(১৯৯৩ সালে লিবারেশন এপ্রিল, মে, জুন ও আগস্ট – চার খণ্ডে প্রকাশিত)
সংঘ পরিবার : স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতক
১৯৪২-এ কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে নিন্দা করেছেন, ধিক্কার জানিয়েছেন অনেকেই। কয়েক বছর আগে শ্রী অরুণ সৌরী মহাফেজখানার নথিপত্র ঘেঁটে ঐ সময় সিপিআই-এর তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকতার বহু তথ্যই হাজির করেছিলেন। অবশ্য তার মধ্যে নিজের কল্পনাপ্রসূত কয়েকটি ‘তথ্য’ও তিনি ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। যাই হোক, একথা অনস্বীকার্য যে ঐ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি এক বিরাট কৌশলগত ভুল করে ফেলেছিল। ভারতের অধিকাংশ কমিউনিস্ট সংগঠনই একথা স্বীকার করে। সংক্ষিপ্ত এই সময়টি ছাড়া কমিউনিস্টরা সবসময়ই ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভগৎ সিং-এর মতো বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী সোভিয়েত ইউনিয়নে অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য তথা কমিউনিস্ট মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আরও অনেকে কমিউনিজমের আদর্শকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।
আধুনিক হিন্দুত্বের প্রথম প্রবক্তা সাভারকর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে গোড়ার দিকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বিশের দশকের মাঝামাঝি হিন্দু মহাসভার নেতা হয়ে ওঠার পর থেকে তিনি ব্রিটিশের সঙ্গে পরিষ্কার সমঝোতার পথেই চলেছেন। এমনকি ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময়ে তিনি আইনসভা ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে মহাসভার সদস্যদের “নিজের নিজের পদে আসীন থেকে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে” চলার নির্দেশ দেন। সাভারকর ও তার মহাসভার উগ্র মুসলিম-বিরোধী প্রচার এবং “রাজনীতির হিন্দুকরণ ও হিন্দুত্বের সামরিকীকরণের” আহ্বান কার্যত যুদ্ধকালীন পর্যায়ে ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতায় পর্যবসিত হয় (ভি ডি সাভারকর, ঐতিহাসিক বক্তব্যসমূহ, ১৯৫৭)। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারও কংগ্রেসের মধ্যেই কাজ করতেন। কিন্তু হিন্দুত্বের মঞ্চকে বরণ করে নেওয়ার ফলে তিনি ও তাঁর সংগঠন স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে ক্রমশ দূরে সরে যান।
বিশের দশকের গোড়ার দিকে অসহযোগ আন্দোলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র পর্যায়ের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী ঐক্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব ১৯২২ সালে বিশ্বাসঘাতকতা করে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। এই আন্দোলন সম্পর্কে হেডগেওয়ারের মন্তব্য কিন্তু অত্যন্ত বিরূপ : “মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশজোড়া (জাতীয়তাবাদী) উদ্দীপনায় ভাঁটা পড়ে। ঐ আন্দোলনের ফলে বহু অনাচারই সমাজজীবনে বিপজ্জনকভাবে মাথাচাড়া দেয়। অসহযোগের দুধকলায় বেড়ে ওঠা যবন সাপেরা বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সারা দেশে দাঙ্গার প্ররোচনা দিয়ে চলতে থাকে।” (ভিষিকার, ১৯৭৯, পৃঃ ৭)
১৯২৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন পুনর্জাগরণের লক্ষণ দেখা গেল, সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল এক শক্তিশালী বিক্ষোভ, তখন এসব থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ একেবারেই দূরে সরে রইল, আরএসএস তখন নাগপুরে তার প্রথম প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে বেশি ব্যস্ত। ঐ বছর সেপ্টেম্বরে নাগপুরে লাগল দাঙ্গা, যার পিছনে সংঘের হাত ছিল সুস্পষ্ট।
লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজকে জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে। এই পটভূমিতে ১৯৩০ সালে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। আবার দেখা গেল লড়াইয়ের ময়দানে আরএসএস অনুপস্থিত। কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারি, ১৯৩০-কে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালনের আহ্বান রাখে। হেডগেওয়ার আরএসএস-এর শাখাগুলিকে নির্দেশ দিলেন ঐ দিনটি উদযাপন করা হবে ভাগোয়া ঝাণ্ডা পুজো করে। সারা দেশজুড়ে জনগণ ঔপনিবেশিক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে দিনটি পালন করেছেন। কিন্তু সেই সংঘর্ষের ময়দানে সংঘের যষ্টিধারী ক্যাডারদের একজনকেও দেখা গেল না।
হেডগেওয়ারের পর ১৯৪০ সালে সরসংঘচালক হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন গোলওয়ালকর। তিনি হিন্দুত্বের মুসলিম-বিরোধী, ব্রিটিশপন্থী প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলেন। গোলওয়ালকরের মতে, “জাতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা গড়ে উঠেছে ভৌগলিক জাতীয়তার তত্ত্ব (অর্থাৎ গোটা ভারতের সব অধিবাসী মিলে একটি জাতি) এবং সাধারণ শত্রুর (অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজ হল হিন্দু মুসলমান সকলেরই সাধারণ শত্রু) তত্ত্বের ভিত্তিতে। এর ফলে নিজেদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবোধের ইতিবাচক ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অন্তর্বস্তু থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ-বিরোধিতাকেই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ বলে চালানো হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র গতিপথের ওপর, তার নেতৃত্বের ওপর এবং সাধারণ মানুষের ওপর এক সর্বনাশা প্রভাব বিস্তার করে।” (গোলওয়ালকর ১৯৬৬, পৃঃ ১৪২-৪৩)।
সম্ভবত এটাই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ধারণার সবচেয়ে সুস্পষ্ট সূত্রায়ন। অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্য যে, হিন্দুত্বের এই প্রবক্তা ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার করেন এমন এক সময়ে যখন ঔপনিবেশিক জোয়াল উৎখাত করতে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আরএসএস-এর যাবতীয় ‘দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী’ হুঙ্কার ও আস্ফালন আসলে কেন্দ্রীভূত ছিল অতীতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে। সংঘের চোখে মুঘল আমলের শেষ বড় সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শিবাজীর লড়াইয়ের পর ইতিহাসে ছেদ ঘটেছিল। রঙ্গমঞ্চে ব্রিটিশের আবির্ভাব মুঘল শাসনের অবশেষটুকু শেষ করে দিয়েছে, সুতরাং তারা মিত্রশক্তি। শিবাজীর সেই লড়াইকেই আজও চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। মহারাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত আরএসএস-এর মধ্যে এইভাবে এক মারাঠা ছাপ সুস্পষ্ট। আর এইভাবে সংঘ সেই ব্রিটিশেরই হাতে পুতুল হয়ে উঠেছিল, যারা সর্বদাই হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে উস্কে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে অন্তর্ঘাত করতে সচেষ্ট ছিল।
