(পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

বিগত কয়েক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক উত্তাপ বেড়েই চলেছে। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসার তাণ্ডবে হাজারে হাজারে মানুষ মারা যাওয়ায় ও জখম হওয়ায় সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নেহরুর অর্থনৈতিক মডেলের পতন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ক্রমবর্ধমান বিরক্তি ও জাতীয় ঐক্যের প্রতি প্রকৃত ও কাল্পনিক বিপদ এবং দক্ষিণপন্থা ও মৌলবাদের উত্থানের এক আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত পরিমণ্ডল, এই বহুমুখী কারণগুলিই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও রাজনীতির উত্থানের এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান জুগিয়েছে। এর ওপর কংগ্রেস(ই), জনতা দল, সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর মতো সমস্ত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি বিজেপির প্রতি বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে যে ধরনের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক আচরণ করেছে তাতে বিজেপির ফুলে ফেঁপে ওঠার পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।

এটি পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া দরকার যে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো সাধারণ মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নয়। আরএসএস এবং বিজেপির চতুর নেতৃবৃন্দ এযাবৎকাল বাবরি মসজিদকে এভাবেই তুলে ধরেছেন যে, বাবরি মসজিদ হল বহিরাগত মুসলমানদের হিন্দু ভারত আক্রমণের স্মৃতিসৌধ এবং হিন্দু গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এর ধ্বংসের প্রয়োজন। এইভাবে রাম জন্মভূমি আরএসএস-এর দীর্ঘমেয়াদী হিন্দুরাষ্ট্র মতাদর্শের একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে পরিণত হয় এবং সরলমনা হিন্দু জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে আকৃষ্ট করে। এভাবে সংঘ পরিবারের সুকৌশলী নেতৃত্বে এবং সংগঠিত প্রচেষ্টায় রাম জন্মভূমিকে ধরে প্রকৃতই এক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে এর মূল বিষয়বস্তু হল রাজনীতি ও মতাদর্শ। রামের নাম নিয়ে বিজেপি দ্রুতই দেশের কোণে কোণে পৌঁছে যায় এবং খুব কম সময়ের মধ্যে প্রধান বিরোধীদলে পরিণত হয়ে ওঠে। চারটি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে স্কুলগুলিকে হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শের প্রচার কেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্যে আরএসএস দ্রুতই স্কুলের পাঠক্রম পাল্টাতে শুরু করে দেয়।
মার্কসবাদী ও অন্যান্য বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের পশ্চাদপসরণ তথা কংগ্রেস(ই)-র বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় আকারের ধ্বস নামার ফলে দেশে যে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক শূন্যতা গড়ে উঠেছে তারই সুযোগ নিয়ে বিজেপি সাহসের সাথে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে।

বুর্জোয়া ও জমিদারদের সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিত্বমূলক চিন্তাধারা ফ্যাসিবাদ স্বভাবতই আক্রমণাত্মক। একটি-দুটি রাজ্যে শাসন ক্ষমতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার দল বিজেপি নয়। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের জন্য পরবর্তী লাফ দিতে সে মরীয়া। তাই সে অযোধ্যা ইস্যুতে চাপ বজায় রেখেছে এবং বাবরি মসজিদকে ভেঙ্গে দেওয়ার পর তার পরবর্তী নিশানা এখন কাশী ও মথুরাতে মুসলিম ধর্মস্থানগুলিকে ধুলিসাৎ করে দেওয়া।

এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে শাসক দল ও সরকারপন্থীরা উদারনৈতিক হিন্দু অবস্থান থেকে আবেদন নিবেদন ও আইনি পথের আশ্রয় নেওয়ার মধ্যেই আটকে রয়েছে। মূলধারার বামপন্থীদের প্রতিক্রিয়াও এই চৌহদ্দির বাইরে যেতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তারা যে স্লোগান নিয়ে আসে তা হল – মন্দিরও হোক, মসজিদও থাকুক – সবাই আইন মেনে চলুক। মার্কস বেঁচে থাকলে মন্তব্য করতেন যে ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে সমস্ত লড়াই, তা সে শ্রেণীগুলির মধ্যকারই হোক কিংবা বিভিন্ন ধ্যানধারণার মধ্যকারই হোক, শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় গিয়ে শেষ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

অনেক মানুষই বিজেপির আর এক ধরনের প্রচারধারায় প্রভাবিত হন যে হিন্দুপ্রধান দেশ বলেই ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পেরেছে। এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন যে ইঙ্গিত আছে তা হল ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত মৌলবাদের তুলনায় হিন্দু ধর্ম কত সহিষ্ণু ও উদার।

প্রথমত, অযোধ্যার ঘটনাপরম্পরা বেশ ভালোভাবেই এই কল্পকথার অসারতাকে প্রমাণ করে দিয়েছে। অযোধ্যাকে তথাকথিত হিন্দু ভ্যাটিকান বানিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আদলে হিন্দু ধর্মকে এক সংগঠিত রূপ দেওয়ার সাথে সাথে হিন্দু ধর্মের মহন্তরাও অন্য যে কোনো ধর্মের মৌলবাদীদের মতোই ধর্মান্ধ ও ধর্মোন্মত্ত হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন।

দ্বিতীয়ত, ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতীয়করণের নামে ভারতের আধুনিক সমাজচিন্তাবিদরা সমস্ত ধর্মের ইতিবাচক আত্তীকরণ বা ‘সর্ব ধর্ম সমভাবের’ যে ধারণা নিয়ে এসেছেন তার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সম্পর্কই নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ হল, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনার সঙ্গে ধর্মের কোনো সংশ্রব না রাখা।

তৃতীয়ত, সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এক সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল হিসাবেই জন্ম নিয়েছে এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে লঘু করে দেওয়ার পিছনে যে বাধ্যবাধকতা কাজ করছে তা ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত চরিত্র সম্পর্কে আরও এক স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো ধর্মের গোঁড়া অথবা উদারনৈতিক রূপের প্রাধান্যমূলক অবস্থান গ্রহণ যে কোনো নাগরিক সমাজের বিবর্তনের স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গোঁড়ামিপূর্ণ থেকে উদারনৈতিক স্তরে খ্রীষ্টধর্মের বিবর্তন কিংবা খালিস্তানের উত্থানের সাথে সাথে আপাত উদার শিখধর্মের গোঁড়ামিপূর্ণ হয়ে ওঠা – এ সবই এই সামাজিক নিয়মের দৃষ্টান্ত।

উদারনৈতিক হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়াতে মর্মাহত কারণ তা হিন্দু মতবাদের বিরুদ্ধ-কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তাঁরা এই ভেবে অবাক হন যে মুসলিম নেতৃবৃন্দ কেন এই জরাজীর্ণ কাঠামোর উপর তাঁদের দাবি ছেড়ে দিচ্ছে না, বিশেষত সেই কাঠামোটি যখন আর মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয় না। তাদের সুবিধামতো তাঁরা এটা ভুলে যান যে মুসলমান জনগণের কাছেও বাবরি মসজিদ ভারতবর্ষের জটিল সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তাঁদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের প্রতীকস্বরূপ এক স্মারক হয়ে উঠেছে।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতার দরুণ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে তাঁরা সহজেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং প্রায়ই মন্দিরের বিরুদ্ধে মণ্ডলকে দাঁড় করানোর নেতিবাদী কৌশলের পথেও চলে যান। গত নির্বাচনে এই কৌশল চরম ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে।

এব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না যে আজকের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমতকে সমাবেশিত করতে হলে হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মের উদারনৈতিক মূল্যবোধ তথা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও আইনি রায় এই সবকিছুকেই ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু এক স্বাধীন বাম মঞ্চ থেকে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার ছাড়া সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে না। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যকর্মের বিপরীতে দাঁড় করানো অথবা ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার নামে সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদী জোটবন্ধনের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করলে চলবে না। বরং এই প্রশ্নটিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এক বিষয় হিসাবেই দেখতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রশ্নও তুলে ধরতে পারে এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার পরিবর্তে আমাদের অবশ্যই চাই এক গণতান্ত্রিক মোর্চা যার কর্মসূচির মধ্যে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নটি যথাযথ অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচিত হবে। শুধুমাত্র এক নৈতিক প্রশ্ন হিসাবে অথবা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ঘোষণা হিসাবে নয়, বরং বাস্তব রাজনীতির প্রশ্ন হিসাবেও, এক আধুনিক ভারত গড়ার চূড়ান্ত পূর্বশর্ত হিসাবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিষয়টি আমাদের দেখতে হবে।

(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৯ সংখ্যায় কমরেড বিনোদ মিশ্রের শেষ লেখা)

পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল

এই চরম অনিশ্চয়তার যুগে আরও একটি আলোড়নময় বছর ছিল ১৯৯৮। কিন্তু গভীর অনুসন্ধান করলে এই বিরাজমান বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এমন কিছু অন্তঃসলিলা ধারা দেখতে পাব যেগুলি নতুন শতকের মোড় নেওয়ার সাথে সাথে বড় বড় অভ্যুত্থানে ফেটে পড়তে পারে।

এই সেদিন পর্যন্ত বিশ্বায়নের প্রবক্তারা বুক বাজিয়ে বলেছিল যে পুঁজিবাদের ‘স্বর্ণযুগ’ অবশ্যই স্থায়ী হবে। তারা দাবি করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির তাবৎ সমস্যার সমাধান নাকি তাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে। কিন্তু ১৯৯৮ এই সমস্ত কিছুকেই উল্টে দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার “শার্দুল অর্থনীতিগুলির” পতন এবং সংকট দ্রুতই লাতিন আমেরিকায় সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠেছে। আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের হতবুদ্ধিগ্রস্ত নীতিনির্ধারকরা আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রেসক্রিপশন হাজির করতে পারছেন না। অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার কোনো কিনারা করতে না পারায় সমাধান সূত্রও অধরা থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কর্তারা বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থারই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, যার মধ্যে আর্থিক পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের বর্ধিত ভূমিকার কথাও রয়েছে। কিছুদিন আগেও নয়া উদারনীতিবাদের কট্টর প্রবক্তাদের কাছে এটা ছিল একেবারে নিষিদ্ধ বিষয়। বিগত প্রায় এক দশক কালের প্রথাকে ভেঙ্গে এই বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় দার্শনিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে, যিনি ‘পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়া’ ঠেকাতে ধনী ও দরিদ্র উভয়েরই সুরক্ষা ব্যবস্থার ওকালতি করেছেন। আমরা জানি না, ৩০ দশকের ভূত দেখে এবং তার আগাম প্রতিকার ব্যবস্থা হিসাবেই নোবেল কমিটি কেইনসের এই তৃতীয় বিশ্বের অবতারকে তুলে ধরেছেন কিনা!

বিশ্বায়নের প্রকল্পটি এইভাবে ধাক্কা খাওয়ার পর বিশ্বের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ফের পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। বর্তমানে অবশ্য মার্কসবাদী চিন্তাধারার সমাজগণতান্ত্রিক ব্যাখ্যাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু সংকট গভীরতর হয়ে ওঠা এবং বিশ্বের সর্বত্র যুব সম্প্রদায় ও শ্রমিকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ভূমিকা বিপ্লবী মার্কসবাদের শক্তিগুলির পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতিতে বামদের দুই কৌশল

অলীক স্থায়িত্বের নাগাল পাওয়ার লক্ষ্যে এই বছরের গোড়ায় মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারপর আট মাসও পার হয়নি, এর মধ্যেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখা যাচ্ছে আর একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা। যুক্তফ্রন্টের জগাখিচুড়ি জোটকে উপহাস করেছিল যে বিজেপি, সে কিন্তু আরও নিকৃষ্ট জোটের ওপর ভর করেই ক্ষমতায় আরোহন করে। তার ‘স্থায়ী সরকার ও দক্ষ নেতা’র স্লোগান বছরের সবথেকে বড় তামাশা হিসােব পরিগণিত হয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেসের হাতে শাসক জোটের পতনের উপক্রম হয়েছে। একইসঙ্গে ‘তৃতীয় শক্তিগুলি’কেও প্রান্তসীমায় ঠেলে দিয়েছে কংগ্রেস, একসময় যার বিপর্যয়ের বিনিময়েই তৃতীয় শক্তির অগ্রগতি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বামদের গ্রহণীয় কৌশল সম্পর্কিত বিতর্ক আবার সামনে এসে গেছে।

যুক্তফ্রন্টের পতন এবং বিজেপির ক্ষমতায় আরোহনের সঙ্গে সঙ্গেই বামদের মধ্যকার সুবিধাবাদী অংশটি অবস্থান পাল্টায় এবং কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাতের ওকালতি শুরু করে। এমনকি নির্বাচনী ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়ার আগেই সুরজিৎ সরকার গঠনে এগিয়ে আসার জন্য কংগ্রেসকে উস্কানি দিতে থাকেন। সম্ভাব্য কংগ্রেস সরকারের জন্য প্রদত্ত সমর্থনকে সিপিআই(এম) কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে ব্যাখ্যা করলেও, পরবর্তীতে দুই দলের মাখামাখি এবং সিপিআই(এম) তাত্ত্বিকবাহিনী বিষয়টিকে যেভাবে চিত্রিত করে, তার থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে দুই দল এক রণনীতিগত সহযোগিতার লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে। সিপিআই ও সিপিআই(এম) উভয়েরই পার্টি কংগ্রেসে ব্যাপক সংখ্যক প্রতিনিধি নেতৃত্বের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন, এমনকি সিপিআই(এমএল)-এর মতো শক্তিগুলিকে নিয়ে তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে নেতৃত্ব তাঁদের পুরোনো পথে চলতেই বদ্ধপরিকর। যুক্তফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই, ১৯৯৭-এর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আমাদের ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে আমরা বলেছিলাম – “বর্তমান জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই বিজেপি-বিরোধী ও কংগ্রেস-বিরোধী দিশায় অবিচল থাকতে হবে। অবশ্যই আমরা ভারতবর্ষের গৈরিক অধিগ্রহণের বিপদকে স্বীকার করি এবং সেই ধরনের পরিণতি এলে বিজেপি-বিরোধী মহাজোট গঠনের জন্য আমাদের কিছু কর্মনীতিগত রদবদল করতে হতে পারে। তবে এই ধরনের রদবদলকে অবশ্যই তিনটি মৌলিক মানদণ্ডের চৌহদ্দির মধ্যে থাকতে হবে : (১) পার্টির স্বাধীনতা ও উদ্যোগকে বজায় রাখতে হবে; (২) যে কোনো বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মহাজোট থেকে কংগ্রেসকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে; (৩) অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেসী যে কোনো সরকারের সমস্ত জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা আমরা চালিয়ে যাব।”

এটাই হত বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির একমাত্র সঠিক নীতি এবং আমাদের পার্টি ধারাবাহিকভাবে তা অনুসরণ করে গেছে।

পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেস কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত মধ্যপন্থী পার্টির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে ফলে তারাও এখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে খুব সরব হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলছেন সমগ্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিই কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুই মেরুর মধ্যে বিভাজিত হয়ে গেছে। ফলে তৃতীয় শক্তির ধারণাটিই আজ অপ্রাসঙ্গিক। এই অভিমত সংকটগ্রস্ত তৃতীয় শিবিরকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এবং মূলত যুক্তফ্রন্টের পুরোনো শরিকদের নিয়েই জোড়াতালি দিয়ে এক তৃতীয় শিবির গঠনের প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। আজকের নির্দিষ্ট অবস্থায় ঐ ধরনের যুক্তফ্রন্ট গঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কংগ্রেসের সাপেক্ষে তাদের দরকষাকষির সামর্থ্য বাড়িয়ে নেওয়া।

আমাদের পার্টি ঐ ধরনের প্রচেষ্টার শরিক হতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের দলগুলির সঙ্গে সংসদ ও বিধানসভার অভ্যন্তরে বোঝাবুঝি এবং নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতিতে এমনকি তাদের সঙ্গে সাময়িক কৌশলগত আঁতাতও অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ অথবা তৃতীয় ফ্রন্টের মধ্যে তাদের সঙ্গে সমালোচনাহীন রণনৈতিক জোটে যুক্ত হওয়াটা বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কৌশল হতে পারে না। সিপিআই দীর্ঘদিন ধরেই ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এর সন্দেহজনক তত্ত্বের আড়ালে ঐ ধরনের কৌশল অনুসরণ করে এসেছে এবং জাতীয় বুর্জোয়ার অন্বেষণ করতে গিয়ে সে কংগ্রেসের কোলে ঢলে পড়েছে। ফলে কংগ্রেস যেখানে এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী, সিপিআই সেখানে দ্রুতই জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে পরিণত হচ্ছে। আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের মাধ্যমে ‘জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এ পৌঁছানের সিপিআই(এম)-এর সূত্রায়ন ঐ দলকেও কংগ্রেসের কবলে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিণতি খুবই স্বাভাবিক, কেননা ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টই যখন আপনার কৌশলের শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন কংগ্রেস ছাড়া কেই বা আপনার স্বাভাবিক মিত্র হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সিপিআই-এর পরিণতি থেকেও রেহাই পাওয়ার রাস্তা নেই।

এর বিপরীতে আমরা জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্র হিসাবে এক বাম মেরু গড়ে তুলতে চাই। আর সেজন্যই আমরা এক বাম মহাজোটের ডাক দিয়েছি, যা গঠিত হবে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী ছাড়াও নতুন সামাজিক আন্দোলনে বিভিন্ন বাম ঝোঁক সম্পন্ন শক্তিগুলি সহ বিপ্লবী গণতন্ত্রের সমস্ত শক্তিগুলিকে নিয়ে। বিপ্লবী গণতন্ত্রের শক্তিগুলি তৃণমূল থেকে উঠে আসছে – সংসদবাদের চৌহদ্দির মধ্যে কদাচিৎ তাদের দেখা মিলবে। তাছাড়া, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মধ্যে সকলে গণতান্ত্রিক নয়; অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি। সুবিধামতো তারা রং পাল্টে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুকূলে ঢলে পড়ে। ১৯৮০-র দশকে ও ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় কংগ্রেস এবং গত বছরে চন্দ্রবাবু নাইডু এটাই করেছিল।

যুক্তফ্রন্টের অগৌরবজনক পতনের পর আমরা সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর কাছে পুনরায় বাম মহাজোটের প্রস্তাব রাখি। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কেননা তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে মাখামাখিতেই ব্যস্ত ছিলেন। একদিকে বামপন্থী কর্মীবাহিনী এবং শ্রমজীবী জনগণ যখন ১১ ডিসেম্বরের ধর্মঘটকে সফল করে তোলার জন্য সংঘবদ্ধভাবে লড়াই চালাচ্ছিলেন; সিপিআই(এম) নেতৃত্ব তখন বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের বিকৃত শক্তিগুলি – যারা সমগ্র নয়া আর্থিক নীতিরই দৃঢ় সমর্থক – তাদের নিয়ে তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যে ঐ ধর্মঘটকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার মতলব করছিলেন। এর বিপরীতে আমাদের অবস্থান হল বামপন্থী কর্মীবাহিনী ও শ্রমজীবী মানুষের এই সংহতিকে বিকশিত করে বাম মহাজোটে রূপান্তরিত করা।

একদিকে যুক্তফ্রন্টের পতন, অন্যদিকে কিছু রাজ্যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতে সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর ব্যর্থতা, এমনকি তাদের সমর্থনভিত্তির ক্ষয় বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের প্রতি তাদের কৌশল সম্পর্কে নিজেদের ভেতরেই গুরুতর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্নেও তাদের মধ্যে বিক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের পার্টি কংগ্রেসগুলিতে ব্যাপক সংখ্যক বাম কর্মীবাহিনী বামদের ঐক্যবদ্ধতা ও তাদের স্বাধীন কার্যকলাপের পক্ষেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সুতরাম বাম মহাজোটের স্লোগান বাম কর্মীবাহিনী ও ব্যাপক সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত করে।

এই ব্যাপারে স্পষ্ট থাকা উচিত যে বাম মহাজোটের স্লোগান যেমনভাবে হোক সমস্ত বাম শক্তিগুলিকে এক মঞ্চে জড়ো করার কোনো সাধু আকাঙ্খা মাত্র নয়, বরং তা হল ‘যুক্তফ্রন্ট’ ধরনের সুবিধাবাদী কৌশলের বিপরীতে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সুনির্দিষ্ট কৌশলগত প্রত্যুত্তর। আমাদের তাই এই শ্লোগানের প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে হবে, বামদের মধ্যকার দুই কৌশলের এই লড়াইকে ব্যাপক বাম কর্মীবাহিনী ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে এবং তাঁদের বিপ্লবী কমিউনিজমের পক্ষে জয় করে আনতে হবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটি এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া এবং সমাজগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের তা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই কৌশল আবার নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও সর্বাপেক্ষা কার্যকরী প্রতেষেধক, কেননা সমাজগণতন্ত্রীদের ‘যুক্তফ্রন্টীয়’ কৌশলের মধ্যে নিহিত সংসদসর্বস্বতাই বিপ্লবী যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত বাম আন্দোলন থেকে বিক্ষিপ্ত করে তাদের নৈরাজ্যবাদী শিবিরের দিকে ঠেলে দেয়।

