(দেশব্রতী, অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে)
এই লেখাটি যখন লিখতে বসছি তখন কংগ্রেস রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। নরসিংহ রাও পদত্যাগ করেছেন এবং সীতারাম কেশরী নতুন কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। এই পরিবর্তনে কংগ্রেসের পুনঃএকীকরণে কী প্রভাব পড়বে তা এখনও পরিষ্কার নয়। অর্জুন সিং থেকে শুরু করে ভি পি সিং পর্যন্ত কংগ্রেসে ফেরার কথা চলছে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে দেবেগৌড়া সরকারের অস্তিত্ব যে কতটা জড়িয়ে আছে তা বোঝা যায় রাও-এর পদত্যাগের খবর শুনেই প্রধানমন্ত্রী তার বাড়িতে দৌড়ে যান এবং উভয়েই ৪৫ মিনিট একান্তে কথা বলেন। খবরের কাগজের হিসাবে এ নিয়ে সাড়ে তিন মাসে চব্বিশবার দেবেগৌড়া রাও-এর বাড়িতে গেলেন।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে এখন সারা দেশ তাকিয়ে আছে। যদিও মুলায়ম সেখানে তার পছন্দমতো রাজ্যপাল বসিয়ে রেখেছেন যাতে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে তাঁর সুবিধা হয়, তবু তাঁর পরাজয় ঘটলে সংযুক্ত মোর্চা সরকারের সংকট ঘনিয়ে আসবে। অন্য অর্থে কংগ্রেসের ওপর এর নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে, এমনকি সরকারে কংগ্রেসের সরাসরি অংশগ্রহণের প্রশ্নও চলে আসবে। রাও-এর পদত্যাগ হয়তো সেই সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় বামপন্থার কৌশল কী হবে? হয়তো শীঘ্রই আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হব। তবে এই মুহূর্তে আমরা বর্তমান সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রতি বিভিন্ন বামপন্থী ধারার মনোভাবের বিচার বিশ্লেষণেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব।
গত লোকসভা নির্বাচনে তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি এবং এই তিনের বাইরে কয়েকটি আঞ্চলিক দল ও ছোটোখাটো রাজনৈতিক দল মিলে ভালো সংখ্যক আসন দখল করে। ত্রিশঙ্কু সংসদে বিজেপি সরকারের ১৩ দিনের চমৎকারিত্বের অবসান হওয়ায় অন্য এক অভিনব ঘটনা ঘটে। ১৩ পার্টির সংযুক্ত মোর্চা কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার বানায় এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সরকারে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বামপন্থী দলগুলির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায় এবং সেই পার্টিগুলির ভিতরে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। বিতর্ক সবচেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরে এবং তাদের পার্টির ফয়সালার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা বামপন্থী মহলে।
এখানে এটি মনে রাখা ভালো যে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার হওয়া। ১৯৮৯-তে তারা রাষ্ট্রীয় মোর্চার অংশীদার ছিল না, বাম মোর্চার ছিল আলাদা অস্তিত্ব। সরকার ছিল রাষ্ট্রীয় মোর্চার, বাম মোর্চা ও বিজেপি উভয়েই তাকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছিল। এখন যেমন সংযুক্ত মোর্চা সরকারকে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছে। যদিও সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিকেরা মাঝেমাঝেই তাদের সমর্থনকেও কংগ্রেসের মতোই বাইরে থেকে সমর্থনের সমতুল্য বলে থাকেন, কিন্তু এটি ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কী বলা যায়। বাম মোর্চার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও একক সত্তাকে সংযুক্ত মোর্চার ভিতরে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। সংযুক্ত মোর্চা ও তার সরকারের মধ্যে চীনের প্রাচীর দাঁড় করানোর চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। আপনি সরকারের অবিভাজ্য অঙ্গ, পার্থক্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ নিয়ে হতে পারে। কিন্তু আপনি সংযুক্ত মোর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তবু সংযুক্ত মোর্চার সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করার কথা বলছেন। এটি বস্তুত স্ববিরোধিতাই। এহেন স্ববিরোধিতার কারণেই সরকারে যোগদান না করার সিপিআই(এম)-এর সিদ্ধান্ত লোকজনের কাছে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মনে হয়েছে এবং তাই এই প্রশ্নে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেও দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
