভিপ্রায়ের আইন।
জার্মান লেখকদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল নতুন ফরাসি ধারণাগুলোকে নিজেদের সনাতন দার্শনিক চেতনার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, নিজেদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ না করে ফরাসি ধারণাগুলোকে আত্মসাৎ করা।
যেভাবে বিদেশী ভাষাকে আয়ত্ত করা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ অনুবাদের মাধ্যমে এই আত্মসাতের কাজ চলেছিল।
প্রাচীন পৌত্তলিক জগতের চিরায়ত সাহিত্যের পুঁথিগুলোর উপরেই সন্ন্যাসীরা কী ভাবে ক্যাথলিক সাধুদের নির্বোধ জীবনী লিখে রাখত সে কথা সুবিদিত। অপবিত্র ফরাসি সাহিত্যের ব্যাপারে জার্মান লেখকরা এ পদ্ধতিটিকে উল্টে দেয়। মূল ফরাসির তলে তারা লিখল তাদের দার্শনিক ছাইপাঁশ। উদাহরণস্বরূপ, মুদ্রার অর্থনৈতিক ক্রিয়ার ফরাসি সমালোচনার নীচে তারা লিখল 'মানবতার বিচ্ছেদ'; বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ফরাসি সমালোচনার নীচে লিখে রাখল 'নির্বিশেষ এই প্রত্যয়ের সিংহাসনচ্যুতি' ইত্যাদি।
ফরাসি ঐতিহাসিক সমালোচনার পিছনে এই সব দার্শনিক বুলি জুড়ে দিয়ে তার নাম তারা দেয় 'কর্মযোগের দর্শন', 'খাঁটি সমাজতন্ত্র', 'সমাজতন্ত্রের জার্মান বিজ্ঞান', 'সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি' ইত্যাদি।
ফরাসি সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনাগুলোকে এইভাবে পুরোপুরি নির্বীর্য করে তোলা হয়। জার্মানদের হাতে যখন এ সাহিত্য এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণীর সংগ্রামের অভিব্যক্তি হয়ে আর রইল না, তখন তাদের ধারণা হল যে 'ফরাসি একদেশদর্শিতা' অতিক্রম করা গেছে, সত্যকার প্রয়োজন নয়, প্রকাশ করা গেছে সত্যের প্রয়োজনকে, প্রতিনিধিত্ব করা গেছে সর্বহারার স্বার্থের বদলে মানব প্রকৃতির, নির্বিশেষে যে মানুষের শ্রেণী নেই, বাস্তবতা নেই, যার অস্তিত্ব কেবল দার্শনিক জল্পনার কুয়াশাবৃত রাজ্যে তার স্বার্থের।
জার্মান এই যে সমাজন্ত্র তার স্কুলছাত্রসুলভ কর্তব্যটাকেই অমন গুরুগম্ভীর ভারিক্কী চালে গ্রহণ করে সামান্য পশরাটা নিয়েই ভড়ংদারের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল তার পণ্ডিতি সারল্যটাও কিন্তু ইতিমধ্যে ক্রমে ক্রমে ঘুচে গেছে।
সামন্ত আভিজাত্য ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জার্মান, বিশেষ করে প্রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণীর লড়াইটা, অর্থাৎ উদারনৈতিক আন্দোলন তখন গুরুতর হয়ে উঠেছে।
তাতে রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে সমাজতন্ত্রের দাবিগুলো তুলে ধরবার বহুবাঞ্ছিত সুযোগ 'খাঁটি' সমাজতন্ত্রের কাছে এসে হাজির হয়, হাজির হয় উদারনীতি, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, বুর্জোয়া প্রতিযোগিতা, সংবাদপত্রের বুর্জোয়া স্বাধীনতা, বুর্জোয়া বিধান, বুর্জোয়া মুক্তি ও সাম্যের বিরুদ্ধে চিরাচরিত অভিশাপ হানবার সুযোগ; জনগণের কাছে এই কথা প্রচারের সুযোগ যে এই বুর্জোয়া আন্দোলন থেকে তাদের লাভের কিছু নেই, সবকিছু হারাবারই সম্ভাবনা। ঠিক সময়টিতেই জার্মান সমাজতন্ত্র ভুলে গেল, যে ফরাসি সমালোচনার সে মূঢ় প্রতিধ্বনি মাত্র সেখানে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্ব আগেই প্রতিষ্ঠিত, অার তার সঙ্গে ছিল অস্তিত্বের আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও তদুপযোগী রাজনৈতিক সংবিধান, অথচ জার্মানিতে আসন্ন সংগ্রামের লক্ষ্যই ছিল ঠিক এগুলোই।
