বলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার-এর প্রকাশনার সমাপতন ঘটেছিল ১৮৪৮-এর ১৮ মার্চের সঙ্গে, যেটা ছিল মিলান ও বার্লিনের বিপ্লবের দিন, যে বিপ্লবগুলো ছিল দুটি জাতির সশস্ত্র অভ্যুত্থান, যার মধ্যে একটি জাতির অবস্থান ইউরোপ মহাদেশের কেন্দ্রে, এবং অন্যটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রে; তখনও পর্যন্ত বিভেদ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ঐ জাতি দুটিকে দুর্বল করে রেখেছিল, এবং ফলে তারা বিদেশী নিয়ন্ত্রণের অধীন হয়েছিল। ইতালি ছিল অস্ট্রিয়ার সম্রাটের অধীন, আর জার্মানি ছিল সমগ্র রাশিয়ার জারের নিয়ন্ত্রণাধীন, সেই নিয়ন্ত্রণ অপ্রত্যক্ষ হলেও কম কার্যকরী ছিল না। ১৮৪৮-এর ১৮ মার্চের ফলস্বরূপ ইতালি ও জার্মানি এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়েছিল; ১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ পর্যায়ে এই মহান জাতি দুটি যদি পুনর্গঠিত হয়ে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠে থাকে তবে তার কারণ ছিল, কার্ল মার্কস যেমন বলতেন, যে ব্যক্তিরা ১৮৪৮-এর বিপ্লবকে দমন করেছিল তারাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এর রূপকার হিসাবে সামনে এসেছিল।
বিপ্লব সর্বত্রই চালিত হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারা; শ্রমিক শ্রেণীই ব্যারিকেডগুলো গড়ে তোলে এবং নিজেদের রক্ত দিয়ে তার মূল্য চোকায়। তবে শুধুমাত্র প্যারিসের শ্রমিকদেরই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উৎখাত করা। কিন্তু নিজ শ্রেণী ও বুর্জোয়াদের মধ্যে তীব্র বৈরিতা সম্পর্কে শ্রমিকরা সচেতন থাকলেও, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা ফরাসি শ্রমিক জনগণের বৌদ্ধিক বিকাশ তখনও এমন স্তরে পৌঁছায়নি যার মধ্যে দিয়ে সামাজিক পুনর্গঠনের বাস্তবায়ন সম্ভব হত। শেষবিচারে বিপ্লবের ফসল অতএব পুঁজিপতি শ্রেণীই হস্তগত করেছিল। অন্যান্য দেশে, ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়াতে শ্রমিকরা একেবারে শুরু থেকেই বুর্জোয়াদের ক্ষমতায় আনা ছাড়া আর কিছুই করেনি। কিন্তু যে কোনো দেশেই জাতীয় স্বাধীনতা ছাড়া বুর্জোয়াদের শাসন সম্ভব নয়। ১৮৪৮-এর বিপ্লবের পরিণামে সেই জাতিগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন হয়ে ওঠাটা তাই অবশ্যম্ভাবি ছিল, ততদিন পর্যন্ত যে জাতিগুলোর তা ছিল না : ইতালি, জার্মানি, হাঙ্গেরি। এরপর পোল্যান্ডেরও তাই হয়ে ওঠার পালা।
সুতরাং, ১৮৪৮-এর বিপ্লব যদি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না হয়ে থাকে তা কিন্তু এর পথ প্রশস্ত করেছিল, এর ভিত্তি তৈরি করেছিল। সমস্ত দেশে বৃহদায়তন শিল্পে ব্যাপক গুরুত্ব প্রদানের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থা গত ৪৫ বছরে সর্বত্রই অসংখ্য, কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী সর্বহারা সৃষ্টি করেছে। কমিউনিস্ট ইস্তাহারের কথায়, এইভাবে তারা জন্ম দিয়েছে তাদের নিজেদের সমাধি খননকারীদের। প্রতিটি দেশের স্বাধীনতা ও ঐক্যের পুনরুদ্ধার ছাড়া সর্বহারার আন্তর্জাতিক ঐক্য, অথবা সাধারণ লক্ষ্যের চরিতার্থতায় এই জাতিগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ এবং বিচক্ষণ সহযোগিতা সম্ভব নয়। শুধু বিচার করুন, ১৮৪৮-এর পূর্ববর্তী পর্যায়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইতালি, হাঙ্গেরি, জার্মানি, পোল্যান্ড ও রাশিয়ার শ্রমিকদের যৌথ আন্তর্জাতিক সংগ্রাম কি সম্ভব ছিল!
১৮৪৮-এর লড়াই অতএব বৃথা যায়নি। সেই বিপ্লবী যুগের পর পার হয়ে যাওয়া ৪৫টি বছরেও কোনো কাজ হয়নি এমন নয়। আমি আশা করি, ইতালি ভাষায় অনুদিত এই সংস্করণ ইতালির সর্বহারার বিজয়ে সেরকম প্রেরণাই সঞ্চার করবে ঠিক যেমন এর প্রথম প্রকাশনা আন্তর্জাতিক বিপ্লবের কাছে হয়ে উঠেছিল।
অতীতে পুঁজিবাদ যে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছিল ইস্তাহার তার প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করেছে। ইতালিই ছিল প্রথম পুঁজিবাদী দেশ। সামন্ততান্ত্রিক মধ্য যুগের অবসান এবং আধুনিক পুঁজিবাদী যুগের সূচনার সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করেছিলেন এক অতিকায় মানব : ইতালির মানুষ দান্তে, যিনি ছিলেন মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক সময়ের প্রথম কবি। ১৩০০ সালের মতো বর্তমান সময়েও এক ঐতিহাসিক যুগ সমাসন্ন। ইতালি আজ কি আবার এক নতুন দান্তে আমাদের উপহার দেবে, যিনি এই নতুন, সর্বহারা যুগের জন্মলগ্নের প্রতিনিধিত্ব করবেন?
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লন্ডন, ১ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