সিপিআই সরকারে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেরী করেনি। কিছু বিরোধিতার কথা শোনা যায় ঠিকই তবে তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। ১৯৬৭-র পর থেকে সিপিআই কয়েকটি রাজ্যে অ-কংগ্রেসী সরকারে সামিল হয় ও পরবর্তীকালে কেরালায় কংগ্রেসের সাথেও যুক্ত সরকারে অংশগ্রহণ করে। কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারকেও তারা বিভিন্ন সময় সমর্থন দিয়ে এসেছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা সরকারকে সমর্থনে। বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বে জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সিপিআই-এর লাইনের চরম পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় জরুরি অবস্থার প্রতি তাদের সমর্থন। ভাতিণ্ডা কংগ্রেসে আত্মসমালোচনা করে সিপিআই এই কলঙ্ককে মুছে ফেলে কংগ্রেসের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার লাইন গ্রহণ করে। সিপিআই-সিপিআই(এম) সম্পর্কের উন্নতি সাধনও তখন থেকেই শুরু। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬-এর মধ্যে রাজনীতির এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে এবং সিপিআই আবারও এক অ-কংগ্রেসী সরকারে – তাও কেন্দ্রে – সামিল হয়েছে, যা টিকে আছে মূলত কংগ্রেসের সমর্থনে। তবে এবার আর সিপিআই(এম) কোনো জোরালো প্রতিবাদ করতে পারছে না, উল্টে সে নিজেই এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। সিপিআই-এর তাত্ত্বিকরা একে তাঁদের জাতীয় গণতন্ত্রের লাইনের বিজয় হিসাবেই দেখছেন। উৎসাহের আতিশয্যে চতুরাননবাবু সিপিআই(এম)-কে কংগ্রেস সম্পর্কে পুনর্বিচারের উপদেশও দিতে দ্বিধা করলেন না।
সিপিআই(এম) অতীতে কংগ্রেসের বেশ কিছু নীতিকে সমর্থন জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেসের প্রার্থীদের কয়েকবার সমর্থনও দিয়েছে, কেন্দ্রের গত কংগ্রেস সরকারের সংকটময় সময়গুলিতে তাকে রক্ষাও করেছে, তবু সে কংগ্রেসের সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়নি। ১৯৭৭-এ কংগ্রেস বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে সে জনতা পার্টি সরকারকে সমর্থন দেয়, যদিও তৎকালীন ভারতীয় জনসংঘ সেই জনতা পার্টির অবিভাজ্য অঙ্গ ছিল। মোরারজীর সরকার পতনের ক্ষেত্রে অবশ্য সিপিআই(এম)-এর ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক যা বিখ্যাত ‘জুলাই সংকট’ বলে পার্টিতে বিতর্কের জন্ম দেয়। ১৯৮৯-তেও কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার জন্য সে বিজেপির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মোর্চা সরকারকে সমর্থন দেয়। এই প্রথম কিন্তু সিপিআই(এম) এক ধর্মসংকটে পড়েছে কারণ তাকে এমন এক অ-কংগ্রেসী সরকারকে সমর্থন দিতে হচ্ছে যা আবার কংগ্রেসের সমর্থনের ওপর একান্তই নির্ভরশীল।
সিপিআই(এম)-এর আশা ছিল তেওয়ারী কংগ্রেস বা কংগ্রেসের অন্য বিদ্রোহী অংশগুলি যথেষ্ট সংখ্যক আসন দখল করবে আর তাতে রাও কংগ্রেসের সমর্থনের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। নির্বাচনের ফলাফল এসে যাওয়ার পরেও কমরেড সুরজিত এই আশা পোষণ করেন যে রাও কংগ্রেসের মধ্যে কোনো বিরাট বিভাজন ঘটবে এবং সেই বিদ্রোহীদের কংগ্রেসের প্রগতিশীল অংশ বলে চালিয়ে দিয়ে তাদের সমর্থনের সাহায্যে এক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা যাবে। তাও কিন্তু ঘটল না। শেষমেষ দেবেগৌড়াকে রাও-এর দরবারে হাজির হতেই হল। এখন সিপিআই(এম)-এর গোটা প্রচারযন্ত্র কর্মীবাহিনীর মগজ ধোলাইয়ে ব্যস্ত। তাদের বোঝানো হচ্ছে যে কংগ্রেসের সামনে সমর্থন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্পই ছিল না, তারা নিঃশর্তভাবে আগ বাড়িয়ে সমর্থন দিয়েছে এবং যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি হয়েছে তা প্রাক্তন রাও-কংগ্রেস সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে খারিজ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেদের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অপাপবিদ্ধতা প্রমাণে তাদের পত্রিকায় এইসব মনোগত বিশ্লেষণেরই ছড়াছড়ি।
অথচ সত্যটা ফাঁস করে দিয়েছেন আর কেউ নন, আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব ভি পি সিং। তিনি নিজেই বলেছেন সংযুক্ত মোর্চা ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। তিনি এটিও স্পষ্ট করে বলেছেন যে যাই বলুক নয়া অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একটি অলিখিত জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। নয়া অর্থনৈতিক নীতির সপক্ষে বহুদিন ধরেই দেবেগৌড়ার বক্তব্য সবারই জানা এবং এটি নিছক দুর্ঘটনা নয় যে চিদম্বরমই ভারতের নতুন অর্থমন্ত্রী, যিনি ব্যক্তিগতভাবে রাও সরকারের আর্থিক নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন। এই বিষয়ে আমরা আবার আলোচনায় ফিরব।
সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার হওয়ার সাথে সাথেই, তার এক স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে, সিপিআই(এম)-এর ওপর সরকারে সামিল হওয়ার জন্য চাপ শুরু হয় এবং এই চাপ দারুণভাবে বেড়ে যায় যখন জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী পদের সর্বসম্মত পছন্দ হয়ে ওঠেন। পার্টির কর্মীবাহিনী, তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এবং বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বহু মানুষই এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। সরকারের বাইরে থাকার যুক্তি কারো কাছে গ্রাহ্য হয়নি, কারণ প্রথমত, সিপিআই(এম) ইতিমধ্যেই সংযুক্ত মোর্চার অংশীদার, দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী পদ তাঁরাই পাচ্ছিলেন, তাই নীতি নির্ধারণেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকতে পারতেন এবং তৃতীয়ত, ১৩ পার্টির সংযুক্ত মোর্চায় তো সকলেই সংখ্যালঘিষ্ঠ, বরং ৫৩ জন সাংসদের বাম ব্লক ছিল তার মধ্যে বৃহত্তম। কাজেই চিরাচরিত যুক্তি, সংখ্যালঘু থাকায় ও নীতি নির্ধারণের প্রধান ভূমিকায় না থাকায় অংশগ্রহণ করব না, এক্ষেত্রে ছিল অপ্রাসঙ্গিক।
এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বে বিভাজন তীব্র করে দেয় এবং যা শোনা যায়, মাত্র কয়েকটি ভোটের ব্যবধানে পার্টি সরকারে না থাকার ফয়সালা বহাল রাখে। প্রশ্ন যদি হয় কংগ্রেসের ওপর সরকারের চূড়ান্ত নির্ভরশীলতা এবং তাই নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালিয়ে যাওয়ার বাধ্যতা, তাহলে অংশগ্রহণ না করার যুক্তি অবশ্যই বোধগম্য এবং সেক্ষেত্রে তো সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু এমনকি সিপিআই(এম) নেতৃত্ব লাগাতার দাবি করে যাচ্ছেন যে, কংগ্রেসের সমর্থন নিঃশর্ত, কোনো বিকল্প না থাকায় বাধ্যতামূলক এবং অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে খারিজ করেছে, তাহলে তো সিপিআই(এম)-এর সরকারে না যাওয়ার যুক্তি বুঝে ওঠা সত্যিই দায়। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কের অবস্থানগুলি এখনও পরিষ্কার হয়ে সামনে আসেনি। হয়তো আগামী পার্টি কংগ্রেসে তা বোঝা যাবে। এখানে আমরা সরকারে অংশগ্রহণের বিষয়টি নাকচ করে দেওয়ার মতামত সম্পর্কে আমাদের আলোচনা চালাব।
সরকারে যোগদান না করার পিছনে যুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একজন নামী বুদ্ধিজীবী লিখেছেন যে জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হলেই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি খেপে গিয়ে দেশজোড়া প্রতিবিপ্লব শুরু করে দিত, সমগ্র পুঁজিপতি শ্রেণী দেশব্যাপী হরতাল করতে যেত এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যা চরিত্র তাও ওদের পক্ষেই থাকত। এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার শক্তি – সশস্ত্র গণরক্ষী বাহিনী সহ – যেহেতু সিপিআই(এম)-এর ছিল না তাই ফ্যাসিবাদীদের প্ররোচনায় পা না দিয়ে সিপিআই(এম) ভালোই করেছে। এসব যুক্তি আরামকেদারায় বসে থাকা তাত্ত্বিকের যুক্তির মতোই শোনায়। গত বিশ বছর ধরে জ্যোতিবাবু পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েই আছেন, সেখানে এমন সব প্রতিবিপ্লব হতে তো দেখা যায়নি, উল্টে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিরা জ্যোতিবাবুকে ‘ভদ্রলোক কমিউনিস্ট’ হিসাবে ভালো চরিত্রের প্রশংসাপত্র দিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কী, জ্যোতিবাবুর নামের প্রতি যে সবার সম্মতি হয়েছিল তা তাঁর কোনো বৈপ্লবিক বামপন্থী ভাবমূর্তির জন্য নয় বরং মূলত তাঁর উদারনৈতিক চরিত্র ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্যতার ফলেই। সেই বুদ্ধিজীবী মশাই এটিও লিখেছেন যে জ্যোতিবাবু একা প্রধানমন্ত্রী হলেই বা কী করতেন, সংযুক্ত মোর্চার যেসব চোর জোচ্চোরদের মন্ত্রী বানাতে হত তাতে সিপিআই(এম)-এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হত। কিন্তু এসব চোর জোচ্চোরদের মহান গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক সাজিয়ে সিপিআই(এম) তো বহুদিন ধরেই তাদের সাথে ঘর করছে, তাছাড়া এরকমের মন্ত্রী-টন্ত্রী নিয়েই তো পশ্চিমবাংলার সরকারেও জ্যোতিবাবুকে ঝামেলা পোহাতেই হয়। সংযুক্ত মোর্চায় থাকলে এসব বদনাম থেকে বাঁচাই বা যাবে কী করে?