কৃষক সংগ্রামকে মূল যোগসূত্র হিসাবে ধরুন

জমিদারদের ভাড়াটে বাহিনী আমাদের সামাজিক ভিত্তির ওপর আঘাত হানায় বিহারের গ্রামাঞ্চলে বিশেষত ভোজপুর ও জাহানাবাদে আমরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছিলাম। ১৯৯৭-এর শেষে ঘটে বাথে গণহত্যা, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই ৬০ জন মানুষকে জবাই করা হয়। এটা অবশ্য আমাদের আন্দোলনের ধারায় একটা মোড়ও সূচিত করে। রাজনৈতিক বিক্ষোভগুলি সংগঠিত করা ছাড়াও কিছু পাল্টা আঘাতও হানা হয় এবং পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে আমরা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে আমাদের ভিতকে ধরে রাখতে ও সক্রিয় করতে সমর্থ হই। সাম্প্রতিককালে তাদের সামাজিক ভিতের মধ্যে ফাটল দেখা দেওয়ায় রণবীর সেনা এক ধরনের স্থিতাবস্থার মধ্যে পড়েছে ও তাদের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে আমাদের ভোজপুরের ‘পুনর্জাগরণ’ সমাবেশ ব্যাপক সাফল্যলাভ করে এবং তা দেখিয়ে দেয় যে গণ উদ্যোগের দরজা আবার খুলে যাচ্ছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই, কেননা রণবীর সেনার আঘাত হানার শক্তি এখনও অটুট। যে শয়তান বাহিনী বিহারে আমাদের আন্দোলনের সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয়েছে, তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভের জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।

ষষ্ঠ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিহারে এবং অন্যত্র আমাদের আন্দোলনের এলাকাগুলিতে ক্ষেতমজুর সংগঠন গড়ে উঠছে। বিহারে এই শাখাগুলির মধ্যে রাজ্যস্তরে সমন্বয়সাধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে এবং নতুন বছরে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজ্য স্তরের একটি সংগঠন বানানো। কৃষি বিপ্লবে নিয়োজিত পার্টির কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল গ্রামীণ সর্বহারাদের তাদের শ্রেণী সংগঠনে সংগঠিত করা ও তাদের শ্রেণী চেতনার বিকাশ ঘটানো।

বিহারে পূর্বেকার কিষাণ সভা অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি পকেটে স্থানীয় ভিত্তিতে ও স্থানীয় ইস্যুর ভিত্তিতে ব্যাপক কৃষক জনতাকে সংগঠিত করার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, অন্ধ্র ও উড়িষ্যাতেও কৃষক প্রতিরোধের কিছু এলাকা বিকাশলাভ করছে। কমরেড নাগভূষণ পট্টানায়কের মৃত্যু সত্ত্বেও উড়িষ্যায় জমিদারদের আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্যিক সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে ভারতীয় কৃষি সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে সমাজগণতন্ত্রীরা গ্রামীণ দরিদ্রদের তাদের সংগ্রাম পরিত্যাগ করতে বলছে এবং ধনী চাষিদের পিছনে সমাবেশিত হওয়ার উপদেশ দিচ্ছে। ঐ একই যুক্তির ভিত্তিতে নৈরাজ্যবাদীরাও ধনী কৃষকদের সংগঠনগুলির সাথে একই মঞ্চে মিলিত হয়েছে। এটি হল দুই চরম বিপরীতের একই বিন্দুতে মিলিত হওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মার্কসবাদের শ্রেণী দৃষ্টিকোণ পরিত্যাগ করেছেন এমন কিছু প্রাক্তন মার্কসবাদী জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্তব্যকর্মকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাই তাঁরা জাতিবর্গের ভিত্তিতেই কথা বলেন, বিএসপি-মার্কা রাজনীতিতে আটকে পড়েন এবং দরিদ্র নিপীড়িত জনতার নেতৃত্ব দলিত ও পশ্চাদপদ বর্গের সেই সুবিধাবাদী স্তরের হাতে তুলে দেন, যারা সাধারণ মানুষকে কামানের খোরাক হিসাবে ব্যবহার করে সংসদীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে তাদের লুটের ভাগ আদায় করে নেয়। অন্ধ্রে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মহলে এই ধারা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল, ফলে সেখানে আন্দোলন প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙ্গন ঘটে। তামিলনাড়ুতেও এই বিষয়টি যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। যথেষ্ট সম্ভাবনা সত্ত্বেও সেখানে আন্দোলন যে জোরদার হয়ে উঠছে না তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এখানেই। বিহারেও এমসিসি ও পার্টি ইউনিটি-কে এই একই চিন্তাধারা শক্তিশালী পশ্চাদপদ জাতি গোষ্ঠীগুলি ও শাসক দলের হাতে দাবার ঘুটিতে পরিণত করেছে।

জাতি হল অবিভাজিত শ্রেণী আর তাই সমস্ত ধরনের জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম – যা হল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ – সমগ্র সমাজে শ্রেণী বিভাজনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হল এই ব্যাপক সামাজিক আলোড়ন থেকে সুনির্দিষ্ট পরিচিতি নিয়ে উঠে আসা সর্বাহারা শ্রেণী শক্তিগুলিকে সংহত করা, আর আমাদের পার্টি ঠিক এই কাজটিই করছে। মণ্ডল হাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে এবং সমাজতন্ত্রের সংকটকালে যাঁরা আমাদের পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁরা লালু বাহিনীর হয় তাত্ত্বিক না হয় সক্রিয় কর্মীতে অধঃপতিত হয়েছেন, আর আমরা আমাদের অবস্থানে দৃঢ় থেকেছি, আমাদের শ্রেণী শক্তিগুলিকে সংগঠিত করেছি, গণআন্দোলনের আগুনের মধ্য থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলেছি এবং ক্রমে ক্রমে তথাকথিত সামাজিক ন্যায়ের শক্তিগুলির দুর্গে হানা দিচ্ছি। কৃষি সংগ্রামের রণাঙ্গনে সমস্ত ধরনের উদারনীতিবাদী ধ্যানধারণার আমাদের দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করতে হবে এবং পার্টির শ্রেণী লাইনের প্রতি অবিচল থাকতে হবে। এই সংগ্রামগুলিই হল পার্টির প্রাণ। এখান থেকেই জন্ম নেবে জনগণের অমিত বলশালী শক্তিগুলি – যে শক্তি দেশের চেহারাটাই দেবে পাল্টে।

সার্বিক উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ুন

প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান পরিচালনা করার যে গৌরবময় ঐতিহ্য পার্টির রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা এই বছরের শেষের দিকে ‘গৈরিক হঠাও, দেশ বাঁচাও’ অভিযান পরিচালনা করি। এই ধরনের অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য হল জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। একইসঙ্গে এই অভিযানগুলির মাধ্যমে সমগ্র পার্টিকে সমাবেশিত করে জাতীয় স্তরের কেন্দ্রীয় ইস্যুর প্রতি পার্টির দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং এইভাবে তার লৌহদৃঢ় ঐক্য সুনিশ্চিত করা হয়। তাই তথাকথিত সৃজনশীল প্রয়োগের নামে কোনো রাজ্য শাখা বা গণসংগঠন যদি জাতীয় স্তরের আহ্বানকে লঘু করে তোলে, তবে সেটা অনুমোদনযোগ্য নয়।

উপরোক্ত অভিযান শেষ হয়ে গেলেও বিজেপি শাসনের বিভিন্ন দিককে এখনও উন্মোচিত করে যেতে হবে। আমাদের বিশেষভাবে জোর দিতে হবে তার আমূল বিশ্বায়নের আর্থিক মতবাদ ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণের ওপর। তার স্বদেশীয়ানার চমকদারি সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে গেছে এবং বামদের পক্ষে স্বনির্ভর অর্থনীতিকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। ১১ ডিসেম্বরের শ্রমিক শ্রেণীর কার্যক্রম ছিল এই লক্ষ্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। শ্রমিক ফ্রন্টে বরফ গলতে শুরু করেছে, আমরাও ভালো সাড়া পাচ্ছি, সুতরাং এখানে আমাদের উদ্যোগ অনেক বাড়িয়ে তুলতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের রাজনৈতিকীকরণ ঘটানোর পক্ষে এটা অত্যন্ত অনুকূল সময় এবং আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে কাগজ-কলমের ওপর জোর কমিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি আন্তঃক্রিয়ার উপর মনোনিবেশ করতে হবে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের পার্টিকে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর তাই আমাদের সমস্ত গণসংগঠনগুলিকে, বিশেষত যুব ফ্রন্টকে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমস্ত ইস্যুতে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। চার দেওয়ালের মধ্যে আলোচনার দিন শেষ। এখন সার্বিক উদ্যোগের সময়। ইতিহাসে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নিষ্পত্তি তো রাস্তাতেই হয়ে থাকে।

পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করুন

পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস পার্টি গঠনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্তব্যকর্মগুলিকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরেছিল : (১) পার্টি সদস্যদের প্রাণবন্ত ও গতিময় পার্টি ব্রাঞ্চগুলিতে সংগঠিত করা; (২) একেবারে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত পার্টি শাখাকে সম্প্রসারিত করা; (৩) পার্টি মুখপত্রগুলিকে জনপ্রিয় গণপত্রিকা হিসাবে বিকশিত করা; (৪) উপদলীয়তার যে কোনো অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম চালানো এবং পার্টির মধ্যে এক স্বাস্থ্যকর ও জীবন্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করা; (৫) লিঙ্গ ও অঞ্চলগত ভারসাম্যহীনতাগুলিকে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং পার্টির মধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর ভিত্তিকে শক্তিশালী করা।

তারপর থেকে এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং আমার মনে হয় প্রতিটি পার্টি কমিটিরই উচিত উপরোক্ত কর্তব্যকর্মের ভিত্তিতে গত এক বছরের সাফল্যের পর্যালোচনা করা। আমার মতে প্রথম এবং চতুর্থ কর্তব্যকর্ম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে আমাদের শক্তিশালী পার্টি কমিটিগুলি থাকতে পারে, কিন্তু নীচে যদি প্রাণবন্ত ও গতিশীল ব্রাঞ্চসমূহের পরিকাঠামো না থাকে তবে ঐ ব্যবস্থাপনাকে যথার্থ সংগঠন বলা যাবে না। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি কাঠামো নিয়েই হয় সংগঠন এবং কমিউনিস্ট পার্টির বুনিয়াদী শক্তি যেহেতু সৈন্যবাহিনীর মতোই দৃঢ়বদ্ধ সংগঠন ছাড়া অন্য কিছু নয়, তাই কমিউনিস্ট পার্টির কাছে এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চতুর্থ কর্তব্যকর্মটি সম্পর্কে বলা যায় যে ইতস্তত কয়েকটি পকেটে ছাড়া আমাদের পার্টিতে উপদলীয়তাবাদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টি কমিটির মধ্যকার নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাবুঝি উৎকৃষ্ট মানের নয়। আমি এমন অনেক নেতাকে দেখেছি যাঁরা পার্টি অফিসে একই সঙ্গে থাকেন বা একই শহরে বা এলাকায় থাকেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বার্তালাপ প্রায় নেই। তাঁদের মধ্যে সদ্ভাবের চেয়ে অসদ্ভাবই বেশি এবং যা আরও খারাপ তা হল এই যে তাঁরা সরাসরি ও খোলাখুলি কথা বলে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন না। প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দের বৃত্ত রয়েছে যেখানে কেবল অন্যের সমস্যা চুপিসাড়ে চর্চিত হয়। একে উপদলীয়তা বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে, কিন্তু পার্টির মধ্যে সুস্থ ও জীবন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশের পথে তা অবশ্যই অন্তরায় সৃষ্টি করে।

পার্টি শিক্ষাকে একেবারে নীচের স্তরে নিয়ে যেতে কয়েকটি রাজ্যের পার্টি কমিটি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেগুলি আদৌ সন্তোষজনক নয়। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পার্টি স্কুল ব্যবস্থাকে পুনরায় সংগঠিত করতে হবে এবং মার্কসবাদী শিক্ষার ওপর জনপ্রিয় পুস্তিকা প্রকাশনাকে পুনরায় শুরু করতে হবে। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত না থাকায় অনেক কমরেডই উদারনীতিবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন। পার্টি যখন গুরুত্বসহকারে সংসদীয় অনুশীলনে নিয়োজিত তখন ঐ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাই থাকে।

পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস সতর্ক করে বলেছিল, “খোলা ও গণ পার্টির অর্থ অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টির বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্যকে লঘু করা নয়, তার সংহত চরিত্রকে দুর্বল করা নয়, তার কেন্দ্রিকতা ও শৃঙ্খলাকে খাটো করা নয়। তাই বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজগণতান্ত্রিক সংসদীয় সংস্থায় রূপান্তরিত করতে চায় এমন সব ধরনের উদারনৈতিক ধারণার বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে সংগ্রাম করতে হবে।” খুব কম করে বললেও বলতে হয়, এই সতর্কীকরণ আজ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

বিপ্লবী মার্কসবাদের পতাকাকে দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এমন এক শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি, গ্রামীণ দরিদ্রদের এক শক্তিশালী আন্দোলন এবং গৈরিক শক্তির দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সার্বিক উদ্যোগ – নতুন বছরে আমাদের সামনে এই তিনটি হল চ্যালেঞ্জ। ভুল কৌশলগত লাইন অনুসরণের জন্য সমাজগণতন্ত্রীরা এবং সমস্ত বর্ণের নৈরাজ্যবাদীরা গুরুতর অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে। আমাদের প্রতিটি অগ্রগতি তাদের আরও টলিয়ে দেবে এবং বাম আন্দোলনের পুরোভাগে নিয়ে আসবে আমাদের পার্টিকে। বুর্জোয়া বিকল্পের বিভিন্ন সংস্করণের বিপরীতে জনগণের এক প্রকৃত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এমন এক গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য এই ধরনের বিকাশ অপরিহার্য।

কমরেডস,

১৯৯৮ সালে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডারকে হারিয়েছি যাঁরা শ্রেণীশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আততায়ীর গুলি কমরেড অনিল বড়ুয়াকে আমাদের মধ্যে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কমরেড অনিল বড়ুয়া ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, অসমীয়া সমাজের এক অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। পার্টি ও জনগণের স্বার্থে তিনি ছিলেন উৎসর্গীকৃত প্রাণ। বছরের শেষদিকে আমরা হারালাম কমরেড নাগভূষণ পট্টনায়ককে। ভারতবর্ষের প্রায় ৭৫ বছরের কমিউনিস্ট আন্দোলন যে কয়েকজন মহান কমিউনিস্ট নেতার জন্ম দিয়েছে নাগভূষণ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণশক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধ্বংসস্তুপ থেকে সিপিআই(এমএল)-এর বারবার উঠে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তির প্রতীক। মৃত্যুশয্যায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “জীবন ও মৃত্যুতে আমি পার্টি ও বিপ্লবের জন্য নিবেদিত প্রাণ।” এই হল একজন যথার্থ বিপ্লবী কমিউনিস্টের ভাবমানস এবং তা অনুসরণ করেই আমরা আগামী দিনগুলিতে বৃহত্তর সাফল্য অর্জনে কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।

(লিবারেশন, অক্টোবর ১৯৯৮ থেকে)

দু-সপ্তাহ আগে কংগ্রেসের পাঁচমারি অধিবেশন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এমএল আপডেটে  আমরা লিখেছিলাম, “সরকারি বামরা অনেক ভরসা করেছিল যে এই অধিবেশনে তাদের প্রত্যাশামতো অর্থনৈতিক নীতির পূনর্মূল্যায়ন হবে। এ প্রশ্নে তারা পাঁচমারি থেকে ইতিবাচক সংকেত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল যাতে কংগ্রেসের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তোলার লাইন ফেরি করা যায়। কংগ্রেস দলের সাথে মাখামাখি করার বিরুদ্ধে আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে জোরদার প্রতিরোধের আশঙ্কা থাকায় সিপিআই এবং সিপিআই(এম) উভয়ের কাছেই এটি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।” আমরা আরও লিখেছিলাম, “যাই হোক না কেন, বাম নেতারা নিজেদের প্রতারিতই বোধ করেছেন কারণ ‘গরিবী হটাও’ মার্কা কিছু পুরোনো বুলি ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটা আনুষ্ঠানিক মন্ত্র আওড়ানো ছাড়া অর্থনৈতিক প্রস্তাবগুচ্ছে বরং মনমোহনতন্ত্রই পুরো প্রাধান্যলাভ করেছে।”

বর্তমানে যখন সিপিআই-এর চেন্নাই কংগ্রেস সমাপ্ত তখন আমরা ঘোড়ার মুখ থেকে কিছু খবর শুনতে পাচ্ছি। ১৯ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকায় শ্রীযুক্ত বর্ধনকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে যে, “কংগ্রেসের পাঁচমারি অধিবেশন তার নীতিগুলির পুনর্মূল্যায়ন করবে বলে আশা ছিল। ... (কিন্তু) অর্থনৈতিক নীতির মূল বিষয়গুলিতে যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া হয়নি।” যাই হোক, কংগ্রেসের সাথে অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে মতভেদ নিয়ে সরকারি বামদের প্রকৃত মাথাব্যথার চাইতে বাইরের ভড়ংই অনেক বেশি, হাজার হোক, যুক্তমোর্চা সরকারের অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির মধ্যে কোনো পৃথক অর্থনৈতিক কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয়নি। মোদ্দা ব্যাপার হল, যুক্তফ্রন্ট অনুশীলন মুখ থুবড়ে পড়ার পর কংগ্রেস ও সরকারি বামদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে আঁতাতের এক নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। পাঁচমারি থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়ার কারণে এবং এর ফলে কংগ্রেসের সাথে সক্রিয় আঁতাতের লাইন ফেরি করা নেতৃত্বের পক্ষে দুষ্কর হওয়ায় গতি অবশ্য শ্লথ করতে হয়েছে। ‘উপরতলায় সমঝোতা চালিয়ে যাওয়ার’ এই নীতির বিরোধিতায় প্রতিনিধিদের ভালো একটি অংশের প্রতিরোধের মুখে এবং কঠোর পরিশ্রমের যে কোনো বিকল্প নেই এই কথা তাঁরা জোর দিয়ে তুলে ধরায় চেন্নাই পার্টি কংগ্রেসকে কংগ্রেসের সাথে কোনো সাধারণ আঁতাত বা এক সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট গড়ে তোলার পরিবর্তে কংগ্রেসকে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা বলেই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে।

সিপিআই(এম) নেতৃত্বও একই পথ ধরে হাঁটছে। কংগ্রেসের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রশ্নে কমরেড জ্যোতি বসু খুবই উৎসাহী, কিন্তু সিপিআই-এর পার্টি কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং কলকাতায় তাঁর নিজের কর্মীবাহিনীর কাছ থেকে এমনকি আরও জোরালো প্রতিরোধ আসার সম্ভাবনা থাকায় পার্টি নেতৃত্ব খুব সতর্কভাবে পা ফেলতে শুরু করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-এর দিল্লী সমাবেশে জ্যোতি বসু অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে অনুপস্থিত থেকেছেন আর ঠিক সেইখানেই সুরজিৎ কংগ্রেসের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তা সে যাই হোক, নীচুতলায় কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে ভালো সমর্থন পাওয়ার আশা না থাকায় এবং খোদ নিজেদের নেতৃত্বের মধ্যেই তীব্র বিভাজন থাকায় এবং সর্বোপরি বামদের সঙ্গে খোলাখুলি একসাথে চলার ব্যাপারে কংগ্রেসেরও উৎসাহের ঘাটতি থাকায়, সিপিআই ও সিপিআই(এম) উভয় দলের নেতৃত্ব ধীরে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আসল বার্তাটি পরিষ্কার। তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার উচ্ছ্বাসকে চুপচাপ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে এবং কংগ্রেসের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার একটি যুগ শুরু হয়েছে।

চক্রের পুরো একটি আবর্তন এইভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে যে, মাত্র দু-বছর আগে এই একই বাম নেতারা যুক্তমোর্চা সরকারের পক্ষে কংগ্রেসী সমর্থনের প্রশ্নে কত বড় বড় কথাই না বলেছিলেন। তাঁরা তখন কংগ্রেসের সমর্থনকে কংগ্রেসের বাধ্যবাধকতা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তো এমনকি কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন – সমর্থন তুলে নিলে মজা টের পাবে। অথচ সমর্থন প্রত্যাহারের বিপদ যখন সত্যিই দেখা দিল যুক্তফ্রন্ট তখন মিউ মিউ করে দেবেগৌড়াকে বিসর্জন দিল। পুনর্বার যখন হুমকি দেওয়া হল তখন তাঁরা দুজন ডিএমকে মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার বদলে বরং সরকারকেই বিসর্জন দেওয়ার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন – যে সাহসের জন্য এখন তাঁদের আফশোসের শেষ নেই। ফলশ্রুতিতে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয় তা বিজেপি-কে ক্ষমতায় নিয়ে আসে, কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং যুক্তফ্রন্টের ওপর এক মরণ আঘাত হানে। রাজনীতি বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে মেরুকৃত হয়ে যায়। আর তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার বহু যত্নলালিত ধারণা, জনগণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে এক তথাকথিত উত্তরণশীল পদক্ষেপের ধারণা ইত্যাদি ভালোরকম ঘা খায়। যে ডিএমকে-র জন্য এত সাহসী আত্মত্যাগ, সেই ডিএমকে-ই সরকার হিসেবে বিজেপি আর দল হিসেবে বিজেপি – দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য করার অভিনব এক তত্ত্ব এনে হাজির করেছে। সেই একই শ্রীযুক্ত ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, চেন্নাইতে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ‘বামরা দুর্বল’ – এই যুক্তি দেখিয়ে ক্ষমতায় আরোহণের জন্য কংগ্রেসের যে প্রচেষ্টা তাকে মদত দেওয়ার ওকালতি করেছেন।