সুতরাং ১৯৪০-৪১-এর আইন অমান্য আন্দোলনে, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে, আজাদ হিন্দ ফৌজে, ফৌজের বিচার ও বোম্বাই নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ১৯৪৫-৪৬ সালে দেখা দেওয়া গণঅভ্যুত্থানগুলিতে আরএসএস-কে যে খুঁজে পাওয়া গেল না তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
আজ পরিস্থিতি পাল্টালেও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। আজ আবার দেশ যখন সেই একই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দিক থেকে নয়া উপনিবেশবাদের গুরুতর বিপদের সম্মুখীন, তখন সংঘ পরিবারও আবার তার প্রভুদের সেবায় প্রস্তুত। তাদের দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভারতের ওপর মার্কিন প্রাধান্য বা আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক-বহুজাতিক সংস্থার খবরদারির বিরোধিতা করার কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের সমস্ত আস্ফালনের লক্ষ্যবস্তু হল সুদূর অতীতের মুসলিম শাসনের চিহ্নগুলি। এরা এইভাবে অর্থনৈতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ও বিপন্ন রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় তথা স্বৈরশাসনের বিরোধিতায় জনগণের এক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্তর্ঘাত করে চলেছে। অপরদিকে এরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদেরই সেবা করে চলেছে যারা কমিউনিস্ট চ্যালেঞ্জের পতনের পর ইসলামকে নতুন বিপদ বলে মনে করছে।
হিন্দু রাষ্ট্রের দর্শন নাৎসিবাদের কাছ থেকেই ধার করা
আরএসএস-বিজেপির প্রচারকরা দিনরাত কমিউনিস্টদের অভিযুক্ত করে যে তারা মার্কস নামে এক জার্মান ভদ্রলোকের কাছ থেকে এক বিদেশী মতাদর্শ ধার করে আসছে, বিপরীতে তারা দাবি করে নিজেরা যেন খাঁটি দেশজ। কিন্তু গোলওয়ালকরের মতাদর্শ ও সংগঠনে যার প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায় সেও একজন জার্মান (যদিও জন্ম অস্ট্রিয়ায়)। এই জার্মান লোকটার নাম অ্যাডলফ হিটলার।
আমরা অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তার সংজ্ঞা রচনায় গোলওয়ালকর লিখেছেন, “জার্মান জাতিগর্ব আজ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাদের জাতি ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সেমিটিক জাতিগুলিকে অর্থাৎ ইহুদিদের তাড়িয়ে দিয়ে জার্মানরা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে। জাতিগর্বের এটাই সর্বোচ্চ প্রকাশ। জার্মানি এটাও প্রমাণ করেছে যে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতিকে – যাদের মধ্যকার ফারাক একেবারেই মৌলিক – মিলিয়ে এক অখণ্ড সমগ্র গড়ে তোলা সত্যিই অসম্ভব। এই শিক্ষা হিন্দুস্তানে আমাদের পক্ষেও খুবই লাভজনক।”
নাৎসিবাদের এই ভারতীয় সংস্করণের অর্থ হল অহিন্দু জনসাধারণকে তাদের স্বকীয় পরিচয়ের সবকিছু – ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সবই – বিসর্জন দিতে হবে। যদি তাঁরা তা করতে অস্বীকার করেন, তাহলে গোলওয়ালকর তাঁদের এদেশে থাকতে দিতে পারেন একটি মাত্র শর্তে – তা হল তাঁরা, “এই হিন্দু রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অধীনতা স্বীকার করবেন, কোনো কিছুই দাবি করবেন না, কোনো সুযোগসুবিধা পাবেন না, কোনো পক্ষপাতের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন।”
আরএসএস-এর হিন্দুরাষ্ট্রের সমগ্র দর্শন তাই জার্মান নাৎসি রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক ধার করা সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়।
পৌরাণিক নায়ক রামকে জাতীয় নায়ক-এ পরিণত করার পিছনে বিজেপির মতলব
বাল্মিকীর রামায়ণ বা তুলসীদাসের রামচরিতমানস-এর মতো জনপ্রিয় মহাকাব্য হল দুষ্টের বিরুদ্ধে ভালোর বিজয়লাভের প্রকৃষ্টতম প্রতীক কাহিনী। তা জনপ্রিয় পৌরাণিক চরিত্র রামকে অবতার পুরুষে পরিণত করেছে। রাম এইভাবে হিন্দু জনসাধারণের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জগতের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়ের মূর্তরূপ হিসাবে মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও তাঁর রামরাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে অনেকেই তুলে ধরেন। আধুনিক হিন্দুত্বের উত্থানের আগে কেউ কখনও রামকে জাতীয় নায়ক বা রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করার কথা চিন্তাও করেননি।
হিন্দুত্বের মতাদর্শের জনক সাভারকর প্রাণপণে হিন্দু ভারতের এক প্রতীকের সন্ধান করতে করতে রামের মধ্যেই তা খুঁজে পান। তিনি লেখেন, “আমাদের কেউ কেউ রামকে অবতার রূপে পুজো করেন, কেউ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন বীর যোদ্ধা হিসাবে, আর সকলেই তাঁকে ভালোবাসেন আমাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে প্রতিনিধি-স্থানীয় সম্রাট হিসাবে।” তারপর থেকেই হিন্দুত্বের প্রবক্তারা এই ‘জাতির সবচেয়ে প্রতিনিধি-স্থানীয় সম্রাটে’র কথা বারংবার তুলে ধরেছেন। ১৯২৭ সালে আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে বেছে নেওয়া হয় বিজয়া দশমীকে। আরএসএস-এর পতাকা হিসাবে বেছে নেওয়া হয় রামের পতাকা বলে পরিচিত গৈরিক পতাকাকে।
শেষ পর্যন্ত, বাবরি মসজিদ – যা নাকি এক রামমন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল – সেটাই সংঘ পরিবারের হাতে হয়ে দাঁড়াল সেরা হাতিয়ার যেখানে রামকে দাঁড় করানো হল বাবরের বিরুদ্ধে। এইভাবে সাংস্কৃতিক-ধর্মীয়-পৌরাণিক নায়ক থেকে রামের রূপান্তর হল রাষ্ট্রনায়কে, যার তীরের লক্ষ্য মুসলিম ‘হানাদাররা’।
রামকথায় রাবণ সীতাকে বন্দিনী করে রেখেছিল। আজ সংঘ পরিবারের রাবণেরা স্বয়ং রামকেই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বন্দী করে রেখেছে। রামকে এদের হাত থেকে মুক্ত করে তাঁর ভক্তদের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় জগতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
আরএসএস বারবার মুসলিমদের বলে এসেছে যে, তাঁরা যদি রামকে তাঁদের নায়ক হিসাবে মেনে নেন তাহলেই সমস্ত সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু মুসলমানদের তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে মুর্তিপূজায় রত হতে বলা কেবল অবাস্তবই নয় ঔদ্ধত্যেরও পরিচায়ক। তাছাড়া হিন্দু ধর্মের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ধারা যখন একেশ্বরবাদ তথা ঈশ্বরকে বিমূর্ত এক সত্তা হিসাবে দেখার পথে এগিয়ে গেছে তখন এই দাবি নিঃসন্দেহে এক পশ্চাদমুখী দাবি।
অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রের সঙ্গে রামের কিছু ফারাক অবশ্য রয়েছে। সবকিছু হারিয়ে তিনি নিম্নতর জাতের মানুষের সাথে জীবনযাপন করছেন, তাদের সহায়তায় ব্রাহ্মণ রাজা রাবণকে পরাজিত করছেন, এ কাহিনী সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। এ সত্ত্বেও বিভিন্ন গোষ্ঠী বা এলাকার হিন্দুদের মধ্যেও রামের আকর্ষণ সমান নয়। বিশেষত দলিতরা এবং আরও কিছু কিছু হিন্দু গোষ্ঠী রামের কয়েকটি কাজের সমালোচনা করে থাকেন, কারণ সেগুলি তাদের মতে উচ্চবর্ণের মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।
এদেশে হিন্দু-মুসলিম উভয়েই ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের তথা ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের শহীদদেরই তাদের জাতীয় নায়ক হিসাবে গণ্য করে থাকেন। এবং এটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতও বটে। সংঘ পরিবারেরও উচিত এই একই মানসিকতা মেনে নেওয়া, কারণ, গোলওয়ালকর যাই বলে থাকুন না কেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের ময়দানেই।
হিন্দু গৌরবের কল্পকথা
সংঘ পরিবারের একটি চটকদার স্লোগান হল : গর্ব সে কহো হম্ হিন্দু হ্যায় অর্থাৎ ‘সগর্বে বলো আমি হিন্দু’। সংঘের তাত্ত্বিকদের মতে, হিন্দু গৌরবের অবনতির দরুণই তাঁরা পরপর বিদেশী হামলার সামনে বিনা প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই হিন্দু গৌরবের পুনরুদ্ধারের জন্যই হিন্দু অবমাননার সমস্ত স্মৃতিচিহ্নগুলিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া দরকার। বিংশ শতকের শেষ লগ্নে হিন্দুর ধর্মযুদ্ধের সূচনা হয়েছে তাই বাবরি মসজিদ ভেঙে। নিঃসন্দেহে এটা কেবল শুরু। তালিকায় আরও আছে কাশী ও মথুরার মসজিদ, জামা মসজিদ, এমনকি তাজমহলও।
আসুন আমরা হিন্দুধর্মের ইতিহাসের পর্যালোচনা করে এই তথাকথিত হিন্দু গৌরবের আসল চেহারাটা বোঝার চেষ্টা করি। মজার কথা এই যে, ভারতে প্রথম বিদেশী হানাদার ছিলেন আর্যরাই। মধ্যপ্রাচ্যের পার্বত্য অঞ্চল থেকে খ্রিষ্টজন্মের হাজার দুয়েক বছর আগে তাঁরা এদেশে আসেন। হিন্দু ভারতের দাবিকে জোরালো করতে সংঘ পরিবার ইতিহাসের সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। সমস্ত সুপরিচিত ঐতিহাসিক ধারণাকে নাকচ করে তারা প্রমাণ করতে চায় – আর্যরা এদেশেরই আদি বাসিন্দা। এটা সবৈব মিথ্যা। সিন্ধু উপত্যকায় হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার জনসাধারণই ভারতের আদি বাসিন্দা। তাঁদের সভ্যতা ছিল আর্যদের চেয়ে উন্নত। প্রাক-আর্য ভারতীয়রা খুব সম্ভবত ছিলেন দ্রাবিড়। আর্য-জাতিগুলি ছিল আধা-যাযাবর প্রকৃতির পশুচারণ-নির্ভর জাতি। তাঁদের সমাজব্যবস্থা ছিল সামরিক গণতন্ত্রনির্ভর উন্নত পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীব্যবস্থা। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন প্রাক-শ্রেণী থেকে শ্রেণী সমাজে উত্তরণের পর্যায়ে। সিন্ধু উপত্যকা ও উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে তাঁরা ধীরে ধীরে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়েন। এই বিস্তারের সময়ে তাঁদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। এই উত্তরণের সমগ্র পর্যায়টিই ঋকবেদ ও অন্যান্য বেদে প্রতিফলিত হয়েছে।
এই সময়ে আর্যদের ধর্মকে বৈদিক ধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে দেব ও অসুর উভয়েই ছিল বৈদিক দেবতা, যদিও দুটি বিরোধী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে, অসুর হয়ে পড়ে অশুভ আত্মা অর্থাৎ অন্যান্য ইরানিদের ক্ষেত্রে যা ঘটল তার ঠিক বিপরীত। আর স্থানীয় বৈরি দ্রাবিড় উপজাতিগুলিকে চিহ্নিত করা হয় রাক্ষস হিসাবে।
বৈদিক আর্যরা বহু দেবতার উপাসক ছিলেন। দেবতাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করা হত। বিশেষত ইন্দ্র দখল করেছিলেন কেন্দ্রীয় অবস্থান। কোনও মন্দির ছিল না, ছিল না পুরোহিততন্ত্র, ছিল না মরণোত্তর প্রায়শ্চিত্যের কোনও ধারণা। শরীরের থেকে আত্মার পৃথক অস্তিত্বের ভাবনাও তখন পর্যন্ত তাঁদের ধারণায় আসেনি। সামাজিক শ্রমবিভাজনের প্রতিফলন হিসাবে গড়ে উঠেছে এক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। এক কথায় বৈদিক ধর্ম ছিল আর্যসমাজের উত্তরণশীল পর্যায়েরই প্রতিফলন। পরলোকের চেয়ে ইহলোকই ছিল তার কাছে প্রধান।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ নাগাদ আর্য জাতিগুলি ধীরে ধীরে কৃষিনির্ভর স্থায়ী জনবসতি গড়ে তোলে। এই সময় আদিম দাসব্যবস্থার ভিত্তিতে অনেকগুলি স্বৈরতান্ত্রিক রাজ্য গড়ে ওঠে। এই পর্যায়ে বৈদিক ধর্মের জায়গা নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদ।
বর্ণভেদ প্রথা এই সময়ে অনেক বেশি কঠোর হয়ে ওঠে এবং বেদজ্ঞ বিশেষ কর্তৃত্ব সম্পন্ন এক নতুন সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ব্রাহ্মণেরা। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মনু সংহিতা বর্ণভেদ ও জাতিভেদকে স্বর্গীয় বিধান হিসাবে তুলে ধরে। ব্রাহ্মণদের প্রায় দেবতায় পরিণত করা হয়। বহু বৈদিক দেবতা পিছনের সারিতে চলে যায়। পরিবর্তে নতুন কিছু দেবতা প্রধান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান হল ব্রহ্মা। স্থানীয় আদিবাসীরা আর্য বিজেতাদের সমাজে ধীরে ধীরে মিশে যেতে শুরু করলে তাঁদের আরাধ্য দেবতারাও ব্রাহ্মণ্যধর্মের অঙ্গীভূত হতে থাকে। অনমনীয় এক জাতিভেদের যুগে দেবতারাও বিশেষ বিশেষ জাতির দেবতা হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে। উপনিষদের যুগে আত্মার দেহান্তর প্রধান ধারণা হিসাবে সামনে আসে এবং কর্মফলের ধারণা পুনর্জন্মবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রাহ্মণ্যযুগকে উপনিষদের যুগও বলা হয়। এই সময়ে চিরায়ত দর্শনের ছটি ধারা গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণদের প্রধান দর্শন ছিল বেদান্ত। এতে আত্মা ও ব্রহ্মের মিলনের কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রত ক্ষত্রিয়রা পক্ষ নেয় সাংখ্য দর্শনের, যা ছিল বস্তুবাদের নিকটতর একটি দর্শন।
চিরায়ত দর্শনের গণ্ডির বাইরে আত্মপ্রকাশ করে চার্বাক ও লোকায়ত বস্তুবাদী দর্শন, যা এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বও অস্বীকার করে। ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ এই দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছিল।
ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার নিজের ভারেই পতনের মুখে পড়ে। ব্যাপক জনসাধারণ অনমনীয় জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে কিছুটা অসচেতন এক প্রতিবাদ হিসাবে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে বৌদ্ধ ও কিছু পরিমাণে জৈন ধর্মের পিছনে সমাবেশিত হতে শুরু করেন।