শোনা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রবীণ নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের ভূমিকাই শেষ পর্যন্ত নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। পিপলস ডেমোক্রেসী ও অন্যান্য কাগজেও তিনি সম্প্রতি কিছু লেখা লিখেছেন, সে সব থেকে আমরা বিভিন্ন প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর মনোভাব ও পার্টির ভেতরের বিতর্কটিও অনুধাবন করার চেষ্টা করব।
তিনি তাঁর যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সংযুক্ত মোর্চা সংক্রান্ত নীতি ও ১৯৫১-র পার্টি কংগ্রেসে কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লাইন, এই দুটি পরিপ্রেক্ষিতের ভিত্তিতে।
তিনি মনে করেন বর্তমান সংযুক্ত মোর্চা হচ্ছে সম্মুখদর্শী বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিকশ্রেণীর মোর্চা সংক্রান্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতির বিশিষ্ট ভারতীয় প্রয়োগ। তাঁর মতে সংযুক্ত মোর্চা দুটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে। একটি অংশ হল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক পার্টিগুলি, যারা শ্রেণী বিচারে প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি, অন্য অংশ হল বাম ও বাম-ঘেঁষা মধ্যপন্থী পার্টিগুলি, যারা শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধি। এই দুটি অংশের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য, কিছু টানাটানির উল্লেখও তিনি করেছেন ও তাতে মোর্চার স্থায়িত্ব নিয়ে কিছু সন্দেহও প্রকাশ করেছেন। তবে সংযুক্ত মোর্চা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই দিকটি তাঁর তত্ত্বে বেশি গুরুত্ব পায়নি। ই এম এস-এর মতে রাও সরকারের নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নে মোর্চার মধ্যে কিছু দোদুল্যমানতা ছিল বটে, তবে এই সবকিছুকে সজোরে নস্যাৎ করা হয় এবং সেই অর্থনৈতিক নীতিকে খারিজ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি সূত্রবদ্ধ করা হয়। বেশ ভালো, এবার তাহলে সংগ্রাম চলবে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি থেকে যাতে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে। কিন্তু না, পরক্ষণেই ই এম এস জানাচ্ছেন যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির নিজের মধ্যেই পূর্বতন রাও সরকারের জনবিরোধী-জাতীয়তা বিরোধী নীতিগুলির কিছু অবশেষ থেকে গেছে। সেকি! তাহলে ঐকমত্য হল কী করে? আপনারা কি নীতিগত প্রশ্নে তাহলে আপোশ করেছেন? নাকি সেইসব জনবিরোধী ও জাতীয়তা বিরোধী অংশগুলি আপনাদের নিজেদের কর্মসূচিরও অঙ্গ? যদি আপনি মনে করেন আজকের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক কর্মসূচির এই সীমাবদ্ধতা অনিবার্য তাহলে সেটি স্পষ্ট করে বলার এবং সেই কর্মসূচিকে তার সমগ্রতায় রক্ষা করার রাজনৈতিক সাহস আপনার নেই কেন? একদিকে কর্মসূচিকে অভিন্ন বলছেন, অন্যদিকে তার কিছু অংশকে জনবিরোধী-জাতীয়তা বিরোধী বলছেন, এটি কি পরিষ্কার স্ববিরোধিতা নয়? এই স্ববিরোধিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক সুবিধাবাদের মর্মবস্তু। ভি পি সিং থেকে শুরু করে দেবেগৌড়া ও নরসিংহ রাও সকলেই নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলে যাচ্ছেন এবং এটি সকলেরই জানা যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির মূল দিশা এই নীতিরই সপক্ষে, তার ছোটোখাটো পরিবর্তন বা সংস্কার যা কিছু করা হয়েছে তা হল এই নীতিকে এক মানবিক চেহারা দেওয়ার জন্যই। সংযুক্ত মোর্চা সরকারে বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিরা আদৌ বড় একচেটিয়া বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে অ-একচেটিয়া বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি নয়, বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল অর্থে কোনো ভাঙ্গন ঘটেনি।
