(লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুলাই ১৯৯৫ থেকে)
১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। দ্রুত বিকাশমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তিদের ভূমিকার এবং ঘটনাবলীরও পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিকতা আজ এমনই যে তাদের যেন প্রহসন, এমনকি সস্তা তামাশা বলে মনে হচ্ছে।
হালে সামাজিক ন্যায়ের যে ধারার প্রচলন শুরু হয়েছে তার সাথে সঙ্গতি রেখে আমরা ইতিমধ্যেই কয়েকজন পশ্চাদপদ মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন উপ-রাষ্ট্রপতিরও দেখা পেয়েছি। অবশেষে সেই চরম বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গেল। ভারতবর্ষের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ আমাদের উপহার দিল এক দলিত, তার ওপরে এক মহিলা, মুখ্যমন্ত্রীকে। কুমারী মায়াবতীর ওপর বাজপেয়ী, রাও ও তিওয়ারী – ব্রাহ্মণ্যবাদী লবির এই ত্রিমূর্তির সমান আশীর্বাদ রয়েছে – এটাও কম বিস্ময়কর নয়। কাঁসিরামের সমস্ত হিসাবই উল্টে গেছে। এক নম্বর শত্রু, দুই নম্বর শত্রু, তিন নম্বর শত্রু ও চার নম্বর শত্রু – সম্মিলিত এই চার শত্রুর চেয়ে পয়লা নম্বরের মিত্র আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
মণ্ডল শিরোমণি ভি পি সিং পড়ে গেছেন উভয় সঙ্কটে। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাবোধকে পাশে সরিয়ে রেখে এই সেদিনও তিনি কে আর নারায়ণনের উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়াকে তাঁর – সামাজিক ন্যায়ের – ধারণার বিজয় হিসাবে তুলে ধরেছেন এবং ১৯৯৬-এ অর্থাৎ যে বছর নারায়ণনের রাষ্ট্রপতি পদে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা, সেই বছর এক দলিত রাষ্ট্রপতি পাওয়ার প্রত্যাশায় রোমাঞ্চ বোধ করছেন। সুতরাং মায়াবতীর ক্ষমতায় আসাকে তিনি কখনই নিন্দা করতে পারেন না। পারেন না আরও এই কারণে যে, এতদিন পর্যন্ত তিনি কাঁসিরামের সঙ্গে মাখামাখি করে আসছিলেন।
উদারনীতিবাদী যে চিন্তাকাঠামো দলিত-পশ্চাদপদ জোটের একমুখী বিকাশই শুধু দেখতে পেয়েছিল এবং এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক স্বাভাবিক ও কার্যকরী প্রতিষেধকের বিকাশ দেখে পরম উল্লসিত হয়েছিল, সমগ্র সেই কাঠামোটাই আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আর ঠিক এটাই আসন্ন লড়াইয়ে বিজেপি-কে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে তার উপর্যুপরি বিজয় এবং সাধারণভাবে অন্যান্য রাজ্যেও ভালো ফলাফল ইতিমধ্যেই তাকে প্রয়োজনীয় নৈতিক শক্তি যুগিয়েছে। এখন উত্তরপ্রদেশের ঘটনাবলীর সাথে সাথে স্পষ্টতই সে উদ্যোগ নিজের হাতে ছিনিয়ে নিয়েছে।
খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক যে একসূত্রী এজেন্ডা তার আছে তাকে স্বদেশীয়ানার আবরণে গোপন করতে সে সক্ষম হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার যেখানে বহুজাতিক সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তোষামোদ করতে ব্যস্ত, সেখানে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার এনরন প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বিজেপি প্রাথমিক এক ধাক্কা খেয়েছিল। সেটা কাটিয়ে উঠে, ১৯৯০-এ যেখানে সে থেমে গিয়েছিল ঠিক সেখান থেকেই সে আবার তার যাত্রা শুরু করেছে। কংগ্রেস(ই)-কেও এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন-তিওয়ারী গোষ্ঠী কোনোরকম সাড়া ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। রাও কংগ্রেস ধীরে ধীরে কিন্তু ধাপে ধাপে তাদের সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলছে। সেই সঙ্গে তারা নয়া অর্থনীতি ও শিল্পনীতির ভিত্তিতে ও সরকারে থাকার সুবাদে বেশ কিছু কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচকমণ্ডলীর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাও দাবি করছেন, নয়া আর্থিক ও শিল্পনীতি নিয়ে এক জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে (আর বাস্তবিকই নেপ রূপায়িত করার ব্যাপারে বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে যে রকম পাগলের মতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে তাতে ঐ নীতির বিরোধিতা যথেষ্টই দুর্বল হয়ে গেছে)। তার ওপর বিজেপির ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার বিপদটাই কংগ্রেসের কাছে বাড়তি লাভ। কারণ বামপন্থীদের একটা বড় অংশ সহ বেশ কিছু উদরনীতিবাদী মানুষ কংগ্রেসের ভাঙ্গনের চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন – বিশেষ করে যখন কার্যকরী কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। তথাকথিত “সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ক্ষমতা দখলকে ব্যর্থ করে দিতে” তারা কংগ্রেসের পিছনে সমবেত হন।
সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ক্ষমতা দখলের বিপদ বনাম পুরোনো সরকারকেই টিকিয়ে রাখা – এই রকম এক দ্বিধাময় পরিস্থিতিতেই তৃতীয় ফ্রন্টের বিষয়টি আবার আজকের রাজনৈতিক আলোচ্যসূচিতে প্রধান জায়গা দখল করে নিয়েছে।
ইতিহাসের সূত্র খুঁজলে দেখতে পাই, জরুরি অবস্থার বিরোধিতার প্রক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস বিরোধী এক মহা ঐক্য গড়ে ওঠে এবং তা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুতও করে। বর্তমানের বিজেপি সেদিনের সেই জোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল আর বৃহৎ বামপন্থী দলগুলি হয় সেই জোটের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, না হয় তার থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখেছিল। ১৯৮৯ সালেও বোফর্স-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে। বামেরা সেবার জাতীয় ফ্রন্টের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল আর বিজেপি এক স্বাধীন শক্তি হিসাবে উঠে এসেছিল। কিন্তু দুবারের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই নিজের ভারে ধ্বসে পড়ে।
এবার সে ধরনের কোনো আন্দোলন নেই, কোনো ঐক্যের জায়গাও দেখা যাচ্ছে না। ‘সামাজিক ন্যায়’-এর মণ্ডলতত্ত্বের দুমুখো চরিত্রের কথা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত ধরনের বিভ্রান্তিকর ও সুবিধাবাদী পথ ধরেই শুরু হয়েছে তৃতীয় ফ্রন্টের সন্ধান। সিপিআই(এম)-এর পার্টি কংগ্রেস ‘বেশি বিপজ্জনক-কম বিপজ্জনক’ প্রেক্ষিত থেকে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে একধরনের বোঝাপড়া। অন্যদিকে জনতা দলের ভিতর থেকেই রামকৃষ্ণ হেগড়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতা দখলের মোকাবিলায় নরসীমা রাও-এর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব রেখেছেন। হেগড়ে খুব ভালোভাবেই জানেন যে বর্তমান মুহূর্তে, কী কংগ্রেস কী জনতা দল, কেউই তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হবে না। তবু, সম্ভবত নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিকে মাথায় রেখেই তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন। জনতা দল সভাপতি বোম্মাই দলের মধ্যে “বিরোধী মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে” বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এপ্রশ্নে দরজা খোলাই রইল।
এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, খ্যাতনামা সমাজতন্ত্রী তাত্ত্বিক শ্রীযুক্ত মধু লিমায়ে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে কংগ্রেসের ক্রম অবলুপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং কংগ্রেস(ই)-র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পক্ষে ওকালতি করেন। কেউ জানে না, মধু লিমায়ের পরামর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজতন্ত্রীদের একটি অংশ ঠিক কী ভাবছেন।
এছাড়া বিজু পট্টনায়েক ভি পি সিং-কে তীব্র আক্রমণ করেন। তাঁর মতে ভি পি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর তাঁবেদার, যাঁকে ইন্দিরা তনয় রাজীব পরে দল থেকে তাড়িয়ে দেন। বিজু আক্ষেপ করেছেন যে, ভি পি-র জাতপাতের রাজনীতি জনতা দলের ধ্বংসের কারণ এবং ভি পি-কে তুলে ধরা জনতা দলের পক্ষে ভুল হয়েছিল। তাঁর মতে, চন্দ্রশেখর ছিলেন যোগ্যতর ব্যক্তি। ভি পি অনুগামীদের তীব্র চাপের মুখে বিজুকে তাঁর বক্তব্য তুলে নিতে হলেও তিনি চারদিকে তাঁর অভিমত জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন এবং ভি পি সিং-এর ভাবমূর্তিকে খর্ব করতে দলে চন্দ্রশেখর ও মুলায়মকে আবার ঢোকানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ঐ একই যুক্তিধারা থেকে ডিএমকে, এমডিএমকে, এআইএডিএমকে ইত্যাদি সবাইকে জাতীয় মোর্চার অন্তর্ভুক্ত করার ও জেতার মতো এক জোট গঠন করার ওকালতি করা হচ্ছে।
জনতা দলের বাঙ্গালোর শিবিরে অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কার্যত নয়া অর্থনৈতিক নীতিকেই অনুমোদন করেছে এবং “কাজের অধিকারের” দাবিকে উপহাস করেছে। অন্যান্য প্রস্তাবগুলিও একেবারেই আনুষ্ঠানিক চরিত্রের। আর প্রধানমন্ত্রী পদের অনেক দাবিদার দাঁড়িয়ে গেছে, যারা ঐ পদের প্রতি তাদের দাবিকে জোরদার করে তুলতে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকেই বেশি করে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কার্যকলাপ সেই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয়, “অধিক সন্ন্যাসীতে ...”।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুকেই জোরের সঙ্গে তুলে ধরা হয়নি, কোনো আন্দোলনের আহ্বানও নেই। ৠাডিকাল কোনো কর্মসূচিও হাজির করা হয়নি। অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বর, পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা, সুবিধাবাদী আঁতাত এবং গোষ্ঠীতান্ত্রিক অন্তর্কলহ ছাড়া জাতীয় স্তরের একমাত্র মধ্যপন্থী দলটির আর কিছুই দেওয়ার নেই।
বিপ্লবী বাম স্পষ্টতই এই সমস্ত কসরতের অংশীদার হতে পারে না। সর্বত্রই বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মীবাহিনীর মোহমুক্তি ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সর্বপ্রধান কর্তব্য হল বিশ্বায়নের মুখোশের আড়ালে নিহিত জাতীয় সার্বভৌমত্ব খোয়ানোর বিপদ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি কর্তৃক ক্ষমতা দখলের বিপদের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে জাতীয় স্তরে এক প্রচার অভিযান সংগঠিত করা। দলিত ও গ্রামীণ গরিবদের অন্যান্য অংশের ওপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের বিষয় এবং শ্রমজীবী মানুষের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার বিষয় ও কাজের দাবির ওপরই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জোর দেব।
বর্তমান সন্ধিক্ষণে এক তৃতীয় ফ্রন্টের সন্ধান খুঁজতে হলে বিস্তৃত আলোচনার জন্য এক আলোচ্যসূচিকে তুলে ধরা প্রয়োজন। নিছক সংখ্যা ও নির্বাচনী জোটের খেলা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে সাধারণভাবে বামেদের ও বিশেষভাবে বিপ্লবী বামেদের উচিত তাঁদের নিজস্ব কর্মসূচির ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা এবং আলোচ্যসূচি নির্ধারণে এক মুখ্য ভূমিকা রাখা। এরপরেই কেবল রাজনৈতিক সমীকরণগুলি গড়ে উঠতে পারে।