এই দুই প্রতিবাদী ধর্মীয় ধারাই ছিল জাতিভেদ ও পুরোহিততন্ত্রের বিরোধী। ক্রমশ বৌদ্ধধর্মই প্রধান ধারা হিসাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের জায়গা দখল করে। এই বৌদ্ধধর্ম খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে মোর্য ও কুশান রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় এমনকি রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদাও অর্জন করে। জটিল আচার আচরণ তথা গণবিচ্ছিন্ন আভিজাত্য নিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয় আবেদনের সমানে দাঁড়াতেই পারেনি।
প্রাধান্য অর্জনের জন্য বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আদি শঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে সাজায়। এভাবেই সূচনা হয় হিন্দুধর্মের। মন্দির ব্যাপারটা বৌদ্ধরাই প্রথম নিয়ে আসেন। জনগণকে আকৃষ্ট করতে গড়ে তোলা হল বিরাট বিরাট দেবমূর্তি সহ বিশাল বিশাল হিন্দু মন্দির ও নানা তীর্থক্ষেত্র। আর জনসমাবেশ সুনিশ্চিত করতে প্রকাশ্য অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় শোভাযাত্রা শুরু করা হল। দেবতাদের সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য অবতারের কল্পনা করা হল। রাম বা কৃষ্ণের মতো পৌরাণিক নায়কদের উত্তীর্ণ করা হল দেবতাদের অবতার তথা পরিত্রাতার ভূমিকায়। বুদ্ধকেও বিষ্ণুর এক অবতার হিসাবে এই ধর্মের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হল এবং আশ্চর্যজনকভাবে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এক বিশ্বমাত্রিক ধর্মে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও তার জন্মভূমিতে বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল।
হিন্দুধর্মের মূলকথা হয়ে দাঁড়াল পুরোনো জাতিভেদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি জনসাধারণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার নতুন নতুন পদ্ধতি। সামাজিক স্তরভেদ, জাত, জাতি ও উপজাতির বিভিন্নতা তথা শ্রেণীসম্পর্কের জটিলতা যত বেড়ে উঠতে শুরু করল হিন্দু সমাজ ততই অসংখ্য বিবদমান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে লাগল।
কেউ কেউ সর্ব পন্থা সমভাবের কথা বলতে চেষ্টা করেন – পরবর্তীতে এটাই সর্ব ধর্ম সমভাবের রূপ নিয়ে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হিসাবে ঘোষিত হয় – কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিছু পরের যুগে প্রথমে ইসলাম ও পরে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবে কিছু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করে। কবীর, নানক, চৈতন্য ও অন্য বহু ধর্মসংস্কারক হিন্দুধর্মের জাতিভেদ ও জটিল আচার-আচরণের তীব্র সমালোচনা করেন। মধ্যযুগে এঁদের এই সংস্কার আন্দোলন ভক্তি আন্দোলন হিসাবে পরিচিত। এই সমস্ত সংস্কারকদের মধ্যে কবীরের নাম সর্বাগ্রগণ্য। সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়ে তিনি ব্রাহ্মণদের কুসংস্কার ও কপটাচারের বিরুদ্ধে কঠোরতম ভাষায় আক্রমণ হানেন।
ব্রিটিশ যুগে সংস্কারের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, দয়ানন্দ সরস্বতী ও বিবেকানন্দ। এঁরা প্রত্যেকেই বেদান্তের অদ্বৈতদর্শনের প্রচার করেন ও জাতিভেদ প্রথা বিলোপের চেষ্টা করেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রবণতাই শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মে আরও একটি নতুন গোষ্ঠীর জন্ম দেওয়ার চেয়ে বেশি কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। অনমনীয় দৈবনির্ধারিত জাতিভেদ প্রথা নিয়ে হিন্দুধর্ম নিজেকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেছিল এবং ফলে তা মূলত একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম বিশ্বমাত্রিক ধর্মের স্বীকৃতি পায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নামটি তাই একেবারেই অসঙ্গত। হিন্দুধর্মকে বিশ্বধর্ম হিসাবে তুলে ধরার এটা এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
হিন্দুধর্মের সমস্ত প্রগতিশীল সংস্কার আন্দোলন এক মিথ্যা হিন্দু গৌরবের ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর যা করেছে তা হল এই ধর্মকে এক উদার, আধুনিক রূপ দেওয়ার, বিশেষ করে তার কঠোর জাতিভেদের অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টা। গোঁড়া হিন্দুধর্মের নিয়ন্তারা সর্বদাই তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলির জোরে এইসব প্রচেষ্টাকে প্রায় ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ এই প্রথম সংঘ পরিবারের পরিচালনায় শুরু হয়েছে এক পাল্টা আন্দোলন যা ঐ সমস্ত সংস্কারের যেটুকু ইতিবাচক প্রভাব ছিল তাকেও ধ্বংস করতে উদ্যত। যাঁরা হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক এই অভ্যুদয়ের ফলে হিন্দুধর্মের কোনও ইতিবাচক সংস্কার আশা করছেন, তাঁরা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। এই আন্দোলনের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা কেবল পেয়েছি ইতিহাসের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি, সাধু ও মহন্তদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, বর্ণহিন্দুদের নতুন আগ্রাসী আচরণ আর উপরন্তু, বজরং দল ও শিব সৈনিকদের লুম্পেন বাহিনী। এটাকেই সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিকরা হিন্দুত্বের অভ্যুদয়, হিন্দুধর্মের মধ্যে খালসা ধরনের ক্ষত্রিয় চেতনার অগ্রগতি ও হিন্দু গৌরবের আত্মঘোষণা হিসাবে বর্ণনা করছেন।
ধর্মকে সঠিকভাবেই পারিপার্শ্বিক অবস্থার কাছে মানুষের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধর্মীয় কল্পকথা সত্যিই মানুষের মনে পরিবেশ-নির্ধারিত শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার মোহ রচনা করে, আর তাই সাধারণ মানুষ সবসময়েই, বিশেষ করে কঠিন সময়ে, ধর্মের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু কল্পনা নিছক কল্পনাই। তা কখনই বাস্তবের বিকল্প হতে পারে না। হিন্দু গৌরবের ঝাণ্ডা উড়িয়ে, হনুমানকে অতিমানবের আসনে বসিয়ে একটা নড়বড়ে কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, সম্ভব শতসহস্র নিরস্ত্র মানুষকে আঘাত হানা, হত্যা করা। কিন্তু তা দিয়ে নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির আক্রমণের মোকাবিলা করা যায় না। এই আক্রমণ এখনও চলছে। আর মজার ব্যাপার এই যে তা চলছে হিন্দু গৌরবের ধ্বজাধারীদের স্পষ্ট প্রশ্রয়েই।
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিন্দুধর্ম – সোনার পাথরবাটি!