আপনি সম্মুখদর্শী বা প্রগতিশীল যাই বলুন, এই সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের হাতেই, বড় বুর্জোয়াদের নয়া আর্থিক নীতি যার চালিকা শক্তি। ছোটোখাটো কিছু বিষয়ে হৈ চৈ করার স্বাধীনতা ছাড়া বামপন্থী শরিকেরা যে সেখানে কিছু করতে অক্ষম তা ইতিমধ্যে কয়েকবারই দেখা গেছে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এ ধরনের মোর্চা বা সরকারে সামিল হওয়াকে যে শ্রেণীসমঝোতা বলে নিন্দাও করেছে ই এম এস তার উল্লেখ করলেও ভালো করতেন।
ই এম এস আরও এগিয়ে গিয়ে এই সংযুক্ত মোর্চাকে জনগণতান্ত্রিক ঐক্যে পৌঁছানোর আবশ্যিক স্তর বলেও বর্ণনা করেছেন। কীভাবে এই উত্তরণ ঘটবে? তাঁর নিজেরই ভাষায়, “সংযুক্ত মোর্চা ও সরকারের দুটি অংশের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগ্রাম শ্রমিক-কৃষকের স্বাধীন অবস্থানকে লাগাতার উন্নত ও মজবুত করবে। এটি আবার ক্রমে ক্রমে সর্বহারা আধিপত্যের বিকাশ ঘটাতে থাকবে। এটিই হচ্ছে প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বর্তমান ঐক্য জনগণতান্ত্রিক ঐক্যে রূপান্তরিত হবে।”
এ জাতীয় সংযুক্ত মোর্চা – যা নেহাৎই এক রাজনৈতিক প্রয়োজনের ফসল, যা কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিতর দিয়ে রূপ পায়নি (নয়া আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় আমরা বামপন্থীরা এদের কারো সাহায্যও যে পাইনি তা ভুলে না যাওয়াই ভালো) এবং যা নিতান্তই উত্তরণশীল চরিত্রের ও বুর্জোয়াদের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার পরিস্থিতিতে এর বিভিন্ন অংশ কে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার ঠিক নেই, এবং এর সরকারকে জনগণতান্ত্রিক মোর্চার পূর্বসূরী ও অপরিহার্য পর্যায় বলে ব্যাখ্যা করা মার্কসবাদের বিপ্লবী তত্ত্বের নির্লজ্জ বিকৃতি ছাড়া আর কী বলা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, ই এম এস এই উত্তরণকে দেখছেন সরলরেখায়, ব্যাপক ঐক্য ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগ্রামের মসৃণ এক প্রক্রিয়ায়, যেখানে তীব্র হয়ে ওঠা শ্রেণীসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বিচ্ছেদ নেই, নেতৃত্বের প্রশ্নে সর্বহারার সাথে কোনো তীব্র সংঘাত নেই। অনেকটা ক্রুশ্চেভের ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের’ প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পাচ্ছি, অবশ্য তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে সর্বহারা আধিপত্যের শক্তি সঞ্চয় সংক্রান্ত গ্রামসীয় ভাষায়। যে পার্টিতে বিপ্লব শব্দটিই নিষিদ্ধ হয়ে উঠেছে সেখানে এইসব উদারনৈতিক ও অর্থহীন বুলিই বেঁচে থাকে।
১৯৫১-র পার্টি লাইনের উল্লেখ করে ই এম এস বলেছেন সেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয় (তিনি যোগ করেছেন, অবশ্য পরিপূরক হিসাবে অ-সংসদীয় সংগ্রামেরও কথা ছিল) এবং তাই সিপিআই(এম)-এর নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকেছে, “অন্য একটি বুর্জোয়া সরকার দিয়ে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপিত করতে আগ্রহী হওয়ার পাশাপাশি সে এরকম একটি সরকারে অংশ নিতে পারে না যেখানে সে চোখে না পড়ার মতো সংখ্যালঘু।”
ই এম এস-এর মতে সিপিআই-এর নীতি ‘শ্রেণী সমঝোতাবাদী’ যেহেতু “তারা এমনকি চোখেই পড়ে না গোছের সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকারে যোগদান করার পক্ষে”।
তাহলে পার্থক্যটি বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ করা নিয়ে নয়, এমনকি সংখ্যালঘিষ্ঠ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকারও নয়, বরং পার্থক্যটি হল সংখ্যালঘিষ্ঠতা চোখে পড়ে কী পড়ে না। ই এম এস নিজেই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির যে উল্লেখ করেছেন তাতে একটি বুর্জোয়া সরকারকে সমর্থন দেওয়া যায় কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ নয়। যাই হোক, অতি সংখ্যালঘু বর্গের উল্লেখ করে তিনি সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর পার্থক্যকে নামিয়ে এনেছেন মাত্র পরিমাণগত মাত্রায়। সরকারটি যখন বুর্জোয়া তখন কমিউনিস্টরা তো সেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠই থাকবে, এটিই তো স্বাভাবিক। এই সংখ্যালঘিষ্ঠতা যদি অতিমাত্রায় না হয়ে চোখে পড়ার মতো হয় তাহলে ই এম এস-এর বুর্জোয়া সরকারে অংশ নিতে আপত্তি নেই!
এ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে দুই বিবাদমান পক্ষের অবস্থান দুটির মাঝে ই এম এস-এর চিরাচরিত মধ্যপন্থী অবস্থানের এক ধারণা পাওয়া যায় এবং এটিও বোঝা যায়, এই অবস্থান কেমন করে কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে আপাতঃ এক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে।
কংগ্রেস সমর্থিত বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ নয় বনাম প্রধানমন্ত্রীর পদ ও বৃহত্তম বাম ব্লক-এর ভিত্তিতে অংশগ্রহণের দুই বিপরীত মতের মাঝখানে বেশ ভালোরকমের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কথা তুলে ই এম এস একদিকে এক পক্ষের অংশগ্রহণ না করার তত্ত্বকে নাকচ করলেন, আর অপরদিকে অংশগ্রহণের বাস্তব যুক্তিকেও খারিজ করলেন। মতপার্থক্যের বিষয়টি যখন নিছক মাত্রাগত সংখ্যালঘিষ্ঠতার তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে সিপিআই-সিপিআই(এম) বিবাদে এবার সে তীব্রতা নেই। এমনকি দুপক্ষের মধ্যে এবিষয়ে এক ভদ্রলোকের চুক্তি লক্ষ্য করা যায়। ই এম এস-এর কয়েকটি বক্তব্য লক্ষ্য করার মতো :
“দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার প্রাক্তন কংগ্রেসী ও কমিউনিস্টদের এক মোর্চা সরকার গঠন করল যে সরকার অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করছে।”
“সংযুক্ত মোর্চার ১৩টি শরিক দল প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে যেখান থেকে যত আক্রমণই আসুক না কেন তার বিরুদ্ধে এই সরকারকে তারা রক্ষা করবে এবং যেখানে চারটি বাম দলের একটি (সিপিআই) সরকারে যোগদান করেছে, সিপিআই(এম) সহ অন্য তিনটি বাম দল সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের রাস্তা নিয়েছে।”
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ই এম এস সংযুক্ত মোর্চাকে বারবারই কমিউনিস্ট ও পূর্বতন কংগ্রেসীদের সংযুক্ত মোর্চা বলেই বর্ণনা করেছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-তে এক লেখায় তিনি আচার্য কৃপালনী থেকে শুরু করে প্রাক্তন কংগ্রেসীদের গান্ধীর প্রকৃত শিষ্য বলে আখ্যায়িত করেন এবং সেই যুগ থেকে কমিউনিস্টদের ও প্রাক্তন কংগ্রেসী বা প্রকৃত গান্ধীবাদীদের মধ্যেকার সহযোগিতার ইতিহাস টেনে আনেন। তাঁর বিশ্লেষণে সেই ঐতিহ্যবহনকারী ও গান্ধীর প্রকৃত শিষ্য আজ দেবেগৌড়া এবং সংযুক্ত মোর্চা সরকার – বামপন্থী ও গান্ধীবাদী ঐতিহ্যের যা সর্বোত্তম, তারই প্রতীক। এসব সর্বোত্তম-মাত্রার বিশেষণগুলি ব্যবহার করার সময় তাঁর বোধ হয় খেয়াল থাকেনি দেবেগৌড়ার রাজনৈতিক গুরু সেই সিন্ডিকেটের প্রখ্যাত নেতা নিজলিঙ্গাপ্পা মহাশয়। উৎসাহের আতিশয্যে এটিও তার খেয়াল থাকেনি যে কমিউনিস্ট (না কী প্রাক্তন কমিউনিস্ট!) ও প্রাক্তন কংগ্রেসীদের এই মোর্চা তার অস্তিত্বের জন্য বর্তমান কংগ্রেসীদের দয়ার ওপরই নির্ভরশীল।
এই সরকারের প্রতি সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থান সম্পর্কেও কথা বলার প্রয়োজন আছে, কারণ তা নিয়েও পার্টির ভিতরে বা বাইরে বিভ্রান্তির অভাব নেই। এটি আবারও পরিষ্কার হয়ে থাকা ভালো যে, সংসদীয় ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক অবস্থান হল বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করা। বিজেপি-কংগ্রেসের চরম দক্ষিণপন্থী সরকার হোক বা লালু-মুলায়মদের মধ্যপন্থী সরকার বা সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর বামফ্রন্ট সরকারই হোক আমাদের মৌলিক অবস্থানে পরিবর্তনের কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
তবে মূল নীতিগুলি মুখস্ত করে নিয়ে তাকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করে গেলে আমরা গোঁড়ামীর শিকার হব এবং লোকে আমাদের বোকা বলবে। ব্যবহারিক রাজনীতিতে এই মৌলিক নীতির প্রয়োগে কৌশলগত নমনীয়তার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিভিন্ন সরকার ও বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের পার্থক্য করতে শিখতে হবে। বিজেপি বা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অনেক সময়ই সংসদে বা বিধানসভায় আমাদের প্রতিনিধিদের বাম বা মধ্যপন্থী শক্তিগুলির পক্ষে ভোট দিতে হতে পারে, দুপক্ষের মধ্যে চরম কোনো মেরুকরণ ঘটলে আমাদের প্রতিনিধিরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না, কারণ সেই নিরপেক্ষতা মূল শত্রুর পক্ষে সাহায্যকারী হয়ে উঠতে পারে ও পার্টির ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগতে পারে। এক উত্তরণশীল পর্যায়ে কোনো মধ্যপন্থী বা বাম সরকারকে আমাদের সমালোচনামূলক সমর্থন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিরোধিতার ভূমিকায় যেতে হতে পারে, যাতে আমাদের অবস্থান জনমতের কাছে যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
সংসদীয় রাজনীতিতে এইসব কৌশলগত পদক্ষেপগুলি অনেক সময়ই কমরেডদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেকেই হয়তো কৌশলগত নমনীয়তাকে মৌলিক অবস্থানের বিরোধী ভাবতে শুরু করেন, আবার অন্যরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কৌশলকেই নীতিগত অবস্থানে উন্নীত করার দাবি করতে থাকেন। গত কয়েক বছরের আমাদের সংসদীয় ক্ষেত্রকে ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে যদিও বিজেপি-কংগ্রেসের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে আমাদের প্রতিনিধিরা মধ্যপন্থী সরকারগুলির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কোনো মধ্যপন্থী সরকারের ক্ষেত্রে আমরা সমালোচনামূলক সমর্থনের কথাও বলেছি, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে সরকার যারই হোক আমরা বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের ভূমিকাই পালন করেছি, এবং সেক্ষেত্রে স্বাধীন এক বাম ব্লক গড়ার কৌশল আমাদের নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেবেগৌড়া সরকারের ক্ষেত্রেও প্রথম কথা আমাদের প্রতিনিধি সংযুক্ত মোর্চার শরিক হননি, কংগ্রেসের সাথে আঁতাতের যাবতীয় প্রশ্নে সরকারের সমালোচনা করেছেন, সরকারের প্রতিটি জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। তারপর যখন আস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে গোটা সংসদ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিভাজিত হয়েছিল তখন আমাদের প্রতিনিধি নয়া আর্থিক নীতি জারি থাকার আশঙ্কার প্রতি সমালোচনামূলক বক্তব্য সহ সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন অর্থাৎ সেই সমর্থনও যে সমালোচনামূলক সমর্থন তা স্পষ্ট করেছেন। সেখানে আমাদের জোর ছিল এটিই যে বামেদের সংযুক্ত মোর্চা থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব ব্লক বানিয়ে স্বাধীন অবস্থান নেওয়া উচিত। বিহার বিধানসভায় আমরা এই অবস্থান নিয়ে চলেছি। আসামেও এএসডিসি সরকারে যেতে অস্বীকার করে বাইরে থেকে সমালোচনামূলক সমর্থনের ঘোষণা থেকে শুরু করে এবং ক্রমে ক্রমে এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্লক বানিয়ে বিরোধীপক্ষের মান বাড়িয়ে চলেছে। আসামের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এভাবেই এগোনো উচিত বলে আমরা মনে করি।
সংসদ ও বিধানসভার বাইরে এইসব সরকারগুলির বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রশ্নে ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে আমরা সর্বদাই আন্দোলনরত।
আজকাল দেখি কিছু কিছু লোক এনিয়ে খুবই চিন্তিত যে আমাদের পার্টি প্রান্তিক শক্তি হয়েই থেকে যাচ্ছে, প্রধান ধারায় যেতে পারছে না। একজন ভদ্রলোক যিনি এক সময় আইপিএফ-এর কেন্দ্রীয় অফিস সামলাতেন, পরে পশ্চাদপসরণ করে নিজে গুছিয়ে-টুছিয়ে আজকাল মুলায়মের প্রশস্তি ও মার্কসবাদের নানা ব্যর্থতা নিয়ে পত্রিকা চালাচ্ছেন, তিনি সম্প্রতি এক পত্রিকায় লিখেছেন যে সিপিআই(এমএল) প্রান্তিক অবস্থায় আছে ও প্রান্তিক থেকে যাবে। তাঁর আক্ষেপ, দুনিয়া এত পাল্টে গেল, তাও আমরা সেই মার্কসবাদই ধরে বসে আছি। নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আমরা চর্চা করি বটে তবে জবাবগুলি সেই মার্কসবাদের অকেজো হয়ে যাওয়া সূত্রগুলিতেই খুঁজে থাকি। তাঁর আরও আক্ষেপ, অন্যরা যখন ‘মণ্ডল’ ও সংরক্ষণ নিয়ে রাজনীতি করছে, আমরা তখন ‘দাম বাঁধো কাম দো’ নিয়ে সমাবেশ করছি বা অন্যরা যখন সামাজিক ন্যায়ের স্লোগান ছেড়ে দিয়েছে তখন আমরা সেই স্লোগান তুলে ধরছি। তাঁর মতে, আমরা সময়ের সাথে তাল দিয়ে চলছি না, তাই প্রান্তিক শক্তি হয়ে থাকাই আমাদের নিয়তি। পার্টির মধ্যেও কিছু কমরেডের কাছে দেখলাম লেখাটি খুব পছন্দ হয়েছে, তাঁরাও মনে করেন যেমন করেই হোক আমাদের প্রধান ধারায় আসতে হবে, এই বিচ্ছিন্ন থাকাটা ঠিক নয়।
বাস্তবিক বিচারে অন্য যে কোনো মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার তুলনায় বিগত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে রাজনীতির প্রধান ধারায় হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে আমাদের পার্টি সর্বতোমুখী চেষ্টা চালিয়েছে। দেশজোড়া গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিভিন্ন ধারার সাথে সম্পর্ক স্থাপন, বামপন্থার সমস্ত ধারার সাথে বিভিন্ন স্তরে যুক্ত কার্যকলাপ, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যকার প্রতিটি বিবাদ বা বিভাজনকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা, দেশব্যাপী রাজনৈতিক অভিযান চালানো ও জাতীয় স্তরে সমাবেশ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হস্তক্ষেপ ইত্যাদির মাধ্যমে পার্টি তার উদ্যোগকে লাগাতার বাড়াতে সচেষ্ট। এসবে ওঠানামার ভিতর দিয়ে একটি স্তরের সাফল্যও আমরা পেয়েছি। এখানে এটি পরিষ্কার হওয়া ভালো যে রাজনীতির প্রধান ধারায় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্থানবিন্দু কী হবে? তা কী বাম-গণতান্ত্রিক রাজনীতির চলমান ধারায় সমাহিত হয়ে যাওয়া, নাকি তাকে রূপান্তরিত করা? সেই ধারায় সমাহিত হয়ে গেলে প্রান্তিক শক্তি হয়ে থেকে যাওয়াই কি চিরদিনের জন্য আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে না? অপরদিকে এই ধারাকে রূপান্তরিত করার কাজ দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতেই তো ভবিষ্যতের সেই বিরাট সম্ভাবনা নিহিত আছে যখন আমরা বর্তমানের বিচ্ছিন্নতাকে ভেঙে প্রধান ধারার নিয়ামক হয়ে উঠতে পারি।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমরা শহুরে ও গ্রামীণ যে সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করি, সেই শ্রেণী বিশাল সংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক শক্তিই হয়ে আছে। প্রশ্ন হল শ্রেণীর রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে তাকে রাজনীতির প্রধান ধারায় নিয়ে এসে হাজির করার। ওপর ওপর কিছু রাজনৈতিক চালবাজি করে সে কাজ হবে না। প্রশ্নটি আদপেই বিমূর্তভাবে সিপিআই(এমএল)-কে, বা কিছু উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তিবর্গকে প্রধান ধারায় এনে হাজির করা নয়।
আমি যখন সেই শ্রেণীর কথা বলি তার মানে এই নয় যে আমরা সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকব। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে জনগণের সমস্ত অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। বাথানিটোলার ঘটনার পরে যখন লালু যাদব বিহার বিধানসভায় আমাদের পার্টির খুব প্রশংসা করলেন এই বলে যে গরিবদের সত্যিকারের পার্টি সিপিআই(এমএল)-ই, তখন আমাদের কয়েকজন কমরেডকে দেখলাম খুব খুশি। তাঁরা বুঝলেন না যে এই দরাজ প্রশংসার মধ্যে লুকিয়ে আছে বুর্জোয়াদের সেই চক্রান্ত – তোমরা শুধু সেখানেই, গ্রামের গরিবদের মধ্যেই পড়ে থাক, সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করো না। শাসকরা প্রথমে আমাদের দমন করে শেষ করার চেষ্টা করে, যখন সফল হয় না তখন তারা আমাদের সীমিত অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় এবং সেখানেই আমাদের আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে। তার জন্য মাঝে মাঝে প্রশংসার বাণীও শোনায়। আমাদের এই সীমাবদ্ধতাকে অবশ্যই ভাঙতে হবে, জনগণের সর্বস্তরে পৌঁছতে হবে, তাদেরও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এখানেই যুক্তমোর্চা গঠনের লক্ষ্যে বিবিধ রাজনৈতিক কৌশল ও সংযুক্ত কার্যকলাপের উপযোগিতা আছে। এসবই করতে হবে বৈপ্লবিক মার্কসবাদের ওপর অবিচল আস্থা রেখে, পার্টির বৈপ্লবিক অবস্থানকে বজায় রেখেই এবং বৈপ্লবিক আন্দোলনে অবিচল থেকেই। তবেই সিপিআই(এমএল)-এর ঐতিহ্যের, হাজার হাজার শহীদদের রক্তদানের সার্থকতা থাকবে। শর্টকার্ট ও নিছক ওপর ওপর কিছু রাজনৈতিক কলাকৌশলের ভরসায় থাকলে পার্টি ঐক্য নষ্ট হবে এবং প্রান্তিক শক্তি হয়ে থাকা শুধু নয়, সামগ্রিক বিপর্যয়ই ঘটবে।
সংযুক্ত মোর্চা সরকারের সাথে কংগ্রেসের দহরম-মহরমকে কেন্দ্র করে বামপন্থী মহলে বিতর্ক আগামীদিনে তীব্র হতে বাধ্য এবং এর মধ্যে দিয়েই বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে নতুন পর্যায়ের মেরুকরণের বিরাট সম্ভাবনা নিহিত আছে। সেই লক্ষ্যে আমাদের জনগণের মধ্যে কষ্টসাধ্য কাজ চালিয়ে নিজস্ব গণভিত্তি গড়ে তুলতে হবে, আমাদের রাজনৈতিক প্রচারকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাপক স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে চলমান বিতর্কে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে হবে। আজকের এই প্রস্তুতিপর্বই অনুকূল রাজনৈতিক ঘটনাক্রমে বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় আমাদের প্রধান অবস্থানে দাঁড় করাবে।