কংগ্রেস বামদের এই উভয় সংকটের কথা ভালোই বোঝে এবং তাই পাঁচমারি অধিবেশনে অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে কোনো ছাড়ের বালাই না রেখে সবুজ সংকেত জানিয়ে দিয়েছে। একইসাথে কংগ্রেস লালু-মুলায়ম উভয়ের থেকে দূরত্ব বজায় রাখারও চেষ্টা করেছে। এক সময়ে তার শক্ত ঘাঁটি উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে দলকে পুনরায় শক্তিশালী করার উদ্যোগ এবং তার চিরাচরিত উঁচু জাত এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে সমর্থনের ভিত্তিকে পুনরুদ্ধারের তাগিদ ছাড়াও – তার ধূর্ত লক্ষ্য হল বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে কোনো বাফার না রাখা।

সংকেতগুলি এভাবেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সুবিধাবাদী বামরা অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে চলেছেন কংগ্রেসের দিকে। এক অর্থে এটি তাঁদের কংগ্রেসের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার দীর্ঘদিনের প্রকাশ্য ও গোপন সম্পর্কেরই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। অন্যদিকে নৈরাজ্যবাদী বামরা তাঁদের প্রিয় অ-রাজনৈতিক পতাকার নীচে, ভারতীয় কৃষিকে বিশ্ববাণিজ্য সংগঠনের কবল থেকে রক্ষা করার নামে পুঁজিবাদী কৃষক লবির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে নিচ্ছেন।

এক গণতান্ত্রিক ভিত্তিভূমির উপর তৃতীয় ফ্রন্ট পুনরায় গড়ে তোলার কর্মসূচি বিপ্লবী বামশক্তিকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো যথেষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিই বিরাজ করছে। এমনকি সিপিআই-এর পার্টি কংগ্রেসেও, সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠেরই আবেগ ছিল এক ব্যাপক বাম মোর্চা গড়ে তোলার অনুকূলে। কিন্তু সেখানে নেতৃত্ব চেষ্টা করেছে এই আবেগকে বিপথে চালিত করে সিপিআই(এম)-কে সাথে নিয়ে তথাকথিত এক কমিউনিস্ট ঐক্য গড়ে তোলার সীমানার মধ্যে আটকে রাখতে। সমতা পার্টি বিজেপির দলবলের সঙ্গে হাত মেলানোর পর পূর্বতন সমাজবাদী শক্তিগুলিও রয়েছে ছত্রভঙ্গ অবস্থায়। একই অবস্থা আরও অসংখ্য শক্তির – যারা অধীরভাবে তাকিয়ে রয়েছে তৃতীয় ফ্রন্টের সমগ্র ধারণাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলার সতেজ কোনো প্রচেষ্টার দিকে। আমরা ইতিমধ্যেই বাম কনফেডারেশন গড়ে তোলার জন্য পুনরায় আহ্বান জানিয়েছি; এখন আমাদের কাজ হল “গৈরিক হঠাও, দেশ বাঁচাও” – আমাদের এই চলমান প্রচার অভিযানকে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার ইতিবাচক অভিযানে রূপান্তরিত করা।

(৪ আগস্ট ১৯৯৮, শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনাসভায় প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ।
লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ থেকে)

পোখরান বিস্ফোরণ পারমাণবিক অস্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের নতুন পর্যায়ের জন্য এক প্রয়োজনীয় গতি সঞ্চার করেছে এবং হিরোসিমা দিবসের উদযাপনকে নতুন গতি প্রদান করেছে। এই গ্রহে মজুত পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সংগ্রামেও তা নতুন প্রেরণা যুগিয়েছে। পারমাণবিক বোমা বিরোধী আন্দোলনের এক শান্তিকামী দিক আছে যা সমস্ত ধরনের পারমাণবিক বোমা ও যুদ্ধের বিরোধী। আমরা আন্তরিকভাবে সেই আন্দোলনের অংশীদার। কিন্তু সাথে সাথে পারমাণবিক বোমার পিছনে রাজনীতিও বোঝা দরকার।

১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট হিরোসিমায় বোমা বর্ষণের উদ্দেশ্য যত না ছিল জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, তার চেয়েও বেশি ছিল বিশ্ব রাজনীতিতে, বিশেষ করে এশিয়ার বুকে আমেরিকার হিংস্র আগমন ঘোষণা করা। এই ঘৃণ্য মার্কিনী কৌশল চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই হিরোসিমার বুকে ঐ নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। আজ আমরা জানি আমাদের কাছে এর অর্থ কী দাঁড়িয়েছে। কাজেই বোমার পিছনের রাজনীতি বুঝে ওঠা বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে উপলব্ধি করার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আজ বোমা বানানোর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা ও কৌশল নিয়ে যথেষ্ট উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে। পারমাণবিক বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমার কিন্তু তাঁর আবিষ্কারকে তেমন বিরাট কিছু হবে ভাবেননি। তিনি এবং আরও অনেক বৈজ্ঞানিক পারমাণবিক বোমা মজুতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং আইনস্টাইনও বারবার তাঁর উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন। পারমাণবিক বোমার বিপদকে মোকাবিলা করার জন্য আইনস্টাইন বিভিন্ন দেশকে নিয়ে এক সর্বোচ্চ বিচার সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন।

অস্ত্রসম্ভার বিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাসে দেখা যায় আক্রমণাত্মক অস্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তার যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক বোমার বিশেষত্ব হল যে এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বা প্রতিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। পারমাণবিক বোমার একমাত্র প্রতিরোধ হল পাল্টা পারমাণবিক বোমা বানানো। এই জন্যই হিরোসিমার ক্রমান্বয়ী প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক দেশ পারমাণবিক বোমা বানানোর দিকে এগিয়ে গেল।

আমেরিকার আজ সাত লক্ষ পারমাণবিক বোমা মজুত আছে। ঐ পারমাণবিক ব্যবস্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণে তাকে প্রতি বছর ৩৫০০ কোটি ডলার – প্রতিদিনের হিসাপে ৯৬০ লক্ষ ডলার ব্যয় করতে হয়। গত পঞ্চাশ বছরে আমেরিকা পারমাণবিক কর্মসূচিতে মোট খরচ করেছে প্রায় ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণের আন্দাজ পাওয়া খুব সহজ নয়, এমনকি আমাদের কল্পনাতেও নয়। এই পরিমাণকে এক ডলারের নোটে পরিণত করে যদি একটার সাথে আর একটাকে জুড়ে দেওয়া যায়, তবে যে শিকল তৈরি হবে তার দৈর্ঘ্য চাঁদে যাওয়া ও পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের দৈর্ঘ্যের সমান।

আমেরিকা এক সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে সে সারা পৃথিবী থেকে বিপুল উদ্বৃত্ত আদায় করে, আর তাই সহজে সে এই পরিমাণ খরচ করতে পারে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের (১৯৮৯ পর্যন্ত) এই সুবিধা ছিল না, এই বিপুল পরিমাণ খরচ তার পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। তাই আমরা দেখলাম, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ থেকে সাম্যবাদকে রক্ষা করার জন্য যে পারমাণবিক বোমার মজুত সে গড়ে তুলেছিল তা বিপরীত ফলাফল দেয় এবং সাম্যবাদের পতনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে পারমাণবিক ব্যবস্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের সুবিপুল খরচ বহন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না। এটি করতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর শিল্পক্ষেত্রকে চরম অবহেলা করা হল, তা অর্থনীতিতে বিকৃতির জন্ম দিল এবং শেষ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটাল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। ক্ষমতায় আসার পর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোই ছিল বিজেপি সরকার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সিদ্ধান্তের পিছনে কিছু উদ্দেশ্য এবং বাধ্যবাধকতাও ছিল।

এই বিষয়ে বিজেপির আশু উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা যায় যে, তারা এই লক্ষ্য পূরণে বিস্ফোরণকে কাজে লাগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা চেয়েছিল, দেশের অভ্যন্তরে উগ্রজাতীয়তাবাদী জিগির তুলতে, পাকিস্তানকে ভয় দেখাতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। মাও একবার পরমাণু বোমাকে বলেছিলেন কাগুজে বাঘ। অন্য দেশের বোমা কাগুজে বাঘ হয়েছে কিনা বলতে পারব না, কিন্তু ভারতের বোমার ক্ষেত্রে মাও-এর ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা এবার তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিপরীতে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধিতা হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ কথাটি এতদিন কমিউনিস্টদের অভিধানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার মধ্যেও আবার সিপিআই(এমএল)-ই এই কথাটি বেশি ব্যবহার করত। অন্যান্য বাম দলগুলি কিছুদিন যাবৎ এর ব্যবহার ভুলে গিয়েছিল। কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁরা বুর্জোয়াদের ঐকতানে সুর মেলাতেন। এই প্রথমবার বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ আদবানির পাকিস্তান-বিরোধী প্ররোচনামূলক বিবৃতির বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে লেখালেখি করেছেন। সংসদের মধ্যেও সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। ঐ সময়ে বাজপেয়ীকেও সংসদে রক্ষণাত্মক অবস্থানে দেখা যায়। এই সমস্ত কিছুই দেখিয়ে দেয় যে তারা যে ঐকমত্যের আশা করেছিল সেটি গড়ে ওঠেনি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদকেও শক্তিপীঠ বানানো, ইত্যাদি কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে হয়। কয়েকদিন পর পাকিস্তান যখন তার বোমা ফাটাল (ভারতের চেয়ে একটি বেশি) বিজেপির মতলবও চুপসে গেল। বিস্ফোরণের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকার সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বিজেপি সুপরিকল্পিতভাবে চীন-বিরোধী ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু হতাশ হয়ে তারা দেখল যে চীন ও আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কদিন আগে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে জার্মান বিদেশ মন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য দেখলাম। তিনি বলেছেন, এই দুই দেশ যারা দেশের মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারে না এবং দেশে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা আবার পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে। ওরা ভেবেছিল যে বোমা তাদের ভাবমূর্তিকে বাড়িয়ে তুলবে, কিন্তু বিপরীতটাই ঘটেছে। তারা দুনিয়ার উপহাসের পাত্র হয়েছে।

মধ্যবিত্তের উপর বিজেপির ভালো প্রভাব আছে। কিন্তু বোমার বিরুদ্ধে প্রচারে নামতে গিয়ে আমরা এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। জনগণ নিজের থেকেই এই ধরনের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি তুলছেন যে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে এইভাবে লাগাতার বিবাদ বাধিয়ে কি আমরা বাঁচতে পারব। তাঁরা অভূতপূর্ব মূল্যবৃদ্ধির জন্য বোমা বিস্ফোরণকেই দায়ী করছেন এবং বিজেপির জনপ্রিয়তার রেখাচিত্রও খুব দ্রুত নীচে নামছে। এই দিক থেকেই আমি বলেছি যে বিজেপির আশু লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গেছে।

কিন্তু পারমাণবিক পরীক্ষার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও তাৎপর্য রয়েছে যাকে তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতির সামরিকীকরণ। আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারপার্সন আর চিদাম্বরম বলেছেন যে, ভারতকে এক সামরিক-শিল্পীয় কাঠামোর বিকাশ ঘটাতে হবে। একবার এটি গড়ে তুলতে পারলে তা শুধু প্রতিরক্ষাই নয় বরং অর্থনৈতিক বিকাশেরও নতুন রণনীতি হয়ে উঠবে। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আমেরিকা ও ইজরায়েলও এ পথ গ্রহণ করতে শুরু করেছে, এটিই হবে ভারতেরও পথ। ভারতীয় শিল্প এখন মন্দার কবলে, আর তাই শিল্পপতিরা প্রতিরক্ষা শিল্পে ঢুকতে চায় এবং এইভাবে শিল্পকে চাঙ্গা করতে চায়! এটিই হচ্ছে সমগ্র পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপদজনক দিক। এর অর্থ হল বাজেটের এক বড় অর্থই সামরিকীকরণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে, ব্যক্তি পুঁজির সঙ্গে প্রতিরক্ষার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হবে এবং এরই উপজাত হিসাবে নাগরিক জীবনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক জীবনের উন্নয়ন এখন আর প্রাথমিক লক্ষ্য থাকবে না; এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে শিল্পীয়-সামরিক কাঠামো গড়ে তোলার উপর : সেনাবাহিনীর জন্য শিল্প, অস্ত্রশস্ত্রের জন্য শিল্প। সামরিক আমলা, বৈজ্ঞানিক আমলা এবং ব্যক্তিপুঁজির আঁতাত – এক নতুন শ্রেণী-আঁতাত ভারতীয় শিল্প ও অর্থনীতিকে এক সম্পূর্ণ নতুন অভিমুখে নিয়ে যেতে চাইবে।

বামপন্থীদের দায়িত্ব হল বোমার বিরোধিতা করা ছাড়াও এই শ্রেণী অন্তর্বস্তুকে উন্মোচিত করা। বোমার বিরোধিতা করার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু বোমার পিছনের এই রাজনীতি সম্পর্কে, বিজেপি সরকারের এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব কেবলমাত্র বামপন্থীদেরই। পরমাণু বোমা বিরোধী আন্দোলনকে এই ভিত্তিতেই ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

(১৫ জুন ১৯৯৮ দিল্লীতে ‘ফোরাম ফর ডেমোক্রেটিক ইনিশিয়েটিভ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণ, ভাষণটি লিবারেশন জুলাই ১৯৯৮ সংখ্যায় প্রকাশ করার জন্য বক্তার দ্বারা অল্প কিছু পরিবর্তিত হয়েছে)

আমি জানি না পোখরান বিস্ফোরণ কী মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার জন্ম দিয়েছে, কিন্তু এটি যে সমগ্র দেশজুড়ে ভালো পরিমাণে মতাদর্শগত দূষণের জন্ম দিয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্ট।

এখন বিস্ফোরণের পেছনকার কারণ সম্পর্কে অনেক মতামত আছে। প্রথমত চতুরাননজীও যার উল্লেখ করেছেন তা হল পারমাণবিক বোমার যখন বিস্ফোরণ ঘটানো হল তখন বলা হল যে গৌতম বুদ্ধ হেসেছেন। তা যদি হয় তাহলে যেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে মারার জন্য এই বোমা ব্যবহার করা হবে সেদিন সম্ভবত বুদ্ধ অট্টহাস্য করে উঠবেন। কিছু ব্যক্তি যুক্তি দেখান যে বিজেপি পরিচালিত জোটের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জয়ললিতা এই দুই মানব বোমাকে প্রশমিত করার জন্য পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। যদি বর্তমান সরকার এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন চিন্তার দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে তা দেশের পক্ষে প্রকৃতই এক বড় বিপদ। আর একটি অভিমতও আছে যে, রামমন্দির কর্মসূচি স্থগিত হওয়ায় বিজেপির বিক্ষুব্ধ ধর্মোন্মাদ কর্মীবাহিনীর কাছে এক বিকল্প কর্মসূচি হাজির করার জন্য এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। তাহলে এটি খুবই উদ্বেগের বিষয় কেননা আপনারা জানেন যে বিজেপির কর্মীবাহিনীর মগজে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা এবং যখন তারা স্লোগান তুলেছিল “গর্বভরে বলো যে আমরা হিন্দু” তখন তা বাবরি মসজিদ ধুলিসাৎ করার মধ্যে পরিণতি পায়। আর আজ বোমাকে কেন্দ্র করে যখন আর একবার শক্তিপীঠ, শৌর্ষ্য দিবস-এর মতো হিন্দু আওয়াজগুলি তোলা হচ্ছে তখন আমি জানি না যে এগুলি কিসে পরিণতি লাভ করবে।

রাম মন্দিরের স্লোগান মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ছিল আর পারমাণবিক বোমা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যে বিজেপি পার্টির কাছে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই এবং যার মূল দিশাই হল মুসলিম বিরোধিতা, তার ক্যাডার বাহিনীর কাছে পারমাণবিক বোমা হিন্দু বোমা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বোমার সাথে আসা এই সমস্ত মতাদর্শগত দূষণ দেশের আকাশকে পরিব্যাপ্ত করেছে আর তা হল পারমাণবিক বিস্ফোরণেরই ফলাফল। তথাপি দেশের মাটিতে এর আরও বেশি বিপজ্জনক ভবিষ্যৎ ফলাফলের তুলনায় আমার কাছে এটি গৌণ। প্রথমত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা, এই উগ্র জাতিদম্ভ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা আমি জানি না। প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনাকে উঁচু মাত্রায় তোলা হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধজিগির তোলা হচ্ছে এবং আমরা প্রকৃতই এক যুদ্ধ প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে চলেছি। এখন সমগ্র বিষয়টি যদি উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার দিকে পরিচালিত হয় এবং এর সাথে সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতিকে বাড়িয়ে তোলা হয় তাহলে জাতীয় রাজনীতির উপরও এর প্রতিক্রিয়া পড়বে। এটাই আমরা দেখেছি ১৯৭৪ সালে পোখরানে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার সময়কালে, যখন পরবর্তী এক বছরের মাথাতেই দেশের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমাদের মনে এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাথে সাথে গড়ে তোলা এই উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা আমাদের দেশে যেটুকু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে তাকে কতদূর পর্যন্ত সহ্য করবে? আর আমরা আবার দেখছি এই যুক্তি তোলা হচ্ছে যে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রপতি ধাঁচের শাসন। তাঁরা বলছেন যে বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্থায়িত্ব আনতে পারে না কেননা এখানে প্রায়শই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হয়, আর এটি কোনো ভালো বিষয় নয় কেননা তা বড় ধরনের জাতীয় খরচ ঘটায়। তারপর তারা একজন মহান ও সক্ষম নেতা, এক মহান ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এই সমস্ত মধ্যবিত্তসুলভ উদ্বেগ ও আকাঙ্খাকে পুঁজি করে জনগণের মনন জগৎকে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে যাতে দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শেষ করে দেওয়া যায় এবং দেশের উপর এক একনায়কত্বের ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া যায়। আমার কাছে এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ যেটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা এবং প্রতিবেশী দেশগুলির বিরুদ্ধে উত্তেজনা গড়ে তোলা ও যুদ্ধ প্রস্তুতির পিছনে ওৎ পেতে আছে।

দ্বিতীয়ত, আমি যা বলতে চাই তা হল এটি নিছক একটি বোমা পরীক্ষার ব্যাপার নয়। এই পারমাণবিক পরীক্ষার ফলশ্রুতি হিসাবে এক পারমাণবিক মজুত ভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের নামে গত ৩০ বছর ধরে একটি সমগ্র প্রকল্প চালানো হচ্ছে এবং পরের পর বাজেটগুলিতে এই খাতে বিপুল পরিমাণে অর্থ বরাদ্দও করা হচ্ছে এবং এখানে ব্যয়ের হিসাব নিকাশ কখনই জনগণের গোচরে আনা হয়নি। ধাপে ধাপে একটি বিরাট আমলাতান্ত্রিক-বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের এক সমগ্র কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আর এখন সমগ্র জাতীয় অর্থনীতির সামরিকীকরণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান আর চিদাম্বরমের কিছু কথা আমি উল্লেখ করতে চাই : “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যা উন্নয়নের বাহক তা জাতীয় নিরাপত্তারও ভিত্তিস্বরূপ এবং নিশ্চিত নিরাপত্তা ছাড়া উন্নয়নও হোঁচট খাবে। ভারতবর্ষের প্রয়োজন হল এক শিল্পীয়-সামরিক কাঠামো (Complex) গড়ে তোলা যা একদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং অপরদিকে উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করতে পারে।” এখন এটি হল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকল্প, উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত বীক্ষা, গত ৫০ বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে যে বীক্ষাকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে সেখান থেকে মূলগতভাবেই সরে আসা। এই নতুন বীক্ষায় বলা হচ্ছে যে অস্ত্র কারখানা, পারমাণবিক শক্তি, বোমা বিস্ফোরণ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে যে পরিমাণে শিল্পীয়-সামরিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা যাবে সে পরিমাণে উন্নয়নের দরজাও খুলে যাবে। আমার কাছে এ এক ভয়ঙ্কর বিপদজনক প্রকল্প। এখন এটিকে নিছক একটি বা দুটি বোমা পরীক্ষার ব্যাপার হিসাবে বা আমাদের উন্নয়নের রণনীতি থেকে আলাদাভাবে বেশ কিছু বোমা ও মিসাইল তৈরি করে অস্ত্র সজ্জিত হওয়ার ব্যাপার হিসাবে দেখা হচ্ছে না। এমনকি আমাদের উন্নয়নের মডেলের একটি অংশ হিসাবেও এটি দেখা হচ্ছে না, বরং এটিকে দেখা হচ্ছে আমাদের সমগ্র উন্নয়নের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হিসাবে। এখন থেকে উন্নয়নের সমগ্র রণনীতি শিল্পীয়-সামরিক কাঠামোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। এটিই হল উন্নয়নের জন্য চিদাম্বরমের প্রকল্প।

এ হল চরম দুর্ভাগ্যজনক ও ধ্বংসাত্মক। যাঁর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক বোমার পরিকল্পনা নেওয়া হয় সেই এলবার্ট আইনস্টাইন সহ বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপক ধ্বংসক্ষম অস্ত্রের প্রতি বিরূপ ছিলেন। এমনকি পারমাণবিক বোমার জনক হিসাবে যিনি পরিচিত সেই ওপেনহাইমার পর্যন্ত হাইড্রোজেন বোমাকে বলেছিলেন অভূতপূর্ব ধ্বংসক্ষম অস্ত্র এবং তিনি এই বোমা তৈরির বিরোধিতা করেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫৩ সালে আমেরিকার পারমাণবিক দপ্তর তাঁকে নিরাপত্তার প্রতি ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু এখানে ভারতে ও পাকিস্তানেও বিজ্ঞানী-আমলারা প্রেস কনফারেন্সে বসে বিজয় চিহ্ন নিয়ে ঝলকে উঠছেন এবং নির্দেশ পেলে তারা যে আরও ধ্বংসক্ষম বোমা তৈরি করতে পারেন তার প্রস্তুতির কথা গর্বভরে ঘোষণা করছেন। আমি মনে করি এটি বিজ্ঞানের যে সমগ্র আত্মা, জ্ঞানের যে আত্মা তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আমি খুবই দুঃখিত যে প্রতিটি রাজনৈতিক পার্টি এই বিজ্ঞানীদের তাদের তথাকথিত মহান সাফল্যের জন্য প্রশংসায় ব্যস্ত। অবশ্য যতদূর জানি যে বহু বিজ্ঞানীও আছেন যারা এই কাজের বিরোধিতা করেছেন।

সুতরাং বোমা বিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত বিরাট বিপদকে আমি নির্দিষ্ট করতে চাই – উগ্র জাতিদম্ভী উন্মাদনাকে সুসংবদ্ধভাবে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে দেশের মধ্যেকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিপদ এবং শিল্পীয়-সামরিক কাঠামো গড়ে তোলার মতবাদের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সামরিকীকরণের বিপদ।

এর সাথে সম্পর্কযুক্ত আর একটি প্রশ্নও উঠে এসেছে এবং তা হল ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলির দমনমূলক কৌশলের প্রতি আমাদের মনোভাব কী হবে! পাঁচটি বৃহৎ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলির পক্ষ থেকে সিটিবিটি-তে সই করানোর জন্য ভারত ও পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা কতটা যুক্তিসঙ্গত বা আইনসম্মত, যখন খোদ আমেরিকান কংগ্রেসই এখনও এই চুক্তি অনুমোদন করেনি? আমেরিকান কংগ্রেসের দ্বারা এই চুক্তি অনুমোদিত হওয়ার সম্ভাবনা কেবলমাত্র ২০০০ সালে। এই দেশগুলি নিজেরাই ব্যাপক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে এবং শত শত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারা এমন একটা স্তরে পৌঁছে গেছে যে কেবলমাত্র কম্পিউটার সিমুলেশন-এর মাধ্যমে তারা আরও পরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারে। তারপর সিটিবিটি-তে এমন ব্যবস্থাপনাও আছে যে এই দেশগুলি তাদের সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে দরকার হলে পরীক্ষা চালাতে পারবে। যখন এই দেশগুলি সিটিবিটি-তে সই করার জন্য আমাদের উপর ও পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন তা নিছক ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি মনে করি শান্তি আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই পাঁচটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে এটিও মনে হচ্ছে যে এই পরীক্ষাগুলি পুরোনো চুক্তিগুলি সম্পর্কে সারা বিশ্বে এক নতুন বিতর্কের সূচনা ঘটিয়েছে। নতুন নতুন উদ্যোগের দরজা খুলে গেছে, জনগণ এই দেশগুলির কাছ থেকে জানতে চাইছেন যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য তাদের কী কর্মসূচি আছে। এই উদ্যোগের সাথে আমাদের মতে আমাদের দেশের শান্তি আন্দোলনের যুক্ত হওয়া উচিত।

কখনও কখনও এটি দেখা যায় যে যখন বিষয়গুলি চরমে পৌঁছায় তখন তারা বিপরীতে ঘুরতে শুরু করে। যদিও ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের বিরুদ্ধে বোমা তৈরি করেছে ও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, এখন এক সমতা অর্জন হয়েছে এবং উভয়েই এখন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হয়েছে, উভয়েই বৃহৎ শক্তিগুলির কাছ থেকে চাপের সম্মুখীন এবং সম্ভবত এখন এক ঐতিহাসিক সুযোগ হাজির হয়েছে যেখানে ভারত ও পাকিস্তান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর আলোচনার জন্য প্রস্তাব বিনিময় হচ্ছে এবং আমি আশা করি নতুন করে আলোচনা শুরু হবে এবং তাদের নিজস্ব পরিচিতি অক্ষুণ্ণ রেখেই দুটি দেশ বৃহৎ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে যৌথ অবস্থান প্রণয়ন করবে। যদি তা ঘটে তবে তা হবে নিশ্চিত এক শুভ সূচনা। এই ধরনের বিকাশের জন্য শর্তগুলি সত্যিই পরিপক্ক হতে শুরু করেছে। অবশ্য যতদিন বিজেপির মতো শক্তি দিল্লীতে শাসন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন এই প্রক্রিয়া গতি পাবে না। শর্তগুলি বিদ্যমান, কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের এই সরকারগুলি এগুলি উপলব্ধি করতে সক্ষম নাও হতে পারে। বিশেষ করে আমি নয়া দিল্লীর বিজেপি সরকারের কথাই বলছি কেননা তার সমগ্র কর্মসূচিই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার স্বার্থ এই সরকারকে হঠানোর কর্মসূচির সাথে আবশ্যিকভাবে যুক্ত। এই সেমিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টি ও বিভিন্ন মতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত আছেন। আমি আশা করি দেশের সামরিকীকরণ ও আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিপদের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে সক্ষম হবো।

(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৮ থেকে)

যুক্তফ্রন্টের পতন ও বিজেপির উত্থান

বেনারস কংগ্রেস কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপির উত্থানের বিপদকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই তুলে ধরেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “গৈরিক শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার বিপদকে আমরা স্বীকার করি। যুক্তফ্রন্টের পতন ঐ পরিণামের অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। নিজের দিক থেকে বিজেপির যদিও সমস্যা রয়েছে – যেমন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দেশের বিভিন্ন অংশে তার বিস্তৃতির সীমাবদ্ধতা, তবুও এই বিপদের যথেষ্ট বাস্তব ভিত্তি রয়েছে এবং আমাদের এটি খাটো করে দেখা উচিত নয়। আর তা যদি সত্যিই ঘটে, তবে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে কর্মনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে।”

একথা আমরা বলেছিলাম ১৯৯৭-এর অক্টোবরে, যখন কংগ্রেসের সমর্থনের আশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার সাবলীলভাবেই চলছিল। পাঁচ মাসেরও কম সময়ে আমাদের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। রিপোর্ট অবশ্যই দেশের বিভিন্ন অংশে বিজেপির বিস্তৃতির সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছিল এবং ১৯৯৮-এর নির্বাচনী ফলাফলও দেখিয়ে দেয় যে, সংসদে তার শক্তির তেমন কোনো বৃদ্ধি ঘটেনি। এসত্ত্বেও আমরা ঐ বিপদকে যদি বাস্তব বলে মনে করে থাকি, তবে মূলত তা ছিল যুক্তফ্রন্টের সম্ভাব্য পতনের ধারণা থেকেই, যে পতন ঐ পরিণামের অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। আর ঠিক তাই ঘটেছে।

পরিহাসের বিষয় হল, পরিস্থিতির খলনায়ক হিসাবে কাজ করেছিল সে কংগ্রেস, যে দুবছরের মধ্যেই দেশকে আবার এক নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, বিজেপির এক শক্তিশালী আক্রমণের মুখে যে দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ছিল বলে মনে হচ্ছিল, সেই কংগ্রেসের কিন্তু শেষমেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। সে নিজের আসন সংখ্যা শুধু বজায় রাখতেই সক্ষম হয়নি, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে বিজেপির উপর প্রবল আঘাত হেনেছে। এই নির্দিষ্ট ঘটনা বিজেপির শাসন করার নৈতিক অধিকারে যথেষ্ট ঘা দিয়েছে।

অপরদিকে যে যুক্তফ্রন্ট এবার এক সাধারণ ইস্তাহারের ভিত্তিতে এবং এক শহীদের ভাবমূর্তিকে সম্বল করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়, আশ্চর্যজনকভাবে সেই যুক্তফ্রন্টের শক্তি কমে অর্ধেক হয়ে যায় এবং বাকি অর্ধেক অংশ চলে যায় বিজেপি শিবিরে।

যুক্তফ্রন্টের সব থেকে বড় শরিক জনতা দল কর্ণাটকে চরম পরাজয় বরণ করে এবং উড়িষ্যায় তার ব্যাপক অংশ বিজেপি-শরিক বিজেডির দিকে চলে যায়। চরম সুবিধাবাদের নিদর্শন রেখে প্রধানমন্ত্রী আকালি দলের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং আর এক মহারথী রামবিলাস পাসোয়ান সমতা পার্টির সঙ্গে এক গোপন সমঝোতায় উপনীত হন। ডিএমকে-টিএমসি জোট সর্বাপেক্ষা অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয় তামিলনাড়ুতে। এ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন বিজেপির অধরাই থেকে গেল, তখন ডিগবাজির এক বিরল নিদর্শন রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন আর কেউ নয়, যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক চন্দ্রবাবু নাইডু। ন্যাশনাল কনফারেন্স, অগপ-র মতো অন্য কয়েকটি শরিকও নির্ধারিতভাবেই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে। বিজেপির মিত্রদের প্রত্যেকেই তাদের ডিগবাজির পিছনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্দিষ্ট স্বার্থকেই (বাধ্যবাধকতা!) তুলে ধরছেন। অবশেষে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক স্বার্থই তাদের যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল আর এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঠিক ঐ বিষয়টিই তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এসব ঢাকার জন্য তাদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আমাদের সমাজগণতন্ত্রী বাক্যবাগীশরাই উদ্ভাবন করেছেন।

সমাজগণতন্ত্রী বামেদের ফলাফলও ভালো হয়নি এবং কলকাতার দেওয়ালের লিখনও যথেষ্ট অশুভ পূর্বাভাসই দিচ্ছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে, কংগ্রেসের ভাঙ্গনকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সমস্ত আসনই জিতে নেবেন। বাস্তব ঘটনা হল, তাঁরা কেবল তাঁদের আসন সংখ্যা ধরে রাখতে পেরেছেন। জয়ের ব্যবধান এবং প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারও যথেষ্ট কমে গেছে।

তাঁরা অবশ্য উটপাখির মতো, ১৯৯৬-এর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি প্রত্যাশা করেছিলেন এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য সাগ্রহে নিজেদের প্রস্তুত করছিলেন। আহত বাঙালি গরিমার পুনরুদ্ধারে জ্যোতি বসু জানিয়ে দেন যে তিনি দিল্লী যেতে প্রস্তুত। ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংশোধনের মরীয়া প্রয়াস সিপিআই(এম)-কে ‘ঐতিহাসিক বোকামির’ পাঁকে নিক্ষেপ করে। যাই হোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক। রাজনৈতিক এবং সংখ্যাগত উভয় দিক থেকেই যুক্তফ্রন্টের পতনে বিজেপিই লাভবান হয়েছে।

খুব কম রাজনৈতিক বিশ্লেষকই অবশ্য যুক্তফ্রন্টের পতন ও বিজেপির ক্ষমতায় উত্থানের মধ্যে প্রত্যক্ষ আন্তসম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। তার কারণ অবশ্য সহজেই বোধগম্য। যেহেতু বিজেপি এবং কংগ্রেসই হল দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই বিশ্লেষণগুলিও বিজেপি বনাম কংগ্রেস কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এটা অবশ্য যথেষ্ট কৌতুহলদ্দীপক যে, বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়েই স্থায়ী সরকার ও সুযোগ্য নেতৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরে। এর মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয় যে, যুক্তফ্রন্ট অস্থায়িত্ব ও অযোগ্য নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণের রায় – প্রভাবশালী শাসকবর্গ কর্তৃক নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে হিসেবের মধ্যে ধরেই বলা হচ্ছে – এবার নির্ধারিতভাবেই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে গেছে। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন এটাই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

যুক্তফ্রন্টের ভুল কোথায় হয়েছিল?

যুক্তফ্রন্টের ভুল কোথায় হয়েছিল এবং তার পতনের তাৎপর্যগুলিই বা কী? বামেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য এই প্রশ্নগুলির বিচার-বিশ্লেষণ খুবই জরুরি।

প্রথমত, যুক্তফ্রন্টকে বিজেপি-বিরোধী, কংগ্রেস-বিরোধী মঞ্চ হিসাবে – এমনকি তার লঘু রূপ বিজেপি-বিরোধী, অকংগ্রেসী মোর্চা হিসাবেও – তুলে ধরা ছিল এক সমাজগণতন্ত্রী কল্পকথা। একই ধারায় যুক্তফ্রন্টকে জনগণতান্ত্রিক মোর্চার দিকে এক ধাপ হিসাবে – যে মোর্চার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী ও সম্মুখদর্শী বুর্জোয়াদের মধ্যে ঐক্য ও সংগ্রামের প্রক্রিয়া অবশেষে সর্বহারার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় পরিণতি লাভ করবে – বর্ণনা করাও আর এক তাত্ত্বিক ভোজবাজি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাঁদের সুবিধাবাদী আঁতাতকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮-এর মধ্যে কংগ্রেসকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতার বাইরে রাখার অবস্থান থেকে সমস্ত উপায়েই কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার অবস্থানে সমাজগণতন্ত্রীদের উত্তরণ যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়।

দ্বিতীয়ত, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট প্রগতিশীল আইন তৈরির বিষয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষেতমজুর সম্পর্কিত বিল মুলতুবি রাখা হয় এবং বিহারে গণহত্যা সহ দলিতদের উপর নিপীড়ন সরকারের মধ্যে কোনো সাড়াই জাগাতে পারেনি। ‘কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’ কাশ্মীর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী সমস্যার মধ্যেই ডুবে থেকেছেন এবং নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সময় বা প্রত্যয় কোনোটিই তাঁর ছিল না। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব উচ্চবর্ণের মানুষদের তুষ্ট রাখতে দলিত আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন।

‘রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে’ নিয়ন্ত্রণ করতেও যুক্তফ্রন্ট কিছুই করেনি, যে বিষয়টি চন্দ্রশেখরের হত্যার পর এক শক্তিশালী ইস্যু হিসাবেই সামনে এসেছিল। বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি সমস্যার মীমাংসায় যুক্তফ্রন্ট কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি, আর মসজিদ ধ্বংসের জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। লালু ও মহন্তের দুর্নীতিপরায়ন রাজের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সমঝোতাই করে গেছে।

তৃতীয়ত, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সে প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বলি দিয়েছে, আর সেই কারণেই শেষের দিকে দুই ডিএমকে মন্ত্রীকে বরখাস্তের প্রশ্নে তার বীরত্ব প্রদর্শন জনগণকে কোনো অংশেই প্রভাবিত করতে পারেনি।

দেড় বছরের যুক্তফ্রন্টরাজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিদাম্বরমের ‘স্বপ্নের বাজেট’ ও ভিডিআইএস প্রকল্পের জন্য। অর্থনীতির বৃদ্ধির নির্দেশকগুলির সার্বিক অবনমনের বিচারে স্বপ্নের বাজেট অবাস্তব স্বপ্ন হয়েই থাকে, আর ভিডিআইএস প্রকল্পও ছিল কালো টাকাকে সাদা করার চরম উদারনীতিবাদী প্রস্তাব।

আপাতবিরোধী মনে হলেও, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বাগাড়ম্বরে সিদ্ধহস্ত বামেদের শক্তিশালী অংশের সমর্থনপুষ্ট হয়েও যুক্তফ্রন্ট ছিল বহুজাতিকদের প্রতি অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন। বহুজাতিকদের প্রিয়পাত্রই অর্থনৈতিক বিষয়াবলীর নেতৃত্বে থাকায় ‘জাতীয়তাবাদী’ ভিত্তিটি বিজেপির কাছে হেলায় সঁপে দেওয়া হয়। কর্পোরেট জগৎ ‘জাতীয়তাবাদী সরকার’ এবং ‘প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র’ নিয়ে শোরগোল তুলে দেয়। আর এর সঙ্গে স্বদেশীয়ানাকে যুক্ত করে বিজেপির প্রচারযন্ত্র পুরোদমে চলতে শুরু করে।

যুক্তফ্রন্টের একমাত্র শক্তিশালী দিক ও তার মৌলিক পরিচিতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতির প্রতি তার দায়বদ্ধতার মধ্যে। ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা’ থেকে ‘শক্তিশালী রাজ্য ও দুর্বল কেন্দ্রের’ মতো স্লোগানগুলি উঠে আসে। ঠিকই, যুক্তফ্রন্ট জমানায় কেন্দ্র দুর্বল ও অস্থায়ী হয়েই দেখা দিয়েছিল আর ঠিক এই কারণেই তার পতন হল। তার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদানই তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়ে উঠল। এই বিষয়টি ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতীয়মান করে। যখনই কোনো শক্তিশালী কেন্দ্র স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে দেখা দেয়, তখনই শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বার্থগুলি তার বিরোধিতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। অবশ্য কেন্দ্র যখন আবার দুর্বল ও অস্থায়ী হয়ে দেখা দেয়, তখন আবার এক শক্তিশালী কেন্দ্রের জন্য আকাঙ্খা জোরালো হয়ে ওঠে। শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলির স্বার্থ ও এক ঐক্যবদ্ধ জাতীয় অর্থনীতির আবশ্যকতার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের গতিশীলতাকে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। চন্দ্রবাবু নাইডু ছিলেন দুর্বল কেন্দ্রের প্রবক্তা যা তাঁকে যুক্তিযুক্তভাবেই যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক করে তোলে, সেই চন্দ্রবাবু নাইডুই আবার বিজেপি সরকার পরিচালিত এক শক্তিশালী কেন্দ্রকে স্থায়ী করার ব্যাপারে মূল কারণ হয়ে উঠলেন।

রাজনৈতিক যুক্তিধারা যুক্তফ্রন্টের বিপক্ষে যাওয়ায় কোনো না কোনোভাবে তার পতন হতই। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয় হল, সে এমন কোনো চিহ্নই রেখে যায়নি যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ঘটানো যেতে পারে।

সমাজগণতান্ত্রিক বামেরা ‘ঐতিহাসিক ভুল ও বোকামী’র মধ্যে আন্দোলিত হয়েছে, কিন্তু তার সামনে যে ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ এসেছিল তাকে কাজে লাগানোর পরিপ্রেক্ষিত থেকে সে কখনোই চিন্তা করতে পারেনি। তার তাত্ত্বিকদের উদ্বেগ সীমাবদ্ধ ছিল সমস্ত ধরনের ‘দালাল’, ‘সমঝোতা’ ও ‘পর্দার আড়ালে বোঝাবুঝির’ মাধ্যমে সরকারের স্থায়িত্বকে দীর্ঘায়িত করার মধ্যে। সুরজিৎ এই অখ্যাত মন্তব্য করেন যে, যুক্তফ্রন্ট সরকার যাতে বিপাকে না পড়ে তার জন্য বামেরা তাদের কোনো কর্মসূচি নিয়েই সরকারকে চাপ দেয়নি। কংগ্রেস এবং যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদের কাছ থেকেও তিনি একই আচরণ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখায়নি। কাজেই বামেদের শক্তিশালী অংশের সমর্থনপুষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার – তার একটি অংশের হাতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সত্ত্বেও – কোনো বাম ছাপই রেখে যেতে পারল না।

বিজেপি সরকার – ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের বিপদ

প্রতিটি সুবিধাবাদী অপকর্ম তার নিজস্ব মাশুল গুণে নেয়। যুক্তমোর্চার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার। অর্ধশতাব্দীর স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়েছে এমন এক পার্টি ও ব্যক্তির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের ভূমিকা খুব কম কথায় বললেও যথেষ্ট সন্দেহজনক ছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের ওপর নেমে আসা এই ট্র্যাজেডি থেকে ভুল শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সহ উদারনৈতিকদের সমগ্র গোষ্ঠী ‘কংগ্রেস নামক মহান প্রতিষ্ঠান’-এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। এ হল আত্মনেতিকরণের এক প্রক্রিয়া যা প্রগতি ও গণতন্ত্রের কংগ্রেস বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসই নাকচ করে দেয়।

বিজেপি সরকার আস্থা ভোটে জয়ী হয়েছে এবং এই সরকার তথাকথিত জাতীয় এজেন্ডার ভিত্তিতে সরকার চালানোর অঙ্গীকার করেছে। অটল বিহারী বাজপেয়ী বারবার জাতিকে আশ্বস্ত করছেন যে যতদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন ততদিন তাঁর সরকার কোনো গোপন এজেন্ডা অনুসরণ করবে না। বিরোধীপক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়া ও তাকে ভাঙ্গা এবং আরও বেশিসংখ্যক মিত্র সংগ্রহ করার জন্য এ হল এক চতুর কৌশল।

কিছু সমাজবাদী ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ইতিমধ্যেই যুক্তি দেখাতে শুর করেছেন যে বিজেপির ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সাথে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে সমার্থক মনে করা উচিত হবে না। কেউ কেউ এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে চিরায়ত বোধ থেকে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে যেরকম উপলব্ধি রয়েছে, ভারতে তা অনুপস্থিত।

সঠিক অর্থনৈতিক অর্থে এটা ঠিকই যে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী, যে নিজেই চরিত্রগতভাবে নির্ভরশীল, বিশ্ব বাজার দখল করা ও উপনিবেশ স্থাপন করার হিটলারীয় এজেন্ডা অনুসরণ করতে পারে না। কিন্তু কেউ কী ঠিক এ ধরনের কথা বলতে চাইছেন! বেনারস কংগ্রেসের রিপোর্টে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে : “বিজেপির কর্মসূচিতে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের বিশেষত পাকিস্তানের ব্যাপারে উগ্র স্বাদেশিকতার নীতি অনুসরণ করা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তোলা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে রূপান্তরিত হবেন এমন এক হিন্দুরাষ্ট্রে ভারতকে রূপান্তরিত করা, যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করা, বর্বরোচিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো, গ্রামীণ দরিদ্রদের কৃষি-আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী সংগঠিত করা, চলমান জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনগুলিকে সামরিকভাবে দমন করা, বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে সব ধরনের ভিন্নমতকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এককথায়, ভারতের ওপর এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া।”

এই একনায়কতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ মাত্রা তথা আঞ্চলিক বৃহৎশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য তার পরিকল্পনা সাধারণের কাছে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র বলে যা পরিচিত তার সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।

একথা ভুললে চলবে না যে বিজেপি অবশ্যই এক ভিন্নতর পার্টি। অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টিগুলি যেখানে নিজেরাই এক স্বতন্ত্র সত্তা সেখানে বিজেপি আরএসএস-এর সংবিধান বহির্ভূত কর্তৃত্বের সাপেক্ষে এক স্বায়ত্ত অবস্থান ভোগ করে মাত্র। এজেন্ডাটি সঠিক অর্থে আরএসএস-এরই এবং তার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে বিজেপি অবশ্যম্ভাবীভাবে এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে। তাছাড়া নিজস্ব এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরএসএস-এর এক ব্যাপক ধরনের ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য বহু সংগঠন রয়েছে।

বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মহাজোটের লক্ষ্যে

ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রগতিকে বিজেপির তথাকথিত নরমপন্থী নেতৃত্ব বা বিজেপির সহযোগী দলগুলির তথাকথিত নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাবের দ্বারা রোধ করা যাবে না। যুক্তমোর্চার সম্প্রসারণের নামে সবধরনের নিন্দিত শক্তির এক পাঁচমিশেলি জোট গঠন করা এবং কংগ্রেসের পিছনে সমাবেশিত হওয়া গৈরিক বিপদের কোনো প্রত্যুত্তর নয়।

বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মধ্যে এক ব্যাপকতর বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করি না এবং বেনারস কংগ্রেসে নির্দিষ্টভাবে ‘নীতিসমূহের কিছু কিছু পুনর্বিন্যাসের’ কথা বলা হয়েছে। নীতিসমূহের পুনর্বিন্যাসের অর্থ অবশ্যই হবে বিরোধীপক্ষের সরকারগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তাদের ব্ল্যাকমেল করা অথবা বরখাস্ত করার বিজেপি সরকারের অপপ্রয়াসের বিরোধিতা করা, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হাত মেলানো, বিজেপির চক্রান্তকে বানচাল করার জন্য সংসদে ও বিধানসভাগুলির অভ্যন্তরে সমন্বয় গড়ে তোলা ইত্যাদি।

কিন্তু বিহারে আরজেডি-র সাথে কিংবা পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের সাথে সরাসরি জোট গড়ে তোলা অবশ্যই এই জটিল প্রশ্নের কোনো সমাধান নয়।

কিছু কিছু রাজনৈতিক ভাষ্যকার লালু প্রসাদের বিরুদ্ধে দু্র্নীতির ইস্যুকে মাত্রাতিরিক্তভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা ও পরবর্তীকালে লালুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বামদের তিরস্কার করেছেন। সমাজগণতন্ত্রীরা এই পরামর্শ গ্রহণ করা ও লালুর পক্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য খুবই উদগ্রীব। কিন্তু এই ঘটনার ব্যাখ্যা কীভাবে পাওয়া যাবে যে ঠিক লালু আর সরকারি বামদের মধুচন্দ্রিমার পর্যায়টিতেই অন্যান্য দিক থেকে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শক্তি বিজেপি রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রস্থলে উঠে এসেছিল? কোনো উচ্চ আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়ে নয়, ১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনে শক্তিশালী বিজেপি-সমতা জোটের আক্রমণের মুখে লালুর আসনসংখ্যা কমে যাওয়া এবং বামদের গুরুতর ধাক্কাই সমাজগণতন্ত্রী শিবিরকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার পথে নিয়ে যায় এবং তারা লালুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

লালুর জমানা সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সার্বিক অপরাধীকরণের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবধরনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্য এক দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বন্ধ্যাবস্থার মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিই বিজেপি-সমতা জোটের উত্থানের উর্বর জমি হিসাবে কাজ করেছে, যা সামন্ত ও ‘উচ্চবর্ণীয় প্রত্যাঘাত’-এর জন্ম দেওয়া ছাড়াও পশ্চাদপদ ও অত্যন্ত পশ্চাদপদ জাতিগুলির একটা বড় অংশকে তাদের পক্ষে জয় করে নিয়ে এসেছে। বাস্তবে লালুর অপশাসনের বিরুদ্ধে বামদের বিরোধিতা নয়, বরং পরিকল্পিত ও ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার অভাবই বিজেপির জন্য অনেকখানি গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং বামদের প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

অনুরূপভাবে, মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী নীতি নিয়ে চলার জন্য শ্রমিকরা যখন বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবং যখন নয়া ধনী ও বহুজাতিকদের তোষণ করার জন্য শ্রমজীবী জনগণকে কলকাতার রাস্তা থেকে নির্দয়ভাবে তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস থেকে উৎখাত করা হচ্ছে তখন সেই সরকারের পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়।

বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের পার্টিগুলির সাথে রাজনৈতিক জোট ও নির্বাচনী বোঝাপড়া একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নীতিমালার মূল স্তম্ভ হতে পারে না। ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া ও তাকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য আমাদের অবশ্য গণআন্দোলনের ওপরই প্রাথমিকভাবে নির্ভর করতে হবে।

বিজেপির জাতীয় এজেন্ডার নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ছাত্র ও যুবরা। এর লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের মানসিক গঠনের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো। বেকারত্বের ভয়াবহতাকে বিজেপি তথাকথিত “জাতীয় পুনর্গঠন বাহিনী” গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করতে চাইছে, যে বাহিনী হবে খুব সম্ভবত আরএসএস শাখাগুলির সরকারি সংস্করণ মাত্র।

পার্টিকে অবশ্যই তাই সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে ছাত্র ও যুবদের সমাবেশিত করা ও কর্মসংস্থানের বড় বড় প্রতিশ্রুতির রূপায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।

মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিলের ব্যাপারে বিজেপি টালবাহানা করতে বাধ্য এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে সবধরনের সংস্কারাচ্ছন্ন এজেন্ডা অনুসরণ সে করবেই। গৈরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মহিলাদের সমাবেশিত করা পার্টির সামনে আর একটা বড় ধরনের আশু এজেন্ডা।

সমস্ত গণসংগঠনগুলিকে সক্রিয় করে তুলে তাদের স্বাধীন উদ্যোগ তথা ব্যাপক সংখ্যক বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিটি নির্দিষ্ট ফ্রন্টেই বিজেপির মোকাবিলা করতে হবে।

বিজেপি সরকারের প্রতিটি নির্দিষ্ট নীতিসংক্রান্ত ঘোষণা ও প্রতিটি নির্দিষ্ট ব্যর্থতা ও অপকর্মকে উদ্ঘাটিত করতে পার্টির প্রচারযন্ত্রকে সচল করে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকারের বা বাকস্বাধীনতার ওপর বিজেপি সরকারের প্রতিটি আক্রমণ এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করার প্রচেষ্টাকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।

পরিশেষে, বিজেপির ক্ষমতায় উত্থানের সাথে সাথে সর্বত্রই সামন্ত শক্তিগুলি আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠবে এবং তার ফলে কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের ওপর আক্রমণ ও দলিতদের ওপর নির্যাতন আরও তীব্রতর হতে বাধ্য। এইসব আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য পার্টিকে তার প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি আরও জোরদার করতে হবে।

সংক্ষেপে, দেশের বুকে এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধের জন্য সমস্ত বাম ও প্রগতিশীল শক্তির কাছে এটাই হল জাতীয় এজেন্ডা। আর জনগণের মধ্যে উন্নত চেতনা গড়ে তোলা ও ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের এক মহাজোট গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারি – যা হবে জনগণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে এক প্রকৃত উত্তরণশীল পদক্ষেপ।

(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৮ থেকে)

প্রত্যাশিত সময়কালের আগেই যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে প্রথম পর্বের সহযোগিতার আকস্মিক ইতি ঘটেছে। রাষ্ট্রপতি উত্তেজনা প্রশমনের সময় দিলেও যুক্তফ্রন্ট-কংগ্রেস যেমন সে পথে যেতে পারেনি, তেমনি আবার টিকতে পারে এমন অন্য কোনো শাসনব্যবস্থাও সামনে আসতে পারেনি। ফলে দুবছরের মধ্যেই দেশকে আবার এক সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

কংগ্রেসের ব্ল্যাকমেলের কাছে নতিস্বীকার করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করার জন্য যুক্তফ্রন্টকে অভিনন্দন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সাহসিক কাজই যুক্তফ্রন্টের শেষ ঐক্যবদ্ধ কাজ হয়ে দেখা দিতে পারে। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে কিছু অংশ আগে থেকেই কংগ্রেসী লাইন অনুসরণে আগ্রহী ছিল, আর নির্বাচন এসে পড়ায় তারা কিছু রাজ্যে বিশেষ পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে খোলাখুলি বা গোপন সমঝোতার পরিকল্পনা করছে। একই বিচার-বিবেচনা থেকে উড়িষ্যার জনতা দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিজেপিকে বরণ করে নিয়েছে। যিনি মন্ত্রীসভা থেকে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মন্ত্রীদের বহিষ্কারের যুক্তফ্রন্টের নির্দেশকে মানতে অস্বীকার করেছিলেন, সেই যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী গুজরালও লোকসভায় প্রবেশের জন্য আকালি দলের আশীর্বাদ প্রার্থনা করছেন। এছাড়াও, অত্যন্ত সুসময়ে জেল থেকে মুক্তির পর লালু যাদবও সাধারণভাবে যুক্তফ্রন্টের কাছে এবং বিশেষভাবে জনতা দলের কাছে অত্যন্ত মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

তাদের এক সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচি ও সাধারণ আবেদন থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্ববিহীন ও দিশাহীন যুক্তফ্রন্ট বিভাজিত শক্তি হিসাবেই দেখা দিচ্ছে। কাজেই, নির্বাচনে এক সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক জোট হিসাবে সাধারণ মানুষের মনে আলোড়ন তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জৈন কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেও, ঐ রিপোর্টের একমাত্র তাৎপর্য হল কংগ্রেস নামক পরিবারটিকে তুলে ধরা এবং তাকে কেন্দ্র করে পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং এইভাবে যুক্তফ্রন্ট থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতাকে যৌক্তিক করে তোলা।

আমাদের পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস যেমন উল্লেখ করেছে, “... একটা জোট যাতে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয় বড় জাতীয় দলই নেই, সংসদে যাদের মিলিত আসন সংখ্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, এমন জোট নিয়ম না হয়ে কেবল ব্যতিক্রমই হতে পারে। শীঘ্রই হোক বা দেরীতে, এই দুই বড় দলের যে কোনো একটি সরকার চালাবার জন্য তাদের পিছনে যথেষ্ট সমর্থন সমাবেশিত করবে।”

যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেস উভয়েরই মিলিতভাবে শাসক ও বিরোধীপক্ষ হিসাবে কাজ করার ভি পি সিং-এর সূত্রায়ন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, “এই যুক্তির মূলগত অসঙ্গতি হল এই যে, তা সংঘাতের লাগাতার প্রক্রিয়া এবং তার ফলে ব্যাপক বিজেপি-বিরোধী পক্ষ গঠনকারী বিভিন্ন দলগুলির মধ্যে শক্তির আপেক্ষিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে। এবং তা ধরে নেয় যে কেন্দ্রে কংগ্রেসের জন্য স্থায়ীভাবে এক গৌণ ভূমিকাই নির্দিষ্ট। কংগ্রেস এখনও প্রধান জাতীয় দলগুলির অন্যতম এবং সে তার বর্তমান অদৃষ্ট নিয়ে কখনই সন্তুষ্ট থাকবে না। সিপিআই(এম) এবং বিজেপি উভয়ের প্রতি বিরোধিতার কর্মসূচিকে সুস্পষ্ট করার মাধ্যমে তার পরিকল্পনা হল মধ্যপন্থী শিবিরে তার প্রভাব খাটিয়ে যুক্তফ্রন্টকেই বানচাল করে দেওয়া।”

রিপোর্টে আরও মন্তব্য করা হয়েছে, “বর্তমানে যুক্তফ্রন্ট সরকার কোনোরকম পরিকল্পনামাফিক পরিচালনার বদলে তালেগোলে চলছে এবং কংগ্রেস ক্ষমতায় আরোহণের জন্য পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।”

এই কংগ্রেসী কৌশল, যা আপাতভাবে ১৯৭৯-এ চরণ সিং সরকার এবং ১৯৯০-এ চন্দ্রশেখর সরকারের সাপেক্ষে প্রয়োগ করা কৌশলের অভিন্ন রূপ, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ফলাফল দিতে পারে। এটা কংগ্রেসের পতনের পর্যায় এবং কংগ্রেস খুব বেশি হলে মধ্যপন্থী শিবিরের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রাখতে পারে যেখানে সে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এই লক্ষ্য অর্জনে কংগ্রেস বিভিন্ন কৌশলের খেলা খেলবে।

পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, “সে (কংগ্রেস) যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য মিত্র যোগাড় করতে চায়। বাম, মধ্যপন্থী ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলির তথাকথিত তৃতীয় শিবিরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ও ভাঙ্গন ধরানো এবং এক কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর মতো যথেষ্ট কূটকৌশলের ক্ষমতা এখনও তার রয়েছে।”

রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, “ইতিমধ্যেই কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সাথে এক সমঝোতা গড়ে তুলেছে, মুলায়মের সাথে সম্পর্কের বিকাশ ঘটাচ্ছে এবং টিএমসি ও ডিএমকে-কে তার দিকে আনার জন্য একনিষ্ঠভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট প্রথমদিকে যে প্রচার চালিয়েছিল, কংগ্রেস যুক্তফ্রন্টকে সেই সমালোচনার সুর নরম করতে বাধ্য করে এবং এইভাবে সে আশা করে যে তার ভাবমূর্তিকে পুনরায় উজ্জ্বল করে তুলতে পারবে, তার দিক থেকে সরে যাওয়া মুসলিমদের পুনরায় জয় করে নিতে পারবে এবং আগামী নির্বাচনে এক বিজেপি-বিরোধী মোর্চার নেতৃত্বে উঠে আসতে পারবে।”

বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়েরই ওজনদার রাজনৈতিক বিকল্প হিসাবে, জোটবদ্ধতার মডেল হিসাবে, ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় মোর্চা হিসাবে এবং এমনকি জনগণতান্ত্রিক মোর্চার অগ্রদূত হিসাবে যুক্তফ্রন্টকে ব্যাখ্যা করার সমগ্র প্রয়াসটি স্পষ্টতই ছিল ভিত্তিহীন। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের বিকল্প অদ্ভুতভাবে কিন্তু প্রকৃত অর্থেই যুক্তফ্রন্ট-কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার রূপে আবির্ভূত হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়ে বিজেপি ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। ঐ রাজনৈতিক যুক্তি তো এখনও খাটে। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচন যুক্তফ্রন্ট-কংগ্রেসের মধ্যকার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রূপকার হয়ে দেখা দেবে। এই প্রক্রিয়ায় উভয় সংগঠনই অবশ্যম্ভাবীভাবেই দলত্যাগ, ভাঙ্গন ও নতুন সামাজিক সমীকরণের রূপে গুরুতর অভ্যন্তরীণ আলোড়নের মধ্য দিয়ে যাবে, কিন্তু তা যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে মাত্র।

বর্তমান টালমাটাল অবস্থা থেকে অবশ্য সব থেকে বেশি লাভবান হচ্ছে বিজেপি। তার ওপর থেকে ‘অস্পৃশ্যতার’ ছাপ মুছে ফেলতে সে সক্ষম হয়েছে এবং নতুন নতুন মিত্রকে তার দিকে সামিল করছে। এই প্রক্রিয়ায় অবশ্য ‘মূল্যবোধের রাজনীতির’ মতো অতিরঞ্জিত দাবিকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। কংগ্রেসী উত্তরাধিকারকে কব্জা করার লক্ষ্যে সে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতির শিরোমণিদের পোষণ করার কুখ্যাত কংগ্রেসী সংস্কৃতিকেও আত্মসাৎ করছে।

শিল্প ও বাণিজ্য মহলের পছন্দের তালিকায় সেই এখন এক নম্বর এবং বেনারস কংগ্রেসের রিপোর্টে যেমন দেখানো হয়েছে, “আগামী নির্বাচনের আগে না হলেও, ঐ নির্বাচনের পরে শাসন ক্ষমতায় বিজেপির আরোহণকে স্বাগত জানাতে ভারতীয় শাসক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি প্রস্তুত।”

বিজেপি জানে যে এর চেয়ে ভালো সুযোগ সে আর পাবে না, আর তাই ‘হয় এখন, নতুবা কখনও নয়’ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সে মরিয়া গতিতে দিল্লী দখলে উদ্যত হয়েছে। বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং স্থায়িত্বের প্রতি প্রবল ঝোঁক এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজেপি কর্তৃক উত্তরপ্রদেশের দুর্গ দখল এবং রণবীর সেনার মতো দুর্বৃত্ত চক্রকে মদত দিয়ে বিহারে সুবিধাজনক অবস্থায় চলে আসা – এ সমস্ত কিছুই বিজেপি-বিপদকে সমাসন্ন করে তুলেছে এবং বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলি কেবলমাত্র নিজেদের বিপদগ্রস্ত করে তোলার ঝুঁকির বিনিময়েই এই বিপদকে উপেক্ষা করতে পারে।

বেনারস কংগ্রেস বলছে, “গৈরিক শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার বিপদকে আমরা অবশ্যই স্বীকার করি। যুক্তফ্রন্টের ব্যর্থতা ঐ পরিণতির অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। নিজের দিক থেকে বিজেপির যদিও নিজস্ব সমস্যা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অংশে তার বিস্তৃতির সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও এই বিপদের যথেষ্ট বাস্তব ভিত্তি রয়েছে এবং আমাদের একে খাটো করে দেখা উচিত নয়। আর তা যদি সত্যিই ঘটে, তবে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে কর্মনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে”।

১৯৯৫-এর বিহার বিধানসভা নির্বাচনের সময় সমতা পার্টির সঙ্গে সাময়িক আঁতাতের বিষয়টি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে পার্টি কংগ্রেস রিপোর্ট দেখিয়েছে, “ব্যবহারিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্বল করার লক্ষ্যে পরিচালিত কৌশলগত আঁতাত প্রায়শই খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়ে দেখা দিতে পারে। এই বিষয়টিকে যদি খেয়াল না করা হয়, তবে পার্টির রাজনৈতিক কলাকৌশলের এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কৌশলগত ক্ষেত্রে নমনীয়তা গ্রহণের সামর্থ্য যথেষ্ট খর্ব হয়ে পড়বে”।

এই বিষয়টি আসন্ন নির্বাচনে সাধারণভাবে বামেদের এবং বিশেষভাবে আমাদের পার্টির কৌশলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করাচ্ছে।

প্রথমত, স্থায়িত্বের তথাকথিত স্লোগানটি একটি ধাপ্পা এবং তা স্থিতাবস্থার শক্তিগুলির জন্যই নির্দিষ্ট। ইন্দিরা গান্ধীর স্থায়িত্ব অত্যধিক কেন্দ্রিকতা ও জরুরি অবস্থায় পরিণতি লাভ করেছিল। নরসিমা রাও-এর স্থায়িত্ব ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিপরায়ন শাসক জমানার জন্ম দিয়েছে। আর বিজেপির স্থায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে ধ্বংস করে কেবলমাত্র রামমন্দিরকেই বাস্তবায়িত করবে এবং রণবীর সেনার মতো দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীকে সাহস যোগাবে। যুক্তফ্রন্ট-কংগ্রেস ধরনের সহযোগিতার ভিত্তিতে ঢিলেঢালা ও অস্থায়ী প্রকৃতির সরকারই ভারতবর্ষে বাম আন্দোলনের অগ্রগতির পক্ষে সর্বাপেক্ষা অনুকূল। এখানে যুক্তফ্রন্টকে ব্যাপকতর সাধারণ প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল সমস্ত ধরনের মধ্যপন্থী শক্তিগুলি, এমনকি সেই শক্তিগুলিও যেগুলিকে লালু যাদব তাঁর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টে সমবেত করেছেন।

দ্বিতীয়ত, এটি সঙ্গতভাবেই বামেদের এক স্বাধীন স্বতন্ত্র সংহতি দাবি করে যা জনগণের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে যতটা সম্ভব সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ঐ সরকারের ওপর চাপ বজায় রাখতে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থায় নিজেদের পেতে পারে। বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণের জন্য লালায়িত হওয়া এবং জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তি বিশেষের জন্য – যে জ্যোতি বসু বুর্জোয়া জগতের কাছে বেঠিক পার্টিতে সঠিক লোক – প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রার্থনা করার পরিবর্তে বামেদের উচিত কেন্দ্রে এক গণতান্ত্রিক বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা।

সরকারি বাম নেতৃত্বের ভাবনা কিন্তু অন্যরকম। এ বি বর্ধন বারবারই এই বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছেন যে, জ্যোতি বসু অনেক ভালো প্রধানমন্ত্রী হতেন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীনে যুক্তফ্রন্ট-কংগ্রেস সহযোগিতা মুখ থুবড়ে পড়তো না। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হত, তা ঈশ্বরই জানেন! এই সেদিন সুরজিৎ কংগ্রেসকে তার চাপ প্রয়োগের কৌশলের জন্য ভর্ৎসনা করতে গিয়ে এই বলে নিজেদের বাহবা দিয়েছেন যে, অনেক বিষয়েই বামেদের আপত্তি থাকলেও, তারা কিন্তু কোনো বিষয়েই চাপাচাপি করেনি। কী নির্লজ্জ দাবি! চিদাম্বরমের ‘স্বপ্নের বাজেট’ হোক, কৃষি শ্রমিক বিল ও নারী সংরক্ষণ বিল নিয়ে গড়িমসি করাই হোক, বামেরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেনি। বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণের গণতান্ত্রিক সমাবেশ ঘটানোর পরিবর্তে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব পুরোপুরি ‘সংখ্যাগত খেলা’ ও ‘কংগ্রেসকে প্রশমিত করার’ মধ্যেই ডুবে থেকেছে। বিজেপিকে বাধাহীনভাবে অনায়াসে জায়গা করে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের ভূমিকার জন্য সমাজগণতন্ত্রীদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে যখন প্রতিটি রাজনৈতিক কার্যকলাপই তাৎপর্যপূর্ণ, তখন তারা বিহার বিধান পরিষদের নির্বাচনে রাবড়ি দেবীর বিরুদ্ধে এক সাধারণ প্রার্থী খাড়া করে বিজেপির সঙ্গেই ভোট দিতে দ্বিধা করেনি – এবং তা করেছে ১৭ পার্টি জোটের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অবমাননা করেই।

সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ভবিষ্যতে সরকারে অংশগ্রহণের জন্য পার্টিকে প্রস্তুত করছে আর জ্যোতি বসু তল্পিতল্পা নিয়ে দিল্লী যাওয়ার জন্য আবারও পা বাড়িয়ে আছেন। কাজেই বামেদের কৌশল সম্পর্কিত বিতর্কটিকে তীব্রতর করে তুলতে হবে এবং এই ব্যাপারে আমরা সিপিআই(এম) নেতৃত্বের একটি অংশের সমর্থন প্রত্যাশা করতে পারি।

আগামী নির্বাচনে আমাদের সমগ্র শক্তিকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং সারা ভারতব্যাপী এক স্বাধীন নির্বাচনী প্রচারাভিযান পরিচালনা করে জনগণের ব্যাপক অংশের কাছে পৌঁছাতে হবে। আমাদের পরিচিতির প্রতীক স্বরূপ আন্দোলনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতেই আমাদের অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এরপর, বিহার এবং আসামের মতো রাজ্যগুলিতে আমাদের জোটের শরিকদের সঙ্গে যতদূর সম্ভব এক রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও আসন ভাগাভাগিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে এবং সবশেষে, ব্যাপক সংখ্যক আসনে যেখানে আমরা বা আমাদের কোনো জোট শরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না, বা যেখানে আমাদের কোনো জোট-শরিক বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাত করেছে, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনকে সমর্থন করব এবং যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে একমাত্র ওজনদার প্রতিদ্বন্দ্বী হল কংগ্রেস প্রার্থী, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা ভোটদানে বিরত থাকব।

ধর্মনিরেক্ষতা, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার পক্ষে এগিয়ে আসুন!
বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণের বিপক্ষে – এক বাম বিরোধীপক্ষের সপক্ষে এগিয়ে আসুন!
গৈরিক বিপদের বিরুদ্ধে সমগ্র শক্তিকে সংহত করুন – নির্বাচনের লক্ষ্যে সমগ্র শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করুন!

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

কংগ্রেসের পতন

১৯৯৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে, ভারতীয় শাসক শ্রেণীগুলির প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস(ই) ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়। সংসদে এর আসনসংখ্যা কমে গিয়ে নীচে নামার রেকর্ড করে। পরবর্তীকালে এর বেশিরভাগ মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও একটার পর একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কারণে চার্জশীট পায়। যে সরকার উদারীকরণের নয়া আর্থিক নীতি প্রবর্তন করেছিল, দেখা গেল তাঁরা দুর্নীতিতেই সবচেয়ে বেশি উদার এবং এ পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত কেন্দ্রীয় সরকার বলে উদ্ঘাটিত হয়েছেন।

এই পার্টিটা পুরোপুরি বে-ইজ্জত হয়ে গেছে। বিশেষ করে সবচেয়ে জনবহুল হিন্দিভাষী দুটি রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে এর প্রান্তিক হয়ে পড়া এর পুনরুজ্জীবনের যে কোনো আশু সম্ভাবনার উপর গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর আছে উপদলীয় সংঘাত ও গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষের ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি। নেতৃত্বকে বদলে দিয়ে ও নেহরু বংশকে আহ্বান জানিয়ে এই পার্টি নিজের ভাবমূর্তিকে নতুন করে সাজাবার কঠোর চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত জনতার কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করার কোনো লক্ষণ নেই।

যদিও রাজনৈতিক প্রভাব ও সাংগঠনিক কাঠামোর বিচারে এটিই একমাত্র পার্টি যার সর্বভারতীয় উপস্থিতি রয়েছে, তথাপি এই পার্টি নিজে নিজে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করার ধারেকাছেও আছে বলে মনে হয় না।

এই অর্থে পরিস্থিতি ১৯৭৭ থেকে এমনকি ১৯৮৯ থেকেও রীতিমতো ভিন্ন। অতএব যুক্তফ্রন্ট সরকারকে যে সমর্থন এই পার্টি দিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদী, রণনৈতিক প্রকৃতির। যুক্তফ্রন্টে যে দ্বন্দ্বগুলি দেখা দেয়, এই পার্টি সেগুলি কাজে লাগাতে চায় এবং মধ্যপন্থী ও আঞ্চলিক শিবির থেকে সহযোগী পেতে চায়, যাতে পরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহ করা যায়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য ও বাম, মধ্যপন্থী ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলির তথাকথিত তৃতীয় শিবিরে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের রূপে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা এখনো এই পার্টি রাখে।

বিজেপির অমঙ্গল সংকেত

গত নির্বাচনে বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করে। তথাপি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে কম থাকে এবং তাদের সেরা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা তারা জোগাড় করতে পারেনি। তবে সহযোগীর খোঁজ পেতে সফল হয়েছে – শিবসেনা ছাড়া, বিএসপি, সমতা, আকালি এবং হরিয়ানা বিকাশ পার্টিতে। কিছু আঞ্চলিক শক্তিকে জয় করে নেওয়ার জন্য এই পার্টি বেপরোয়া চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে পাল্লা তার দিকে ঝুঁকে যায় আর অটল বিহারী বাজপেয়ী এক জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কথাও বলে চলেছেন। চলার পথে একসময় এই পার্টি বুঝতে পেরেছে যে সে তার চরমে পৌঁছেছে এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বাইরে বিস্তারে আর সমর্থ হয়নি। তারপরে তার ভাগের বাগেলা ও খুরানারাও আছে।

তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা, যা বাবরি মসজিদ ঘটনার পর মার খেয়েছিল, তাকে বাড়ানোর জন্য এই পার্টি দুমুখো রণনীতি গ্রহণ করেছে। প্রথমে এই পার্টি কঠোরভাবে চেষ্টা করছে যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকারকে আত্মসাৎ করতে পারে এবং সেজন্য এই পার্টি নিজেকে কংগ্রেসের গান্ধী-প্যাটেল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে তুলে ধরতে চায়। এই পার্টি আশা করে, এর ফলে তার পক্ষে কংগ্রেস ঘাঁটিতে আরও ঢুঁ মারতে সুবিধা হবে। দ্বিতীয়ত, এই পার্টি কঠোর চেষ্টা চালাচ্ছে তার বানিয়া-উচ্চবর্ণের ভাবমূর্তিটি পরিত্যাগ করতে এবং দলিত ও পশ্চাদপদদের এবং সেই সাথে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেও, যারা পূর্বে উত্তর ভারতে চরণ সিং-এর ভিত গঠন করত, তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে। তার জন্য এই পার্টি সমতা এবং বিএসপি-র সাথে রণনৈতিক অংশীদারিত্বের ওকালতি করে ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে আসা রাজ্য স্তরের নেতাদের তুলে ধরতে চায়।

স্বদেশীর স্লোগান উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে এই পার্টি ভারতের শিল্পপতিদের কাছে বহুজাতিকদের সাথে আরও ভালো দরকষাকষির আশ্বাস দিতে চায়। আর ‘শুচিতা’ ও ‘ভয়মুক্ত সমাজ’-এর কথা সদাসর্বদা বলে বিজেপি তার পুঁজি বুদ্ধিজীবী ও শহুরে মধ্যবিত্তি শ্রেণীর মধ্যে ভালোমতো বাড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এনরন প্রশ্নে তার পূর্বেকার ডিগবাজি যেমন গেরুয়া স্বদেশীর পালিশ তুলে নিয়েছিল, তেমনি উত্তরপ্রদেশের চলমান ঘটনাবলীও, যেখানে কল্যাণ সিং পুরো এক সারি অপরাধীদের নিয়ে নেওয়া সহ সবচেয়ে নির্লজ্জ ধরনের কেনা-বেচার পথ অবলম্বন করছেন, বিজেপির ‘একমাত্র বিশিষ্ট পার্টি’ হওয়ার দাবিকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই বিরাটভাবে চোখ খুলে দেওয়ার কাজ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর গদীতে বসতে না বসতেই, তিনি এমনকি অযোধ্যা ধ্বংসকাণ্ড মামলার একজন মূল আসামী হিসাবে চার্জশীট পাওয়া সত্ত্বেও, অযোধ্যা প্রশ্নটিকে খুঁচিয়ে তুলতে কোনো কালক্ষেপ করেননি। উত্তরপ্রদেশে আমাদের কমরেডরা তাঁর দ্বিতীয়বারের শপথগ্রহণ যখন চলছিল, তখন রাজ্য বিধানসভার বাইরে এক বহু বিজ্ঞাপিত ধর্ণা সংগঠিত করে এক সময়োচিত প্রতিবাদ-ধ্বনি তুলেছিলেন।

সংক্ষেপে, আশির দশকের শেষের দিকের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক আলোড়নের ফলশ্রুতিতে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক আসে, তা বিজেপির মধ্যে কেন্দ্রীভূত অভিব্যক্তি পায় এবং গেরুয়ার এক প্রকৃত অমঙ্গল ছায়া ভারতের উপর এই প্রথম বড় হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং-এর দ্বিতীয়বারের ক্ষমতায় আসার মধ্যে যার পূর্বাভাষ পাওয়া যায়।

এই পার্টির কর্মসূচিতে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের বিশেষত পাকিস্তানের ব্যাপারে উগ্র-জাতিদম্ভের নীতি অনুসরণ করা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উত্তপ্ত করে তোলা, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন এখন হিন্দুরাষ্ট্রে ভারতকে রূপান্তরিত করা, যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে হীনবল করা, বর্বরোচিত রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন চালানো, গ্রামীণ দরিদ্রদের কৃষি আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী সংগঠিত করা, চলমান জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনগুলিকে সামরিকভাবে দমন করা; বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে সবধরনের মতভেদকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। সংক্ষেপে, ভারতে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব চাপিয়ে দেওয়া।

এটা অবশ্যই ভুললে চলবে না যে, দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয়, কংগ্রেসের পরিপূর্ণ অধঃপতন, সামাজিক ন্যায়ের শিবিরের ভাঙ্গন, বামপন্থীদের মতাদর্শগত বাঁধুনির অবমূল্যায়ন ও বর্তমান যুক্তফ্রন্ট ব্যবস্থার ব্যর্থতা – এসব কিছু বিজেপির জন্য এক প্রশস্ত জায়গা সৃষ্টি করেছে। বাস্তবে, ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী পরবর্তী নির্বাচনের মধ্যে, এমনকি হয়তো বা তার আগেও, বিজেপির ক্ষমতায় আরোহনকে স্বাগত জানাতে পুরো তৈরি হয়ে আছে।

যুক্তফ্রন্ট পরিঘটনা

রাজনৈতিক অচল অবস্থার এক পরিস্থিতিতে ১৩ দলের যুক্তফ্রন্ট রূপ লাভ করে এবং কংগ্রেসের সমর্থনে ক্ষমতাগ্রহণ করে। তারপর থেকে প্রায় দেড় বছর এটা শীর্ষে বসে আছে। যদিও সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়, তবু হরকিষেণ সিং সুরজিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রথম পর্যায়ে মহা-প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তবে কংগ্রেস এক নতুন সভাপতির অধীনে সংহত হয় ও চমৎকার এক অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনে বাধ্য করে ও উদ্যোগ ছিনিয়ে নেয়। কংগ্রেস সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টের নেতাদের ভাষা রাতারাতি পাল্টে যায়। বর্তমানে যুক্তফ্রন্ট সরকার কোনো পরিকল্পনায় চলছে না, চলছে আর কেউ নেই বলে। কংগ্রেস নিজেকে ক্ষমতায় তুলতে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।

যুক্তফ্রন্ট পরিঘটনাকে কয়েকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেগুলির যৌক্তিকতা বিচার করা যাক।

প্রথমে, এটা বলা হয় যে যুক্তফ্রন্ট ভারতীয় রাজনীতিতে কোয়ালিশন যুগের আবির্ভাবের প্রতীক। অবশ্য, ভারতের বহুমুখী বৈচিত্র্য পুরোপুরি প্রদর্শিত হলে যে কোনো একটি পার্টির পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতে রাখা কঠিন হতে পারে এবং এই অর্থে কোয়ালিশন যুগ থাকতেই এসেছে বলে মনে হয়। কিন্তু একটি কোয়ালিশন যাতে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় বড় জাতীয় পার্টি নেই, যারা একত্রে সংসদে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখলে রাখে, এমন কোয়ালিশন নিয়ম না হয়ে কেবল ব্যতিক্রমই হতে পারে। আগে হোক পরে হোক, বড় দুইটি পার্টির যে কোনো একটি সরকার চালানোর মতো যথেষ্ট সমর্থন নিজেদের পিছনে সমবেত করবে।

দ্বিতীয়ত যুক্তফ্রন্ট রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার আবির্ভাব সূচিত করে বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যখন আঞ্চলিক পার্টিগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ভোগ করছে। আঞ্চলিক পার্টিগুলির ভূমিকা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সত্যিই উদয় হয়েছে, বিশেষত নয়া অর্থনৈতিক নীতির আবির্ভাবের সাথে সাথে। এই নীতি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দ্বারা বেসরকারি বিনিয়োগ সরাসরি আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে রাজ্যগুলিকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে বিদেশী পুঁজি আনার জন্য সোজা পশ্চিমে চলে যাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের কর ছাড়ের উৎসাহ দিতে মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন।

নবম পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে ৩৬ শতাংশ করা হয়েছে, এর মোটা অংশই বেসরকারি সমিতিবদ্ধ ক্ষেত্র (কোম্পানি) থেকে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ যদি বাস্তবায়িত হয়ও তা কেবল বেশি লাভের ক্ষেত্র ও এলাকায় যাবে। এর ফলে রাজ্যগুলির মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে।

প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের রাজ্যের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলির রাজ্যের বা স্বায়ত্ততার দাবি মানতে রীতিমতো অনিচ্ছুক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তিগোষ্ঠীগুলি জমিদার-কুলাক গোষ্ঠীর উপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল। ফলে তাঁরা ভূমিসংস্কারকে চালিয়ে যেতে উৎসাহী নন।

সুতরাং, ভারতীয় পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রবাদ পরিষ্কার অর্থে, গণতান্ত্রিক সংস্কার চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অতো স্বর্ণময় নয়। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পরিপ্রেক্ষেত শক্তিশালী ও দুর্বল রাজ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়। যদি পাঞ্জাবে পৃথক খালিস্তানের দাবি ওঠে বা অকালীরা দাবি করে যে, চারটি বিষয় ছাড়া, অর্থাৎ মুদ্রা, বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া, আর সব ক্ষমতা রাজ্যের হাতে ন্যস্ত হবে, তবে এটা সফল শক্তির বিচ্ছিন্নতা হবে। আর আসামের ক্ষেত্রে, বেশিটাই দিল্লীর শাসকদের অবহেলা থেকে অনুরূপ দাবি উদ্ভূত হয়।

তৃতীয়ত, যুক্তফ্রন্টকে বিজেপি-বিরোধী অ-কংগ্রেসী ফ্রন্ট হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, শ্রমিক কৃষক এবং সম্মুখদর্শী বুর্জোয়া শ্রেণীর এক যুক্তফ্রন্ট, এক ঐক্য যা কিনা সর্বহারাশ্রেণীর আধিপত্যের বিকাশের প্রক্রিয়ার সময় কাঙ্খিত জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে রূপান্তরিত হবে, এবং বামপন্থার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও গান্ধীবাদী উত্তরাধিকারের সম্মিলন হিসাবে ইত্যাদি। এই মতামতগুলি ব্যক্ত করেছেন, আর কেউ নন, কমরেড নাম্বুদিরিপাদ, সিপিআই(এম)-এর সরকারি মুখপাত্র। এইগুলি ছিল ফ্রন্টের গঠনমূলক পর্যায়ে মতামত, যখন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এই কল্পকথা ছড়াতে ব্যস্ত ছিলেন যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি রাও সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে বাতিল করেছে এবং কংগ্রেসের সমর্থন নিঃশর্ত ও বাধ্যতা থেকে উদ্ভূত।

এরপর থেকে যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। কংগ্রেস উদ্যোগ ছিনিয়ে নিয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপর বেশি প্রভাব খাটাচ্ছে। অন্যদিকে সিপিআই(এম) প্রান্তিক হয়ে পড়েছে বলে মনে করে এবং কথায় বার্তায় অনেক বেশি সমালোচনামূলক হয়েছে। পরিহাসের বিষয় এই যে, এখন যারা বাধ্য হয়ে যুক্তফ্রন্টে থেকে যাচ্ছে তাঁরা আর কেউ নয়, সিপিআই(এম)।

এটা জানা নেই যে, সিপিআই(এম) নেতৃত্ব কীভাবে তাঁদের আগেকার সূত্রায়নগুলিকে বিচার করে, কিন্তু সব বলা ও করার পর যুক্তফ্রন্টের জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে রূপান্তরিত হওয়ার আশা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে এবং এখন এটা কেবল এক রাজনৈতিক আবশ্যিকতার প্রশ্ন।

পুনর্বিন্যাস ও স্থান পরিবর্তন

ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে দূরদর্শী বুর্জোয়া দ্রষ্টা শ্রী ভি পি সিং দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এক, নয়া আর্থিক নীতিকে ঘিরে সমস্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে এবং দুই, যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার এক যুগ শুরু হয়েছে। তিনি সম্পূর্ণত সঠিক।

বাস্তব রাজনীতির জগতে এই যুক্তিকে টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি এক দাওয়াই নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং বাতলেছেন যে, বিভিন্ন রাজ্যে শাসক ও বিরোধী উভয় স্থানই যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন দলগুলি, কংগ্রেস এবং সামাজিক ন্যায় শিবিরে মোটামুটি পড়ে, এমন অন্যান্য দলগুলির মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে।

এই যুক্তির মূলগত গলদ হল এই যে, তা অগ্রাহ্য করে সংঘাতের লাগাতার প্রক্রিয়া ও তার ফলে বিভিন্ন পার্টিগুলি যারা অন্যভাবে ব্যাপক বিজেপি-বিরোধী সারিতে পড়ে, তাদের তুলনামূলক শক্তিতে পরিবর্তন এবং এই যুক্তি ভুলভাবে ধরে নেয় যে কেন্দ্রে কংগ্রেস স্থায়ীভাবে অধীনস্থ ভূমিকায় থাকবে। কংগ্রেস এখনো একটি প্রধান জাতীয় পার্টি, তার বর্তমান সংকটাবস্থা নিয়ে কংগ্রেস সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তার বিজেপি এবং সিপিআই(এম) উভয়ের বিরোধিতা করার কর্মসূচি স্পষ্ট করে দিয়ে কংগ্রেস পরিকল্পনা করেছে মধ্যপন্থী শিবিরে কাজ করার, যাতে যুক্তফ্রন্টের পথে বাধা সৃষ্টি করা যায়। ইতিমধ্যে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সাথে এক সমঝোতা গড়ে তুলেছে, মুলায়মের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, টিএমসি ও ডিএমকে-কে লাইনে আনার জন্য যত্ন ও মনোযোগ সহকারে কাজ করে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুর্নীতির ইস্যুতে যুক্তফ্রন্টের প্রাথমিক কংগ্রেস-সমালোচনার সুর নামিয়ে দিতে বাধ্য করে, কংগ্রেস তার ভাবমূর্তিকে আবার সাজিয়ে নেওয়ার, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুসলিমদের জয় করে নেওয়ার ও পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী যুক্তমোর্চার সামনে উঠে আসার আশা করে।

বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-বিরোধী বিষয়বস্তু ইতিমধ্যেই জলে ধোয়া হয়ে বিজেপি-বিরোধী অ-কংগ্রেসী মোর্চা ও সরকারের শ্লোগানে এসে দাঁড়িয়েছে এবং যুক্তফ্রন্টের শরিকদের অন্তত কিছুর ক্ষেত্রে এটা আরও জোলো হয়ে বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-ঘেঁষা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে, আমরা জোরের সাথে এই মতের পক্ষে যে, যেহেতু কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই শাসক শ্রেণীগুলির সর্বভারতীয় দুটি প্রধান পার্টি, আমাদের অবশ্যই উভয়কেই প্রাথমিক শত্রু হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং আমাদের বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-বিরোধী দিশায় দৃঢ় থাকতে হবে।

(দেশব্রতী, অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে)

এই লেখাটি যখন লিখতে বসছি তখন কংগ্রেস রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। নরসিংহ রাও পদত্যাগ করেছেন এবং সীতারাম কেশরী নতুন কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। এই পরিবর্তনে কংগ্রেসের পুনঃএকীকরণে কী প্রভাব পড়বে তা এখনও পরিষ্কার নয়। অর্জুন সিং থেকে শুরু করে ভি পি সিং পর্যন্ত কংগ্রেসে ফেরার কথা চলছে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে দেবেগৌড়া সরকারের অস্তিত্ব যে কতটা জড়িয়ে আছে তা বোঝা যায় রাও-এর পদত্যাগের খবর শুনেই প্রধানমন্ত্রী তার বাড়িতে দৌড়ে যান এবং উভয়েই ৪৫ মিনিট একান্তে কথা বলেন। খবরের কাগজের হিসাবে এ নিয়ে সাড়ে তিন মাসে চব্বিশবার দেবেগৌড়া রাও-এর বাড়িতে গেলেন।

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে এখন সারা দেশ তাকিয়ে আছে। যদিও মুলায়ম সেখানে তার পছন্দমতো রাজ্যপাল বসিয়ে রেখেছেন যাতে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে তাঁর সুবিধা হয়, তবু তাঁর পরাজয় ঘটলে সংযুক্ত মোর্চা সরকারের সংকট ঘনিয়ে আসবে। অন্য অর্থে কংগ্রেসের ওপর এর নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে, এমনকি সরকারে কংগ্রেসের সরাসরি অংশগ্রহণের প্রশ্নও চলে আসবে। রাও-এর পদত্যাগ হয়তো সেই সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় বামপন্থার কৌশল কী হবে? হয়তো শীঘ্রই আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হব। তবে এই মুহূর্তে আমরা বর্তমান সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রতি বিভিন্ন বামপন্থী ধারার মনোভাবের বিচার বিশ্লেষণেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব।

বামদের অভ্যন্তরে কেন এই বিতর্ক?

গত লোকসভা নির্বাচনে তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি এবং এই তিনের বাইরে কয়েকটি আঞ্চলিক দল ও ছোটোখাটো রাজনৈতিক দল মিলে ভালো সংখ্যক আসন দখল করে। ত্রিশঙ্কু সংসদে বিজেপি সরকারের ১৩ দিনের চমৎকারিত্বের অবসান হওয়ায় অন্য এক অভিনব ঘটনা ঘটে। ১৩ পার্টির সংযুক্ত মোর্চা কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার বানায় এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সরকারে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বামপন্থী দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায় এবং সেই পার্টিগুলির ভিতরে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। বিতর্ক সবচেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরে এবং তাদের পার্টির ফয়সালার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা বামপন্থী মহলে।

এখানে এটি মনে রাখা ভালো যে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার হওয়া। ১৯৮৯-তে তারা রাষ্ট্রীয় মোর্চার অংশীদার ছিল না, বাম মোর্চার ছিল আলাদা অস্তিত্ব। সরকার ছিল রাষ্ট্রীয় মোর্চার, বাম মোর্চা ও বিজেপি উভয়েই তাকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছিল। এখন যেমন সংযুক্ত মোর্চা সরকারকে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছে। যদিও সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিকেরা মাঝেমাঝেই তাদের সমর্থনকেও কংগ্রেসের মতোই বাইরে থেকে সমর্থনের সমতুল্য বলে থাকেন, কিন্তু এটি ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কী বলা যায়। বাম মোর্চার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও একক সত্তাকে সংযুক্ত মোর্চার ভিতরে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। সংযুক্ত মোর্চা ও তার সরকারের মধ্যে চীনের প্রাচীর দাঁড় করানোর চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। আপনি সরকারের অবিভাজ্য অঙ্গ, পার্থক্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ নিয়ে হতে পারে। কিন্তু আপনি সংযুক্ত মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তবু সংযুক্ত মোর্চার সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করার কথা বলছেন। এটি বস্তুত স্ববিরোধিতাই। এহেন স্ববিরোধিতার কারণেই সরকারে যোগদান না করার সিপিআই(এম)-এর সিদ্ধান্ত লোকজনের কাছে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মনে হয়েছে এবং তাই এই প্রশ্নে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেও দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

সিপিআই সরকারে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেরী করেনি। কিছু বিরোধিতার কথা শোনা যায় ঠিকই তবে তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। ১৯৬৭-র পর থেকে সিপিআই কয়েকটি রাজ্যে অ-কংগ্রেসী সরকারে সামিল হয় ও পরবর্তীকালে কেরালায় কংগ্রেসের সাথেও যুক্ত সরকারে অংশগ্রহণ করে। কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারকেও তারা বিভিন্ন সময় সমর্থন দিয়ে এসেছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা সরকারকে সমর্থনে। বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বে জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সিপিআই-এর লাইনের চরম পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় জরুরি অবস্থার প্রতি তাদের সমর্থন। ভাতিণ্ডা কংগ্রেসে আত্মসমালোচনা করে সিপিআই এই কলঙ্ককে মুছে ফেলে কংগ্রেসের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার লাইন গ্রহণ করে। সিপিআই-সিপিআই(এম) সম্পর্কের উন্নতি সাধনও তখন থেকেই শুরু। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬-এর মধ্যে রাজনীতির এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে এবং সিপিআই আবারও এক অ-কংগ্রেসী সরকারে – তাও কেন্দ্রে – সামিল হয়েছে, যা টিকে আছে মূলত কংগ্রেসের সমর্থনে। তবে এবার আর সিপিআই(এম) কোনো জোরালো প্রতিবাদ করতে পারছে না, উল্টে সে নিজেই এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। সিপিআই-এর তাত্ত্বিকরা একে তাঁদের জাতীয় গণতন্ত্রের লাইনের বিজয় হিসাবেই দেখছেন। উৎসাহের আতিশয্যে চতুরাননবাবু সিপিআই(এম)-কে কংগ্রেস সম্পর্কে পুনর্বিচারের উপদেশও দিতে দ্বিধা করলেন না।

সিপিআই(এম) অতীতে কংগ্রেসের বেশ কিছু নীতিকে সমর্থন জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেসের প্রার্থীদের কয়েকবার সমর্থনও দিয়েছে, কেন্দ্রের গত কংগ্রেস সরকারের সংকটময় সময়গুলিতে তাকে রক্ষাও করেছে, তবু সে কংগ্রেসের সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়নি। ১৯৭৭-এ কংগ্রেস বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে সে জনতা পার্টি সরকারকে সমর্থন দেয়, যদিও তৎকালীন ভারতীয় জনসংঘ সেই জনতা পার্টির অবিভাজ্য অঙ্গ ছিল। মোরারজীর সরকার পতনের ক্ষেত্রে অবশ্য সিপিআই(এম)-এর ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক যা বিখ্যাত ‘জুলাই সংকট’ বলে পার্টিতে বিতর্কের জন্ম দেয়। ১৯৮৯-তেও কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার জন্য সে বিজেপির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মোর্চা সরকারকে সমর্থন দেয়। এই প্রথম কিন্তু সিপিআই(এম) এক ধর্মসংকটে পড়েছে কারণ তাকে এমন এক অ-কংগ্রেসী সরকারকে সমর্থন দিতে হচ্ছে যা আবার কংগ্রেসের সমর্থনের ওপর একান্তই নির্ভরশীল।

সিপিআই(এম)-এর আশা ছিল তেওয়ারী কংগ্রেস বা কংগ্রেসের অন্য বিদ্রোহী অংশগুলি যথেষ্ট সংখ্যক আসন দখল করবে আর তাতে রাও কংগ্রেসের সমর্থনের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। নির্বাচনের ফলাফল এসে যাওয়ার পরেও কমরেড সুরজিত এই আশা পোষণ করেন যে রাও কংগ্রেসের মধ্যে কোনো বিরাট বিভাজন ঘটবে এবং সেই বিদ্রোহীদের কংগ্রেসের প্রগতিশীল অংশ বলে চালিয়ে দিয়ে তাদের সমর্থনের সাহায্যে এক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা যাবে। তাও কিন্তু ঘটল না। শেষমেষ দেবেগৌড়াকে রাও-এর দরবারে হাজির হতেই হল। এখন সিপিআই(এম)-এর গোটা প্রচারযন্ত্র কর্মীবাহিনীর মগজ ধোলাইয়ে ব্যস্ত। তাদের বোঝানো হচ্ছে যে কংগ্রেসের সামনে সমর্থন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্পই ছিল না, তারা নিঃশর্তভাবে আগ বাড়িয়ে সমর্থন দিয়েছে এবং যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি হয়েছে তা প্রাক্তন রাও-কংগ্রেস সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে খারিজ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেদের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অপাপবিদ্ধতা প্রমাণে তাদের পত্রিকায় এইসব মনোগত বিশ্লেষণেরই ছড়াছড়ি।

অথচ সত্যটা ফাঁস করে দিয়েছেন আর কেউ নন, আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব ভি পি সিং। তিনি নিজেই বলেছেন সংযুক্ত মোর্চা ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। তিনি এটিও স্পষ্ট করে বলেছেন যে যাই বলুক নয়া অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একটি অলিখিত জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। নয়া অর্থনৈতিক নীতির সপক্ষে বহুদিন ধরেই দেবেগৌড়ার বক্তব্য সবারই জানা এবং এটি নিছক দুর্ঘটনা নয় যে চিদম্বরমই ভারতের নতুন অর্থমন্ত্রী, যিনি ব্যক্তিগতভাবে রাও সরকারের আর্থিক নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন। এই বিষয়ে আমরা আবার আলোচনায় ফিরব।

সিপিআই(এম) সরকারে যোগ দেয়নি কেন?

সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার হওয়ার সাথে সাথেই, তার এক স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে, সিপিআই(এম)-এর ওপর সরকারে সামিল হওয়ার জন্য চাপ শুরু হয় এবং এই চাপ দারুণভাবে বেড়ে যায় যখন জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী পদের সর্বসম্মত পছন্দ হয়ে ওঠেন। পার্টির কর্মীবাহিনী, তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এবং বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বহু মানুষই এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। সরকারের বাইরে থাকার যুক্তি কারো কাছে গ্রাহ্য হয়নি, কারণ প্রথমত, সিপিআই(এম) ইতিমধ্যেই সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার, দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী পদ তাঁরাই পাচ্ছিলেন, তাই নীতি নির্ধারণেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকতে পারতেন এবং তৃতীয়ত, ১৩ পার্টির সংযুক্ত মোর্চায় তো সকলেই সংখ্যালঘিষ্ঠ, বরং ৫৩ জন সাংসদের বাম ব্লক ছিল তার মধ্যে বৃহত্তম। কাজেই চিরাচরিত যুক্তি, সংখ্যালঘু থাকায় ও নীতি নির্ধারণের প্রধান ভূমিকায় না থাকায় অংশগ্রহণ করব না, এক্ষেত্রে ছিল অপ্রাসঙ্গিক।

এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বে বিভাজন তীব্র করে দেয় এবং যা শোনা যায়, মাত্র কয়েকটি ভোটের ব্যবধানে পার্টি সরকারে না থাকার ফয়সালা বহাল রাখে। প্রশ্ন যদি হয় কংগ্রেসের ওপর সরকারের চূড়ান্ত নির্ভরশীলতা এবং তাই নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালিয়ে যাওয়ার বাধ্যতা, তাহলে অংশগ্রহণ না করার যুক্তি অবশ্যই বোধগম্য এবং সেক্ষেত্রে তো সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এমনকি সিপিআই(এম) নেতৃত্ব লাগাতার দাবি করে যাচ্ছেন যে, কংগ্রেসের সমর্থন নিঃশর্ত, কোনো বিকল্প না থাকায় বাধ্যতামূলক এবং অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে খারিজ করেছে, তাহলে তো সিপিআই(এম)-এর সরকারে না যাওয়ার যুক্তি বুঝে ওঠা সত্যিই দায়। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কের অবস্থানগুলি এখনও পরিষ্কার হয়ে সামনে আসেনি। হয়তো আগামী পার্টি কংগ্রেসে তা বোঝা যাবে। এখানে আমরা সরকারে অংশগ্রহণের বিষয়টি নাকচ করে দেওয়ার মতামত সম্পর্কে আমাদের আলোচনা চালাব।

সরকারে যোগদান না করার পিছনে যুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একজন নামী বুদ্ধিজীবী লিখেছেন যে জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলেই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি খেপে গিয়ে দেশজোড়া প্রতিবিপ্লব শুরু করে দিত, সমগ্র পুঁজিপতি শ্রেণী দেশব্যাপী হরতাল করতে যেত এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যা চরিত্র তাও ওদের পক্ষেই থাকত। এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার শক্তি – সশস্ত্র গণরক্ষী বাহিনী সহ – যেহেতু সিপিআই(এম)-এর ছিল না তাই ফ্যাসিবাদীদের প্ররোচনায় পা না দিয়ে সিপিআই(এম) ভালোই করেছে। এসব যুক্তি আরামকেদারায় বসে থাকা তাত্ত্বিকের যুক্তির মতোই শোনায়। গত বিশ বছর ধরে জ্যোতিবাবু পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েই আছেন, সেখানে এমন সব প্রতিবিপ্লব হতে তো দেখা যায়নি, উল্টে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিরা জ্যোতিবাবুকে ‘ভদ্রলোক কমিউনিস্ট’ হিসাবে ভালো চরিত্রের প্রশংসাপত্র দিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কী, জ্যোতিবাবুর নামের প্রতি যে সবার সম্মতি হয়েছিল তা তাঁর কোনো বৈপ্লবিক বামপন্থী ভাবমূর্তির জন্য নয় বরং মূলত তাঁর উদারনৈতিক চরিত্র ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্যতার ফলেই। সেই বুদ্ধিজীবী মশাই এটিও লিখেছেন যে জ্যোতিবাবু একা প্রধানমন্ত্রী হলেই বা কী করতেন, সংযুক্ত মোর্চার যেসব চোর জোচ্চোরদের মন্ত্রী বানাতে হত তাতে সিপিআই(এম)-এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হত। কিন্তু এসব চোর জোচ্চোরদের মহান গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক সাজিয়ে সিপিআই(এম) তো বহুদিন ধরেই তাদের সাথে ঘর করছে, তাছাড়া এরকমের মন্ত্রী-টন্ত্রী নিয়েই তো পশ্চিমবাংলার সরকারেও জ্যোতিবাবুকে ঝামেলা পোহাতেই হয়। সংযুক্ত মোর্চায় থাকলে এসব বদনাম থেকে বাঁচাই বা যাবে কী করে?

নাম্বুদিরিপাদের মধ্যপন্থী অবস্থান

শোনা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রবীণ নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের ভূমিকাই শেষ পর্যন্ত নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। পিপলস ডেমোক্রেসী ও অন্যান্য কাগজেও তিনি সম্প্রতি কিছু লেখা লিখেছেন, সে সব থেকে আমরা বিভিন্ন প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর মনোভাব ও পার্টির ভেতরের বিতর্কটিও অনুধাবন করার চেষ্টা করব।

তিনি তাঁর যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সংযুক্ত মোর্চা সংক্রান্ত নীতি ও ১৯৫১-র পার্টি কংগ্রেসে কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লাইন, এই দুটি পরিপ্রেক্ষিতের ভিত্তিতে।

তিনি মনে করেন বর্তমান সংযুক্ত মোর্চা হচ্ছে সম্মুখদর্শী বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিকশ্রেণীর মোর্চা সংক্রান্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতির বিশিষ্ট ভারতীয় প্রয়োগ। তাঁর মতে সংযুক্ত মোর্চা দুটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে। একটি অংশ হল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক পার্টিগুলি, যারা শ্রেণী বিচারে প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি, অন্য অংশ হল বাম ও বাম-ঘেঁষা মধ্যপন্থী পার্টিগুলি, যারা শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধি। এই দুটি অংশের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য, কিছু টানাটানির উল্লেখও তিনি করেছেন ও তাতে মোর্চার স্থায়িত্ব নিয়ে কিছু সন্দেহও প্রকাশ করেছেন। তবে সংযুক্ত মোর্চা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই দিকটি তাঁর তত্ত্বে বেশি গুরুত্ব পায়নি। ই এম এস-এর মতে রাও সরকারের নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নে মোর্চার মধ্যে কিছু দোদুল্যমানতা ছিল বটে, তবে এই সবকিছুকে সজোরে নস্যাৎ করা হয় এবং সেই অর্থনৈতিক নীতিকে খারিজ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি সূত্রবদ্ধ করা হয়। বেশ ভালো, এবার তাহলে সংগ্রাম চলবে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি থেকে যাতে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে। কিন্তু না, পরক্ষণেই ই এম এস জানাচ্ছেন যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির নিজের মধ্যেই পূর্বতন রাও সরকারের জনবিরোধী-জাতীয়তা বিরোধী নীতিগুলির কিছু অবশেষ থেকে গেছে। সেকি! তাহলে ঐকমত্য হল কী করে? আপনারা কি নীতিগত প্রশ্নে তাহলে আপোশ করেছেন? নাকি সেইসব জনবিরোধী ও জাতীয়তা বিরোধী অংশগুলি আপনাদের নিজেদের কর্মসূচিরও অঙ্গ? যদি আপনি মনে করেন আজকের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক কর্মসূচির এই সীমাবদ্ধতা অনিবার্য তাহলে সেটি স্পষ্ট করে বলার এবং সেই কর্মসূচিকে তার সমগ্রতায় রক্ষা করার রাজনৈতিক সাহস আপনার নেই কেন? একদিকে কর্মসূচিকে অভিন্ন বলছেন, অন্যদিকে তার কিছু অংশকে জনবিরোধী-জাতীয়তা বিরোধী বলছেন, এটি কি পরিষ্কার স্ববিরোধিতা নয়? এই স্ববিরোধিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক সুবিধাবাদের মর্মবস্তু। ভি পি সিং থেকে শুরু করে দেবেগৌড়া ও নরসিংহ রাও সকলেই নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলে যাচ্ছেন এবং এটি সকলেরই জানা যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির মূল দিশা এই নীতিরই সপক্ষে, তার ছোটোখাটো পরিবর্তন বা সংস্কার যা কিছু করা হয়েছে তা হল এই নীতিকে এক মানবিক চেহারা দেওয়ার জন্যই। সংযুক্ত মোর্চা সরকারে বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিরা আদৌ বড় একচেটিয়া বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে অ-একচেটিয়া বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি নয়, বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল অর্থে কোনো ভাঙ্গন ঘটেনি।

আপনি সম্মুখদর্শী বা প্রগতিশীল যাই বলুন, এই সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতেই, বড় বুর্জোয়াদের নয়া আর্থিক নীতি যার চালিকা শক্তি। ছোটোখাটো কিছু বিষয়ে হৈ চৈ করার স্বাধীনতা ছাড়া বামপন্থী শরিকেরা যে সেখানে কিছু করতে অক্ষম তা ইতিমধ্যে কয়েকবারই দেখা গেছে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এ ধরনের মোর্চা বা সরকারে সামিল হওয়াকে যে শ্রেণীসমঝোতা বলে নিন্দাও করেছে ই এম এস তার উল্লেখ করলেও ভালো করতেন।

ই এম এস আরও এগিয়ে গিয়ে এই সংযুক্ত মোর্চাকে জনগণতান্ত্রিক ঐক্যে পৌঁছানোর আবশ্যিক স্তর বলেও বর্ণনা করেছেন। কীভাবে এই উত্তরণ ঘটবে? তাঁর নিজেরই ভাষায়, “সংযুক্ত মোর্চা ও সরকারের দুটি অংশের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগ্রাম শ্রমিক-কৃষকের স্বাধীন অবস্থানকে লাগাতার উন্নত ও মজবুত করবে। এটি আবার ক্রমে ক্রমে সর্বহারা আধিপত্যের বিকাশ ঘটাতে থাকবে। এটিই হচ্ছে প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বর্তমান ঐক্য জনগণতান্ত্রিক ঐক্যে রূপান্তরিত হবে।”

এ জাতীয় সংযুক্ত মোর্চা – যা নেহাৎই এক রাজনৈতিক প্রয়োজনের ফসল, যা কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিতর দিয়ে রূপ পায়নি (নয়া আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় আমরা বামপন্থীরা এদের কারো সাহায্যও যে পাইনি তা ভুলে না যাওয়াই ভালো) এবং যা নিতান্তই উত্তরণশীল চরিত্রের ও বুর্জোয়াদের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার পরিস্থিতিতে এর বিভিন্ন অংশ কে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার ঠিক নেই, এবং এর সরকারকে জনগণতান্ত্রিক মোর্চার পূর্বসূরী ও অপরিহার্য পর্যায় বলে ব্যাখ্যা করা মার্কসবাদের বিপ্লবী তত্ত্বের নির্লজ্জ বিকৃতি ছাড়া আর কী বলা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, ই এম এস এই উত্তরণকে দেখছেন সরলরেখায়, ব্যাপক ঐক্য ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগ্রামের মসৃণ এক প্রক্রিয়ায়, যেখানে তীব্র হয়ে ওঠা শ্রেণীসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিচ্ছেদ নেই, নেতৃত্বের প্রশ্নে সর্বহারার সাথে কোনো তীব্র সংঘাত নেই। অনেকটা ক্রুশ্চেভের ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের’ প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পাচ্ছি, অবশ্য তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে সর্বহারা আধিপত্যের শক্তি সঞ্চয় সংক্রান্ত গ্রামসীয় ভাষায়। যে পার্টিতে বিপ্লব শব্দটিই নিষিদ্ধ হয়ে উঠেছে সেখানে এইসব উদারনৈতিক ও অর্থহীন বুলিই বেঁচে থাকে।

১৯৫১-র পার্টি লাইনের উল্লেখ করে ই এম এস বলেছেন সেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয় (তিনি যোগ করেছেন, অবশ্য পরিপূরক হিসাবে অ-সংসদীয় সংগ্রামেরও কথা ছিল) এবং তাই সিপিআই(এম)-এর নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকেছে, “অন্য একটি বুর্জোয়া সরকার দিয়ে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপিত করতে আগ্রহী হওয়ার পাশাপাশি সে এরকম একটি সরকারে অংশ নিতে পারে না যেখানে সে চোখে না পড়ার মতো সংখ্যালঘু।”

ই এম এস-এর মতে সিপিআই-এর নীতি ‘শ্রেণী সমঝোতাবাদী’ যেহেতু “তারা এমনকি চোখেই পড়ে না গোছের সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকারে যোগদান করার পক্ষে”।

তাহলে পার্থক্যটি বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ করা নিয়ে নয়, এমনকি সংখ্যালঘিষ্ঠ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকারও নয়, বরং পার্থক্যটি হল সংখ্যালঘিষ্ঠতা চোখে পড়ে কী পড়ে না। ই এম এস নিজেই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির যে উল্লেখ করেছেন তাতে একটি বুর্জোয়া সরকারকে সমর্থন দেওয়া যায় কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ নয়। যাই হোক, অতি সংখ্যালঘু বর্গের উল্লেখ করে তিনি সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর পার্থক্যকে নামিয়ে এনেছেন মাত্র পরিমাণগত মাত্রায়। সরকারটি যখন বুর্জোয়া তখন কমিউনিস্টরা তো সেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠই থাকবে, এটিই তো স্বাভাবিক। এই সংখ্যালঘিষ্ঠতা যদি অতিমাত্রায় না হয়ে চোখে পড়ার মতো হয় তাহলে ই এম এস-এর বুর্জোয়া সরকারে অংশ নিতে আপত্তি নেই!

এ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে দুই বিবাদমান পক্ষের অবস্থান দুটির মাঝে ই এম এস-এর চিরাচরিত মধ্যপন্থী অবস্থানের এক ধারণা পাওয়া যায় এবং এটিও বোঝা যায়, এই অবস্থান কেমন করে কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে আপাতঃ এক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে।

কংগ্রেস সমর্থিত বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ নয় বনাম প্রধানমন্ত্রীর পদ ও বৃহত্তম বাম ব্লক-এর ভিত্তিতে অংশগ্রহণের দুই বিপরীত মতের মাঝখানে বেশ ভালোরকমের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কথা তুলে ই এম এস একদিকে এক পক্ষের অংশগ্রহণ না করার তত্ত্বকে নাকচ করলেন, আর অপরদিকে অংশগ্রহণের বাস্তব যুক্তিকেও খারিজ করলেন। মতপার্থক্যের বিষয়টি যখন নিছক মাত্রাগত সংখ্যালঘিষ্ঠতার তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে সিপিআই-সিপিআই(এম) বিবাদে এবার সে তীব্রতা নেই। এমনকি দুপক্ষের মধ্যে এবিষয়ে এক ভদ্রলোকের চুক্তি লক্ষ্য করা যায়। ই এম এস-এর কয়েকটি বক্তব্য লক্ষ্য করার মতো :

“দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার প্রাক্তন কংগ্রেসী ও কমিউনিস্টদের এক মোর্চা সরকার গঠন করল যে সরকার অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করছে।”

“সংযুক্ত মোর্চার ১৩টি শরিক দল প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে যেখান থেকে যত আক্রমণই আসুক না কেন তার বিরুদ্ধে এই সরকারকে তারা রক্ষা করবে এবং যেখানে চারটি বাম দলের একটি (সিপিআই) সরকারে যোগদান করেছে, সিপিআই(এম) সহ অন্য তিনটি বাম দল সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের রাস্তা নিয়েছে।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ই এম এস সংযুক্ত মোর্চাকে বারবারই কমিউনিস্ট ও পূর্বতন কংগ্রেসীদের সংযুক্ত মোর্চা বলেই বর্ণনা করেছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-তে এক লেখায় তিনি আচার্য কৃপালনী থেকে শুরু করে প্রাক্তন কংগ্রেসীদের গান্ধীর প্রকৃত শিষ্য বলে আখ্যায়িত করেন এবং সেই যুগ থেকে কমিউনিস্টদের ও প্রাক্তন কংগ্রেসী বা প্রকৃত গান্ধীবাদীদের মধ্যেকার সহযোগিতার ইতিহাস টেনে আনেন। তাঁর বিশ্লেষণে সেই ঐতিহ্যবহনকারী ও গান্ধীর প্রকৃত শিষ্য আজ দেবেগৌড়া এবং সংযুক্ত মোর্চা সরকার – বামপন্থী ও গান্ধীবাদী ঐতিহ্যের যা সর্বোত্তম, তারই প্রতীক। এসব সর্বোত্তম-মাত্রার বিশেষণগুলি ব্যবহার করার সময় তাঁর বোধ হয় খেয়াল থাকেনি দেবেগৌড়ার রাজনৈতিক গুরু সেই সিন্ডিকেটের প্রখ্যাত নেতা নিজলিঙ্গাপ্পা মহাশয়। উৎসাহের আতিশয্যে এটিও তার খেয়াল থাকেনি যে কমিউনিস্ট (না কী প্রাক্তন  কমিউনিস্ট!) ও প্রাক্তন কংগ্রেসীদের এই মোর্চা তার অস্তিত্বের জন্য বর্তমান কংগ্রেসীদের দয়ার ওপরই নির্ভরশীল।

এইসব সরকারগুলির প্রতি সিপিআই(এমএল)-এর মনোভাব

এই সরকারের প্রতি সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান সম্পর্কেও কথা বলার প্রয়োজন আছে, কারণ তা নিয়েও পার্টির ভিতরে বা বাইরে বিভ্রান্তির অভাব নেই। এটি আবারও পরিষ্কার হয়ে থাকা ভালো যে, সংসদীয় ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক অবস্থান হল বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করা। বিজেপি-কংগ্রেসের চরম দক্ষিণপন্থী সরকার হোক বা লালু-মুলায়মদের মধ্যপন্থী সরকার বা সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর বামফ্রন্ট সরকারই হোক আমাদের মৌলিক অবস্থানে পরিবর্তনের কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

তবে মূল নীতিগুলি মুখস্ত করে নিয়ে তাকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করে গেলে আমরা গোঁড়ামীর শিকার হব এবং লোকে আমাদের বোকা বলবে। ব্যবহারিক রাজনীতিতে এই মৌলিক নীতির প্রয়োগে কৌশলগত নমনীয়তার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিভিন্ন সরকার ও বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের পার্থক্য করতে শিখতে হবে। বিজেপি বা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অনেক সময়ই সংসদে বা বিধানসভায় আমাদের প্রতিনিধিদের বাম বা মধ্যপন্থী শক্তিগুলির পক্ষে ভোট দিতে হতে পারে, দুপক্ষের মধ্যে চরম কোনো মেরুকরণ ঘটলে আমাদের প্রতিনিধিরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না, কারণ সেই নিরপেক্ষতা মূল শত্রুর পক্ষে সাহায্যকারী হয়ে উঠতে পারে ও পার্টির ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগতে পারে। এক উত্তরণশীল পর্যায়ে কোনো মধ্যপন্থী বা বাম সরকারকে আমাদের সমালোচনামূলক সমর্থন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিরোধিতার ভূমিকায় যেতে হতে পারে, যাতে আমাদের অবস্থান জনমতের কাছে যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

সংসদীয় রাজনীতিতে এইসব কৌশলগত পদক্ষেপগুলি অনেক সময়ই কমরেডদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেকেই হয়তো কৌশলগত নমনীয়তাকে মৌলিক অবস্থানের বিরোধী ভাবতে শুরু করেন, আবার অন্যরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কৌশলকেই নীতিগত অবস্থানে উন্নীত করার দাবি করতে থাকেন। গত কয়েক বছরের আমাদের সংসদীয় ক্ষেত্রকে ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে যদিও বিজেপি-কংগ্রেসের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে আমাদের প্রতিনিধিরা মধ্যপন্থী সরকারগুলির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কোনো মধ্যপন্থী সরকারের ক্ষেত্রে আমরা সমালোচনামূলক সমর্থনের কথাও বলেছি, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে সরকার যারই হোক আমরা বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের ভূমিকাই পালন করেছি, এবং সেক্ষেত্রে স্বাধীন এক বাম ব্লক গড়ার কৌশল আমাদের নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেবেগৌড়া সরকারের ক্ষেত্রেও প্রথম কথা আমাদের প্রতিনিধি সংযুক্ত মোর্চার শরিক হননি, কংগ্রেসের সাথে আঁতাতের যাবতীয় প্রশ্নে সরকারের সমালোচনা করেছেন, সরকারের প্রতিটি জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। তারপর যখন আস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে গোটা সংসদ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিভাজিত হয়েছিল তখন আমাদের প্রতিনিধি নয়া আর্থিক নীতি জারি থাকার আশঙ্কার প্রতি সমালোচনামূলক বক্তব্য সহ সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন অর্থাৎ সেই সমর্থনও যে সমালোচনামূলক সমর্থন তা স্পষ্ট করেছেন। সেখানে আমাদের জোর ছিল এটিই যে বামেদের সংযুক্ত মোর্চা থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব ব্লক বানিয়ে স্বাধীন অবস্থান নেওয়া উচিত। বিহার বিধানসভায় আমরা এই অবস্থান নিয়ে চলেছি। আসামেও এএসডিসি সরকারে যেতে অস্বীকার করে বাইরে থেকে সমালোচনামূলক সমর্থনের ঘোষণা থেকে শুরু করে এবং ক্রমে ক্রমে এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্লক বানিয়ে বিরোধীপক্ষের মান বাড়িয়ে চলেছে। আসামের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এভাবেই এগোনো উচিত বলে আমরা মনে করি।

সংসদ ও বিধানসভার বাইরে এইসব সরকারগুলির বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রশ্নে ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে আমরা সর্বদাই আন্দোলনরত।

সীমাবদ্ধতাগুলি ও প্রান্তিকীকরণের প্রশ্ন

আজকাল দেখি কিছু কিছু লোক এনিয়ে খুবই চিন্তিত যে আমাদের পার্টি প্রান্তিক শক্তি হয়েই থেকে যাচ্ছে, প্রধান ধারায় যেতে পারছে না। একজন ভদ্রলোক যিনি এক সময় আইপিএফ-এর কেন্দ্রীয় অফিস সামলাতেন, পরে পশ্চাদপসরণ করে নিজে গুছিয়ে-টুছিয়ে আজকাল মুলায়মের প্রশস্তি ও মার্কসবাদের নানা ব্যর্থতা নিয়ে পত্রিকা চালাচ্ছেন, তিনি সম্প্রতি এক পত্রিকায় লিখেছেন যে সিপিআই(এমএল) প্রান্তিক অবস্থায় আছে ও প্রান্তিক থেকে যাবে। তাঁর আক্ষেপ, দুনিয়া এত পাল্টে গেল, তাও আমরা সেই মার্কসবাদই ধরে বসে আছি। নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আমরা চর্চা করি বটে তবে জবাবগুলি সেই মার্কসবাদের অকেজো হয়ে যাওয়া সূত্রগুলিতেই খুঁজে থাকি। তাঁর আরও আক্ষেপ, অন্যরা যখন ‘মণ্ডল’ ও সংরক্ষণ নিয়ে রাজনীতি করছে, আমরা তখন ‘দাম বাঁধো কাম দো’ নিয়ে সমাবেশ করছি বা অন্যরা যখন সামাজিক ন্যায়ের স্লোগান ছেড়ে দিয়েছে তখন আমরা সেই স্লোগান তুলে ধরছি। তাঁর মতে, আমরা সময়ের সাথে তাল দিয়ে চলছি না, তাই প্রান্তিক শক্তি হয়ে থাকাই আমাদের নিয়তি। পার্টির মধ্যেও কিছু কমরেডের কাছে দেখলাম লেখাটি খুব পছন্দ হয়েছে, তাঁরাও মনে করেন যেমন করেই হোক আমাদের প্রধান ধারায় আসতে হবে, এই বিচ্ছিন্ন থাকাটা ঠিক নয়।

বাস্তবিক বিচারে অন্য যে কোনো মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার তুলনায় বিগত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে রাজনীতির প্রধান ধারায় হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে আমাদের পার্টি সর্বতোমুখী চেষ্টা চালিয়েছে। দেশজোড়া গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিভিন্ন ধারার সাথে সম্পর্ক স্থাপন, বামপন্থার সমস্ত ধারার সাথে বিভিন্ন স্তরে যুক্ত কার্যকলাপ, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যকার প্রতিটি বিবাদ বা বিভাজনকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা, দেশব্যাপী রাজনৈতিক অভিযান চালানো ও জাতীয় স্তরে সমাবেশ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হস্তক্ষেপ ইত্যাদির মাধ্যমে পার্টি তার উদ্যোগকে লাগাতার বাড়াতে সচেষ্ট। এসবে ওঠানামার ভিতর দিয়ে একটি স্তরের সাফল্যও আমরা পেয়েছি। এখানে এটি পরিষ্কার হওয়া ভালো যে রাজনীতির প্রধান ধারায় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্থানবিন্দু কী হবে? তা কী বাম-গণতান্ত্রিক রাজনীতির চলমান ধারায় সমাহিত হয়ে যাওয়া, নাকি তাকে রূপান্তরিত করা? সেই ধারায় সমাহিত হয়ে গেলে প্রান্তিক শক্তি হয়ে থেকে যাওয়াই কি চিরদিনের জন্য আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে না? অপরদিকে এই ধারাকে রূপান্তরিত করার কাজ দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতেই তো ভবিষ্যতের সেই বিরাট সম্ভাবনা নিহিত আছে যখন আমরা বর্তমানের বিচ্ছিন্নতাকে ভেঙে প্রধান ধারার নিয়ামক হয়ে উঠতে পারি।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমরা শহুরে ও গ্রামীণ যে সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করি, সেই শ্রেণী বিশাল সংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক শক্তিই হয়ে আছে। প্রশ্ন হল শ্রেণীর রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে তাকে রাজনীতির প্রধান ধারায় নিয়ে এসে হাজির করার। ওপর ওপর কিছু রাজনৈতিক চালবাজি করে সে কাজ হবে না। প্রশ্নটি আদপেই বিমূর্তভাবে সিপিআই(এমএল)-কে, বা কিছু উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তিবর্গকে প্রধান ধারায় এনে হাজির করা নয়।

আমি যখন সেই শ্রেণীর কথা বলি তার মানে এই নয় যে আমরা সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকব। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে জনগণের সমস্ত অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। বাথানিটোলার ঘটনার পরে যখন লালু যাদব বিহার বিধানসভায় আমাদের পার্টির খুব প্রশংসা করলেন এই বলে যে গরিবদের সত্যিকারের পার্টি সিপিআই(এমএল)-ই, তখন আমাদের কয়েকজন কমরেডকে দেখলাম খুব খুশি। তাঁরা বুঝলেন না যে এই দরাজ প্রশংসার মধ্যে লুকিয়ে আছে বুর্জোয়াদের সেই চক্রান্ত – তোমরা শুধু সেখানেই, গ্রামের গরিবদের মধ্যেই পড়ে থাক, সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করো না। শাসকরা প্রথমে আমাদের দমন করে শেষ করার চেষ্টা করে, যখন সফল হয় না তখন তারা আমাদের সীমিত অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় এবং সেখানেই আমাদের আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে। তার জন্য মাঝে মাঝে প্রশংসার বাণীও শোনায়। আমাদের এই সীমাবদ্ধতাকে অবশ্যই ভাঙতে হবে, জনগণের সর্বস্তরে পৌঁছতে হবে, তাদেরও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এখানেই যুক্তমোর্চা গঠনের লক্ষ্যে বিবিধ রাজনৈতিক কৌশল ও সংযুক্ত কার্যকলাপের উপযোগিতা আছে। এসবই করতে হবে বৈপ্লবিক মার্কসবাদের ওপর অবিচল আস্থা রেখে, পার্টির বৈপ্লবিক অবস্থানকে বজায় রেখেই এবং বৈপ্লবিক আন্দোলনে অবিচল থেকেই। তবেই সিপিআই(এমএল)-এর ঐতিহ্যের, হাজার হাজার শহীদদের রক্তদানের সার্থকতা থাকবে। শর্টকার্ট ও নিছক ওপর ওপর কিছু রাজনৈতিক কলাকৌশলের ভরসায় থাকলে পার্টি ঐক্য নষ্ট হবে এবং প্রান্তিক শক্তি হয়ে থাকা শুধু নয়, সামগ্রিক বিপর্যয়ই ঘটবে।

সংযুক্ত মোর্চা সরকারের সাথে কংগ্রেসের দহরম-মহরমকে কেন্দ্র করে বামপন্থী মহলে বিতর্ক আগামীদিনে তীব্র হতে বাধ্য এবং এর মধ্যে দিয়েই বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে নতুন পর্যায়ের মেরুকরণের বিরাট সম্ভাবনা নিহিত আছে। সেই লক্ষ্যে আমাদের জনগণের মধ্যে কষ্টসাধ্য কাজ চালিয়ে নিজস্ব গণভিত্তি গড়ে তুলতে হবে, আমাদের রাজনৈতিক প্রচারকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাপক স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্কে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে হবে। আজকের এই প্রস্তুতিপর্বই অনুকূল রাজনৈতিক ঘটনাক্রমে বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় আমাদের প্রধান অবস্থানে দাঁড় করাবে।