সংঘ পরিবার আর একটি বক্তব্য বহুবার তুলে ধরেছে – ভারতবাসীর ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দু বলেই ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, হিন্দুধর্মের এই তথাকথিত অন্তর্নিহিত সহিষ্ণুতাকে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে এক করে দেখার ধারণাটি সরকারি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ও গোড়ার কথা। আর তাই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারে ক্রমাগত হিন্দু মানসিকতার জয়গানই শোনা যায়।
হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক উত্থানের ফলে আজ আমরা দেখছি হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনার সাংঘাতিক বৃদ্ধি, দেশের রাজনীতিতে সাধু-মহন্তদের ক্রমবর্ধমান রমরমা, বজরং দল বা শিবসেনার মতো সংগঠনগুলিতে সমাজের যত আবর্জনার একত্রিত হওয়া, মুসলিম-বিরোধী হত্যালীলার মারাত্মক বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখায় প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতের বহিঃপ্রকাশ এবং শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতে সমস্ত বিরোধী মতামতের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। এর থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে একটা নির্ভেজাল হিন্দু রাষ্ট্র মানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
দ্বিতীয়ত বেশ কিছু উন্নত দেশ, যেখানে প্রধান ধর্ম খ্রিষ্ট বা বৌদ্ধধর্ম, তারা ভারতের থেকে অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। বিশেষত খ্রিষ্টধর্ম এক সময় অত্যন্ত গোঁড়া ও অসহিষ্ণু ধর্ম ছিল – ইনকুইজিশনের (রোমান ক্যাথলিক যাজকদের তৈরি বিচারসভা) কথা মনে করে দেখুন। অনেক ইউরোপীয় দেশে চার্চও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান। সময়ের ধারাবাহিকতায় খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে বহু ধারার জন্ম হয় এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্য রাষ্ট্র ও চার্চের বিচ্ছেদ নিশ্চিত করে। বস্তুত, রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিই পশ্চিমী দেশগুলিতে সফল বুর্জোয়া বিপ্লবের ফসল।
হিন্দুধর্মের তথাকথিত এই অন্তর্নিহিত সহনশীলতার প্রবক্তারা অবশ্য এর সঙ্গে তুলনা করেন কেবল ইসলামের তথাকথিত অন্তর্নিহিত অসহিষ্ণুতার। হিন্দু জনসাধারণের এক বিরাট অংশ ইসলাম সম্পর্কে এই রকম ধারণাই পোষণ করেন। কাজেই ইসলামের বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানা প্রয়োজন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতি পরস্পর শক্তিক্ষয়ী এক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। মরুবাণিজ্যের মন্দা ও তার দরুণ জমির চাহিদায় বৃদ্ধির জন্যই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যুযুধান উপজাতিগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার আন্দোলন হিসাবেই ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। এই ঐতিহাসিক সময়ে বিভিন্ন উপজাতীয় রীতিনীতির মিলন ও একক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অর্থাৎ আল্লার প্রতি আনুগত্যের বাণী প্রচার শুরু করেন মহম্মদ। তাঁর নিজের উপজাতি কোয়েরিশের প্রধানরা ও বণিক অভিজাততন্ত্র প্রথমে তাঁর এই মতের তীব্র বিরোধিতা করে। তিনি মক্কা থেকে পালাতে বাধ্য হন। মদিনার মরুদ্যানের কৃষিজীবী জনসাধারণ ছিলেন মক্কার এই অভিজাততন্ত্রের বিরোধী। তাঁরা মহম্মদকে সমর্থন যোগান। এঁদের সাহায্যেই তিনি শেষপর্যন্ত মক্কা দখল করেন। এক প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় কেন্দ্র হিসাবে মক্কার আবির্ভাবের সাথে সাথে কোয়েরিশ অভিজাততন্ত্রও ইসলাম গ্রহণ করে, এমনকি তার নেতায় পরিণত হয়।
এঙ্গেলসের কথায় ইসলাম ধর্ম ছিল একদিকে শহরবাসী বণিক ও শিল্পী সম্প্রদায়ের জন্য, আবার একই সঙ্গে যাযাবর বেদুইনদের জন্যও।
আরবদের জাতীয় ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ইসলাম অল্পদিনের মধ্যেই এক বিশ্বধর্মে পরিণত হয়। অষ্টম ও নবম শতাব্দীর মধ্যে স্পেন থেকে মধ্য এশিয়ার ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূখণ্ডের একমাত্র ধর্ম হয়ে ওঠে ইসলাম। পরবর্তী শতকগুলিতে এই ধর্ম উত্তর ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আরও পরে ইন্দোনেশিয়া, ককেশিয়া তথা বলকান রাষ্ট্রগুলির কিছু কিছু জাতির মধ্যেও এই ধর্মের বিস্তার ঘটে।
নতুন নতুন এলাকা দখল ও তাদের এক করে তুলতে আরবরা যে সব ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ পরিচালনা করেছিল সেগুলি ইসলামের প্রসারে এক প্রধান ভূমিকা নেয়। কিন্তু বাইজানটাইন বা সিসামিড সাম্রাজ্যের মতো দেশের জনসাধারণ যে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তোলেননি তার জন্য দায়ী স্থানীয় সামন্তপ্রভুদের মারাত্মক নিপীড়ন। আরবদের বিজিত দেশগুলিতে কৃষক জনসাধারণের, বিশেষত যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের দেয় খাজনা অনেকাংশে কমানো হয়। ভারতে ইসলামের বিস্তারে সাহায্য করেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিভেদের অমানুষিক নিপীড়ন। প্রাচ্যের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত রাষ্ট্রগুলিতে কৃষক জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল তার সরল রীতিনীতির দরুণ।
পরবর্তীকালে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও ধর্মনিরপেক্ষ গবেষকরা জিহাদের নির্দেশাবলীকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এমনকি হিন্দুধর্মকেও এক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ-সম্বলিত ধর্ম হিসাবে, রাম ও কৃষ্ণকে তাঁদের যুগের পয়গম্বর হিসাবে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। পাঠক এ প্রসঙ্গে বিহারের মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক মহলে ওঠা এক সাম্প্রতিক বিতর্কের কথা স্মরণ করতে পারেন। কোনও এক মুসলিম পণ্ডিত হিন্দুদের কাফের বলা উচিত নয় বলে মতপ্রকাশ করলে এই বিতর্কের জন্ম হয়।
ইসলামে ধর্মীয় বিধানের ভিত্তিতে নাগরিক আইন ও দণ্ডবিধি সূত্রবদ্ধ আছে – একেই শরিয়ৎ বলে। পিতৃতান্ত্রিক উপজাতীয় মানসিকতা ইসলামের পারিবারিক মূল্যবোধকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল, আর তাই নারী সেখানে পুরুষের অধীন। কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রায় সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য। বরং তৎকালীন আরবের নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অত্যাচারের নিন্দা করে এবং স্ত্রীলোকের সম্পত্তির অধিকার – পণ ও উত্তরাধিকারের অধিকার – নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে কোরান নারীর মর্যাদাকে কিছুটা বাড়াতেই সমর্থ হয়েছিল।
ইসলাম ব্যাপক সংখ্যায় মানুষকে ধর্মের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হলেও মুসলিম দেশগুলিতে জাতীয় ও শ্রেণীদ্বন্দ্বগুলি বেড়েই চলতে থাকে। এরই প্রতিফলন হিসাবে ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ও গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
এদের মধ্যে প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গোষ্ঠীটি হল শিয়া। আরবদের আভ্যন্তরীণ লড়াই তথা মহম্মদের উত্তরসূরীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হিসাবে এর শুরু হলেও শীঘ্রই তা আরব বিজেতাদের বিরুদ্ধে পারস্যের জনগণের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের রূপ নেয়। আজও ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম শিয়া। মুসলিম জগতের অধিকাংশই অবশ্য সুন্নি। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে সুন্নিদের একটি গোষ্ঠী, মুজীলাইটরা এক যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম মতবাদকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন যে কোরান ঈশ্বরসৃষ্ট নয়, মানুষেরই রচনা আর মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। ধর্মীয় বিধানের আক্ষরিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে চলে আসা গোঁড়া ধারার বিপরীতে ইসলামের মধ্য থেকেই এমন কিছু কিছু ধারা উঠে আসে যেগুলি এর অনেক উদার ব্যাখ্যা অনুমোদন করে। মুসলিম জগতের অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলিতে এগুলি যথেষ্ট সমর্থন ভোগ করে।
সুফীবাদের সূচনা শিয়াদের মধ্যে হলেও পরবর্তীকালে সুন্নিদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছিল। সুফীরা বাহ্যিক আচার আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে এক মায়াময় মিলনের কথা বলতেন। তাঁদের অদ্বৈতবাদী ধারণা গোঁড়া অর্থে কোরানের থেকে বিচ্যুতিই ছিল। গোঁড়া মুসলিমদের হাতে তাই প্রথমদিকে তাঁদের অত্যাচারিত হতে হয়েছে। পরে অবশ্য একটা আপোশরফা হয়।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুসলিম ঐতিহ্যে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসে। বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রভাব সীমায়িত হয়, আইনব্যবস্থাকে করে তোলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ, আর মুসলিম মোল্লাতন্ত্রের হাত থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করা হয়। তুরস্কে ১৯২০-র দশকে কামাল পাশার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আমূল কিছু সংস্কার প্রবর্তিত হয়।
ভারত এক্ষেত্রে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এখানে হিন্দুধর্মের অসংখ্য দেবদেবী ও মূর্তি পূজার সঙ্গে ইসলাম সহাবস্থান করে এসেছে বহু শতাব্দী ধরে। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে দুটি ধর্মের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। অথচ তৃণমূলস্তরে উভয় ধর্মের সাধারণ মানুষ এক অভিন্ন জীবনযাত্রা, আশা-আকাঙ্খা, এমনকি বহু অভিন্ন বিশ্বাসের অংশীদার। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর যে সমস্ত মুসলিম জনগণ ভারতে থেকে গেলেন তাঁদের যে পাকিস্তানের প্রতি একটা দুর্বলতা থাকবে এটা স্বাভাবিক, ঠিক যেমন পাকিস্তানি বা বাংলাদেশী হিন্দুদের ভারতের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। দেশভাগের পর ভারতীয় মুসলিমদের রাজনীতি মোটামুটিভাবে কংগ্রেসের চারপাশেই ঘোরাফেরা করেছে। নিজের ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে কংগ্রেস মুসিলম মৌলবাদী শক্তিগুলিকে অনেক সময় বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য হিন্দু মৌলবাদকে দেওয়া ছাড়ের সামাল দিতেই এটা তাকে করতে হয়েছে। এই খেলার অবশ্য বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কংগ্রেসের প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মোহভঙ্গ ঘটিয়েছে। জনতা দলের মতো দলগুলি কংগ্রেসের এই দুরবস্থার সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদেরও লক্ষ্য সেই মৌলবাদী অংশটিকেই দলে টানা।
বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র তথা ধর্মীয় তাণ্ডব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসাপে মুসলিমদের মধ্যে মৌলবাদকেই শক্তিশালী করেছে। প্রগতিশীল সমাজসংস্কার হিসাবে বহুবিবাহের বিরোধিতা করা এক জিনিস, কিন্তু একে মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা উদ্ভট ব্যাপার। বহু সন্তানের জন্মদান সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য – কোনও বিশেষ ধর্মের ব্যাপার নয়। ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহের খুব একটা প্রচলন নেই বললেই চলে। তাছাড়া একটু সাধারণ বুদ্ধি খাটালেই বোঝা যায়, নারী-পুরুষের বর্তমান অনুপাতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা কখনই বহুলপ্রচলিত হতে পারে না, জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য দায়ী হওয়া তো দূরের কথা। এক অভিন্ন নাগরিক আইন তথা মুসলিম নারীদের অধিকার নিয়ে বিজেপির দুশ্চিন্তা আসলে বিরাট ভাঁওতাবাজি – মুসলিম সত্তার ওপর এক সামগ্রিক আক্রমণের অংশবিশেষ। শাহবানু মামলায় তার হস্তক্ষেপ কেবল গোঁড়া মুসলমানদের পাল্টা আঘাতকেই ডেকে আনে। ফলে এক প্রগতিশীল সমাজসংস্কারের ব্যাপারে মুসলিম জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তা ধাক্কার মুখে পড়ে।
হিন্দু-ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য করার কথা বলে বিজেপি তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতকেই শক্তিশালী করছে। একইভাবে মুসলিম সত্তাকে হিন্দু ‘সাংস্কৃতিক’ সত্তায় মিলিয়ে দেওয়ার বিজেপির দাবিও ভারতের মিশ্র প্রকৃতিকে সরাসরি নাকচ করারই সমার্থক। বিজেপি হিন্দু সত্তাকেই ভারতীয় সত্তা হিসাবে চালাতে যত চেষ্টা করুক না কেন, সংঘ পরিবারের মতাদর্শগত আক্রমণ ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে মোহকেই জিইয়ে রাখবে ও শক্তিশালী করবে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুস্পষ্ট হিন্দু পক্ষপাতের জন্যই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান সম্বন্ধে এক মোহ। আর আজ সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের আস্ফালনের দরুণই তা টিকে থাকছে, শক্তিশালী হচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি করে আজ আবার তারা নয়া ঔপনিবেশিক বিপদের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের প্রতিরোধে ভাঙ্গন ধরাতে, তাকে দুর্বল করতে উদ্যত। সংঘ পরিবার আজ আবার তার প্রভুদের সেবায় হাজির – ঠিক যখন তার সেবার দরকারও সবচেয়ে বেশি।
যাই হোক, ভারতীয় মুসলিমদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শেষ কথা বিজেপি বলবে না। মুসলিম যুবকদের নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানের প্রতি কোনো আন্তরিক টান নেই, বরং তাঁরা ভারতে ভারতীয় মুসলিম হিসাবেই নিজেদের স্থান করে নিতে আগ্রহী। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক নন। আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাঁদের বামপন্থীদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। মুসলিমদের মধ্যকার প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম সমাজের গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলছেন, জোর দিচ্ছেন আধুনিক শিক্ষার ওপর, বিশেষত নারীর অবস্থার উন্নতির ওপর। সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কর্তব্য ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই বিকাশমান ধারাটিকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করা, যাতে তাঁরা ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সমান অংশীদার হয়ে উঠতে পারেন। কেবল এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাষ্ট্রই পাকিস্তানের অস্তিত্বের যৌক্তিকতাকে অমূলক করে তুলতে পারে। আর তারপরও যদি পাকিস্তান থাকে, তাহলে দেখবেন ভারতীয় মুসলিম যুবকেরা সেদিন ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয়ে তাঁদের হিন্দু ভাইদের সঙ্গে একইভাবে আনন্দে মেতে উঠবেন।
উপসংহারের পরিবর্তে
গত মার্চ মাসে একজন কমরেড আমার হাতে একটি প্রশ্নমালা তুলে দেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের সময় এই প্রশ্নমালা প্রচার করেছিল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। কমরেডটি অনুরোধ করেছিলেন ঐ প্রশ্নমালার এক ‘মুখের মতো’ প্রত্যুত্তর আমি যেন তৈরি করি। প্রশ্নগুলি ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পুরোনো সব অভিযোগের চর্বিতচর্বন – তাদের মতবাদ নাকি বিদেশী; ভারত ছাড়ো আন্দোলনে, দেশভাগের সময়, এমনকি জরুরি অবস্থার সময় তাদের ভূমিকা ইত্যাদি। বিদ্যার্থী পরিষদ অবাক হয়ে গিয়েছিল – সোভিয়েতের পতনের পর ভারতবর্ষে মার্কসবাদের আর কী প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে। কিন্তু কী অবাককাণ্ড! অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েই বিদ্যার্থী পরিষদ পেয়ে গেল মুখের মতো জবাব!
বিশ্ব বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় এই লড়াই স্পষ্টতই এক মতাদর্শগত মাত্রা অর্জন করে এবং আইসা-র কাছে পর্যুদস্ত হতে হয় বিদ্যার্থী পরিষদ-কে। এই বিজয় ছিল আইসা-র একক কৃতিত্ব, কেননা সিপিআই, সিপিআই(এম), জনতা দল, মুলায়ম এবং এমনকি প্রাক্তন নকশালপন্থীদের ছাত্রসংগঠনগুলিও আইসা-কে হারাতে উঠে পড়ে লেগেছিল। নৈনিতাল ও এলাহাবাদের ধারাবাহিকতাতেই আসে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় এবং তা সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।
এই সেদিনও সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিক বাহিনী মার্কসবাদের ‘মৃত্যুকে’ উল্লাসের সঙ্গে উপভোগ করেছেন এবং পশ্চিমবাংলা ও কেরলে তাঁদের বর্ধমান প্রভাবকে ঐ মৃত্যুর প্রমাণ হিসাবে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন। আজ কিন্তু উত্তর প্রদেশের বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্রগুলিতে মার্কসবাদের এই পুনরুত্থানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হয়। পাল্টা আক্রমণ হানার পক্ষে পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে ওঠে এবং সেখান থেকেই এই ধারাবাহিকের জন্ম।
দুঃখের কথা, সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক দর্শনের বিরুদ্ধে অধিকাংশ রচনাই এক উদারনীতিবাদী হিন্দু কাঠামোর মধ্যে আটকে থেকেছে : রামের মহিমাকীর্তন, হিন্দু সহিষ্ণুতা ও সর্ব ধর্ম সমভাবের বিষয়বস্তু এবং তারই পরিপূরক হিসাবে গান্ধী ও বিবেকানন্দের উদার হিন্দু ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা এবং সাম্প্রদায়িক বিবেকের কাছে আবেদন জানানো – ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের প্রচারের মূল ধারা এই খাতেই রয়েছে। ধর্মের ভূমিকা সম্বন্ধে এক নতুন উপলব্ধির কথা বলে বাম নেতৃবৃন্দও এর সুরে সুর মেলান। সিপিআই ও সিপিআই(এম) পন্থীদের কাছে যিনি খুব কাছের ছিলেন, সেই নেহরুও অপাংক্তেয় হয়ে পড়লেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বামেদের রচনায় নেহরুকে সরিয়ে তার স্থান গ্রহণ করেন গান্ধী। কপট ধর্মনিরপেক্ষতা আর কী হতে পারে!
হিন্দু রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী অন্তর্বস্তু তথা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির ব্যাপকতম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু একটি বাম কেন্দ্রকে নতুন করে সংহত করে তোলার বিষয়টি অবহেলিত থাকায় তা মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের পথকেই প্রশস্ত করে। একথা বলাই বাহুল্য যে, এক শাণিত প্রতি-আক্রমণ ছাড়া তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে সামগ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রচারই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দায়িত্ব নেবে? সেই দায়িত্ব একমাত্র মার্সবাদী-লেনিনবাদীদের উপরই বর্তায়।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের জনপ্রিয় প্রচার অভিযানে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম :
(ক) স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন হিন্দু প্রতীকের, বিশেষত রামরাজ্যের, ব্যবহার করার গান্ধীবাদী পদ্ধতির বিরুদ্ধে এবং একেই মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করি।
(খ) রাধাকৃষ্ণণ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্ব ধর্ম সমভাব হিসাবে যে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন – এবং যা সরকারি অবস্থান হয়েও দাঁড়ায় – তার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে ধর্মের প্রতি যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের নীতি কেবলমাত্র হতে পারে সর্ব ধর্ম বর্জিত।
(গ) রামের মতো একটি ধর্মীয় চরিত্রকে জাতীয় নায়ক হিসাবে তুলে ধরার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে এই মর্যাদা একমাত্র জননায়ক ভগৎ সিং-এরই প্রাপ্য।
(ঘ) দেশের ঐক্য রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে হিন্দু রাষ্ট্রকে তুলে ধরার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে, ইতিহাসের শিক্ষা যদি সত্যি হয় তবে হিন্দুরাষ্ট্র অবশ্যই ভেঙ্গে গিয়ে অসংখ্য রাজ্যের জন্ম দেবে। শিবসেনার মারাঠা রাষ্ট্রের বিকাশের যে লক্ষণগুলি দেখা যাচ্ছে তা এই বিষয়টিকেই দেখিয়ে দেয়।
(ঙ) ১৯৪২-এ তার ভূমিকা সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র পর্যায়ে আরএসএস-এর ভূমিকা, সমগ্র মুসলিম জনসংখ্যাকে পাকিস্তানে নির্বাসিত করতে হবে এই দাবি তুলে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া ও দেশ বিভাগকে তার সমর্থন এবং জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে তার দহরম-মহরমের বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে আরএসএস তার মতাদর্শগত প্রেরণা লাভ করেছিল এক বিদেশী মতাদর্শ, নাজিবাদ থেকে।
(চ) মুসলিম জুজুর কথা বলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায়ে আরএসএস তার নিজস্ব ধারায় ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত হতে না দিয়ে তাকে যেভাবে বিক্ষিপ্ত করেছিল তার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে, আজ আবার যখন নয়া-উপনিবেশবাদের বিপদ ঘনিয়ে আসছে তখন সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
(ছ) পাক বিরোধিতাকে ভারতবর্ষের বিদেশনীতির অক্ষ করে তোলার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার এক ইতিবাচক দ্বিপাক্ষিক সমাধান ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির পক্ষে অপরিহার্য। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ – এই তিন স্বাধীন রাষ্ট্রকে নিয়ে এক মহাজোট গড়ে তোলার প্রস্তাবও আমরা করি।
পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় আমরা দেখাই যে বুর্জোয়াদের সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল অংশ এবং জমিদার শ্রেণী ও উচ্চবর্ণের মধ্যে বিজেপির সামাজিক ভিত্তি, নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনে সাধু ও মহন্তদের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ, সমাজের সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত অংশটিকে নিয়ে করসেবকের রূপে এক জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলা, ইতিহাসকে বিকৃত করে তোলা, সংগঠিত অভিযানের মাধ্যমে ঘৃণা সৃষ্টি এবং বিদ্বৎ সমাজে যে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর ভুঁইফোড় বুদ্ধিজীবীর দল – এই সমস্তই মিলেমিশে তৈরি করেছে নির্ভেজাল ফ্যাসিবাদকে।
পুনশ্চ
বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করা হয়েছে। সমস্ত ধরনের গণতন্ত্রীরা সঠিকভাবেই দাবি করেছেন – ঐতিহাসিক ন্যায়ের স্বার্থে ঐ স্থানেই বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আদৌ সম্ভব বা বাস্তবসম্মত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
সেখানে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা একটা রামমন্দির রয়েছে। এবং যেভাবে রাও সরকার এগোচ্ছেন – ‘রাজনীতি থেকে ধর্মকে যোগচ্ছিন্ন করার’ কংগ্রেসী মার্কা পথ – এবং পিছন থেকে চন্দ্রস্বামী ও শঙ্করাচার্যদের মাধ্যমে কলকাঠি নাড়ছেন, তাতে রামমন্দিরের সম্ভাবনাই জোরালো হচ্ছে। কৃতিত্বটা শেষ পর্যন্ত কার কপালে জুটবে – কংগ্রেস না বিজেপি – সেটাই এখন দেখার।
সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিকেরা বারবার বলে এসেছেন, বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদ কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় বিরোধ নয়। তাঁদের মতে বাবরি মসজিদ যেহেতু এক জাতীয় অবমাননা, মুসলিম আগ্রাসন তথা হিন্দু ভারতবর্ষের উপর তাদের শাসনের প্রতীক, তাই এটি জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন।
তাহলে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের স্বার্থে ঐ স্থানে কেন একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা যাবে না? বাবরি মসজিদও নয়, রাম মন্দিরও নয়, ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের স্মৃতিতে একটা স্মৃতি সৌধ। এটা তো ঠিক অযোধ্যা ছিল ঐ বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র, আর তাই অযোধ্যার এক জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়ে তুললে ঐ ইতিহাসের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা যাবে।
হিন্দুত্ব যদি শুধু একটা ধর্ম না হয়ে তা যদি ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের এক সম্মিলিত সংস্কৃতি হয়, হিন্দুত্ব যদি ভারতীয়ত্বের সমার্থক হয় এবং জাতীয় অবমাননার প্রতীক হওয়ার জন্যই যদি বাবরি মসজিদকে ভাঙ্গা হয়ে থাকে, তবে জাতীয় গৌরবের এক স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলার ব্যাপারে সংঘ পরিবারের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সংঘ পরিবারের মহাজাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকপ্রবরেরা এই প্রস্তাবকে মেনে নিয়েই দেখুন না ‘জাতিদ্রোহী’ মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কী হয়। সর্বশ্রী মালকানি, গোবিন্দাচার্যের দল, আপনারা শুনছেন কি?
তা তাঁরা শুনুন বা না শুনুন, ধর্মনিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক শক্তির তরফে ঐ জায়গায় রামমন্দির গড়ে ওঠা ঠেকানোর জন্যই এই প্রস্তাবটিকে তুলে ধরা দরকার। ঐখানে রামমন্দির গড়ে উঠলে তা হবে ভারতীয় মুসলিমদের অবমাননা ও বিচ্ছিন্নতা বোধের এক চিরন্তন উৎস, আর এই কারণে জাতীয় বিভাজনের প্রতীক। একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের দাবিই আজকের পরিস্থিতিতে একমাত্র নীতিনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত দাবি। একটি জাতীয় বিপর্যয় ঠেকাতে গোটা দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজন হলে নানা রঙের কট্টরপন্থীদের বাধা সবলে অপসারিত করেই এগিয়ে আসতে হবে।