পুরোহিত, পণ্ডিত, গ্রাম্য জমিদার, আমলা ইত্যাদি অনুচর সহ জার্মান স্বৈর সরকারগুলোর কাছে আক্রমণোদ্যত বুর্জোয়া শ্রেণীকে ভয় দেখাবার চমৎকার জুজু হিসাবে তা কাজে লাগল।
ঠিক একই সময়ে এই সরকারগুলো জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্রোহসমূহকে চাবুক ও গুলির যে তিক্ত ওষুধ গেলাচ্ছিল তার মধুরেণ সমাপয়েৎ হল এতে।
এই 'খাঁটি' সমাজতন্ত্র এদিকে এইভাবে সরকাগুলোর কাজে লাগছিল জার্মান বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়ার হাতিয়ার হিসাবে, আর সেই সঙ্গেই তা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ, জার্মানির কূপমণ্ডুকদের স্বার্থের প্রতিনিধি। জার্মানিতে প্রচলিত অবস্থার প্রকৃত সামাজিক ভিত্তি ছিল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী, ষোলো শতকের এই ভগ্নশেষটি তখন থেকে নানা মূর্তিতে বারবার আর্বিভূত হয়েছে।
এ শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হল জার্মানির বর্তমান অবস্থাটাকেই জিইয়ে রাখা। বুর্জোয়া শ্রেণীর শিল্পগত ও রাজনৈতিক আধিপত্যে এ শ্রেণীর নির্ঘাত ধ্বংসের আশঙ্কা – একদিকে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে, অপরদিকে বিপ্লবী সর্বহারার অভ্যুদয়ে। মনে হল যেন এই দুই পাখিকে এক ঢিলেই মারতে পারবে 'খাঁটি' সমাজতন্ত্র। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ল তা।
বাগজালের ফুলে নকশা কাটা, ন্যক্কারজনক ভাবালুতায় সিক্ত বিভ্রমের জল্পনা দিয়ে তৈরি বিমূর্ত আলখাল্লায় জার্মান সমাজতন্ত্রীরা তাদের শোচনীয়, অস্তিচর্মসার “চিরন্তন সত্যকে” আবৃত করল, এবং ফলে ঐ ধরনের মানুষের মধ্যে তাদের মালের কাটতি অনেক বেড়ে গেল।
কূপমণ্ডুক পেটি বুর্জোয়ার বাগাড়ম্বরী প্রতিনিধিত্বটাই যে তার কাজ, জার্মান সমাজতন্ত্র নিজের দিক থেকে তা ক্রমেই বেশি করে উপলব্ধি করতে থাকে।
তারা ঘোষণা করল যে জার্মান জাতি হল আদর্শ জাতি, কূপমণ্ডুক জার্মান মধ্যবিত্তই হল আদর্শ মানুষ। এই আদর্শ মানুষের প্রতিটি শয়তানি নীচতার এরা এক একটা গূঢ় মহত্তর সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিল, যা তার আসল প্রকৃতির ঠিক বিপরীত। এমনকি সাম্যবাদের 'পাশবিক ধ্বংসাত্মক' ঝোঁকের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধতা ও সব ধরনের শ্রেণীসংগ্রাম সম্বন্ধে পরম ও নিরপেক্ষ অবজ্ঞা ঘোষণায় তার দ্বিধা হল না। আজকের দিনে (১৮৪৭) যত তথাকথিত সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনা জার্মানিতে প্রচলিত, যৎসামান্য কয়েকটিকে বাদ দিলে তার সমস্তটাই এই কলুষিত ক্লান্তিকর সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে।