(লিবারেশন, আগস্ট ১৯৯৩ থেকে)

নারীমুক্তি আজও প্রায় সমগ্র দুনিয়ার নারী সমাজের স্লোগান। এর অর্থ সমগ্র মানবসমাজের অর্ধেক অংশ আজও পরাধীন। আমরা সর্বহারা মুক্তির কথা, কৃষক মুক্তির কথা, জাতীয় মুক্তির কথা বলে থাকি। জাতীয় মুক্তি বলতে আমরা মনে করি উপনিবেশবাদী শক্তিগুলির আর্থিক-রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। বিশ্বের অনেক দেশই মুক্তি অর্জন করেছে – অনেক দেশে মুক্তির সংগ্রাম চলছে। কৃষক মুক্তি হল সামন্ত-বন্ধন থেকে মুক্তি। অনেক দেশেই কৃষকরা মুক্তি অর্জন করেছেন এবং অন্য অনেক দেশে মুক্তির জন্য লড়ছেন। সর্বহারা মুক্তির অর্থ হল মজুরি-শ্রম থেকে মুক্তি। সর্বহারাও কয়েকটি দেশে এই লড়াই জিতেছেন এবং অন্যত্র তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মহিলারা জাতি, কৃষক, সর্বহারা প্রভৃতির অংশ হিসাবে এই সমস্ত লড়াইয়ে কম বেশি মাত্রায় অংশীদার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও নারীমুক্তি সংগ্রামের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, স্বকীয়তা আছে।

নারী মুক্তির কথা যখন উঠছে তখন স্পষ্টতই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে নারী পরাধীন, সে হল অন্যের গোলাম। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা পুরুষ দ্বারা, পুরুষের জন্য নির্মিত। পুরুষ কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া গোলামীর মুখ্য রূপ হল মহিলাদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখা ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা। সর্বহারা, কৃষক ও জাতি যেখানে বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করেই নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারেন, নারীমুক্তি সেখানে পুরুষদের বিনাশ নয় বরং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে।

অতীতে একসময় মহিলাদের গৃহস্থালীর কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হত, তখন সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে পরিচিত ছিল। ঐ সমাজে শ্রেণী বিভাজন ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ক্রমে ক্রমে চাষবাসের কাজে লোহার যন্ত্রপাতির প্রচলন হল। উদ্বৃত্ত শ্রমকে আত্মসাৎ করতে মানবজাতির এক অংশ অন্য অংশকে দাস অর্থাৎ সর্বহারাতে পরিণত করল। সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেল, ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হল। এ থেকে পুরুষতান্ত্রিকতারও বিকাশ হল এবং গৃহকর্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার অবনতি হতে থাকল। সর্বহারার গোলামী এবং নারীর গোলামী একই সময়ে এবং একই কারণে শুরু হয়েছিল। সেই কারণেই এই দুই অত্যাচারিতের আন্দোলনের মধ্যে বোধহয় এক স্বাভাবিক মিল রয়েছে। তাই দেখা যায় সর্বাহারা পরিবারেই মহিলারা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন।

নারীকে দাসত্ব স্বীকার করানোর জন্য পুরুষেরা কতরকম ধার্মিক রীতি-রেওয়াজ, সামাজিক সংহিতা তৈরি করেছে। হিন্দু সমাজে তো পতিকেই পরমেশ্বর করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই সমাজ পতির মৃত্যুর পর পত্নীকে সতী হওয়ার জন্য বাধ্য পর্যন্ত করেছে। আজ দুনিয়া অনেক পাল্টে গেছে। কারিগরী বিকাশ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে নারী-পুরুষের শারীরিক ক্ষমতার পার্থক্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অর্থহীন হয়ে গেছে। বেশি সংখ্যায় মহিলা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। নারীমুক্তি আন্দোলনেও মহিলারা অনেক সফলতা অর্জন করেছেন। আমাদের দেশেও অনেক আইন তৈরি হয়েছে, সংস্কার হয়েছে যা নারীমুক্তি আন্দোলনে নতুন গতি এনেছে।

সমানাধিকারের জন্য মহিলাদের সংগ্রাম আসলে এমন এক সমাজব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম যেখানে সমানাধিকার অর্জনের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজই সেই সমাজ, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণী বিভাজন ধ্বংস করবে; যেখানে নারীর প্রাথমিক পরিচয় সাংসারিক ভূমিকা নয়, সামাজিক ভূমিকার দ্বারা নির্ধারিত হবে; যেখানে সন্তান উৎপাদনের ওপর নারীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। তাই কমিউনিস্ট চিন্তাধারার পথ ধরেই নারীমুক্তি আন্দোলন তার অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। পশ্চিমী নারীবাদী আন্দোলন যখন বুঝতে পারল যে ইউরোপে সমাজবাদের পতন তাদের আন্দোলনকেও দুর্বল করেছে তখন সমাজবাদ ও নারীমুক্তির মধ্যকার অভিন্ন সম্পর্ককে তারা সামনে নিয়ে এল।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক তার কর্মসূচিতে আইনের চোখে ও বাস্তব জীবনে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সামাজিক সমানাধিকার; পতি-পত্নীর সম্পর্ক ও পারিবারিক আচরণ সম্পর্কিত নিয়মাবলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; মাতৃত্বকে সামাজিক কাজের মর্যাদা; শিশু ও কিশোর-কিশোরীর দেখাশোনা ও শিক্ষার দায়িত্ব সমাজের ওপর অর্পণ এবং নারীকে গোলাম বানিয়ে রাখে এরকম যাবতীয় চিন্তাভাবনা ও প্রথার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালানোর কথা ঘোষণা করেছিল।

নারীমুক্তি আন্দোলনে উপরোক্ত কর্মসূচি আজও আপনাদের সামনে মৌলিক দিশা হিসাবে রয়েছে।

১। মহিলাদের গোলাম বানিয়ে রাখে এরকম চিন্তাভাবনা ও প্রথার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। আজকের ভারতীয় পরিস্থিতিতে এটা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ সমজের সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ধর্মের আড়ালে নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চাইছে, পুরোনো সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। পিছন দিকে চলতে গিয়ে এমনকি সতীপ্রথার গুণগানও শুরু করেছে। আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত ভগবানই পুরুষের তৈরি যাদের বিশালকায় মূর্তির সামনে নারীকে ভীত ও ধর্মভীরু করে তোলা হয়। এমনকি দেবীদের আবিষ্কারও পুরুষেরাই করেছে। সবথেকে অকর্মণ্য পতিও নারীর কাছে পরমেশ্বর। কিন্তু নারীরূপে সম্মান পেতে হলে একজন মহিলাকে দেবী রূপ নিতে হবে। সমস্ত আচারসংহিতা পুরুষেরাই তৈরি করেছে এবং তাকে দৈবিক রূপ দিয়ে মহিলাদের তা মানতে বাধ্য করেছে।

২। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সামাজিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল আইন তৈরি করার জন্য যেমন আন্দোলন করতে হবে, তার থেকেও বেশি লড়াই করতে হবে এ ধরনের আইন কার্যকরী করার জন্য।

আইন যত প্রগতিশীলই হোক না কেন, আমলাতান্ত্রিকতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের জন্য তা নিজে থেকেই কার্যকরী হয়ে যাবে না। আমলাতান্ত্রিকতা ও সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রের এই সমস্যা এমনকি বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

৩। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মহিলাদের প্রেরণা যোগাবে কমিউনিস্ট নারী সংগঠন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে তাকে মহিলাদের সংগঠিত করতে হবে। গণআন্দোলন দমনের জন্য স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি বিশেষ করে মহিলাদের ওপর অত্যাচার নামাবে। ফলে ধাপে ধাপে মহিলাদের চেতনা ও লড়াকু মানসিকতার বিকাশ হবে এবং নারী আন্দোলন তখন রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে।

৪। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনকে শ্রমিক-কৃষকের গণআন্দোলনে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে মহিলাদের বেশি বেশি অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বড় সংখ্যায় মহিলাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলন প্রকৃত গণআন্দোলন হয়ে উঠতে পারে না। এই অংশগ্রহণ নারীমুক্তি আন্দোলনে বাধা দেয় না বরং মহিলাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে আস্থা বাড়িয়ে তোলে, পুরুষদের সাথে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়। নিজেদের পারিবারিক সম্পর্কে অজান্তেই এক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং এইভাবে নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

৫। মহিলাদের ছোটো-বড় সমস্ত ধরনের প্রতিবাদ, তা সে যে কোনো সংগঠনের পতাকাতলেই সংগঠিত হোক না কেন, কমিউনিস্ট নারী সংগঠন অবশ্যই সমর্থন করবে। আমাদের দেশে বুর্জোয়া নারীবাদী আন্দোলনেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয় এবং এখানে বামপন্থী সংগঠনগুলি তাদের স্বাভাবিক মিত্র হয়ে উঠতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে এই ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থী নারী সংগঠনের মোর্চা তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব এবং একান্ত জরুরি।

৬। কমিউনিস্ট নারী সংগঠন পতি-পত্নী সম্পর্ক ও পারিবারিক নিয়মের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য আওয়াজও তুলবে। রুশ বিপ্লবের পর ১৯২৪ সালে কমিন্টার্ন নিজের ঘোষণায় বলেছিল – “যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্কের বিধানে পরিবর্তন না হবে ততদিন বিপ্লব হয়ে থাকবে ক্লীব ও শক্তিহীন।” মুসলিম মহিলারা আজ পর্দার বাইরে এসে তালাকের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন। আপনাদের অবশ্যই ওঁদের সমর্থন করা উচিত। বিহারে গণতান্ত্রিক বিবাহের কথা আমার কানে এসেছে, যেখানে পুরোহিত থাকছে না, জাঁকজমক থাকছে না, খুব সাদাসিধেভাবে বিয়ে হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো কথা। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিবাহের অর্থ হল মহিলারা তাদের জীবনসাথী বেছে নিতে পারবেন এবং বিয়ের পরে পারিবারিক দায়িত্বে তাঁরা হবেন অংশীদার। কিন্তু এই ধরনের গণতান্ত্রিক বিবাহে তো দূরের কথা পার্টির মধ্যে তথাকথিত বিপ্লবী বিবাহের অধিকাংশতেও এই সমস্ত নীতিগুলি খুব কমই কার্যকরী হতে দেখা যায়।

৭। আজ পর্যন্ত মহিলাদের প্রগতির জন্য, বিভিন্ন সংস্কারের জন্য, মহিলাদের আন্দোলনের তুলনায় প্রগতিশীল পুরুষদের ভূমিকাই বেশি থেকেছে। কমিউনিস্ট নারী সংগঠনের বিশেষ দায়িত্ব হল এ বিষয়ে নারীদের ভূমিকা বাড়িয়ে তোলা, কারণ নারীর মুক্তি তাঁদের নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। এমনকি আমাদের পার্টিতেও মহিলা ক্যাডারের মর্যাদাহানির ঘটনা ঘটে থাকে। কিছু কিছু পুরুষ ক্যাডার দ্বারা সাধারণ মহিলাদের প্রতি অন্যায় আচরণের অনেক রিপোর্ট আসে। পার্টি সংস্থাগুলি এসব বিষয়ে পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। তবুও আমার মনে হয় কমিউনিস্ট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ধরনের বিষয়ে পার্টির ওপর নজর রাখা ও চাপ সৃষ্টি করার ভূমিকা পালন করতে হবে।

নারী-পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক পার্থক্য ছাড়া অন্য সব পার্থক্যই কৃত্রিম। ঐতিহাসিক বিকাশের একটি পর্যায় এই কৃত্রিম পার্থক্যগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, ঐতিহাসিক বিকাশের অন্য এক পর্যায় এই সমস্ত পার্থক্যগুলি শেষ করে দেবে। এই পর্যায়টি আসলে শুরুই হয়ে গেছে। মানব জাতির দুই রূপের মধ্যকার সম্পর্ক যখন সহজ, স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তখনই মানবজাতি তার হারিয়ে ফেলা অখণ্ড সত্তাকে আবার ফিরে পাবে। এই লক্ষ্যের দিকে যাত্রাপথ এমন এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাবে যার পতাকায় লেখা থাকবে ‘সমাজতন্ত্র ও নারীমুক্তি’।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টের পরিশিষ্ট থেকে)

পেশাদারী খুনীদের এই ভ্রাম্যমান সেনা ভোজপুরের ভূমিহার জাতের কাছ থেকে এবং বিহার জুড়ে, এমনকি উত্তরপ্রদেশেরও কোনো কোনো অংশে ছড়িয়ে থাকা এই জাতের লোকজনের কাছ থেকে খুবই জোরদার সমর্থন ভোগ করে আসছে। পার্টি-নির্বিশেষে বড় বড় সরকারি অফিসার এবং রাজনীতিবিদরাও একে মদত দিয়েছেন। ভোজপুরে রাজপুতদের কাছ থেকেও রণবীর সেনা কিছুটা সমর্থন পেয়েছে। কুলাকদের কৃষি-সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া তুলে ধরার অজুহাতে এবং প্রধানত কংগ্রেসের উদ্যোগে এর সূচনা হয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই এর নেতৃত্ব চলে যায় বিজেপির হাতে এবং এটি হয়ে দাঁড়ায় ভোজপুর থেকে মালে-কে নির্মূল করার ঘোষিত লক্ষ্যে মরীয়া এক সশস্ত্র বাহিনী। অন্তত শুরুর দিকে জনতা দলের নেতারাও এর সঙ্গে দহরম মহরম চালাচ্ছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধে যাদব কুলাকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ার দিকেও এরা বিশেষ নজর রাখে। আমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মোর্চার ব্যাপারও ১৯৯৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে সামনে চলে আসে, যখন দেখা যায় বিজেপি সমর্থিত সমতা প্রার্থী এবং কংগ্রেস ও জনতা দল প্রার্থী – সকলেই রণবীর সেনার সমর্থন আদায়ে রেষারেষি শুরু করেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে জনতা সাংসদ সেনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানান। এদের সকলের মধ্যেকার আঁতাত আবার প্রকাশ হয়ে পড়ে যখন বাথানিটোলা গণহত্যার পর ডিএম ও এসপি-র বদলির বিরুদ্ধে এরা যুক্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে। এ ব্যাপারে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর ভূমিকাও মোটেই ভালো ছিল না। তারা লাগাতার এই প্রচারই চালিয়ে যায় যে, মালে-র জাতপাতের রাজনীতি, মজুর আর চাষিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেখা এবং হঠকারী কার্যকলাপই রণবীর সেনার উত্থানের জন্য মূলত দায়ী।

পার্টির বিরুদ্ধে রণবীর সেনার প্রচারধারাতেও বিজেপির কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শোনা গেছে। তারা ভারতের সামাজিক বিন্যাস অর্থাৎ জাতপাতভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসকে ধ্বংস করতে উদ্গ্রীব বিদেশী শক্তি অর্থাৎ চীন ও পাকিস্তানের চর হিসাবে মালে-কে চিহ্নিত করে এবং কেবল ভোজপুর নয়, ভারতের মাটি থেকেই লাল পতাকা উৎখাত করার শপথ নেয়। তাদের প্রতীকের রঙও গৈরিক।

সশস্ত্র জমিদারদের হামলাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বেলাউরের বুকে কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে অবস্থানগত যুদ্ধ। লড়াকু মনোভাব তখনও তুঙ্গে। আরায় এক জবরদস্ত সমাবেশে আকাশ কাঁপানো স্লোগান ওঠে – ‘বিহটা-একোয়ারি ধ্বংস হল, এবার পালা বেলাউরের।’

পিছনের দিকে তাকিয়ে অনেক কমরেড মনে করেন, কেবল আত্মরক্ষার বদলে আমরা যদি বেলাউরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম, তবে হয়তো রণবীর সেনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করা যেত। একথা ঠিক যে, সেই সন্ধিক্ষণে আমরা ব্যাপারটির তাৎপর্য পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। বেলাউরের লড়াইকে আমরা একটি গ্রামের স্থানীয় ব্যাপার হিসাবে নিয়েছিলাম। আসলে কিন্তু জাতপাতভিত্তিক জোট বাঁধার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই সন্দেশ ব্লকের অনেক গ্রামে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল, এতকাল চুপচাপ থাকা সাহারের গ্রামগুলিতেও জমিদাররা সক্রিয় হয়ে উঠল। তারা যাকে তাকে খুন করতে লাগল। জনগণের শক্তিগুলি কিন্তু বাছাই করা লক্ষ্যেই আঘাত হানতে থাকে।

এরপর আসে ১৯৯৫-এর নির্বাচন এবং আমরা সাহার ও সন্দেশ উভয় আসনেই বিজয়ী হলাম। এইভাবে সর্বপ্রথম জমিদার ও কুলাকদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল। এই দুই ব্লক ঐতিহাসিকভাবে ভোজপুরে আমাদের সবচাইতে শক্তিশালী ঘাঁটি হলেও ১৯৯০-এর নির্বাচনে এখান থেকে আমরা জিততে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এই বিজয় জমিদার এবং আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলিকে মরীয়া করে তোলে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং আরাতে আমরা যে ‘মহাধর্ণা’ চালাচ্ছিলাম তাতে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। এতে একজন কমরেড নিহত ও আরও অনেকে আহত হন। এই ঘটনা শিশু ও মহিলাদের বাদ দিয়ে রণবীর সেনার সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্কযুক্ত ভূমিহার সহ সাধারণভাবে সমস্ত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার আহ্বানকে জাগিয়ে তোলে। একইদিনে রণবীর সেনার আটজন লোককে গণরোষের শিকার হতে হয়। হত্যা, পাল্টা হত্যা চলতেই থাকে, এবং এর পরিণতিতে ১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক আগে নারহিতে জনগণের বাহিনীর আক্রমণে ৯ জন রণবীর সেনা সমর্থক নিহত হয়। এই পর্যায়ে প্রশাসন আমাদের পার্টিকে নিষিদ্ধ করে ব্যাপক নিপীড়ন নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আমরা অবশ্য সাহার ও সন্দেশে আমাদের আধিপত্যকে মোটামুটি ধরে রাখতে সমর্থ হই।

ইতিমধ্যে সংঘাতের কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে বাথানিটোলা ও তার আশেপাশে কেন্দ্রীভূত হয়। “কারবালা”র জমি মুক্ত করা নিয়ে করপাহাড়ি ও নওয়াডিতে এক আন্দোলন শুরু হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় দুই প্রভাবশালী রাজপুত নেতা জনরোষের শিকার হয়। রণবীর সেনার সংগঠকরা ও বিজেপির রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের প্রিয় সাম্প্রদায়িক তাসকে কাজে লাগিয়ে রাজপুত ও ভূমিহারদের ঐক্যবদ্ধ করে। এটি শেষপর্যন্ত বাথানিটোলা গণহত্যায় পরিণতি লাভ করে। স্থানীয় জনগণের স্কোয়াডগুলি বাথানি, চৌরি এবং নিকটবর্তী অন্যান্য গ্রামগুলিতে ঐ ধরনের অনেক আক্রমণকেই প্রতিহত করেছিল। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর একটা ধারাও গড়ে উঠেছিল। বাথানিটোলায় দুর্ঘটনার দিন স্থানীয় স্কোয়াড আক্রমণকারীদের ঠেকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু একজন যোদ্ধা আহত হন (পরে তিনি মারা যান), গোলাগুলি ফুরিয়ে যায় এবং তাঁরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। কিছু বিভ্রান্তির জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে শক্তি এসে পৌঁছায় অনেক দেরীতে। বাথানিটোলার ঘটনায় আমাদের বিধায়ক রামেশ্বর প্রসাদের আমৃত্যু অনশন সহ এক শক্তিশালী রাজনৈতিক বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।

বাথানিটোলার গণহত্যা সত্ত্বেও জনগণ লড়াকু মেজাজেই ছিলেন। কিন্তু ভালোরকম বিভ্রান্তি থাকার জন্য দ্রুত ও তাৎক্ষণিক বদলা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক দিশাহীন পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে এবং সুসজ্জিত রণবীর সেনার সঙ্গে লড়াই করার জন্য উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।

রণবীর সেনার সশস্ত্র দলকে ধ্বংস করার জন্য একবার একটি দুঃসাহসিক প্রয়াস গ্রহণ করা হয়, কিন্তু তা পুরোপুরি সফল হয় না। জনগণের দিক থেকে বাছাই করা যে কোনো বদলার প্রতিক্রিয়ায় রণবীর সেনা নির্বিচারে বহু মানুষকে হত্যা করছিল। সুস্পষ্ট জাতপাতের মেরুকরণের দরুণ শত্রুর মধ্যকার খবর সংগ্রহের জাল পুরোপুরি অকেজো হয়ে থাকে, ফলে তাদের মূল সশস্ত্র দলটির গতিবিধি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট খবরাখবর সংগ্রহ করতে আমরা ব্যর্থ হই।

রণবীর সেনা ও তার সামাজিক ভিত্তি প্রচণ্ড উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং জনগণের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। ধাক্কার এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই কিছু বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জন্ম দিল। একটি নির্দিষ্ট মতামত ছিল এই যে, সাবর্ণদের (উচু জাতি) সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যকে চূর্ণ করার আমাদের স্লোগান এবং ব্যাপকভাবে উচ্চবর্ণের জমিদারদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তোলাই তাদের উঁচু মাত্রায় জাতভিত্তিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই মতামত অতিসরলীকরণ ও একপেশেপনার শিকার বলে মনে হয়। আমাদের স্লোগান ভোজপুরে বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করেছে। জোয়ালা সিং-এর নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের সমাবেশকে আমরা চূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি এবং এই স্লোগান সত্ত্বেও বিহটার রাজপুতদের কাছে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য করার আমাদের নীতিকে বারবার ব্যাখ্যা করে রাজপুতদের একটি ভালো অংশকে নিরপেক্ষ করতে আমরা সমর্থ হই।

বস্তুত, রণবীর সেনার বিষয়টি যখন দেখা দিতে শুরু করে তার আগেই আমরা আমাদের স্লোগানকে পরিবর্তিত করে সাম্প্রদায়িক-সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের (যা উচ্চবর্ণের সামন্তদের বিজেপির অনুকূলে সমাবেশিত হওয়ার রাজনৈতিক বিকাশকেই প্রতিফলিত করেছিল) বিরুদ্ধে চালিত করি। কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছিল এবং সেগুলির অবশ্যই কিছু ভূমিকা ছিল, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তা নির্ধারক হয়ে ওঠেনি। লিফলেট প্রকাশ করে আমরা ভূমিহারদের মধ্যে বিশেষ প্রচারাভিযান চালাই এবং শান্তি অভিযানের মাধ্যমে মধ্যবর্তী অংশটির সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছাই। আমরা আলোচনাসভাও সংগঠিত করি যাতে ভালোসংখ্যক ভূমিহার বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেন। সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভোজপুরের নির্ভীক কমরেডরা সংগ্রামে অবিচল থাকেন।

রণবীর সেনার আক্রমণাত্মক অবস্থা এখন এক স্থিতাবস্থায় পরিণত হয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে আমাদের উদ্যোগকে পুনরুদ্ধার করছি। কিন্তু তাদের মূল সশস্ত্র শক্তি এখনও অটুট এবং গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতাদের হত্যা করাই এখন তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। ঝামেলা পাকিয়ে তোলা এবং গণহত্যা সংগঠিত করার সামর্থ্য এখনও তাদের রয়েছে। কাজেই আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখে আমাদের আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে হবে। জেলা কমিটি বিস্তৃত আলাপ-আলোচনা এবং একের পর এক ক্যাডার সম্মেলনের মাধ্যমে রণবীর সেনার সঙ্গে সংগ্রামের সমগ্র প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করেছে, তার ঐক্যকে শক্তিশালী করেছে এবং বিজয় অর্জন পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর আগেও ভোজপুর অনেকবারই এটি করেছে এবং আরও একবার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছে।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

ভোজপুরে আজ তিন বছর ধরে রণবীর সেনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলছে। সব মিলিয়ে রণবীর সেনা ১৬২ জনকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে ৪ জন স্থানীয় স্কোয়াড কমাণ্ডার ও ৮ জন স্থানীয় সক্রিয় কর্মী সহ আমাদের ২০ জন পার্টি সভ্য রয়েছেন, ১৫ থেকে ২০ জন ছিলেন জনতা দল বা সমতা পার্টির সাথে যুক্ত এবং এর মধ্যে বড় সংখ্যকই রাজনীতিগতভাবে নিরপেক্ষ মানুষ, যারা নিহত হয়েছেন কেবলমাত্র তাঁরা দলিত বা পিছড়ে বর্গের পরিবার থেকে আসা বলে। তবে, রণবীর সেনার প্রধান সংগঠকরা বা প্রধান সশস্ত্র সেনাদল এখনো অটুট রয়েছে।

ভোজপুরে আমাদের ২৫ বছরের বেশি আন্দোলনে জমিদারদের নিজস্ব বাহিনীগুলির মধ্যে এই সেনা সবচেয়ে কুখ্যাত ও সবচেয়ে নিষ্ঠুর হিসাবে উঠে এসেছে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই রীতিমতো দীর্ঘস্থায়ী ও কঠিন হবে বলে প্রমাণিত হয়েছে। তারা কোনো শাস্তি ভোগ না করে মানুষজনকে হত্যা করেছে, আমাদের জনসমাবেশের উপর গ্রেনেড ছুঁড়েছে এবং এমনকি পার্টি অফিস আক্রমণ করেছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।

যেহেতু ভোজপুরে গ্রামীণ সর্বহারা ‘আত্ম সচেতন শ্রেণী’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সম্পূর্ণ প্রান্তিক অবস্থা থেকে তাঁদের পার্টি সিপিআই(এমএল)-এর পতাকাতলে জেলার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থল দখল করতে এগিয়ে এসেছে এবং যেহেতু তা জনতা দল ও ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাধান্যের পক্ষে বিপদ হয়ে উঠেছে এবং সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর মতাদর্শগত-রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে, তাই এই সেনা ও প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক অশুভ আঁতাত খুবই স্বাভাবিক। যেহেতু ভোজপুরের আন্দোলন রাজনৈতিক প্রাধান্যের জন্য গ্রামীণ গরিবদের শ্রেণী সংগ্রামকে ও নিপীড়িত জাতিগুলির সামাজিক সমতার গণআন্দোলনকে সামনে নিয়ে এসেছে, তাই সামন্ত শ্রেণী ও জাতিগুলি নির্দোষ নারী-শিশু নির্বিশেষে সর্বাপেক্ষা বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সহ গণসন্ত্রাসের কৌশল অবলম্বন করেছে। সামন্ত শ্রেণীগুলি সংগ্রামের যে রূপ গ্রহণ করেছে তা কোনো বিকৃতি নয়, বরং শ্রেণীসংগ্রামের গতি-প্রকৃতির দ্বারাই নির্ধারিত।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে, আমরা ঠিকই বাথানিটোলাকে এক বড় প্রচার-আলোড়নের বিষয় করে তুলেছিলাম, বিধানসভায় জঙ্গী ঘেরাও থেকে শুরু করে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক জনমতকে সমাবেশিত করি এবং শেষপর্যন্ত জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে বদলি করতে ও এক তদন্ত বসাতে সরকারকে বাধ্য করি। কিন্তু তৃণমূলে, রণবীর সেনার প্রধান সশস্ত্র দলকে চূরমার করে দেওয়ার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা যায়নি।

অসংখ্য গ্রামের জনগণকে সশস্ত্র করার ব্যাপারে আমরা প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছি। প্রতিরোধে সক্ষম জঙ্গী অংশ অনেক গ্রামে উঠে এসেছে। পার্টি তিনটি নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়েছে : (১) উন্নত ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে – এর পরিবর্তে পার্টি জোর দিয়েছে গেরিলা অ্যাকশনের পুরোনো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার উপরে, যাতে ঘরোয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও আরও উন্নত আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত শত্রুকে পরাজিত করা যায়, (২) প্রশাসনের উপর নির্ভরতার প্রশ্নে – এর পরিবর্তে আমরা জনগণের প্রতিরোধের ক্ষমতাকে বিকশিত করার উপরে জোর দিই এবং (৩) উচ্চতর কমিটির নির্দেশের উপর নির্ভরতার প্রশ্নে – এর পরিবর্তে আমরা কর্মনীতির প্রশস্ত কাঠামোর ভিতরে, বিশেষত দ্রুত বদলা নেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় উদ্যোগকে উন্মুক্ত করার উপর জোর দিয়েছি।

রণবীর সেনা শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে যাদবদের উপরও আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে যাদব কৃষক ও যুবকদের অংশবিশেষকে স্বপক্ষে জয় করে আনার মধ্য দিয়ে আমরা সামাজিক ভারসাম্যকে বদলে দিতে শুরু করেছি। এর ফলে কিছু সফল অ্যাকশন করা গেছে। আমরা ভূমিহারদের মধ্যেও আমাদের প্রচারকে বাড়িয়ে তুলেছি এবং এখন মনে হচ্ছে কিছু ফাটল বেড়ে চলেছে এবং তাদের মধ্যেকার সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে। আমরা রাজপুতদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র খোলা সযত্নে এড়িয়ে গেছি এবং এর ফলে তাদের অংশগ্রহণ নীচুগ্রামে থেকেছে। বন্যা ও অন্যান্য ত্রাণের বিষয়ে কিষাণসভা কর্তৃক গৃহীত সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগের ফলে ব্যাপক মাত্রায় সমাবেশ দেখা গেছে। আরা শহরের এক সাম্প্রতিক ঘটনায়, রণবীর সেনা কর্তৃক অপহৃত ৪ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয় এবং দুজন ‘রণবীর’কে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

স্থানীয় জনগণের স্কোয়াডগুলি ক্রমে ক্রমে তাঁদের আক্রমণ বাড়াচ্ছে। আর আজকাল রণবীর সেনারা প্রত্যাঘাতের ব্যাপারে আগের মতো দ্রুতগতি সম্পন্ন নেই। তবু, কাজের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা জাল বিকশিত করা এবং মূল পাণ্ডাদের হদিস খুঁজে বার করা এখনো অবহেলিত।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

(১) সারসংকলন করে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বহু এলাকায় জমির প্রশ্ন আজও কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে রয়েছে। তবে ভূমিসংস্কার কার্যকরী হওয়ার মাত্রা যেহেতু বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম, তাই ভূমিসংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধারণ স্লোগানও বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে।

(২) আহর, পুখর, তালাও ইত্যাদি ক্ষুদ্র সেচের উৎসগুলির উপর, নদী ও বালুচর প্রভৃতি সাধারণ সম্পত্তির উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সংগ্রামের এক প্রধান কর্মসূচি। সাধারণত, সামন্তশ্রেণীর লোকেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠী এগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ খাটায়।

(৩) মজুরি, পুরুষ ও নারীর জন্য সম কাজে সম মজুরি, উন্নত কাজের অবস্থা, বসতবাড়ি জমি ও পাকা বাড়ি ইত্যাদি সারা দেশ জুড়েই গ্রামীণ সর্বহারার মোটামুটিভাবে সাধারণ দাবি হিসাবে উঠে এসেছে। জমি ও মজুরির ক্ষেত্রে, পাট্টা যেন নারী-পুরুষ উভয়ের নামে হয়, তার দাবি করতে হবে।

(৪) পঞ্চায়েত ও ব্লক অফিসে গ্রামীণ গরিবদের রিলিফের জন্য বা ছোটো ও মাঝারি কৃষকদের উপকারের জন্য বরাদ্দ অর্থ দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসাররা শক্তিশালী জমিদার ও কুলাকদের – যারা আবার রাজনৈতিক ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রণ করে – সঙ্গে জোট বেঁধে আত্মসাৎ করে নেয় এবং দুর্নীতির এই সমস্ত ইস্যু জনসমাবেশ ঘটানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

(৫) জনজাতির প্রশ্ন – তা সে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন অথবা আসামের পার্বত্য জেলা ও অন্যান্য জনজাতি এলাকার সংগ্রাম কিংবা অন্ধ্রপ্রদেশের গিরিজন আন্দোলন ইত্যাদি যে কোনো আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন – আসলে কৃষক প্রশ্ন ছাড়া কিছুই নয়। আর এই কারণেই, সুদখোর-ব্যবসায়ীদের দ্বারা তাদের জমি হরণ তথা বনের জমি ও বনজ সম্পদের ওপর তাদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে রয়েছে।

(৬) যেখানেই আন্দোলন তীব্রতা অর্জন করে সেখানেই জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী বা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলির গুণ্ডাবাহিনী পার্টির নেতা ও ক্যাডারদের খুন করে ও জনগণের গণহত্যা সংগঠিত করে। অবধারিতভাবে এর সঙ্গে নেমে আসে পুলিশী অত্যাচার।

(৭) নৈরাজ্যবাদী সংগঠনগুলি অর্থ সংগ্রহের যন্ত্রে অধঃপতিত হয়েছে এবং আমাদের ক্যাডার তথা জনগণের ওপর একের পর এক হত্যালীলা চাপিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের সন্দেহজনক যোগসূত্রগুলি এবং সংগঠিত গণআন্দোলন ধ্বংস করার তাদের নোংরা উদ্দেশ্য আড়াল করতে তারা পুরোদমে অতি-বাম বুলি আউড়ে চলেছে।

নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিশেষ মনোযোগ দাবি করে :

(ক) আমরা মনে করি, কৃষি-পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফারাকের দরুণ সর্বভারতীয় স্তরে সাধারণ কৃষক আন্দোলন ও একটি সুসংহত কৃষক সংগঠনের বিশেষ কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকছে না। অভিজ্ঞতা বিনিময় ও মাঝে মাঝে কর্মনীতি সংক্রান্ত ঘোষণা এবং সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি সংগঠিত করার জন্য একটি সর্বভারতীয় সমন্বয় কাঠামো থাকাই যথেষ্ট। এমনকি রাজ্যগুলিতেও কিষাণ সভার জেলা বা আঞ্চলিক স্তরের কাঠামোকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে হতে পারে, কারণ বড় বড় রাজ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ভিন্নতা দেখা যায়। ব্যাপক কৃষকদের সমাবেশিত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দাবি ও এলাকাভিত্তিক কৃষক সংগঠন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কিষাণ সভার সাংগঠনিক কাজকর্ম শক্তিশালী করার দিকেও যথোপযুক্ত মনোযোগ দিতে হবে। অনেক জায়গায় কৃষকদের মধ্যে আমাদের প্রভাবের তুলনায়, এমনকি আমাদের কর্মসূচিগুলিতে যত মানুষ সামিল হন সেই তুলনায়, কিষাণ সভার সদস্যসংখ্যা অনেক কম রয়েছে। কিষাণ সভা সংগঠনের সক্রিয় উদ্দীপনার, এমনকি শত্রুর অত্যাচারের মধ্যেও এই সক্রিয়তা ধরে রাখার চাবিকাঠি রয়েছে গ্রাম কমিটির সজীব কার্যকলাপের মধ্যে। তাদের উচিত নিয়মিতভাবে কৃষক সমিতির গ্রামস্তরের সাধারণ সভা আহ্বান করে আন্দোলনের সমস্যাগুলি আলোচনা করা, সদস্যপদ নবীকরণ, এমনকি নতুন সদস্য গ্রহণের কাজও সাধারণ সভাতেই করা উচিত। গ্রাম কমিটিগুলিকে জনগণের ক্ষমতার স্থানীয় সংস্থা হিসাবে গড়ে তোলার পরিপ্রেক্ষিত থেকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় মিলিশিয়াকে প্রশিক্ষিত করা ও গ্রামীণ আত্মরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার কাজ পরিকল্পিতভাবে হাতে নিতে হবে।

মামলাগুলি দেখাশোনা করার জন্য একটি আইনি সেল ও জেলের কমরেডদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য একটি বিশেষ দল গড়ে তোলা প্রয়োজন।

যেখানেই সম্ভব, কিষাণ সভা সংগঠনের মধ্যে মহিলা সেল গঠন করা উচিত।

জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলিতে প্রথমেই পার্টির সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে স্থানীয় কিষাণ সভার শাখাগুলি সেগুলি অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে মীমাংসা করতে পারে। অন্যথায় বিক্ষুব্ধ অংশের দ্বারস্থ হওয়ার মতো আর কোনো কর্তৃপক্ষস্থানীয় কেউ থাকছেন না এবং এর ফলে তাঁদের বিচ্ছিন্নতা ঘটতে পারে। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলি বা রণবীর সেনার মতো শক্তিশালী এই ধরনের দ্বন্দ্বগুলি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে রীতিমতো ওস্তাদ। সুতরাং জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলিকে অবশ্যই বিচক্ষণতার সাথে ও যত্ন সহকারে এবং কিষাণ সভার মাধ্যমে মীমাংসা করতে হবে।

(খ) কৃষি শ্রমিকদের বিষয়টি অবশ্য কেবল কৃষিক্ষেত্রেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁদের জন্য এক কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়নের দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছে। উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের অধীনে কৃষিতে ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়া তা সে যে ধরনেরই হোক না কেন, কৃষি শ্রমিকদের বিষয়টিকে আরও সামনে ঠেলে দেবে।

তদুপরি, মধ্যম জাতের অংশসমূহ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী হিসাবেও উঠে আসছে, কৃষক আন্দোলন কেবল ক্রমবর্ধমানভাবে পুঁজিবাদী চাষি ও ধনী কৃষকদের ব্যাপকতর অংশের সম্মুখীনই হতে পারে। কৃষি শ্রমিকদের আন্দোলন, অতএব, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা বহন করবে। ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে, একটি কৃষি শ্রমিক সংগঠন চালু করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ও বিষয়টির গভীর অধ্যয়নের জন্য আমাদের একটি প্রস্তুতি কমিটি সংগঠিত করতে হবে।

(গ) যখন আমরা বিভিন্ন বেসরকারি সেনার সঙ্গে শক্তিক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি তখন কৃষক সমিতির কার্যকলাপ ও কৃষকদের ইস্যুগুলি নিয়ে আন্দোলন পিছনে চলে যায়। একথা ঠিক যে, এই পরিস্থিতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং এটি এড়িয়ে যাওয়ার বিশেষ কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কৃষক সমিতির সক্রিয়তা কীভাবে ধরে রাখা যায় – এটিও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর সমাধান আমরা এখনও বের করতে পারিনি। সেনার সঙ্গে সংঘাতে একটু ফাঁক পেলেই কৃষি আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা আমরা অনেকবার করেছি, কিন্তু এজন্য যথাযথ ব্যবস্থা বা মাধ্যম গড়ে তোলা যায়নি। মনে হয় কৃষক সমিতির রাজ্য নেতৃত্বের উদ্যোগ এরকম সন্ধিক্ষণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর নির্দিষ্ট দাবিভিত্তিক সংগঠনও এরকম পরিস্থিতির মোকাবিলায় খুবই সহায়ক হতে পারে।

(ঘ) গত কয়েক বছরে আমরা যে একের পর এক গণহত্যার সম্মুখীন হয়েছি তা পার্টির ভেতরে ও বাইরে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সবচাইতে সরলীকৃত ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছে নৈরাজ্যবাদীরা এবং সংবাদ মাধ্যমের নিরাপদ জগতে থাকা বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকাররা। তাঁদের মতে, সিপিআই(এমএল) সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে সংসদীয় সংগ্রাম ধরেছে বলেই জমিদাররা ১৯৭০ দশকের বদলা নিচ্ছে, অর্থাৎ ২৫ বছর আগেকার খতমগুলির বদলা নিচ্ছে। এটি একেবারেই অর্থহীন, দূরভিসন্ধিমূলক ও সবচেয়ে অবাস্তব মনোগত চিন্তার প্রকাশ।

মার্কসবাদী হিসাবে আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, নতুন ধরনের বেসরকারি সেনার উদ্ভব ও পরপর গণহত্যার ব্যাপার বর্তমান রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। একটু গভীরে অনুসন্ধান করলেই সহজে দেখা যাবে – বেসরকারি বাহিনীগুলির কাজকর্ম মূলত সেইসব এলাকাতেই তীব্রতা পেয়েছে ও কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যেখানে আমরা প্রধান শাসক পার্টিগুলির প্রতি সংসদীয় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পেরেছি। ভোজপুরের সাহার ও সন্দেশ আর সিওয়ানের মেরোয়াঁ ও দরৌলি এরকমই এলাকা এমনকি বিষুণগড়ে জেএমএম (মার্ডি) গোষ্ঠীর মদতে এমসিসি-র হত্যাকাণ্ড এবং চাতরায় যে অংশটি বারাচট্টির ঠিক পাশে সেখানে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মদতে এমসিসি-র গণহত্যা আসলে আমাদের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে দুর্বল করার সুচতুর পদক্ষেপ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ এ দুটি নির্বাচনী কেন্দ্রেই আমরা যথাক্রমে জেএমএম (মার্ডি) ও আরজেডি-র সামনে সম্ভাব্য বিপদ হয়ে উঠেছি। চাতরায় গণহত্যার কয়েকদিনের মধ্যেই বারাচট্টিতে এমসিসি-র অভিযান এবং মালে ছেড়ে দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি তাদের হুমকি একথাই আরও স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এর ঠিক পরেই সিপিআই(এমএল)-এর সংশ্রব ত্যাগ করার জন্য বারাচট্টিতে আরজেডি প্রচার চালায়। বগোদরকে টার্গেট করাও এই সামগ্রিক পরিকল্পনারই অঙ্গ।

প্রশাসনযন্ত্রের সক্রিয় সহযোগিতায় বেসরকারি সেনাগুলিকে গণহত্যা সংঘটিত করতে দেওয়ার পর লালু যাদব সেখানে ক্ষতিপূরণ হাতে পৌঁছে যান। মানুষকে তিনি বলে অস্ত্র হাতে তুলে নিও না, পড়াশোনায় মন দাও, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘাতক আর পুরোহিত এইভাবেই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যবাদীরা আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে যতই সমস্যার সৃষ্টি করুক না কেন, শাসকশ্রেণীগুলির রাজনৈতিক আধিপত্যের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ তারা ছুঁড়ে দেয় না। ১৯৭০ দশকে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান ছিল সুতীব্র বিপ্লবী অগ্রগতির প্রকাশ আর ১৯৯০ দশকে তা অধঃপতিত হয়েছে চরম সুবিধাবাদী বিশ্বাসঘাতকতায়। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবেই বিষয়গুলি তাদের দ্বান্দ্বিক বিপরীতে রূপান্তরিত হয়। নির্বাচন বয়কটের স্লোগান এই গোষ্ঠীগুলিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে নিতে ধূর্ত বুর্জোয়া রাজনীতিকদের সুবিধা করে দিয়েছে। নির্বাচনে জনতা দল প্রার্থীদের জন্য এমসিসি ও পিইউ ক্যাডাররা সক্রিয়ভাবে ভোট জোগাড় করছেন – এমন অনেক নিদর্শন আছে।

এছাড়া এও সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার যে আমরা সশস্ত্র প্রতিরোধ ছেড়ে দিয়েছি। ঘটনা হল, জনগণকে সশস্ত্র করার ব্যাপার যে কোনো সময়ের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির এতগুলো বছর ধরে বিহারে শত শত গ্রামে নিয়মিত গুলি বিনিময় ঘটে চলেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে সমগ্র জেলা নেতৃত্ব সহ গোটা রাজ্য জুড়ে আমাদের হাজার হাজার কমরেডের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে প্রতিরোধ সংগঠিত করার অপরাধে। প্রায় গোপন অবস্থাতেই এঁদের কাজ করে যেতে হচ্ছে।

এককথায় আমাদের পশ্চাদপসরণ নয় বরং যথাস্থিতির শক্তিগুলির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করে এক বড় শক্তি হিসাবে আমাদের অগ্রগতিই আমাদের ওপর এইসব তীব্র আক্রমণের আসল কারণ। একথা কখনও ভোলা উচিত নয় যে, রাজনৈতিক উদ্যোগ, জনপ্রিয় ইস্যুতে আন্দোলন এবং গণপ্রতিরোধ – এগুলিই হল সামন্তশক্তি-রাষ্ট্রশক্তির মিলিত আক্রমণ মোকাবিলা করার প্রধান উপাদান। যে কোনোভাবেই এই সেনা বা সেই সেনাকে শেষ করে দেওয়াই বড় কথা নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, জনগণের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করা, সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাসে পরিবর্তন নিয়ে আসা এবং এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপকতম গণসমাবেশ সুনিশ্চিত করা। অন্যথায় আমরা নিছক একটি জঙ্গী গোষ্ঠীতে পরিণত হব। তবে দীর্ঘায়ত সশস্ত্র সংঘর্ষ যেহেতু বিহারে কৃষক আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, পার্টিকে তাই নিজের প্রস্তুতির দিকটি বাড়িয়ে তুলতে হবে। বিশেষত শত্রুকে নির্ধারক আঘাত হানা কঠিন গুরুত্বপূর্ণ এবং সে জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র দলকে উচ্চতর স্তরে সংগঠিত করা।


(দুটি অংশে লিবারেশন-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং নভেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যায় প্রকাশিত)

আমাদের কৃষিবিপ্লব তিনটি বুনিয়াদী প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে রয়েছে :

(১) এটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অঙ্গ এবং এই বিপ্লবের মর্মবস্তু হল সামন্ত অবশেষের কবল থেকে গ্রামাঞ্চলকে মুক্ত করা।

(২) আর্থ-সামাজিক দিক থেকে এই কৃষিবিপ্লব হল বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লব পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদী শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিকাশকে দুর্বল না করে তাকে বরং শক্তিশালী করবে।

(৩) কমিউনিস্টদের অবশ্যই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এই বিপ্লবকে সমর্থন করতে হবে এবং নেতৃত্ব দিতে হবে। আর নির্দিষ্ট কিছু প্রতিশ্রুতির মধ্যে আটকে না পড়ে সামন্ত অবশেষের আমূল দূরীকরণের লক্ষ্যে, অর্থাৎ অন্য কথায় সর্বোচ্চ বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কার অর্জনের লক্ষ্যে তাদের আশু দাবিগুলি সূত্রবদ্ধ করতে হবে।

কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচির দিশার প্রশ্নে লেনিন প্রায়শই কাউটস্কির একটি বক্তব্যকে সঠিক বলে উদ্ধৃত করেছেন :

“শুধু বর্তমান মুহূর্তের জন্যই কমিউনিস্ট কর্মসূচি রচিত হয় না, বর্তমান সমাজের সমস্ত সম্ভাবনাকেই তার যথাসম্ভব মাথায় রেখে চলা উচিত। শুধুমাত্র ব্যবহারিক কাজকর্মই নয়, প্রচারের কাজেরও দিকনির্দেশ করবে কর্মসূচি। কোনও অলীক স্বর্গলোকের কল্পনা না করে, আমরা যে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারি তা কোনও বিমূর্ত কর্মসূচির চেয়ে যত বেশি জীবন্তভাবে কিছু নির্দিষ্ট দাবি সূত্রায়নের মাধ্যমে এই কর্মসূচিতে তুলে ধরা যায় ততই ভালো। তাহলেই আমরা কোনদিকে এগোচ্ছি তা জনগণের কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, এমনকি তাঁদের কাছেও স্পষ্ট হবে যাঁরা আমাদের তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত ঠিক ধরতে পারেন না। বর্তমান সমাজ বা বর্তমান রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা কী আশা করি তা নয়, কর্মসূচি তুলে ধরবে তাদের কাছ থেকে আমরা কী দাবি করি সেটাই।”

কৃষিবিপ্লবের প্রস্তাবনা এবং কমিউনিস্ট কর্মসূচির দিশার প্রশ্নগুলির মীমাংসার পর উন্নত দেশগুলির বিপরীতে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলির, অর্থাৎ যেখানে কৃষিক্ষেত্রে সামন্ত অবশেষগুলি এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী সেইসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কৃষি কর্মসূচির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য উপলব্ধি করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

আর একবার লেনিনকে উদ্ধৃত করা যাক : “পশ্চিমে কৃষি কর্মসূচিগুলি রচিত হয় বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধা-কৃষক, আধা-শ্রমিকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে; আর আমাদের মতো দেশে ঐ কর্মসূচির লক্ষ্য হল ভূমিদাস ব্যবস্থার অবশেষের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কৃষক জনগণকে সমাবেশিত করা। সুতরাং পশ্চিমে কৃষিতে পুঁজিবাদ যত বিকাশলাভ করবে কৃষি কর্মসূচির গুরুত্ব ততই বৃদ্ধি পাবে। আর কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে আমাদের কৃষি কর্মসূচির, অন্তত তার অধিকাংশ দাবির, গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকবে, কারণ যে ভূমিদাস প্রথার অবশেষের বিরুদ্ধে এই কর্মসূচির বর্শামুখ নিবদ্ধ তা কালের গতিতে স্বাভাবিকভাবেই তথা সরকারি নীতির ফলশ্রুতিতে অবলুপ্তির পথে চলেছে।”

এই পরিস্থিতি কমিউনিস্টদের সামনে দুটি বিকল্প হাজির করে, যার দরুণ তারা বিপ্লবী এবং সুবিধাবাদী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুবিধাবাদী অংশ স্বতস্ফূর্ততার ওকালতি করে এবং দ্রুততর গতিতে অগ্রসর হওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার অজুহাতে এমনকি তার লেজুড়ে পরিণত হয়। কেউ কেউ এমনকি কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্যোগী কৃষিজীবীতে পরিণত হওয়ার কথা বলেন, এইভাবে কমিউনিস্ট শিবির ত্যাগ করে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির পৃষ্ঠপোষকতায় ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সমাজসংস্কারের অরাজনৈতিক পথে পা বাড়ান।

অপরদিকে বিপ্লবী অংশ সামন্ত অবশেষের দ্রুত ও আমূল দূরীকরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিজের আয়ত্তে আনার তথা কৃষক জনগণকে সমাবেশিত করার জন্য এক বিপ্লবী কৃষি কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়ায়।

এখানে একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে গ্রামাঞ্চলে সামন্ত সম্পর্কের অবশেষগুলি প্রায়শই পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কৃষকরা, এমনকি ছোটো কৃষকরাও, বিভিন্ন মাত্রায় বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। আর এক্ষেত্রে ঋণ, ভর্তুকি, কৃষি উৎপাদন ক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়। এই কারণেই রাজনৈতিক রদবদলের সময় প্রায়শই দেখা যায় যে ঋণ মকুব ইত্যাদি কিছু কিছু ছাড় ঘোষণা করে সরকার কৃষকদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে, তাঁদের বিপ্লবী মানসিকতাকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি সামান্য বা নগণ্য ছাড় এবং সেগুলিও পেয়ে থাকেন সামান্য কয়েকজন ছোটো জমির মালিক। কৃষকদের মধ্যকার রক্ষণশীল অংশের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া যতই গভীর হবে, কৃষকদের বিপ্লবী অংশকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমাদের দাবিগুলিও হয়ে উঠবে ততই বিপ্লবী। সামান্য যা কিছু ছাড় আদায় করা যাবে তা অবশ্য আমরা ছেড়ে দেব না।

কৃষক শ্রেণীর কেন্দ্রীয় দাবি সম্পর্কে বলতে গেলে, জমির সার্বিক পুনর্বণ্টনের কথাই সবার আগে আসে। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে কৃষক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাদের, অর্থাৎ যাঁরা শ্রমিকদের বদলে কৃষকদেরই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারক ও বাহক হিসাবে গণ্য করেন তাঁদের কাছেও এই দাবি একটি সমাজতান্ত্রিক দাবি। তাঁদের ধারণায় জমির সার্বিক পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষক উৎপাদনকে সাধারণীকরণ করা যায় এবং স্থায়ী রূপ দেওয়া যায়। কৃষক সমাজতন্ত্রের এই প্রতিক্রিয়াশীল অলীক ধারণাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আমরা মনে করি সার্বিক পুনর্বণ্টন পুঁজিবাদ, কৃষকদের মধ্যে বিভাজন ও শ্রেণীদ্বন্দ্বগুলিকেই সাহায্য করবে। তা সত্ত্বেও এই দাবি আমরা সমর্থন করি কারণ এর মধ্যে এক কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে সমস্ত সামন্ত অবশেষ নির্মূল করার বিপ্লবী উপাদান নিহিত রয়েছে।

প্রথমেই এটা স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে জমির জাতীয়করণের অর্থ বস্তুত রাষ্ট্রের হাতে খাজনার হস্তান্তর। এর সঙ্গে ‘চাষ করে যে জমি তার’ – এর সাধারণ গণতান্ত্রিক শ্লোগানের কোনো বিরোধ নেই। জমির পুনর্বণ্টন ও জাতীয়করণ – উভয় ক্ষেত্রেই যে চাষ করে তার কাছেই জমি হস্তান্তরিত হয়। মূল প্রশ্ন মালিকানার রূপের সঙ্গে জড়িত। প্রথম ক্ষেত্রে মালিকানা ন্যস্ত হয় কৃষকদের হাতে, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হাতেই জমির মালিকানা থাকে। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কৃষকদের জমি লিজ দেয়। জমির জাতীয়করণ হলে কৃষক ও রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীর বিলোপ ঘটে।

জমির জাতীয়করণকে প্রায়শই কৃষি উৎপাদনের সমাজতান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। সমাজতান্ত্রিকীকরণে শুধুমাত্র জমিই নয়, উৎপাদনের সমস্ত উপকরণেরই জাতীয়করণ করা হয় এবং বড় বড় রাষ্ট্রীয় খামারে যৌথভাবে চাষবাস সংগঠিত হয়। স্পষ্টতই আমরা বলছি জমির বুর্জোয়া জাতীয়করণের কথা, যা সমস্ত ধরনের সামন্ত অবশেষকে নির্মূল করবে, চাষবাসকে সবচেয়ে যুক্তিসম্মতভাবে সংগঠিত করবে এবং এইভাবে পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে।

পুঁজিবাদ অনিবার্যভাবেই পুরোনো সামন্ত ভূ-মালিকানার পরিবর্তন ঘটায়। তবে বিভিন্ন দেশে তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ঘটে থাকে।

জার্মানিতে ভূ-মালিকানার মধ্যযুগীয় রূপের পরিবর্তন ঘটে সংস্কারবাদী পথে। সামন্ত তালুকগুলি ক্রমশ যুঙ্কার (Junker) সম্পত্তিতে পরিবর্তিত হয়। ইংল্যান্ডে এই রূপান্তর ঘটে হিংসাত্মক বিপ্লবী পথে। কিন্তু এই হিংসা ব্যবহৃত হয় ভূস্বামীদের স্বার্থে – কৃষক জনগণকে করের বোঝায় নিঃস্ব করে তাঁদের বাস্তুচ্যুত করা হয়।

আমেরিকার দক্ষিণী রাজ্যগুলির দাস খামারগুলিতে এই রূপান্তর সহিংস পথেই ঘটে। এক্ষেত্রে দাসমালিক জমিদারদের বিরুদ্ধেই হিংসা পরিচালিত হয়। তাদের জমিদারী তালুকগুলি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। বিরাট সামন্ত জমিদারীর জায়গায় গড়ে ওঠে ছোটো ছোটো পুঁজিবাদী খামার।

কেবলমাত্র পুঁজিবাদের বিকাশের উচ্চ পর্যায়েই জাতীয়করণ সম্ভব – এই ধারণাকে লেনিন বারংবার খণ্ডন করেছেন।

লেনিন বলেছেন, “তত্ত্বগত দিক থেকে জাতীয়করণ হল কৃষিতে পুঁজিবাদের ‘আদর্শ’ বিশুদ্ধ বিকাশ। জাতীয়করণকে বাস্তব করে তোলার জন্য পুঁজিবাদী সমাজে শর্তাবলী ও শক্তিসমূহের সম্পর্কের যে সমন্বয় প্রয়োজন সেই পরিস্থিতি ইতিহাসে বারবার আসে কিনা তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। তবে জাতীয়করণ পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশের কেবল প্রতিশ্রুতিই নয়, তার শর্তও বটে। কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশের অত্যন্ত উচ্চস্তরেই কেবল জাতীয়করণ সম্ভব – এমন মনে করার একমাত্র অর্থ হল বুর্জোয়া প্রগতির উপায় হিসাবে জাতীয়করণকে নাকচ করা; কারণ কৃষিতে পুঁজিবাদের উচ্চতর বিকাশ সর্বত্রই ‘কৃষি উৎপাদনের সামাজিকীকরণ’ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে আশু কর্মসূচি হিসাবে হাজির করেছে (এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে অন্যান্য দেশেও যথাসময়ে তা করবে)। সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যে সংগ্রাম যখন তীব্রতর হয়ে ওঠে, সে রকম পরিস্থিতিতে কোনো বুর্জোয়া পদক্ষেপকেই বুর্জোয়া প্রগতির পদক্ষেপ বলে ভাবা যায় না। এ ধরনের পদক্ষেপের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে সেই সমস্ত ‘নবীন’ পুঁজিবাদী দেশে যার শক্তির বিকাশ বিশেষ ঘটেনি, যার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহ এখনও পূর্ণ বিকশিত হয়নি এবং সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠার মতো শক্তিশালী এক সর্বহারা যেখানে গড়ে ওঠেনি। আর শুধুমাত্র ১৮৪৮-এর জার্মানিতে বুর্জোয়া বিপ্লবের যুগেই নয়, ১৮৪৬-এর আমেরিকার ক্ষেত্রেও মার্কস জমির জাতীয়করণের সম্ভাবনা মেনে নিয়েছেন, এমনকি কখনও কখনও সরাসরি তার ওকালতি করেছেন। অথচ মার্কস নিজেই অত্যন্ত সঠিকভাবে দেখিয়েছেন যে সেই সময়ে আমেরিকায় শিল্প বিকাশ সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে জমির জাতীকরণের কোনো বিশুদ্ধ রূপের দৃষ্টান্ত আমরা পাই না। নবীন পুঁজিবাদী গণতন্ত্র নিউজিল্যান্ডে এর অনুরূপ কিছু আমরা প্রত্যক্ষ করি, যেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদের উন্নত বিকাশের কোনো চিহ্ন নেই। আমেরিকার সরকার যখন বাস্তুজমি আইন (Homestead Act) চালু করে এবং নামমাত্র খাজনায় ক্ষুদে কৃষকদের জমি বিতরণ করে তখন সেখানকার অবস্থাও ছিল অনেকটা একইরকম।” (লেনিন, সমাজগণতন্ত্রের কৃষি কর্মসূচি)

মার্কস কখনই কৃষিতে পুঁজিবাদের অনুন্নত পর্যায়কে জাতীয়করণের পথে বাধা মনে করেননি। তাঁর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে মার্কস বলেছেন যে পুঁজিবাদী উৎপাদনে জমির মালিক নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়, রাষ্ট্রের হাতে জমি থাকলেই পুঁজিবাদী উৎপাদনের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে সিদ্ধ হয়।

তত্ত্বগতভাবে একজন চরমপন্থী বুর্জোয়া যদিও জমির ওপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান কামনা করে, বাস্তবে কিন্তু সে জাতীয়করণকে ভয় পায়। মার্কস এর দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

প্রথমত একজন চরমপন্থী বুর্জোয়া ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির ওপর আঘাত হানতে সাহস পায় না সমস্ত ধরনের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর সমাজতান্ত্রিক আঘাত, অর্থাৎ এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভয়ে।

দ্বিতীয়ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উৎপাদনের বুর্জোয়া ধরন ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে, অর্থাৎ এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি সামন্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি বুর্জোয়া চরিত্রসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। শ্রেণী হিসাবে বুর্জোয়ারা যেখানে ইতিমধ্যেই “নিজেদের জমিভিত্তিক করে তুলেছে”, “জমিতে আস্তানা গেড়েছে”, ভূসম্পত্তিকে নিজেদের অধীনস্থ করেছে, সেখানে জাতীয়করণের সপক্ষে বুর্জোয়াদের দ্বারা কোনো যথার্থ সামাজিক আন্দোলন সম্ভব নয়। কারণটি সহজবোধ্য, কোনো শ্রেণীই নিজের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না।

রাশিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনিন অবশ্য বলেছেন, “সমস্ত দিক থেকে রাশিয়ার বুর্জোয়া বিপ্লব বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমাদের অবশ্যই রাশিয়ার সর্বাধিক সামন্ত অবশেষের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে শিল্পে তুলনামূলকভাবে বিকশিত পুঁজিবাদ ও গ্রামাঞ্চলের ভয়াবহ পশ্চাদবর্তিতার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে এবং বস্তুগত কারণেই বুর্জোয়া বিপ্লবকে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী করে তোলে ও কৃষির অত্যন্ত দ্রুত বিকাশের শর্ত সৃষ্টি করে। জমির জাতীয়করণই হল আমাদের কৃষিতে দ্রুত পুঁজিবাদী অগ্রগতির অন্যতম শর্ত। রাশিয়াতে এক “চরমপন্থী বুর্জোয়াশ্রেণী” রয়েছে যারা এখনও নিজেদের  “জমিভিত্তিক” করে তোলেনি, যাদের এই মুহূর্তে কোনো সর্বহারা “আঘাতের” ভয় নেই। এই চরমপন্থী বুর্জোয়ারা হল রাশিয়ার কৃষক।” (ঐ)

ভারতের পরিস্থিতি কি রাশিয়ার এই বর্ণনার অনুরূপ নয়?

(চতুর্থ পার্টি কংগ্রেস, ১৯৮৭-র রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

মধ্য বিহারে সাতটি জেলা জুড়ে আন্দোলন চলছে। জেলাগুলি হল : ভোজপুর, রোহতাস, পাটনা, গয়া, জাহানাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ ও নালন্দা। আমাদের পার্টি এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বকারী শক্তি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ভোজপুর ও পাটনার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলনের এই পর্যায়টির আবির্ভাব ঘটে। ১৯৪৬-৪৯ সালে তেলেঙ্গানা ও ১৯৬৭-৭১ নকশালবাড়ি পর্যায়ের পরবর্তীতে এই হল তৃতীয় মাইলস্টোন।

বর্তমান কৃষক আন্দোলনের স্তর শুরু হয় ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে, পাটনার গ্রামাঞ্চলে। পরে তা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে নালন্দা ও জাহানাবাদে। ভোজপুর, ঔরঙ্গাবাদ, রোহতাস ও গয়ার কিছু অঞ্চলে এক নতুন জাগরণ দেখা যায়। সরকার এর জবাব দিল ব্যাপক পুলিশী অভিযান চালিয়ে। কখনও কখনও এই অভিযানকে অপারেশন টাস্ক ফোর্স নামে অভিহিত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সেনা হিসাবে সমধিক পরিচিত জমিদারদের সশস্ত্র বাহিনীকে মদত দেওয়া, কিছু কিছু প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করা, প্রচার মাধ্যমকে ও হরেকরকমের রাজনৈতিক পার্টিকে বিশেষত সিপিআই ও সর্বোদয় গোষ্ঠীগুলিকে তার সমর্থনে দাঁড় করানো, এইসব বহুমুখী উদ্যোগ নিয়ে সরকার এই আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করে। সরকারের এই সমস্ত পদক্ষেপের মুখে পড়ে এবং আমাদের নিজেদের কিছু কৌশলগত ভুলের কারণে কয়েকটি এলাকায় আমরা ধাক্কা খাই, কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়। অন্য অনেক কাজের এলাকায় আমরা পিছু হটি, কিছু পুনর্বিন্যাসও ঘটাতে হয়। যদিও সামগ্রিকভাবে, এই সমস্ত পদক্ষেপগুলিকে মোকাবিলা করতে আমরা সফল হয়েছি। ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম মাত্রায় সীমিত রাখতে, নিজেদের হাতে উদ্যোগ ধরে রাখতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

মর্মবস্তুতে, এই আন্দোলন তিনটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছে :

(১) কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যারা হলেন এইসব এলাকার গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩০-৪০ শতাংশ। সামন্ত প্রথা ও সস্তা শ্রমের কারণে জমি মালিকদের একটি ভালো অংশ মাঠে শ্রম দেয় না। অনিবার্যভাবেই, এই সংগ্রামের লক্ষ্যবস্তু বিস্তৃত হয়ে যায় এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে তা জাতপাতের ভিত্তিতে লোকজনকে সামিল করানো ও ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। সাধারণত ধর্মঘটকেই সংগ্রামের রূপ হিসাবে গ্রহণ করা হয় যা প্রায়শই সশস্ত্র সংঘর্ষের আকার নিয়ে নেয়। আমরা দৃঢ়তার সাথে ধর্মঘটকে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এবং সম্ভব হলে জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা ও শ্রেণী সংহতির বিকাশ ঘটাতে এই কাজটা একান্ত প্রয়োজন এবং কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে এই শ্রেণীকে সংগঠিত করা যারা গ্রামাঞ্চলের সর্বাপেক্ষা অগ্রণী বাহিনী হিসাবে রয়েছে। উদারনৈতিক চিন্তাপদ্ধতি তথাকথিত ব্যাপক কৃষক ঐক্যের নামে এই ধরনের সংগ্রামকে এড়িয়ে যায়। এর বিপরীতে বাস্তব অনুশীলনে দেখা যায় যে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ধর্মঘট সংগ্রাম সংগঠিত করতে পারলে তা জমিদারদের প্রগতিশীল জোটকে ভেঙে দিতে পারে এবং মধ্যবর্তী স্তরের সাথে সমঝোতা সহজতর করে।

(২) জমিদার, মহান্ত ও ধনী কৃষকদের দখলে থাকা উদ্বৃত্ত জমি, খাস জমি ও বসত জমিকে দখল করে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা। এই সংগ্রামে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যথাসম্ভব মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বিরুদ্ধেই পরিচালিত করা হয়। সাধারণত, খাস জমি আছে এমন মধ্য কৃষকদের ছাড় দেওয়া হয়। ধনী কৃষকদের ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলা ও চাপ সৃষ্টি করার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। জমি বণ্টনের সময় জনগণকে সামিল করা ও ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা থাকে। জমি, শস্য ও পুকুর দখল করা এবং খাল বা নদীতে মাছ ধরার অধিকার আদায় করার সংগ্রামগুলি প্রায়শই সশস্ত্র সংঘর্ষের দিকে চলে যায়।

জমি দখল ও বণ্টন, পাট্টার অধিকার অর্জন করা, উৎপাদন সংগঠিত করা এবং পরিশেষে জনগণের মধ্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হাত থেকে অর্জিত সাফল্যগুলি সুরক্ষিত করা – এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় সংগ্রাম কোনো একটি স্তরের পরে সাধারণত আটকে যায়। এ ব্যাপারে সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার ঘটনা বোধহয় বেশি। সাম্প্রতিককালে, কাজের সঠিক পথনির্দেশ সূত্রবদ্ধ করা এবং আরও কঠোরভাবে তা প্রয়োগে নিয়ে যাওয়ার ফলে অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয়।

(৩) দলিত ও পশ্চাদপদ জাতিগুলির সামাজিক মর্যাদার আন্দোলন। এই সংগ্রাম সামন্ত কর্তৃত্বের মূলে আঘাত করায় যথেষ্ট তীব্রতা অর্জন করে, “বাবুসাহেব, বাভন ও বাবাজী” উচ্চবর্ণের এই সমগ্র স্তর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ে। অপরদিকে, পশ্চাৎপদ জাতের প্রায় সমস্ত শ্রেণীই এই ধরনের সংগ্রামকে সমর্থন করে। অবশ্য উভয় তরফ থেকে সবসময় কিছু না কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। সাধারণত প্রত্যেকটি গ্রামে উঁচু জাতের ছোটো একটি প্রগতিশীল অংশ এই সংগ্রামে সহযোগিতা করে, আবার পশ্চাৎপদ জাতের কিছু অংশ উঁচু জাতের প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে হাত মিলিয়ে বসে। বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের প্রভাবে কয়েকটি অঞ্চলের উঁচু জাতের কিছু অংশ তাদের সনাতন মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে।

জনগণের মধ্যে শ্রেণীর ভিত্তিতে বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে এবং গ্রামীণ জনসংখ্যার ব্যাপক অংশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আমরা বেশ কিছু অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ইস্যুকেও হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ইস্যুগুলি হল, প্রজাসত্ব রেকর্ডভুক্ত করা, ব্লক কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সামিল করানো প্রভৃতি। দুর্নীতির প্রশ্ন কৃষির বিকাশের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে, কারণ স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের যোগসাজশে ব্লক কর্তৃপক্ষ সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগই আত্মসাৎ করে ফেলে। এছাড়া ব্যাপক গ্রামীণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ডাকাত দলকে শায়েস্তা করা, কিছু কিছু গ্রাম উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া, রিলিফ দেওয়া, প্রভৃতি পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়।

আমরা মনে করি যে, এই সমস্ত ইস্যুতে সংগ্রাম ও বিভিন্ন উদ্যোগের এক অবিচ্ছেদ্য কর্মসূচিই কেবল কৃষি-শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে ব্যাপক কৃষক ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। রঙ-বেরঙের সুবিধাবাদীরা অনেক সময় আমাদের অভিযুক্ত করেন যে আমরা নাকি ব্যাপক কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছি ও কৃষি-শ্রমিকদের দাঁড় করাচ্ছি কৃষকদের বিরুদ্ধে। কৃষি-শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিলে এবং গণসংগ্রামে সামিল করাতে অস্বীকার করলে তাদের শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণী সংহতি কখনই বাড়িয়ে তোলা যায় না। কৃষক আন্দোলনের ওপর তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও হয় না। স্বাভাবিকভাবেই, তথাকথিত ব্যাপক কৃষক ঐক্য নিছকই ধনী কৃষকের অধীনে কৃষক ঐক্যে পর্যবসিত হয়। এর মাঝামাঝি অন্য কোনো পথ নেই।

আমরা এখনও এটা দাবি করতে পারি না যে শ্রেণী ও জাতপাতের ভারসাম্যকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি, তবে সম্পূর্ণ নতুন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা অভিষ্ট ঐক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কয়েকটি অঞ্চলে, মধ্য কৃষক ও উঁচু জাতের মধ্যবর্তী স্তর কিষাণ সভার পতাকাতলে সামিল হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই অঞ্চলে পার্টির সংহতকরণ অভিযান খুবই নিষ্ঠার সাথে ও কার্যকরীভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল। পার্টি গঠনের কাজকে অবহেলা করা, (বিশেষত আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে) আমাদের পার্টির ইতিহাসে এক সাধারণ দুর্বলতা হিসাবে থেকেছে। বহু অঞ্চলে দীর্ঘকালীন ধাক্কার পিছনে এটাই প্রধান কারণ। আন্দোলন চলাকালীন যে নেতিবাচক ঝোঁকগুলি সামনে চলে আসে তাকে প্রতিহত করা, সঠিক কর্মনীতির সূত্রায়ন ও তার রূপায়ন, আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে এগিয়ে আসা কর্মীবাহিনীর রূপান্তর সাধন ঘটিয়ে পার্টির স্থায়ী সম্পদ হিসাবে গড়ে তোলা, আন্দোলনকে অব্যাহত রাখা ও ক্রমান্বয়ে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করা – এই সমস্ত কাজগুলি সম্পাদনের জন্য পার্টিকে মজবুত করা একান্তভাবেই প্রয়োজন।

চিন্তার এমন এক ধারা আছে যা সচেতন প্রচেষ্টার গুরুত্বকে এই অজুহাতে খাটো করে দেখায় যে জনগণের স্বাধীন উদ্যোগ এর দরুণ মার খাবে। বাস্তবে সচেতন উদ্যোগের বাড়াবাড়ির জন্য নয়, বরং তার ঘাটতির জন্যই সংগ্রাম বিপথগামী হয়, সংকীর্ণ কৃষক মানসিকতা জোরদার হয়ে ওঠে, যোদ্ধারা ডাকাতদলে অধঃপতিত হয়, ছোটোখাটো কিছু অনর্থক সংঘর্ষের মধ্যে তা আটকে যায় এবং শেষপর্যন্ত জনগণের স্বাধীন উদ্যোগের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। ঔরঙ্গাবাদের কয়েকটি এলাকায় জাতপাতের শক্তিক্ষয়ী যুদ্ধে এমসিসি-র প্রশ্রয় এবং জাহানাবাদের কয়েকটি এলাকায় সিওসি(পি ইউ)-র কার্যকলাপ এটিই প্রমাণ করে। পাটনা, নালন্দা ও জাহানাবাদের কিছু কিছু জায়গায় আমাদেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত আমাদের পার্টি সংগঠন এই ধরনের নেতিবাচক প্রবণতাগুলিকে প্রধানত কাটিয়ে তুলেছে এবং পার্টির কাজ এখন অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গতভাবে সংগঠিত হচ্ছে। আর এই প্রশ্নে একান্ত প্রয়োজনীয় অগ্রগতি শুরু হয়েছে পার্টির সংহতকরণ অভিযানের মধ্য দিয়েই।

গত কয়েক বছরের অনুশীলনের ভিতর দিয়ে আন্দোলন থেকে বহু কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। এগুলিকে সারা অঞ্চল জুড়ে জনপ্রিয় করা হচ্ছে এবং সমগ্র কাজটি পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। এখন আমরা এই পরিবর্তন ও বিকাশগুলিকে এই অধ্যায়ে আলোচনা করব।

গ্রাম কমিটির গঠন সম্পর্কে

আমরা লক্ষ্য করি যে ভোজপুরের কোনো একটি গ্রামে স্থানীয় কমরেডরা গ্রাম কমিটি গঠনের জন্য যে পদ্ধতি নিয়েছেন তা কিষাণসভার এযাবৎ অনুসৃত আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির থেকে আলাদা। গ্রামটি সংগ্রামের এক স্থানীয় কেন্দ্র এবং গ্রাম কমিটি গঠনের সময় নতুন এক অগ্রণী ধারণা নিয়ে আসা হয়। তারা গ্রাম কমিটি গঠনের কাজটিকে জনগণের উৎসবে পরিণত করার শপথ নেন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের নিজস্ব কমিটিকে নির্বাচিত করার জন্য তারা জনগণকে ধাপে ধাপে সামিল করেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে আন্দোলনের জোয়ারের সময় সমস্ত ধরনের কার্যকলাপ চালানোর জন্য জনগণ নিজেদের গ্রাম কমিটিকে কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন। কিন্তু বিপরীতে, কিষাণসভার দিক থেকে তারই সর্বনিম্ন ইউনিট হিসাবে এই গ্রাম কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া খুবই গৎবাঁধা ও আনুষ্ঠানিক এক ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। বহুক্ষেত্রে, গ্রাম কমিটিগুলি শ্রেণীসংগ্রাম ত্যাগ করে, কিষাণসভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিছক এক গ্রামোন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়ে। ভোজপুরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্টি গ্রাম কমিটির ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করে। এরপর থেকে নীচুতলায় জনগণের উদ্যোগ উন্মুক্ত করার চাবিকাঠি হিসাবে, তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা উন্নত করার এক জীবন্ত মাধ্যম হিসাবে এবং তাদের বিষয়ীগত চেতনায় বিপ্লবী গণতন্ত্রের ধারণা একাত্ম করার জন্য গ্রাম কমিটির উপর গুরুত্ব আরোপিত করা শুরু হয়। কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন অথবা সাধারণ রাজনৈতিক সমাবেশগুলি ব্যাপক জনগণের চেতনার বিপ্লবীকরণের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, যে চেতনা আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রসর্বস্ব বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির নিষ্ফলতা সম্পর্কে সজাগ করতে পারে। শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের উপর ভিত্তিশীল গ্রাম কমিটি যখন আন্তরিকভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করে চলে তখন তা নির্দিষ্টভাবেই জনগণকে আমাদের গণতন্ত্রের সাথে তাদের গণতন্ত্রের ফারাক টানতে শেখায়।

পকেট গড়ে তোলা সম্পর্কে

সংগঠকদের ভ্রাম্যমান কাজের ধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর জন্য এবং নীচুতলায় পার্টি কাঠামোকে মজবুত করার লক্ষ্যেই পকেট-এর ধারণা নিয়ে আসা হয়। প্রত্যেক সংগঠককে সংশ্লিষ্ট পার্টি কমিটির তরফ থেকে ১০-১৫টি গ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে একটি পার্টি ইউনিট ও তাকে ঘিরে এক পুরোদস্তুর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে এমনকি শ্বেতসন্ত্রাসের সময়েও তিনি তাঁর পকেটে থাকতে পারেন, সেখানকার জনগণের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে পারেন এবং প্রতিবাদী কার্যকলাপে তাদের সংগঠিত করতে পারেন। কেবলমাত্র পার্টি কমিটির নির্দেশ অনুসারে তিনি তাঁর অঞ্চল থেকে উঠে যেতে পারবেন। এই ধারণা সংগঠকদের কাজকর্মে আরও নিষ্ঠা যুগিয়েছে এবং এমন অনেক সংগঠক কমরেড এগিয়ে আসেন যাঁরা তার আগে পর্যন্ত পার্টি সংগঠনের প্রান্তসীমায় থেকে যাচ্ছিলেন। এই ধারণা তাঁদের পরিকল্পনা রচনা ও কাজকর্মকে আরও ভালোভাবে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে। পকেটগুলিকে নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করা ও সেইমতো শ্রেণীবিন্যাস করা হচ্ছে। পকেটের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আন্তরিক ও সফল প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এমন সংগঠকদের সংখ্যা এবং কয়েকটি পকেটে ইতিমধ্যেই শক্তিশালী পার্টি ইউনিট গড়ে উঠেছে।

কৃষক সমিতিকে পুনর্গঠিত করা সম্পর্কে

কৃষক সমিতিকে ব্লক স্তরে সংগঠিত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, প্রথমে ৩০-৪০টি গ্রামে কাজ কেন্দ্রীভূত করা, তারপরে ক্রমান্বয়ে ব্লকের বাকি অংশে কাজ সম্প্রসারিত করার কর্মপদ্ধতি স্থির করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক কৃষক সমিতিকেই সবচেয়ে নির্মম দমন-পীড়নের মুখে পড়তে হয়। তাই নেতৃত্বের মধ্যে কিছু পুনর্বিন্যাস ঘটানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। শত্রুর কাছে সব নেতাদের প্রকাশ করে দেওয়া কোনো বিচক্ষণ কর্মনীতি নয়। সুতরাং, তাদের আধা-গোপন পদ্ধতিতে কাজ করার বিষয় রপ্ত করতে হবে। অপরদিকে, তাদের ব্যাপক পরিমাণে সভ্য সংগ্রহের অভিযানে নামতে, নিজেদের সম্মেলনের সময়ে জনগণকে বিশাল সংখ্যায় সমাবেশিত করতে এবং ব্লক অফিসের কার্যকলাপে আরও বেশি মাত্রায় হস্তক্ষেপ ঘটাতে বলা হয়েছে যাতে প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত হরেকরকম সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলির আসল চরিত্র উদ্ঘাটন করা যায়।

কয়েকটি এলাকায় কৃষক সমিতি ভাগচাষি ও মধ্য কৃষকদের নিয়ে সম্মেলন সংগঠিত করেছে। কোনো কোনো জায়গায়, তাঁরা বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক সংগঠিত করেছেন, যাতে সরাসরি তাঁদের দাবিগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। আজকাল বহু জায়গায় তাঁরা শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে কৃষকদের নিয়ে ব্লক অফিসগুলিতে চড়াও হন। সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কৈফিয়ত দাবি করেন, ত্রাণ ও সংস্কারের জন্য সরকারি অফিসারদের ক্যাম্পগুলিকে গরিব পাড়ায় স্থানান্তরিত করতে বাধ্য করেন এবং জনগণের দাবির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের স্লোগান হল : সবকিছুই কৃষক সমিতির মাধ্যমে করতে হবে। ছিটেফোঁটা সংস্কার কর্মসূচির মারফৎ সংগঠনকে দুর্বল করার সরকারি চক্রান্ত বানচাল করতে এই কৌশল সহায়ক হয়ে উঠেছে।

গ্রামরক্ষীদল সংগঠিত করা সম্পর্কে

পূর্ববর্তী পর্যায়গুলির তুলনায় আজকের দিনে এই দিকটির উপর বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক সংখ্যক যুবকদের এই দলগুলিতে সংগঠিত করা হচ্ছে। বর্শা হাতে নিয়ে তাদের মূর্তি দেখলে শত্রুর বুকে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। এরাই হলেন সেই শক্তি যাঁরা প্রতিরোধ সংগ্রামের সময়, কৃষক নেতাদের বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে এবং মিছিল সংগঠিত করা ও রক্ষা করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। গ্রাম কমিটির পরিচালনাধীনেই এই গ্রামরক্ষী বাহিনী তার কার্যকলাপ চালায়।

নীচুতলার সংগঠনের এই রূপগুলি পার্টির সংহতকরণ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আরও গুরুত্ব ও স্পষ্টতা নিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে। ভোজপুরের চারপোখরী, নালন্দার ইসলামপুর এবং ঔরঙ্গাবাদের দাউদনগর হল এই তিনটি এলাকা, যেখানে এ পর্যন্ত আলোচিত কাজের সমস্ত দিকগুলিকে ভালো পরিমাণে মেলানো হয়েছে। আমাদের কাজের অনেকগুলি পুরোনো অঞ্চলে এই সমস্ত বিষয়ের বেশ কিছু রূপায়িত হয়েছে এবং রোহতাস ও গয়া জেলায় অনেক নতুন কাজের পয়েন্ট গড়ে উঠেছে। নালন্দা ও ঔরঙ্গাবাদ জেলায় পার্টি কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিল। বর্তমানে জেলা পার্টি কমিটি ও সমগ্র পার্টি কাঠামোর অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে।

জনগণের সশস্ত্র শক্তি সম্পর্কে

এটা হয়তো সব কমরেডদের জানা নেই যে ১৯৭৫-এর শেষদিকে ভোজপুরের সাহারে আমাদের একটি মাত্র সশস্ত্র ইউনিট অবশিষ্ট ছিল। এমনকি তার মধ্যেও ভ্রাম্যমানতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং রাজনৈতিক কমিশারের পক্ষেও তা নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, ১৯৭৬-এর শেষে স্কোয়াড সদস্যদের বিকেন্দ্রীভূত করে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একটি নতুন কাজের অঞ্চলে কমরেড জিয়ুতকে ঘিরে তখন আরেকটি সশস্ত্র ইউনিট সবেমাত্র গড়ে উঠেছিল। পাটনাতেও একটিমাত্র সশস্ত্র ইউনিট অবশিষ্ট ছিল এবং সেটিও ভেঙ্গে পড়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। বেশিরভাগ নেতা ও ক্যাডার তখন হয় নিহত অথবা গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। আমাদের পুরোনো কাজের সমস্ত অঞ্চল জুড়েই তখন চলছিল শ্বেতসন্ত্রাস। জনগণ হতোদ্যম অবস্থায় ছিলেন। যে সংগঠক কমরেডরা টিকে ছিলেন, তাঁরা ঐ প্রতিকূল অবস্থা তুচ্ছ করে কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যান, জ্বালিয়ে রাখেন সংগ্রামের অনির্বাণ শিখা। ১৯৭৭ সালে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন ও ১৯৭৯-তে বিশেষ সম্মেলনে রাজনৈতিক লাইনের বিরাট পরিবর্তন ছাড়া আজকের এই কৃষক আন্দোলন বা সশস্ত্র সংগ্রাম সম্ভব হত না। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে সশস্ত্র এ্যাকশনগুলি ১৯৭৭ সাল থেকে ফের শুরু হয়। সশস্ত্র ইউনিট ও আগ্নেয়াস্ত্রের দিক থেকে, সশস্ত্র অভিযানের মাত্রার দিক থেকে আমরা আগেকার স্তরকে অনেক ছাড়িয়ে গেছি। সেদিনের বিপ্লবী কমিটির তুলনায় আজকের গ্রাম কমিটি অনেক বেশি কর্তৃত্ব চালাতে পারে এবং সেদিনের লাল অঞ্চলের তুলনায় আজকের লাল এলাকা অনেক বেশি লাল। বাস্তব জীবনে আজকের এই অগ্রগতি ঘটেছে ধারণার পশ্চাদপসরণ ঘটিয়ে, আর অতীতে ধারণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বাস্তব জীবনে পশ্চাদপসরণই নিয়ে আসে।

তবুও, আমরা মনে করি যে বিহারের বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম এখনও তার প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এর অর্থ হল, শ্রেণীশক্তির ভারসাম্যকে পাল্টানোর জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। আমাদের সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে সংরক্ষিত করতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে শক্তি এবং ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ ঘটিয়ে সংগ্রামকে উন্নতস্তরে উন্নীত করতে হবে।

এই বাস্তবতা আমাদের সশস্ত্র শক্তির বর্তমান অবস্থা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, অনেক লড়াকু লোকজন এই ইউনিটগুলিতে যোগ দিলেও তারাই শেষপর্যন্ত টিকে যান যাদের পরবর্তীকালে পার্টি ক্যাডার হিসাবে গড়ে তোলা গিয়েছিল। আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিয়মিত ও স্থায়ী সশস্ত্র ইউনিটের বিকাশ খুবই মন্থরগতিতে চলেছিল।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা এলাকাভিত্তিক স্কোয়াড গড়ে তোলার ওপর জোর দিই। নতুন পরিস্থিতি অনুসারে এই স্কোয়াডগুলির নির্দিষ্ট কাজ আমরা সূত্রায়িত করতে না পারায় ঐ লক্ষ্যে বিশেষ অগ্রগতি ঘটানো যায়নি। খতমের জন্য এবং খতমের মধ্যে দিয়েই স্কোয়াড গড়ে তোলা – স্কোয়াড গঠনের আগেকার এই প্রক্রিয়াকে আমরা নিরুৎসাহিত করে এসেছি। এরপর সশস্ত্র প্রচার স্কোয়াডের ধারণা নির্দিষ্ট করা হয় এবং এলাকাভিত্তিক সশস্ত্র স্কোয়াডগুলিকে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট ও গ্রামরক্ষী বাহিনীর মধ্যকার যোগসূত্র হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এলাকা হিসাবে ১৫-২০টি গ্রাম নির্দিষ্ট করা হয়, যেখানে প্রত্যেক মাসে এই স্কোয়াডগুলি একটা নির্ধারিত সময়ের জন্য মার্চ করবে। নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটে স্থায়ীভাবে থাকতে পারছেন না এমন বহু যোদ্ধাকে এই স্কোয়াডগুলিতে সামিল করানো হয়। নিয়মিত ইউনিট এই স্কোয়াডগুলির সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপে সামিল করানো হয়। তারা স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শায়েস্তা করে থাকে, নিজেদের উদ্যোগে আগ্নেয়াস্ত্রও তারা দখল করে। তারা গ্রামের সাধারণ যুবকদেরও গ্রামরক্ষী বাহিনীতে সংগঠিত করে।

আমরা মনে করি যে, সশস্ত্র সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে, এই সশস্ত্র প্রচার স্কোয়াডের উপরই প্রধান জোর দেওয়া উচিত। এগুলি নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো হিসাবে কাজ করে। ভবিষ্যতে এই স্কোয়াডগুলি থেকে ব্যাপক পরিমাণে শক্তি নিয়োগ করে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট গড়ে উঠতে পারে।

গত কয়েক বছরে কৈথী (ঔরঙ্গাবাদ), বুনাই (ভোজপুর), গঙ্গাবিঘায় (নালন্দা) আমাদের নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট কিছু বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমস্ত ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলির মধ্যে এমন কিছু চর ছিল জমিদারদের কাছে যারা খবর পাচার করে দিত এবং সেখান থেকে তা যেত পুলিশের কাছে। আমরা এই চরদের গতিবিধি সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলাম। আমাদের সশস্ত্র ইউনিটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমগ্র ধারণা এখানেই ঘুরপাক খেত যে জমিদার ও চিহ্নিত চরদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং সারা রাত ধরে টহল দিতে হবে।

এই ঘটনাগুলির পরে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে চরদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এই ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি শত্রুর গোয়েন্দাদের সমস্ত জালকে (Net Work) নির্মূল করতে পারেনি এবং তা করতেও পারে না। শ্রেণীসংগ্রাম খুবই জটিল এক প্রক্রিয়া আর আমাদের গ্রামগুলি থেকে তাদের এজেন্ট নিয়োগ করার ব্যাপারে শত্রু যথেষ্ট পারদর্শী। আমাদের বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে শত্রুর জাল প্রায়শই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তারা তাকে আরও ধূর্ত ও সূক্ষ্ম কায়দায় আবার গড়ে তোলে।

আধুনিক যুদ্ধের কলাকৌশলের কাছে আমাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারণা ছিল খুবই সাদামাটা ও সেকেলে। আমরা এখন আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছি। শত্রুর শিবিরের মধ্যে থেকে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে এবং খবরাখবর সংগ্রহের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোকজনদের নিয়োগ করতে হবে। এমনকি আজকের এই স্তরে, নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট ও সুব্যবস্থিত স্থানীয় স্কোয়াড ছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র সংগঠনের যা যা থাকা দরকার তা হল : তার নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী (Net Work), আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা ও তার যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করার উপায়, চিকিৎসা শাখা এবং স্কাউট সেবাদল বাহিনী। এই ধরনের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাই সশস্ত্র ইউনিটগুলির গতিবিধিকে অবাধ করে তুলতে সাহায্য করবে এবং কেবল তাহলেই তাদের কার্যকলাপে তারা পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে পারবেন। আমরা মনে করি যে এই অঞ্চলগুলিতে জেলা পার্টি কমিটির তরফ থেকে জেলা স্তরের একজন করে যোগ্য কমরেডকে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হিসাবে রাখতে হবে। সশস্ত্র ইউনিট ও সশস্ত্র সংগ্রাম খেলার জিনিস নয়, তাই এ সম্পর্কে কোনো ধরনের দায়সারা মনোভাব থাকা অনুচিত।

এই স্তরের সংগ্রামে নিয়মিত সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে ক্ষমতাবান জমিদারদের গুণ্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন কিছু সশস্ত্র হামলা সংগঠিত করতে হবে যা নির্ধারক হয়ে উঠবে। তাদের কাজ হল পুলিশী দমন-পীড়ন থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং দোষী পুলিশ অফিসারদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করা।

উপসংহারে আমি বলতে চাই যে :

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা এত দীর্ঘ পর্যায় ধরে কৃষক সংগ্রামকে সফলতার সাথে অব্যাহত রেখেছেন, ক্রমাগত সম্প্রসারিত করে চলেছেন তার সীমান্ত।

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা সংগ্রামের সমস্ত রূপ হাতে তুলে নিয়েছেন। আইনি ও বেআইনি, সংসদ বহির্ভূত ও সংসদীয়, সশস্ত্র কার্যকলাপ ও গণসংগ্রাম, এবং এগুলির মধ্যে একটির জন্য অপরটিকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পরিবর্তে, সমস্ত রূপগুলির মেলবন্ধন ঘটাতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা জাতপাত ও শ্রেণীসংগ্রামের এই দ্বৈত সমস্যাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়েছেন, জাতপাতভিত্তিক নিপীড়নের উপর জোরালো আঘাত হেনেছেন। একইসাথে, কৃষিশ্রমিক, গরিব ও মধ্য কৃষকদের শ্রেণীগত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করার সাথে সাথে দলিত সম্প্রদায়কে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন।

এই প্রথম অগণিত নেতা ও ক্যাডার উঠে এসেছেন গ্রামীণ দরিদ্র জনতার মধ্য থেকে এবং এঁরাই হলেন আমাদের পার্টির মেরুদণ্ড শক্তি। সমস্ত ফ্রন্টে তাঁরাই কাজকর্ম ও সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকেন। জাতীয়স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীতে দরিদ্র গ্রামীণ জনতার ব্যাপক অংশকে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামে সামিল করানো হয়েছে।

আর, শাসকশ্রেণীগুলির সমস্ত ধরনের চালাকি সত্ত্বেও, বিলোপপন্থী ও আধা নৈরাজ্যবাদীদের সমস্ত ধরনের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপ সত্ত্বেও, ক্ষয়ক্ষতির অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও, এই প্রথম ভারতের কমিউনিস্টরা সেই পার্টি সংগঠনের অটুট ঐক্য ধরে রেখেছেন, যে সংগঠন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের লাইন ও কর্মনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছি। গুরুতর মতপার্থক্য ও বিতর্ক হয়েছিল আমাদের মধ্যে, কিন্তু আমরা বরাবরই কঠোর শৃঙ্খলার মনোভাব নিয়ে কদম বাড়িয়েছি একসাথে।

(১৩ মে, ১৯৮৬)

এক বিপুল সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু[] যদি সমাজগণতন্ত্রকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে পূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে থাকে, তবে সমাজগণতন্ত্রীদেরও তাদের এই জয়ের জন্য বড় কম মূল্য দিতে হয়নি। কার্যত একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসাবেই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে – সমাজগণতন্ত্রীরা কখনই হিন্দি বলয়ের কেন্দ্রভূমিতে কোনোরকম জায়গা নিতে পারেনি। একাদিক্রমে ন’বছর ধরে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সমাজগণতন্ত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও, সিপিআই(এম) বিহারে কোনো অগ্রগতি ঘটাতে সামগ্রিভাবে ব্যর্থ কেন? এ থেকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়?

“ভারতের সবচেয়ে অনগ্রসর রাজ্যগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে বিহার। জাত-পাতের কঠোর বিভাজনে বিদীর্ণ এই রাজ্যের সঠিক অর্থে কোনো বুর্জোয়া সংস্কারের ইতিহাস নেই।” নাম্বুদিরিপাদ অ্যান্ড কোং[] এই যুক্তি হাজির করে থাকেন। তবে, এই তথ্যের সাথে সাথে এই নিয়মটিও কিন্তু তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত যে, গণতন্ত্রের দৌড় যেখানে শেষ, বিপ্লবী গণতন্ত্রের অভিযান শুরু ঠিক সেখান থেকেই। সেই পিছিয়ে পড়া বিহারই বিপ্লবী গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটি হয়ে উঠেছে যেখানে সমাজের অন্ত্যজ মানুষজনকেও কৃষক সংগ্রামের প্রবল ঘূর্ণিবাত্যায় টেনে আনা গেছে। পিপড়া গণহত্যা থেকে আরওয়ালের বধ্যভূমি, জমিদারদের ভাড়াটে জল্লাদ বাহিনী থেকে খুনে আধা-সামরিক বাহিনী, ‘সর্বাত্মক বিপ্লব’-এর প্রবক্তা থেকে ‘একান্ত অনুগত প্রতিপক্ষ’ – কোনো কিছুই বিহারের বহ্নিমান ক্ষেত খামারে শ্মশানের ‘শান্তি’ চাপিয়ে দিতে পারেনি। এবং কেউই পারবে না বিরল কীর্তির স্রষ্টা এই কুশীলবদের, এই কৌলিন্যহীন ব্রাত্যবীরদের ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চের বাইরে লোকচক্ষুর আড়ালে ঠেলে দিতে।

কিন্তু বিহারের কৃষক শ্রেণীর এই সংগ্রাম সত্যিই কি একটি নতুন পথের দিশা দিতে পথিকৃৎ হয়ে উঠতে পারবে? নাকি আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে কিংবা মাঝামাঝি কোনো আপোশরফার মধ্যে দিয়ে একদিন হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে, যেমনটা ঘটেছে তার পূর্বসূরীদের ক্ষেত্রে? এই প্রশ্ন আজ প্রতিটি সৎ কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী-গণতন্ত্রের দরদীকে পীড়া দেয়। আর এই বিষয়েই এক ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম প্রয়াস হল বর্তমান বইটি। বইটির মূল অংশে ঢোকার আগে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বন্দ্বাকীর্ণ গতিপথটিকে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। তারপর বিহারের কৃষক জনগণের সংগ্রামের বিশেষ ধারাটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

যেসব অনগ্রসর দেশে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষিজীবী, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টিকে দুটি মৌলিক কৌশলগত প্রশ্নের সমাধান করতেই হয় : কৃষকশ্রেণীর সাথে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন। ১৯১৯ সালে লেনিন প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের বলশেভিক বিপ্লবের সাধারণ শিক্ষার ভিত্তিতে তাঁদের নিজ নিজ দেশের রণনীতি নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের এ বিষয়ে সচেতন করে দেন যে তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধানসূত্র সম্ভবত কোনও কমিউনিস্ট পুস্তকে পাওয়া যাবে না।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এ কথার তাৎপর্য একেবারেই ধরতে পারেনি, কিন্তু মাও সে তুঙ ঠিক এই কাজেই অনন্য একাগ্রতায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরে কৃষক সম্প্রদায় ও বুর্জোয়াদের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কগুলি সঠিক সমাধানে সফল হয়েছিল। এইভাবে সে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বকারী শক্তি হয়ে উঠেছিল এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অনগ্রসর দেশগুলির সুনির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতির সাথে মেলাবার ক্ষেত্রে মূল্যবান পথনির্দেশ জুগিয়েছিল। অপরপক্ষে ভারতীয় কমিউনিস্টরা পূর্বোক্ত সমস্যাটির সমাধানে কোনো সুসংবদ্ধ লাইনের বিকাশ ঘটাতে পারেননি। ফলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা সেজে বসে বাহবা কুড়োল আর কমিউনিস্টরা তার লেজুড় বলে গণ্য হলেন। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবেও তাঁদের চিহ্নিত করা হল। অবশ্য এই ব্যর্থতার বেশ কিছু কারণও ছিল। ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিক শাসন তো বটেই, তা বাদে আরও ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্য নিয়ে কংগ্রেসের উত্থান ও বিকাশ, যার বহিরঙ্গে ছিল অতীব উন্নত গণতান্ত্রিক কর্মরীতি (নিয়মিত অধিবেশন, সভাপতি পরিবর্তন, বহুমুখী প্রবণতাগুলির সহাবস্থান ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি) আর অন্তঃস্থলে ছিল প্রায় অন্ধভক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত গান্ধীর সংগঠন-বহির্ভূত কর্তৃত্ব। তাছাড়াও ছিল বহু জটিল জাতীয়, জাত-পাত সম্পর্কিত এবং সম্প্রদায়গত প্রশ্ন এবং কমিন্টার্ন তথা দেশের বাইরে থেকে পার্টি পরিচালনারত কয়েকজন ভারতীয় নেতার পরস্পর বিরোধী উপদেশ। তবে সবচাইতে যেটা আশ্চর্যজনক তা হল, নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে এমন একটি চিন্তাধারা গড়ে উঠেছিল যেখানে সাধারণভাবে রাশিয়া ও চীনের বিপ্লবের অভিজ্ঞতাগুলিকে এবং বিশেষভাবে লেনিন ও মাও-কে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল। আর সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল ভারত ও চীনের অবস্থার পার্থক্য বর্ণনায়! কী সাংঘাতিক সমস্যা! ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এশিয়ার বৃহত্তম দেশের (ঘটনাক্রমে যেটি আমাদের প্রতিবেশীও বটে) মহান বিপ্লব থেকে এবং তার অবিসম্বাদি নেতা মাও সে তুঙ-এর চিন্তাধারা থেকে কোনো শিক্ষা নিতে অস্বীকার করল। এই মহান নেতার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নয়, সম্ভ্রম নয়, ছিল শুধু বিদ্রুপ।

পি সি যোশীর লাইনের পরাজয় এবং তেলেঙ্গানা (১৯৪৬-১৯৫১)-র উত্থান ও পতনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনটি স্বতন্ত্র লাইন আত্মপ্রকাশ করে। রণদিভে অ্যান্ড কোং-এর ফেরি করা লাইন চীন বিপ্লবের তাৎপর্যকে নস্যাৎ করে মাও-কে আরেকজন টিটো বলে ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণ করা হয়। এই লাইনে শ্রমিকশ্রেণীর শহরভিত্তিক বিদ্রোহগুলিকে ভিত্তি করে যুগপৎ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ওকালতি করা হয়। চীন বিপ্লব এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে স্টালিনের একেবারে গোড়ার দিককার অবিশ্বাস থেকে রসদ সংগ্রহ করে গড়ে ওঠা এই বাম হঠকারী লাইনটি অবশ্য শেষপর্যন্ত চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অন্ধ্র সম্পাদকমণ্ডলীর লাইন তেলেঙ্গানার বীরত্বপূর্ণ লড়াই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীন বিপ্লব ও মাও-এর শিক্ষাকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু অন্ধ্র নেতৃত্ব অন্ধ্র মহাসভার সাথে একযোগে নিজামের সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে লড়লেও নেহরু সরকার ও তার সেনাবাহিনীর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জটিল প্রশ্নটির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য সম্ভবত সেটা করা যায়নি, আর তার ফলে পার্টির মধ্যেকার দুই লাইনের লড়াই কোনো যুক্তিসম্মত পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। এ সত্ত্বেও তেলেঙ্গানা আজ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একটি অংশ যে চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার এবং কৃষি-বিপ্লবকে অক্ষ হিসাবে ধরে ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি সুসংহত লাইনের বিকাশ ঘটানোর ঐকান্তিক প্রয়াস চালিয়েছিল সেকথাও স্মরণ করিয়ে দেয় এই মহান সংগ্রাম।

নেহরু সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরেছিল আর সেই পথকে মুড়ে দিয়েছিল জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মতো চটকদার কিছু সংস্কারের আস্তরণে। তেলেঙ্গানার লড়াইয়ে ধাক্কা আসায়, ইতিমধ্যেই বস্তুগত পরিস্থিতি অজয় ঘোষ ও ডাঙ্গের তুলে ধরা মধ্যপন্থী লাইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল হয়ে উঠেছিল। এই লাইন চীনা ও ভারতীয় পরিস্থিতির ফারাককে বিরাট বাড়িয়ে দেখেছিল এবং পার্টিকে সংসদীয় পথে ঠেলে দিয়েছিল।

১৯৫৭ সালে কমিউনিস্টরা কেরালায় সরকার গঠনে সক্ষম হয়। কিন্তু মৌলিক কৃষিসংস্কারের চেষ্টা শুরু করা মাত্র সরকারকে ফেলে দেওয়া হল। সংসদীয় লড়াইকে কাজে লাগানোর কৌশলের বিবর্তনের পথে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বাস্তব অভিজ্ঞতা কৃষক সংগ্রামের বিকাশের প্রয়োজনীয়তা এবং সমস্ত সংসদীয় লড়াইকে সংসদ বহির্ভূত সংগ্রামের অধীনে পরিচালনার বিষয়টিকে পুনরায় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরল। কিন্তু পার্টি সে শিক্ষা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং পুরোনো পথেই চলতে থাকল। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে, ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের উত্থান এবং ভারত-চীন যুদ্ধের পর পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হল। ডাঙ্গেপন্থী নেতৃত্ব উগ্রজাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়ে তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ পথে অ-পুঁজিবাদী উন্নয়ন’-এর তত্ত্ব ফেরি করতে শুরু করে। সিপিআই-এর জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন কালক্রমে তাকে কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত করে। এই লাইন অনুযায়ী হয় ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের অস্তিত্ব নেই, অথবা যদি থেকেও থাকে, কংগ্রেস সরকার স্বয়ং তার মোকাবিলা করতে সক্ষম।

অপর গোষ্ঠী সিপিআই(এম) তার মধ্যপন্থী লাইন নিয়ে এগিয়ে চলল। অতীতের রণদিভে-উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় স্ট্যালিনকে তাঁরা মাও-এর মুখোমুখি দাঁড় করালেন আর তার ফলে ক্রুশ্চেভকেও পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলেন না। এই সংগঠন ‘জনগণতন্ত্রের’ কথা বলে, কিন্তু তাদের কল্পনায় লালিত জনগণতন্ত্রের ছবিটির সাথে বেশি সাদৃশ্য আছে পূর্ব ইউরোপীয় ধরনের জনগণতন্ত্রের মডেলগুলির। এঁরা চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতার মহতী শিক্ষাগুলিকে কালিমালিপ্ত করেই চলেছেন। মাও সে তুঙ চিন্তাধারা এঁদের কাছে উপহাসের বস্তু। ইদানিংকালে, সিপিআই(এম)-এর মুখ্য তাত্ত্বিক মুখপাত্র বাসবপুন্নাইয়া মাও-এর প্রতি আক্রমণ আরও শাণিত করেছেন[]। দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে মাও-এর দার্শনিক অবস্থান এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্পর্কে তাঁর কৌশল নিয়ে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন তিনি। সিপিআই(এম) আজও প্রচার করে চলেছে যে ভারত ও চীনের পরিস্থিতিগত বৈসাদৃশ্যের কারণে ভারতে পার্টিজান সংগ্রাম অসম্ভব। শুধু তাই নয়, চীন বিপ্লব সম্পর্কে সিপিআই-এর পুরোনো মূল্যায়নটি নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই মূল্যায়ন অনুযায়ী, ঘাঁটি এলাকাগুলি এবং লালফৌজ চীনে এমন কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত সৈন্য সমাবেশই নাকি চীন বিপ্লবের বিজয়ের প্রধান কারণ।

সিপিআই-এর উগ্রজাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে ছিলেন। পার্টি সংসদীয় কার্যকলাপে এগিয়ে চলে এবং তারপর উত্তাল গণআন্দোলনের শীর্ষারূঢ় হয়ে এক সুবিধাবাদী সমঝোতার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। কিন্তু নকশালবাড়ি আন্দোলন দমনে এই সরকারের ভূমিকা অচিরেই নেতৃত্বের সংশোধনবাদী চরিত্র উদ্ঘাটন করে দিল। সমস্ত দিক থেকে পার্টির মধ্যে একটি সর্বাত্মক বিদ্রোহের পরিস্থিতি পেকে উঠছিল এবং অবশেষে সত্যিই এক বিদ্রোহ হল – পশ্চিমবঙ্গে ও কেরালায় সিপিআই(এম)-এর শক্তি প্রভূত পরিমাণে ক্ষয় পেল। কয়েকটি রাজ্যে তো গোটা রাজ্য কমিটিই নকশালবাড়ি সংগ্রামের সমর্থনে পার্টি থেকে বেরিয়ে এল।

নকশালবাড়িতে অভিব্যক্ত হয়েছিল তেলেঙ্গানারই বিপ্লবী ভাবমানস – ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কৃষক সংগ্রামের গুরুত্ব তুলে ধরার এবং চীনের অভিজ্ঞতা ও মাও-এর শিক্ষাকে কাজে লাগানোর এক দুর্জয় আবেগ। সময়টা অবশ্য অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। নকশালবাড়ি দেখা দিল এক নতুন প্রেক্ষাপটে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ততদিনে ঘটে গেছে এক বিভাজন। কংগ্রেসের আপাতগণতান্ত্রিক চেহারার বিভ্রম এবং তথাকথিত ভূমিসংস্কারের চটকদারিত্ব তখন দ্রুত অপসৃয়মান, দেশ গুরুতর কৃষিসংকটের সম্মুখীন, সবুজ বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের মাধ্যমে যা থেকে মুক্তি খোঁজা হচ্ছিল। সর্বোপরি, দেখা দিয়েছিল ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক সংকট, যার প্রতিফলন ঘটেছিল কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রথম পরাজয়ে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নকশালবাড়ি ঘটেছিল এক চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতিতে, যখন শাসকশ্রেণী পুরোনো কায়দায় তার শাসন বজায় রাখতে পারছিল না। নকশালবাড়ি ছিল হতমান ও ক্ষয়িষ্ণু শাসকশক্তির ওপর সরাসরি এক চরম আঘাত। অপরদিকে পুলিশের কৃষক ও বিপ্লবী নিধন অভিযান পরিচালনা করে পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজের অবস্থানটিকে বুঝিয়ে দিল।

যেহেতু পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম তাই ফলশ্রুতিও হল ভিন্নতর। নকশালবাড়ি নকশালবাড়িতেই থেমে থাকেনি। প্রথমে এআইসিসিসিআর এবং তারপর সিপিআই(এমএল) গঠনের পর দাবানল ছড়িয়ে পড়ল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। নতুন বিপ্লবী পার্টি বিশেষ জোর দিয়েছিল লেনিনবাদ এবং মাও সে তুঙ-এর নেতৃত্বে আধা-ঔপনিবেশিক চীনে তার প্রয়োগের গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যে দিয়ে প্রবহমান লোহিতরেখার ওপর। ভারতীয় ধাঁচের সংশোধনবাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পার্টি তার পথনির্দেশক মতাদর্শে কেবল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নয়, মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকেও একাত্ম করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারতীয় ও চীনা পরিস্থিতির মধ্যকার সাদৃশ্যের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে, কিছু ব্যক্তি যাঁরা নিজেদের মাওবাদী কমিউনিস্ট বলে জাহির করেন, তাঁদের মতো কখনই এই পার্টি নিজেকে মাওবাদী পার্টি বলে প্রচার করেনি, বরং ভারতের প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি হিসাবেই নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। সূচনাপর্বে, ভারতীয় বিপ্লবের সম্পূর্ণ নতুন যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপে পার্টির কাছে চীনা মডেলটির অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না, যে মডেল সে সময় ভিয়েতনামে তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও গণমুক্তি সংগ্রামে দিশারী হয়ে উঠেছিল।

তেলেঙ্গানা যেন তার সমস্ত প্রাণোচ্ছ্বাস আর সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে জেগে উঠল। আকাশ বাতাস মুখরিত হল গেরিলাযুদ্ধ, লালফৌজ আর ইয়েনানের শ্লোগানে, অনুরণিত হল লং-মার্চের গানে গানে। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে উঠল প্রধান ঘাঁটি আর সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল এই আন্দোলন। হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক-যুবতীরা দামাল দিনের উত্তাল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি নতুন ধারা হিসাবে নকশালপন্থা জাতীয় জীবনে যুক্ত হল, নতুন একটি শব্দ হিসাবে সংযোজিত হল রাজনৈতিক অভিধানে।

তবে এই উচ্ছ্বাস বেশি দিন টিকল না। যাকে বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্ত বলে মনে হয়েছিল তা যে আসলে একটি পূর্ণাঙ্গ মহড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেকথা অচিরেই বোঝা গেল। শত শত বিপ্লবী অকালে ঝরে গেল, হাজার হাজার কর্মীকে জেলে পোরা হল, ঘনিয়ে এল নৈরাশ্য আর বিষাদের অন্ধকার। আর সবসময় যা হয়ে থাকে, এই অন্ধকারের অনুচর হয়ে এল বিভ্রান্তি, ভাঙ্গন আর বিভাজন। বিভিন্ন পার্টি নেতার অবস্থান সম্পর্কে কেউই সুনিশ্চিত হতে পারছিল না। লোকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তাদের অবস্থান পাল্টাতে লাগল। গতকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর কমরেডরা রাত পোহাতেই প্রতিপক্ষ বনে গেল।

অনেকের কাছে মুক্তির স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল দুঃস্বপ্ন। জেল থেকে এল নেতাদের আবেদন, ছিন্নভিন্ন সংগঠনকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলল। কিন্তু কোনো কিছুই এই ভাঙ্গনের স্রোতকে রুখতে পারল না। নির্বিকার ইতিহাস তার নিজের পথে এগিয়ে গেল। এককালে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকের মনে হল আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে চিরতরে, অন্য অনেকে ১৯৭০ দশকের মধুর স্মৃতি সম্বল করে দিন গুণতে লাগলেন এই বৃথা আশায় যে পুরোনো স্লোগানগুলির বলিষ্ঠ পুনরুচ্চারণে হয়তো আবার ফিরিয়ে আনবে পুরোনো দিনগুলি। অপর একটি অংশ এই সাদামাটা অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে রইলেন যে, ছত্রখান হয়ে যাওয়া পুরোনো সমস্ত শক্তিকে যেভাবে হোক ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেই বোধ হয় পরিস্থিতিটা পাল্টানো যেত।

আন্দোলনের এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় উপদল গঠনের সমস্ত সম্ভাব্য প্রবণতা ও প্রচেষ্টাগুলি মাথাচাড়া দিতে থাকল, শুরু হল এক তিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক। বিভিন্ন ধরনের মানুষ, এমনকি যাঁদের ভাবা গিয়েছিল একেবারে শেষ হয়ে গেছেন বা চিরদিনের মতো চুপ করে গেছেন, তাঁরাও বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসতে লাগলেন। আর তাঁদের সাথে ফিরে এল সেই সব প্রশ্ন যেগুলির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে বলে ভাবা হয়েছিল।

বিষয়টা ছিল, কীভাবে আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায়। কেউ কেউ মনে করেছিলেন খতমের লাইন, নির্বাচন ও ট্রেড ইউনিয়ন বয়কটের লাইন ইত্যাদি বাতিল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ সিপিআই(এমএল)-কেই বাতিল করার কথা ভেবে বসে রইলেন। তাঁদের মতে এআইসিসিসিআর-কে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলেই আন্দোলনকে চাঙ্গা করা যাবে।

জরুরি অবস্থা জারির পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গেই চারু মজুমদারকে এক ব্যর্থ বিপ্লবী নায়ক হিসাবে হাজির করার চেষ্টা হল। মঞ্চে তখন জাঁকিয়ে বসেছিলেন এস এন সিং এবং তাঁর পিসিসি। এরপর চরম আঘাতটি এল কানু সান্যালের কাছ থেকে। সবাইকে তিনি জানালেন, নকশালবাড়ির সংগ্রাম আসলে ছিল তারই মস্তিষ্ক প্রসূত, চারুবাবুর বাম-হঠকারী হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করতে তিনিই এ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। আর চারু মজুমদার যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাথে কৌশলগত চুক্তিতে আসার (সম্ভবত ১৯৫১ সালে পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক তেলেঙ্গানা সংগ্রাম প্রত্যাহার করে নেওয়ার পুরোনো ঢঙে) কানুবাবুর প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে আন্দোলনের ধ্বংস ডেকে আনেন!

পশ্চিমবঙ্গে সমাজগণতন্ত্রীদের জমানায় এবং অন্ধ্রেও যখন এইসব ব্যাপার ঘটছে (সি পি রেড্ডি গোষ্ঠী সহ শ্রীকাকুলামের নেতৃত্বের অবশিষ্টাংশ এস এন সিং-এর সঙ্গে ততদিনে হাত মিলিয়েছেন) তখন বিহারের ইতিহাসটি ছিল একেবারে অন্যরকম, আর নিশ্চিতভাবেই তার এই স্বাতন্ত্র্যের শুরু আরও অনেক আগে থেকেই।

স্বাধীনতা সংগ্রামের গান্ধীবাদী রণকৌশলের বিকল্প হিসাবে এবং তার বিপরীতে, বাংলা যদি সন্ত্রাসবাদ ও সুভাষ-ঘরানার ‘বামপন্থা’র জন্য উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে, এবং বম্বেতে যদি সাড়া জাগানো শ্রমিক ধর্মঘট হয়ে থাকে, বিহার তবে সামনে এসেছিল সেই ৩০-এর দশকেই শক্তিশালী কিষাণসভা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।

গান্ধী বিহারের চম্পারণে কৃষক সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়েই তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে, অথচ ‘স্বদেশী’ জমিদারদের গায়ে যাতে আঁচড়টি না লাগে এমনভাবে, কৃষকদের শান্তিপূর্ণ, অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সামিল করার কৌশল আবিষ্কার করেন। বিহারের কৃষকশ্রেণী কংগ্রেস নেতৃত্বের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আহ্বানে সোৎসাহে সাড়া দিয়েছেন, কিন্তু কখনই তাঁরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনের বেঁধে দেওয়া সীমায় নিজেদের আটকে রাখেননি। বরং তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই জমিদারদের বিরুদ্ধে সক্রিয়, কখনও কখনও সহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সামাজিক স্তম্ভ ছিল এই জমিদাররা। কৃষকরা তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের নিজেদের মতো করে আন্দোলনের এই ডাকগুলিতে সাড়া দিয়েছিলেন। বাস্তব জীবনের এই সংঘাত বিহারের অন্তর্বর্তী কংগ্রেস মন্ত্রীসভাকে (যা ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল) বাধ্য করল জমিদারদের সাথে একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করতে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিপরীতে, কংগ্রেসের একটি শাখা হিসাবে শুরু হওয়া কিষাণসভা ক্রমশ কংগ্রেস থেকে সরে যায় এবং বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের পতাকাতলে আসে। এর একটি বড় অংশ পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কিষাণসভা আন্দোলনের সময়ে জাতভিত্তিক মেরুকরণ পিছনে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন বা আম্বেদকর ধাঁচের দলিত আন্দোলন অথবা জগজীবন রামের হরিজন স্বার্থের বিষয়টি – কোনোটিই বিহারে কখনও বিশেষ আমল পায়নি। সিপিআই এবং সমাজবাদীরা কিন্তু সেখানে সাফল্যের সঙ্গে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এখনও যদি বিহারে সিপিআই-এর মজবুত সংগঠন থেকে থাকে তবে তা প্রধানত কিষাণসভা আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং ১৯৫০-এর দশকে তেলেঙ্গানার সময়কার কিছু ইতিবাচক সাফল্যের জন্যই।

স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে, পাছে তেলেঙ্গানা-ধরনের লড়াই আবার শুরু হয়ে যায়, তাই আগাম প্রতিষেধক হিসাবে বিহারকে আরও একবার বিনোবা ভাবের সর্বোদয় পন্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বেছে নেওয়া হল। এককালের সমাজবাদী এবং কিষাণসভা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী জয়প্রকাশ নারায়ণকে বিহারের সর্বোদয়ের মূল প্রবক্তা ও সংগঠক করা হল। কিন্তু বিহারের কৃষি-বাস্তবতার কাছে তাঁদের সমস্ত বাগাড়ম্বর নস্যাৎ হয়ে গেল। ভূদান পর্যবসিত হল চরম ব্যর্থতায়। ব্যর্থমনোরথ বিনোবা ওয়ার্ধায় ফিরে গেলেন আর জে পি-ও সাময়িকভাবে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন। বিনোবা এবং জে পি-র এই পিছু হটার পর মধ্য-ষাটের বিহারে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। আর এই প্রেক্ষাপটেই নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষ প্রতিধ্বনিত হল উত্তর বিহারের মুজফ্ফরপুর জেলার মুসাহারি ব্লকে। কিন্তু সেখানকার সংগ্রামে খুব শীঘ্রই ধাক্কা এল। জে পি আবার একবার তাঁর নব-সর্বোদয় কৌশলে সজ্জিত হয়ে বিশেষ তৎপরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই ডামাডোলের মধ্যে। পরে এটাই তাঁর ‘সর্বাত্মক বিপ্লবের’ তত্ত্ব হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে।

জে পি যখন নকশালবাদের ‘ভয়াবহ বিপদ’-কে রোখার ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, বিপ্লবী কমিউনিস্টরাও তখন বিহারের বিভিন্ন অংশে কৃষক সংগ্রামের বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শুরুতে তাদের সামান্যই সাফল্য আসে। কিন্তু ১৯৭১-এর শেষে ঠিক যখন বাংলার ধরনে ঘটনাগুলি ঘটছিল, তখন একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে মধ্য বিহারের দুটি জেলা ভোজপুর এবং কিছুটা কম মাত্রায় পাটনা থেকে উৎসাহজনক সংকেত পাওয়া যেতে লাগল। বর্তমান সামাজিক অবস্থার গভীরে সুপ্রোথিত ভোজপুর ও পাটনার এই সংগ্রাম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুরু হয়। আর তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে স্থানীয় নেতৃত্বের এক অ-চিরাচরিত কেন্দ্র।

দেশজুড়ে আমাদের বীর শহীদরা কতই না রক্ত ঝরিয়েছেন ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে, নির্যাতন কক্ষে, জেলের কুঠরিতে – চিরভাস্বর তাঁদের সেই আত্মবলিদান গগনচুম্বী হয়ে ভোজপুরের আকাশ উদ্ভাসিত করল অপূর্ব এক রক্তিম আভায়। আর এই দ্যুতি, এই ঔজ্জ্বল্য কোনো ক্ষণপ্রভ উল্কার ছিল না, ছিল এক লাল তারার – যে তারার উদয় হয়েছে দীপ্তিমান হয়ে থাকার জন্যই। পরবর্তী বছরগুলি একথা প্রমাণ করে দিয়েছে।

কৃষক সংগ্রামের স্বতস্ফূর্ত স্বাধীন ধারা এবং সেই স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে সচেতনতা দেওয়ার জন্য পার্টির ঐকান্তিক প্রয়াস – এই জটিল প্রক্রিয়াটি ঐক্য ও সংগ্রামের এক বিচিত্র পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। অগ্রণী কৃষক যোদ্ধাদের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট সংগঠকদের গড়ে তোলার জন্য পার্টি  কঠোর পরিশ্রম করেছে; এই সংগঠকরা আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ত নেতিবাচক প্রবণতাগুলি রোধ করার ও আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার জন্য সদাসচেষ্ট থেকেছেন। তবে কখনও কখনও পার্টির তরফ থেকে সংগ্রাম ও সংগঠন সম্পর্কে তার গোঁড়া ধ্যানধারণাকে আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ভালোরকম চেষ্টাও চলেছে যা অবধারিতভাবে উল্টো ফল দিয়েছে।

পরিশেষে, জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্টি জুড়ে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং বিকাশমান কৃষক সংগ্রামে নতুন গতি সঞ্চার করে। আর এভাবেই আমরা ব্যাপক কৃষক-গণজাগরণের বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছি।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এই গোটা বিকাশ প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন এস এন সিং[] যিনি আবার বিহার তো বটেই খোদ ভোজপুরেরই মানুষ। চারু মজুমদারের ভূত তাঁকে বিহার ছাড়া করল। শুধু তাই নয়, এ রাজ্যের কমিউনিস্ট বিপ্লবী মহলে তিনি হয়ে দাঁড়ালেন সবচেয়ে নিন্দিত ব্যক্তি।

প্রসঙ্গক্রমে, সিপিআই(এমএল)-এর প্রথম এবং এ পর্যন্ত একমাত্র মৌলিক বিভাজনের ‘কৃতিত্ব’টি আর কারও নয়, এস এন সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিহার রাজ্য কমিটিরই প্রাপ্য! অন্য সব বিভাজনগুলি হয় কৃত্রিম, নয়তো সাময়িক অথবা তাৎপর্যহীন। কয়েকটি গোষ্ঠীর তরফ থেকে একটি সুসংহত ‘বাম’ লাইন সূত্রবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল, এখনও তা চলছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সেরকম কোনো লাইনের বিকাশ ঘটেছে বলে কেউ দাবি করতে পারছেন না। আধা-নৈরাজ্যবাদ এখনও পর্যন্ত বড়জোর সংগ্রাম ও সংগঠনের রূপ ও পদ্ধতিগত একটি প্রবণতা মাত্র, যা নিয়ে বিতর্ক এখনও অব্যাহত। এই প্রবণতায় এখনও যাদের বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন রয়েছে তাঁদের একটা বড় অংশই ফিরে আসবেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাতলে, কারণ সময় তাঁদের অভিজ্ঞ করে তুলবে আশা করা যায়। বিপরীতে এস এন সিং-এর ছিল সুনির্দিষ্ট বিকল্প কৌশলগত লাইন যেখানে সুনির্দিষ্ট সামাজিক শক্তিগুলির সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের ওকালতি করা হয়েছে। আর সে কারণেই তাঁকে বারে বারে কবর থেকে তুলে আনা হয়েছে, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও আমাদের আন্দোলনের অন্য একটি মেরুতে তিনি বারবার উঠে আসছেন। ধনী চাষিদের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নেই চারু মজুমদারের সাথে তাঁর মৌলিক মতপার্থক্য শুরু হয়েছিল। তিনি ধনী চাষিদের সাথে ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সি এম জোর দিয়েছিলেন সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের নিষ্ক্রিয় রাখার উপর। ফলত এই লাইন (এস এন-এর লাইন) হয়ে ওঠে জমিদার শ্রেণীর কয়েকটি অংশের সাথে এবং বিরোধীপক্ষের বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য গড়ার লাইন। (ভাস্কর নন্দী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সূত্রের ভিত্তিতে এই ঐক্যকে তত্ত্বায়িত করে এস এন-কে সাময়িকভাবে বোকা বানিয়েছিলেন। তবে এস এন দ্রুতই নিজেকে নন্দীর ভ্রান্ত তত্ত্বচর্চা থেকে সরিয়ে এনেছিলেন)।

পরবর্তীকালে, যুক্তফ্রন্টের প্রশ্নে এসএন এবং আমরা উভয়েই কংগ্রেসী শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক বিকল্পের বিকাশ ঘটানোর একই সূত্র থেকে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সাদৃশ্য এ পর্যন্তই। কারণ এস এন, জে পি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে, জনতা দলের নেতৃবৃন্দ ও বেশ কিছু উদারপন্থীর সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে, কৃষি-বিপ্লবের নির্ধারক ভূমিকাকে খারিজ করে দিলেন। এমনকি তিনি আপোশের রাস্তায় এতটাই এগিয়ে গেলেন যে সর্বাহারা শ্রেণী গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে আবার নাও পারে – অধুনা-খ্যাত এই সূত্রায়নটি পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হলেন না। একথা সত্যি যে বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা ও চাপে পড়ে এস এন-কে তাঁর ঘোষিত অভিমত সম্পর্কে বেশ কিছু আপোশ-মীমাংসায় আসতে হয়েছিল। কিন্তু মূলত সেগুলি ছিল কৌশল মাত্র এবং তা তাঁর প্রকৃত অবস্থানকে প্রভাবিত করেনি।

অন্যদিকে, আমরা কৃষক সংগ্রামকে সাহসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে দাঁড়াই। এই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে ধনী কৃষকদের সেইসব প্রতিপত্তিশালী অংশকেও আঘাত হেনেছিল, বিহারে যারা ভালোরকম সামন্ততান্ত্রিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকে। এক কথায়, এইসব সংগ্রামের ভিত্তিতে আমরা শ্রমিক, কৃষক এবং পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবী জোটকে কংগ্রেসী শাসনের বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে থাকি। অবশ্য আমরা বিরোধী বুর্জোয়া দল ও গোষ্ঠীগুলির সাথে কৌশলগত কার্যকলাপের জন্য দরজা খোলা রেখেছিলাম।

দুই কৌশলগত লাইনের লড়াইয়ের এই প্রেক্ষাপটেই বিহারের কৃষক সংগ্রাম বিকশিত ও সম্প্রসারিত হতে থাকে।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক স্বতন্ত্র বিন্যাসের মধ্যে উদ্ভূত বিহারের কৃষক সংগ্রাম চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সমর্থন পায়নি। আর তীব্র গোষ্ঠী বিভাজনের পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনের জন্য ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী গ্রুপের থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দূরে থাক, সহানুভূতিসূচক একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। নকশালবাড়ি এবং শ্রীকাকুলামের সংগ্রাম চলাকালীন পরিস্থিতি থেকে এই পরিস্থিতি ছিল প্রকৃতপক্ষেই বিরাটভাবে আলাদা। তবে বিভিন্ন মহল থেকে এই আন্দোলনকে ব্যাপক সংহতি জানানো হয়েছে। সত্যি বলতে কী, এতগুলি বছর ধরে আন্দোলনকে ধরে রাখা অসম্ভব হতো, যদি না ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব এবং ঐক্যবদ্ধ সিপিআই(এমএল)-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মূল্যবান নির্দেশনা ও বিভিন্ন গ্রুপে থাকা কমিউনিস্ট বিপ্লবী কর্মী, মার্কসবাদী শিক্ষাবিদ, বিপ্লবী গণতন্ত্রী, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, সত্যান্বেষী সাংবাদিক, প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল প্রবাসী ভারতীয় এবং চীন, নেপাল, ফিলিপিনস, পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বিদেশী বন্ধুদের সমর্থন না পাওয়া যেত।

বিহারের বর্তমান সংগ্রাম সেই জেলাগুলিতেই বিস্তৃতি লাভ করেছে যেখানে অতীতের কিষাণসভা আন্দোলন থেকেই এক লড়াকু ঐতিহ্য রয়েছে। এইসব জেলায় বৃহৎ ভূস্বামীতন্ত্রের নজির কম থাকলেও জমিদারতন্ত্র ব্যাপকতর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ এর মধ্যে শুধু প্রাক্তন মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই নয়, পূর্বতন শক্তিশালী রায়তরা পর্যন্ত রয়েছে। বিহারের অন্যান্য অংশের তুলনায় এসব জেলার কৃষি আধুনিক পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং বাজারমুখী গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য। এইসব জেলায় কৃষি সংক্রান্ত যেসব প্রশ্ন সামনে এসেছে, সেগুলি সারা ভারতেই গ্রামীণ দরিদ্রদের পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেমন ন্যূনতম মজুরি; প্রজাস্বত্বের অধিকার; খাস, বেনামি, সম্প্রদায়গত এবং সরকারি জমির দখল; শস্যের অভাবী বিক্রয় রোধ; বিভিন্ন কৃষি উপকরণের সুলভতা ইত্যাদি। এককথায়, বহুলাংশেই এই অঞ্চল পরিবর্তনশীল ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি।

ভারতীয় কৃষি আজ এক নতুন সংকটের সম্মুখীন যে সংকটের কারণ সবুজ বিপ্লবের রণনীতির সংপৃক্তি এবং ‘অতি-উৎপাদন’। এই সংকটের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে নতুন ধরনের চাষি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছে। বিশেষত মহারাষ্ট্রে এই আন্দোলন পেয়েছে এক উর্বর জমি এবং শারদ যোশীর মতো এক শক্তিশালী প্রবক্তা। যোশী মহাশয় দরিদ্র গ্রামীণ ভারত[] বনাম ধনী শহুরে ‘ইন্ডিয়া’ দ্বন্দ্বের[] ওপর তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। তিনি দেশের যাবতীয় সমস্যার সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছেন। আর তার জন্য সবকিছু ছেড়ে একমাত্র গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর একদফা দাবি : কৃষিপণ্যের লাভজনক মূল্য। গ্রামীণ জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে কোনো বড় ধরনের সংঘাতের বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে, একথা তিনি বিশ্বাস করেন না। আর না বললেও চলে, তাঁর ধারণার কৃষকরা আসলে ধনী ও মধ্য চাষি ছাড়া আর কেউ নয়। স্বভাবতই সেকারণে তিনি কৃষি শ্রমিকদের ওপর বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেননি। মিঃ যোশী মনে করেন, প্রথমত, কৃষকদের অর্থনৈতিক লাভ হলে তা আপনা-আপনি পূর্বোল্লিখিত শ্রেণীটির (কৃষিশ্রমিক) কাছে উচ্চতর মজুরির আকারে চুঁইয়ে আসবে। দ্বিতীয়ত সামাজিক রূপান্তর সাধনের ইতিহাসে সবচেয়ে নীচুতলার মানুষের কোনো অগ্রণী ভূমিকা কোনোদিন থাকেনি, থাকতে পারেও না।

তাঁর কর্মধারায় আলোড়নমুখী দিক থাকা সত্ত্বেও দলবিহীন রাজনীতির জন্য তাঁর নাছোড়বান্দা মনোভাব, কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রবণতা এবং গ্রামীণ উন্নতির উপর এই জোর মিঃ যোশীকে সর্বোদয়ীদের কাছের মানুষ করে তুলেছে, যাঁরা সম্ভবত বিনোবা এবং জে পি-র মৃত্যুর পর নতুন কোনো ত্রাণকর্তার সন্ধানে ছিলেন।

এইভাবেই আজ কৃষক আন্দোলনের আঙ্গিনায় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে একদিকে বিহার ও অন্যদিকে মহারাষ্ট্র থেকে বয়ে আসা পূবালী ও পশ্চিমা বাতাসের মধ্যে এক জবরদস্ত সংগ্রাম। মহারাষ্ট্রের চাষি আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যাচ্ছে বিহারে। সেখানে কৃষক সংগ্রামের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেন কৃষি-শ্রমিকরা, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর তাঁদের সাথে রয়েছেন দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্য কৃষকরা। অন্যদিকে, আক্রমণের একটি লক্ষ্যবস্তু হিসাবে অন্তত বর্তমান পর্যায়ে  রয়েছে কুলাকদের এক বিরাট অংশ, কোনো কোনো অঞ্চলে যাদের মধ্যে আছে কিছু কিছু অনগ্রসর জাতির কুলাকরাও। কিন্তু বিহারের কৃষক আন্দোলন আমূল ভূমিসংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও, সবুজ বিপ্লবের সংকট থেকে উদ্ভূত যেসব ইস্যু মধ্য ও উচ্চ-মধ্য কৃষকদের একটা বিশাল অংশকে প্রভাবিত করে সেগুলিকেও ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এই দুটি হাওয়ার মধ্যেকার যুদ্ধের পরিণতি এখনও নির্ধারিত হয়ে যায়নি। ভারতের ইতিহাসে যা হয়তো সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মহাকাব্য হয়ে উঠবে তার চূড়ান্ত দৃশ্যগুলি এখনো আমরা দেখতে পাইনি। তবুও যখন অজানা, অচেনা, ধূলিধূসর মেঠোপথের ছোট্ট মফঃস্বল শহর আরওয়ালে[] দরিদ্রতম কৃষকদের মামুলি মৃত্যু বিহারে ক্ষমতাসীন শক্তির রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে তোলে, তখন গভীর প্রত্যয়ে ঘোষণা করাই যায় : নায়করা অবশেষে মঞ্চে এসে গেছেন।

টীকা

  • (১) পাশবিক অত্যাচারের মুখে নকশালবাড়ি থেকে উদ্ভূত প্রথম বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ধাক্কার কথা এখানে বলা হচ্ছে।
  • (২) সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বিহারে তাঁদের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই যুক্তিটিই দিয়েছিলেন।
  • (৩) সোসাল সায়েন্টিস্ট পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সংখ্যা প্রকাশিত “বৈরী ও অবৈরী দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে” দেখুন।
  • (৪) লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এস এন একসময় ভোজপুরের সংগ্রামকে জগজীবন রামের টাকায় ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বলে অপবাদ দিয়েছিলেন। পরে পিসিসি নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশও ভোজপুরের সংগ্রামকে সম্পূর্ণভাবে জাত-পাতের লড়াই বলে খারিজ করে দেয়। প্রয়াত কমরেড সি পি (কমরেড চন্দ্রপোল্লা রেড্ডী – সম্পাদক) আমার (কমরেড ভি এম-এর – সম্পাদক) সাথে সাক্ষাতকারে জানান যে কীভাবে চীনা কমরেডদের ভোজপুর সম্পর্কে বারংবার অনুসন্ধানের জবাবে ভাস্কর নন্দী বারে বারে একই অপবাদ দিয়েছিলেন। সি পি অবশ্য তাঁদের সাথে ভিন্নমত ছিলেন এবং ভোজপুরে যেভাবে খতম অভিযান চালানো হয়েছে তার ব্যবহারিক যৌক্তিকতা মেনে নিতেও তিনি অনেকটা প্রস্তুত ছিলেন।
  • (৫) মজার ব্যাপার হল, মিঃ যোশী তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে লেনিনের বিরোধিতায় রোজা লুক্সেমবার্গের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। স্ট্যালিন যেভাবে কুলাকদের বিষয়টি দেখেছেন তারও তিনি বিশেষ বিরোধী। অবশ্য মাও সে তুঙ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানা যায়নি।
  • (৬) এটা স্বীকার না করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে যে, শহরের দরিদ্রদের কয়েকটি অংশও তাঁর গ্রামীণ ভারতের অন্তর্ভুক্ত; যেমন বস্তিবাসীরা। এদের তিনি দারিদ্র্যের তাড়নায় গাঁ-ছাড়া কৃষক বলেই বিবেচনা করেছেন।
  • (৭) ১৯৮৬ সালের কুখ্যাত আরওয়াল গণহত্যার বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।

(১৯৯৩ সালে লিবারেশন এপ্রিল, মে, জুন ও আগস্ট – চার খণ্ডে প্রকাশিত)

সংঘ পরিবার : স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতক

১৯৪২-এ কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে নিন্দা করেছেন, ধিক্কার জানিয়েছেন অনেকেই। কয়েক বছর আগে শ্রী অরুণ সৌরী মহাফেজখানার নথিপত্র ঘেঁটে ঐ সময় সিপিআই-এর তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকতার বহু তথ্যই হাজির করেছিলেন। অবশ্য তার মধ্যে নিজের কল্পনাপ্রসূত কয়েকটি ‘তথ্য’ও তিনি ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। যাই হোক, একথা অনস্বীকার্য যে ঐ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি এক বিরাট কৌশলগত ভুল করে ফেলেছিল। ভারতের অধিকাংশ কমিউনিস্ট সংগঠনই একথা স্বীকার করে। সংক্ষিপ্ত এই সময়টি ছাড়া কমিউনিস্টরা সবসময়ই ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভগৎ সিং-এর মতো বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী সোভিয়েত ইউনিয়নে অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য তথা কমিউনিস্ট মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আরও অনেকে কমিউনিজমের আদর্শকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।

আধুনিক হিন্দুত্বের প্রথম প্রবক্তা সাভারকর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে গোড়ার দিকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু বিশের দশকের মাঝামাঝি হিন্দু মহাসভার নেতা হয়ে ওঠার পর থেকে তিনি ব্রিটিশের সঙ্গে পরিষ্কার সমঝোতার পথেই চলেছেন। এমনকি ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময়ে তিনি আইনসভা ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে মহাসভার সদস্যদের “নিজের নিজের পদে আসীন থেকে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে” চলার নির্দেশ দেন। সাভারকর ও তার মহাসভার উগ্র মুসলিম-বিরোধী প্রচার এবং “রাজনীতির হিন্দুকরণ ও হিন্দুত্বের সামরিকীকরণের” আহ্বান কার্যত যুদ্ধকালীন পর্যায়ে ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতায় পর্যবসিত হয় (ভি ডি সাভারকর, ঐতিহাসিক বক্তব্যসমূহ, ১৯৫৭)। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারও কংগ্রেসের মধ্যেই কাজ করতেন। কিন্তু হিন্দুত্বের মঞ্চকে বরণ করে নেওয়ার ফলে তিনি ও তাঁর সংগঠন স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে ক্রমশ দূরে সরে যান।

বিশের দশকের গোড়ার দিকে অসহযোগ আন্দোলনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র পর্যায়ের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী ঐক্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব ১৯২২ সালে বিশ্বাসঘাতকতা করে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়। এই আন্দোলন সম্পর্কে হেডগেওয়ারের মন্তব্য কিন্তু অত্যন্ত বিরূপ : “মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশজোড়া (জাতীয়তাবাদী) উদ্দীপনায় ভাঁটা পড়ে। ঐ আন্দোলনের ফলে বহু অনাচারই সমাজজীবনে বিপজ্জনকভাবে মাথাচাড়া দেয়। অসহযোগের দুধকলায় বেড়ে ওঠা যবন সাপেরা বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সারা দেশে দাঙ্গার প্ররোচনা দিয়ে চলতে থাকে।” (ভিষিকার, ১৯৭৯, পৃঃ ৭)

১৯২৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন পুনর্জাগরণের লক্ষণ দেখা গেল, সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল এক শক্তিশালী বিক্ষোভ, তখন এসব থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ একেবারেই দূরে সরে রইল, আরএসএস তখন নাগপুরে তার প্রথম প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে বেশি ব্যস্ত। ঐ বছর সেপ্টেম্বরে নাগপুরে লাগল দাঙ্গা, যার পিছনে সংঘের হাত ছিল সুস্পষ্ট।

লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজকে জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে। এই পটভূমিতে ১৯৩০ সালে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। আবার দেখা গেল লড়াইয়ের ময়দানে আরএসএস অনুপস্থিত। কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারি, ১৯৩০-কে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালনের আহ্বান রাখে। হেডগেওয়ার আরএসএস-এর শাখাগুলিকে নির্দেশ দিলেন ঐ দিনটি উদযাপন করা হবে ভাগোয়া ঝাণ্ডা পুজো করে। সারা দেশজুড়ে জনগণ ঔপনিবেশিক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে দিনটি পালন করেছেন। কিন্তু সেই সংঘর্ষের ময়দানে সংঘের যষ্টিধারী ক্যাডারদের একজনকেও দেখা গেল না।

হেডগেওয়ারের পর ১৯৪০ সালে সরসংঘচালক হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন গোলওয়ালকর। তিনি হিন্দুত্বের মুসলিম-বিরোধী, ব্রিটিশপন্থী প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলেন। গোলওয়ালকরের মতে, “জাতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা গড়ে উঠেছে ভৌগলিক জাতীয়তার তত্ত্ব (অর্থাৎ গোটা ভারতের সব অধিবাসী মিলে একটি জাতি) এবং সাধারণ শত্রুর (অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজ হল হিন্দু মুসলমান সকলেরই সাধারণ শত্রু) তত্ত্বের ভিত্তিতে। এর ফলে নিজেদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবোধের ইতিবাচক ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অন্তর্বস্তু থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ-বিরোধিতাকেই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ বলে চালানো হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র গতিপথের ওপর, তার নেতৃত্বের ওপর এবং সাধারণ মানুষের ওপর এক সর্বনাশা প্রভাব বিস্তার করে।” (গোলওয়ালকর ১৯৬৬, পৃঃ ১৪২-৪৩)।

সম্ভবত এটাই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ধারণার সবচেয়ে সুস্পষ্ট সূত্রায়ন। অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্য যে, হিন্দুত্বের এই প্রবক্তা ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার করেন এমন এক সময়ে যখন ঔপনিবেশিক জোয়াল উৎখাত করতে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আরএসএস-এর যাবতীয় ‘দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী’ হুঙ্কার ও আস্ফালন আসলে কেন্দ্রীভূত ছিল অতীতের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে। সংঘের চোখে মুঘল আমলের শেষ বড় সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শিবাজীর লড়াইয়ের পর ইতিহাসে ছেদ ঘটেছিল। রঙ্গমঞ্চে ব্রিটিশের আবির্ভাব মুঘল শাসনের অবশেষটুকু শেষ করে দিয়েছে, সুতরাং তারা মিত্রশক্তি। শিবাজীর সেই লড়াইকেই আজও চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। মহারাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত আরএসএস-এর মধ্যে এইভাবে এক মারাঠা ছাপ সুস্পষ্ট। আর এইভাবে সংঘ সেই ব্রিটিশেরই হাতে পুতুল হয়ে উঠেছিল, যারা সর্বদাই হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে উস্কে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে অন্তর্ঘাত করতে সচেষ্ট ছিল।

সুতরাং ১৯৪০-৪১-এর আইন অমান্য আন্দোলনে, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে, আজাদ হিন্দ ফৌজে, ফৌজের বিচার ও বোম্বাই নৌবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ১৯৪৫-৪৬ সালে দেখা দেওয়া গণঅভ্যুত্থানগুলিতে আরএসএস-কে যে খুঁজে পাওয়া গেল না তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে?

আজ পরিস্থিতি পাল্টালেও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। আজ আবার দেশ যখন সেই একই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দিক থেকে নয়া উপনিবেশবাদের গুরুতর বিপদের সম্মুখীন, তখন সংঘ পরিবারও আবার তার প্রভুদের সেবায় প্রস্তুত। তাদের দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভারতের ওপর মার্কিন প্রাধান্য বা আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক-বহুজাতিক সংস্থার খবরদারির বিরোধিতা করার কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের সমস্ত আস্ফালনের লক্ষ্যবস্তু হল সুদূর অতীতের মুসলিম শাসনের চিহ্নগুলি। এরা এইভাবে অর্থনৈতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ও বিপন্ন রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় তথা স্বৈরশাসনের বিরোধিতায় জনগণের এক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্তর্ঘাত করে চলেছে। অপরদিকে এরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদেরই সেবা করে চলেছে যারা কমিউনিস্ট চ্যালেঞ্জের পতনের পর ইসলামকে নতুন বিপদ বলে মনে করছে।

হিন্দু রাষ্ট্রের দর্শন নাৎসিবাদের কাছ থেকেই ধার করা

আরএসএস-বিজেপির প্রচারকরা দিনরাত কমিউনিস্টদের অভিযুক্ত করে যে তারা মার্কস নামে এক জার্মান ভদ্রলোকের কাছ থেকে এক বিদেশী মতাদর্শ ধার করে আসছে, বিপরীতে তারা দাবি করে নিজেরা যেন খাঁটি দেশজ। কিন্তু গোলওয়ালকরের মতাদর্শ ও সংগঠনে যার প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায় সেও একজন জার্মান (যদিও জন্ম অস্ট্রিয়ায়)। এই জার্মান লোকটার নাম অ্যাডলফ হিটলার।

আমরা অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তার সংজ্ঞা রচনায় গোলওয়ালকর লিখেছেন, “জার্মান জাতিগর্ব আজ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাদের জাতি ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সেমিটিক জাতিগুলিকে অর্থাৎ ইহুদিদের তাড়িয়ে দিয়ে জার্মানরা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে। জাতিগর্বের এটাই সর্বোচ্চ প্রকাশ। জার্মানি এটাও প্রমাণ করেছে যে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতিকে – যাদের মধ্যকার ফারাক একেবারেই মৌলিক – মিলিয়ে এক অখণ্ড সমগ্র গড়ে তোলা সত্যিই অসম্ভব। এই শিক্ষা হিন্দুস্তানে আমাদের পক্ষেও খুবই লাভজনক।”

নাৎসিবাদের এই ভারতীয় সংস্করণের অর্থ হল অহিন্দু জনসাধারণকে তাদের স্বকীয় পরিচয়ের সবকিছু – ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সবই – বিসর্জন দিতে হবে। যদি তাঁরা তা করতে অস্বীকার করেন, তাহলে গোলওয়ালকর তাঁদের এদেশে থাকতে দিতে পারেন একটি মাত্র শর্তে – তা হল তাঁরা, “এই হিন্দু রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অধীনতা স্বীকার করবেন, কোনো কিছুই দাবি করবেন না, কোনো সুযোগসুবিধা পাবেন না, কোনো পক্ষপাতের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন।”

আরএসএস-এর হিন্দুরাষ্ট্রের সমগ্র দর্শন তাই জার্মান নাৎসি রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক ধার করা সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়।

পৌরাণিক নায়ক রামকে জাতীয় নায়ক-এ পরিণত করার পিছনে বিজেপির মতলব

বাল্মিকীর রামায়ণ বা তুলসীদাসের রামচরিতমানস-এর মতো জনপ্রিয় মহাকাব্য হল দুষ্টের বিরুদ্ধে ভালোর বিজয়লাভের প্রকৃষ্টতম প্রতীক কাহিনী। তা জনপ্রিয় পৌরাণিক চরিত্র রামকে অবতার পুরুষে পরিণত করেছে। রাম এইভাবে হিন্দু জনসাধারণের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জগতের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়ের মূর্তরূপ হিসাবে মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও তাঁর রামরাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে অনেকেই তুলে ধরেন। আধুনিক হিন্দুত্বের উত্থানের আগে কেউ কখনও রামকে জাতীয় নায়ক বা রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করার কথা চিন্তাও করেননি।

হিন্দুত্বের মতাদর্শের জনক সাভারকর প্রাণপণে হিন্দু ভারতের এক প্রতীকের সন্ধান করতে করতে রামের মধ্যেই তা খুঁজে পান। তিনি লেখেন, “আমাদের কেউ কেউ রামকে অবতার রূপে পুজো করেন, কেউ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন বীর যোদ্ধা হিসাবে, আর সকলেই তাঁকে ভালোবাসেন আমাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে প্রতিনিধি-স্থানীয় সম্রাট হিসাবে।” তারপর থেকেই হিন্দুত্বের প্রবক্তারা এই ‘জাতির সবচেয়ে প্রতিনিধি-স্থানীয় সম্রাটে’র কথা বারংবার তুলে ধরেছেন। ১৯২৭ সালে আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে বেছে নেওয়া হয় বিজয়া দশমীকে। আরএসএস-এর পতাকা হিসাবে বেছে নেওয়া হয় রামের পতাকা বলে পরিচিত গৈরিক পতাকাকে।

শেষ পর্যন্ত, বাবরি মসজিদ – যা নাকি এক রামমন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল – সেটাই সংঘ পরিবারের হাতে হয়ে দাঁড়াল সেরা হাতিয়ার যেখানে রামকে দাঁড় করানো হল বাবরের বিরুদ্ধে। এইভাবে সাংস্কৃতিক-ধর্মীয়-পৌরাণিক নায়ক থেকে রামের রূপান্তর হল রাষ্ট্রনায়কে, যার তীরের লক্ষ্য মুসলিম ‘হানাদাররা’।

রামকথায় রাবণ সীতাকে বন্দিনী করে রেখেছিল। আজ সংঘ পরিবারের রাবণেরা স্বয়ং রামকেই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বন্দী করে রেখেছে। রামকে এদের হাত থেকে মুক্ত করে তাঁর ভক্তদের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় জগতে ফিরিয়ে দিতে হবে।

আরএসএস বারবার মুসলিমদের বলে এসেছে যে, তাঁরা যদি রামকে তাঁদের নায়ক হিসাবে মেনে নেন তাহলেই সমস্ত সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু মুসলমানদের তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে মুর্তিপূজায় রত হতে বলা কেবল অবাস্তবই নয় ঔদ্ধত্যেরও পরিচায়ক। তাছাড়া হিন্দু ধর্মের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ধারা যখন একেশ্বরবাদ তথা ঈশ্বরকে বিমূর্ত এক সত্তা হিসাবে দেখার পথে এগিয়ে গেছে তখন এই দাবি নিঃসন্দেহে এক পশ্চাদমুখী দাবি।

অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রের সঙ্গে রামের কিছু ফারাক অবশ্য রয়েছে। সবকিছু হারিয়ে তিনি নিম্নতর জাতের মানুষের সাথে জীবনযাপন করছেন, তাদের সহায়তায় ব্রাহ্মণ রাজা রাবণকে পরাজিত করছেন, এ কাহিনী সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। এ সত্ত্বেও বিভিন্ন গোষ্ঠী বা এলাকার হিন্দুদের মধ্যেও রামের আকর্ষণ সমান নয়। বিশেষত দলিতরা এবং আরও কিছু কিছু হিন্দু গোষ্ঠী রামের কয়েকটি কাজের সমালোচনা করে থাকেন, কারণ সেগুলি তাদের মতে উচ্চবর্ণের মানসিকতারই পরিচয় বহন করে।

এদেশে হিন্দু-মুসলিম উভয়েই ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের তথা ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের শহীদদেরই তাদের জাতীয় নায়ক হিসাবে গণ্য করে থাকেন। এবং এটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতও বটে। সংঘ পরিবারেরও উচিত এই একই মানসিকতা মেনে নেওয়া, কারণ, গোলওয়ালকর যাই বলে থাকুন না কেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের ময়দানেই।

হিন্দু গৌরবের কল্পকথা

সংঘ পরিবারের একটি চটকদার স্লোগান হল : গর্ব সে কহো হম্ হিন্দু হ্যায় অর্থাৎ ‘সগর্বে বলো আমি হিন্দু’। সংঘের তাত্ত্বিকদের মতে, হিন্দু গৌরবের অবনতির দরুণই তাঁরা পরপর বিদেশী হামলার সামনে বিনা প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করেছেন। এই হিন্দু গৌরবের পুনরুদ্ধারের জন্যই হিন্দু অবমাননার সমস্ত স্মৃতিচিহ্নগুলিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া দরকার। বিংশ শতকের শেষ লগ্নে হিন্দুর ধর্মযুদ্ধের সূচনা হয়েছে তাই বাবরি মসজিদ ভেঙে। নিঃসন্দেহে এটা কেবল শুরু। তালিকায় আরও আছে কাশী ও মথুরার মসজিদ, জামা মসজিদ, এমনকি তাজমহলও।

আসুন আমরা হিন্দুধর্মের ইতিহাসের পর্যালোচনা করে এই তথাকথিত হিন্দু গৌরবের আসল চেহারাটা বোঝার চেষ্টা করি। মজার কথা এই যে, ভারতে প্রথম বিদেশী হানাদার ছিলেন আর্যরাই। মধ্যপ্রাচ্যের পার্বত্য অঞ্চল থেকে খ্রিষ্টজন্মের হাজার দুয়েক বছর আগে তাঁরা এদেশে আসেন। হিন্দু ভারতের দাবিকে জোরালো করতে সংঘ পরিবার ইতিহাসের সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। সমস্ত সুপরিচিত ঐতিহাসিক ধারণাকে নাকচ করে তারা প্রমাণ করতে চায় – আর্যরা এদেশেরই আদি বাসিন্দা। এটা সবৈব মিথ্যা। সিন্ধু উপত্যকায় হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার জনসাধারণই ভারতের আদি বাসিন্দা। তাঁদের সভ্যতা ছিল আর্যদের চেয়ে উন্নত। প্রাক-আর্য ভারতীয়রা খুব সম্ভবত ছিলেন দ্রাবিড়। আর্য-জাতিগুলি ছিল আধা-যাযাবর প্রকৃতির পশুচারণ-নির্ভর জাতি। তাঁদের সমাজব্যবস্থা ছিল সামরিক গণতন্ত্রনির্ভর উন্নত পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীব্যবস্থা। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন প্রাক-শ্রেণী থেকে শ্রেণী সমাজে উত্তরণের পর্যায়ে। সিন্ধু উপত্যকা ও উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে তাঁরা ধীরে ধীরে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়েন। এই বিস্তারের সময়ে তাঁদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। এই উত্তরণের সমগ্র পর্যায়টিই ঋকবেদ ও অন্যান্য বেদে প্রতিফলিত হয়েছে।

এই সময়ে আর্যদের ধর্মকে বৈদিক ধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে দেব ও অসুর উভয়েই ছিল বৈদিক দেবতা, যদিও দুটি বিরোধী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে, অসুর হয়ে পড়ে অশুভ আত্মা অর্থাৎ অন্যান্য ইরানিদের ক্ষেত্রে যা ঘটল তার ঠিক বিপরীত। আর স্থানীয় বৈরি দ্রাবিড় উপজাতিগুলিকে চিহ্নিত করা হয় রাক্ষস হিসাবে।

বৈদিক আর্যরা বহু দেবতার উপাসক ছিলেন। দেবতাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করা হত। বিশেষত ইন্দ্র দখল করেছিলেন কেন্দ্রীয় অবস্থান। কোনও মন্দির ছিল না, ছিল না পুরোহিততন্ত্র, ছিল না মরণোত্তর প্রায়শ্চিত্যের কোনও ধারণা। শরীরের থেকে আত্মার পৃথক অস্তিত্বের ভাবনাও তখন পর্যন্ত তাঁদের ধারণায় আসেনি। সামাজিক শ্রমবিভাজনের প্রতিফলন হিসাবে গড়ে উঠেছে এক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। এক কথায় বৈদিক ধর্ম ছিল আর্যসমাজের উত্তরণশীল পর্যায়েরই প্রতিফলন। পরলোকের চেয়ে ইহলোকই ছিল তার কাছে প্রধান।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ নাগাদ আর্য জাতিগুলি ধীরে ধীরে কৃষিনির্ভর স্থায়ী জনবসতি গড়ে তোলে। এই সময় আদিম দাসব্যবস্থার ভিত্তিতে অনেকগুলি স্বৈরতান্ত্রিক রাজ্য গড়ে ওঠে। এই পর্যায়ে বৈদিক ধর্মের জায়গা নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদ।

বর্ণভেদ প্রথা এই সময়ে অনেক বেশি কঠোর হয়ে ওঠে এবং বেদজ্ঞ বিশেষ কর্তৃত্ব সম্পন্ন এক নতুন সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ব্রাহ্মণেরা। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে মনু সংহিতা বর্ণভেদ ও জাতিভেদকে স্বর্গীয় বিধান হিসাবে তুলে ধরে। ব্রাহ্মণদের প্রায় দেবতায় পরিণত করা হয়। বহু বৈদিক দেবতা পিছনের সারিতে চলে যায়। পরিবর্তে নতুন কিছু দেবতা প্রধান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান হল ব্রহ্মা। স্থানীয় আদিবাসীরা আর্য বিজেতাদের সমাজে ধীরে ধীরে মিশে যেতে শুরু করলে তাঁদের আরাধ্য দেবতারাও ব্রাহ্মণ্যধর্মের অঙ্গীভূত হতে থাকে। অনমনীয় এক জাতিভেদের যুগে দেবতারাও বিশেষ বিশেষ জাতির দেবতা হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে। উপনিষদের যুগে আত্মার দেহান্তর প্রধান ধারণা হিসাবে সামনে আসে এবং কর্মফলের ধারণা পুনর্জন্মবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

ব্রাহ্মণ্যযুগকে উপনিষদের যুগও বলা হয়। এই সময়ে চিরায়ত দর্শনের ছটি ধারা গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণদের প্রধান দর্শন ছিল বেদান্ত। এতে আত্মা ও ব্রহ্মের মিলনের কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রত ক্ষত্রিয়রা পক্ষ নেয় সাংখ্য দর্শনের, যা ছিল বস্তুবাদের নিকটতর একটি দর্শন।

চিরায়ত দর্শনের গণ্ডির বাইরে আত্মপ্রকাশ করে চার্বাক ও লোকায়ত বস্তুবাদী দর্শন, যা এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বও অস্বীকার করে। ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ এই দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছিল।

ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার নিজের ভারেই পতনের মুখে পড়ে। ব্যাপক জনসাধারণ অনমনীয় জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে কিছুটা অসচেতন এক প্রতিবাদ হিসাবে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে বৌদ্ধ ও কিছু পরিমাণে জৈন ধর্মের পিছনে সমাবেশিত হতে শুরু করেন।

এই দুই প্রতিবাদী ধর্মীয় ধারাই ছিল জাতিভেদ ও পুরোহিততন্ত্রের বিরোধী। ক্রমশ বৌদ্ধধর্মই প্রধান ধারা হিসাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের জায়গা দখল করে। এই বৌদ্ধধর্ম খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে মোর্য ও কুশান রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় এমনকি রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদাও অর্জন করে। জটিল আচার আচরণ তথা গণবিচ্ছিন্ন আভিজাত্য নিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয় আবেদনের সমানে দাঁড়াতেই পারেনি।

প্রাধান্য অর্জনের জন্য বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আদি শঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে সাজায়। এভাবেই সূচনা হয় হিন্দুধর্মের। মন্দির ব্যাপারটা বৌদ্ধরাই প্রথম নিয়ে আসেন। জনগণকে আকৃষ্ট করতে গড়ে তোলা হল বিরাট বিরাট দেবমূর্তি সহ বিশাল বিশাল হিন্দু মন্দির ও নানা তীর্থক্ষেত্র। আর জনসমাবেশ সুনিশ্চিত করতে প্রকাশ্য অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় শোভাযাত্রা শুরু করা হল। দেবতাদের সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য অবতারের কল্পনা করা হল। রাম বা কৃষ্ণের মতো পৌরাণিক নায়কদের উত্তীর্ণ করা হল দেবতাদের অবতার তথা পরিত্রাতার ভূমিকায়। বুদ্ধকেও বিষ্ণুর এক অবতার হিসাবে এই ধর্মের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হল এবং আশ্চর্যজনকভাবে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এক বিশ্বমাত্রিক ধর্মে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও তার জন্মভূমিতে বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল।

হিন্দুধর্মের মূলকথা হয়ে দাঁড়াল পুরোনো জাতিভেদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি জনসাধারণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার নতুন নতুন পদ্ধতি। সামাজিক স্তরভেদ, জাত, জাতি ও উপজাতির বিভিন্নতা তথা শ্রেণীসম্পর্কের জটিলতা যত বেড়ে উঠতে শুরু করল হিন্দু সমাজ ততই অসংখ্য বিবদমান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে লাগল।

কেউ কেউ সর্ব পন্থা সমভাবের কথা বলতে চেষ্টা করেন – পরবর্তীতে এটাই সর্ব ধর্ম সমভাবের রূপ নিয়ে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি হিসাবে ঘোষিত হয় – কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিছু পরের যুগে প্রথমে ইসলাম ও পরে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবে কিছু ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করে। কবীর, নানক, চৈতন্য ও অন্য বহু ধর্মসংস্কারক হিন্দুধর্মের জাতিভেদ ও জটিল আচার-আচরণের তীব্র সমালোচনা করেন। মধ্যযুগে এঁদের এই সংস্কার আন্দোলন ভক্তি আন্দোলন হিসাবে পরিচিত। এই সমস্ত সংস্কারকদের মধ্যে কবীরের নাম সর্বাগ্রগণ্য। সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়ে তিনি ব্রাহ্মণদের কুসংস্কার ও কপটাচারের বিরুদ্ধে কঠোরতম ভাষায় আক্রমণ হানেন।

ব্রিটিশ যুগে সংস্কারের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, দয়ানন্দ সরস্বতী ও বিবেকানন্দ। এঁরা প্রত্যেকেই বেদান্তের অদ্বৈতদর্শনের প্রচার করেন ও জাতিভেদ প্রথা বিলোপের চেষ্টা করেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রবণতাই শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মে আরও একটি নতুন গোষ্ঠীর জন্ম দেওয়ার চেয়ে বেশি কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। অনমনীয় দৈবনির্ধারিত জাতিভেদ প্রথা নিয়ে হিন্দুধর্ম নিজেকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেছিল এবং ফলে তা মূলত একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম বিশ্বমাত্রিক ধর্মের স্বীকৃতি পায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নামটি তাই একেবারেই অসঙ্গত। হিন্দুধর্মকে বিশ্বধর্ম হিসাবে তুলে ধরার এটা এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

হিন্দুধর্মের সমস্ত প্রগতিশীল সংস্কার আন্দোলন এক মিথ্যা হিন্দু গৌরবের ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর যা করেছে তা হল এই ধর্মকে এক উদার, আধুনিক রূপ দেওয়ার, বিশেষ করে তার কঠোর জাতিভেদের অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টা। গোঁড়া হিন্দুধর্মের নিয়ন্তারা সর্বদাই তাদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলির জোরে এইসব প্রচেষ্টাকে প্রায় ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজ এই প্রথম সংঘ পরিবারের পরিচালনায় শুরু হয়েছে এক পাল্টা আন্দোলন যা ঐ সমস্ত সংস্কারের যেটুকু ইতিবাচক প্রভাব ছিল তাকেও ধ্বংস করতে উদ্যত। যাঁরা হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক এই অভ্যুদয়ের ফলে হিন্দুধর্মের কোনও ইতিবাচক সংস্কার আশা করছেন, তাঁরা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। এই আন্দোলনের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা কেবল পেয়েছি ইতিহাসের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি, সাধু ও মহন্তদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, বর্ণহিন্দুদের নতুন আগ্রাসী আচরণ আর উপরন্তু, বজরং দল ও শিব সৈনিকদের লুম্পেন বাহিনী। এটাকেই সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিকরা হিন্দুত্বের অভ্যুদয়, হিন্দুধর্মের মধ্যে খালসা ধরনের ক্ষত্রিয় চেতনার অগ্রগতি ও হিন্দু গৌরবের আত্মঘোষণা হিসাবে বর্ণনা করছেন।

ধর্মকে সঠিকভাবেই পারিপার্শ্বিক অবস্থার কাছে মানুষের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধর্মীয় কল্পকথা সত্যিই মানুষের মনে পরিবেশ-নির্ধারিত শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার মোহ রচনা করে, আর তাই সাধারণ মানুষ সবসময়েই, বিশেষ করে কঠিন সময়ে, ধর্মের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু কল্পনা নিছক কল্পনাই। তা কখনই বাস্তবের বিকল্প হতে পারে না। হিন্দু গৌরবের ঝাণ্ডা উড়িয়ে, হনুমানকে অতিমানবের আসনে বসিয়ে একটা নড়বড়ে কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, সম্ভব শতসহস্র নিরস্ত্র মানুষকে আঘাত হানা, হত্যা করা। কিন্তু তা দিয়ে নয়া ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির আক্রমণের মোকাবিলা করা যায় না। এই আক্রমণ এখনও চলছে। আর মজার ব্যাপার এই যে তা চলছে হিন্দু গৌরবের ধ্বজাধারীদের স্পষ্ট প্রশ্রয়েই।

‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিন্দুধর্ম – সোনার পাথরবাটি!

সংঘ পরিবার আর একটি বক্তব্য বহুবার তুলে ধরেছে – ভারতবাসীর ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দু বলেই ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, হিন্দুধর্মের এই তথাকথিত অন্তর্নিহিত সহিষ্ণুতাকে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে এক করে দেখার ধারণাটি সরকারি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ও গোড়ার কথা। আর তাই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারে ক্রমাগত হিন্দু মানসিকতার জয়গানই শোনা যায়।

হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক উত্থানের ফলে আজ আমরা দেখছি হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনার সাংঘাতিক বৃদ্ধি, দেশের রাজনীতিতে সাধু-মহন্তদের ক্রমবর্ধমান রমরমা, বজরং দল বা শিবসেনার মতো সংগঠনগুলিতে সমাজের যত আবর্জনার একত্রিত হওয়া, মুসলিম-বিরোধী হত্যালীলার মারাত্মক বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখায় প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতের বহিঃপ্রকাশ এবং শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতে সমস্ত বিরোধী মতামতের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। এর থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে একটা নির্ভেজাল হিন্দু রাষ্ট্র মানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

দ্বিতীয়ত বেশ কিছু উন্নত দেশ, যেখানে প্রধান ধর্ম খ্রিষ্ট বা বৌদ্ধধর্ম, তারা ভারতের থেকে অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। বিশেষত খ্রিষ্টধর্ম এক সময় অত্যন্ত গোঁড়া ও অসহিষ্ণু ধর্ম ছিল – ইনকুইজিশনের (রোমান ক্যাথলিক যাজকদের তৈরি বিচারসভা) কথা মনে করে দেখুন। অনেক ইউরোপীয় দেশে চার্চও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান। সময়ের ধারাবাহিকতায় খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে বহু ধারার জন্ম হয় এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্য রাষ্ট্র ও চার্চের বিচ্ছেদ নিশ্চিত করে। বস্তুত, রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিই পশ্চিমী দেশগুলিতে সফল বুর্জোয়া বিপ্লবের ফসল।

হিন্দুধর্মের তথাকথিত এই অন্তর্নিহিত সহনশীলতার প্রবক্তারা অবশ্য এর সঙ্গে তুলনা করেন কেবল ইসলামের তথাকথিত অন্তর্নিহিত অসহিষ্ণুতার। হিন্দু জনসাধারণের এক বিরাট অংশ ইসলাম সম্পর্কে এই রকম ধারণাই পোষণ করেন। কাজেই ইসলামের বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানা প্রয়োজন।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতি পরস্পর শক্তিক্ষয়ী এক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। মরুবাণিজ্যের মন্দা ও তার দরুণ জমির চাহিদায় বৃদ্ধির জন্যই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে যুযুধান উপজাতিগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার আন্দোলন হিসাবেই ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। এই ঐতিহাসিক সময়ে বিভিন্ন উপজাতীয় রীতিনীতির মিলন ও একক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অর্থাৎ আল্লার প্রতি আনুগত্যের বাণী প্রচার শুরু করেন মহম্মদ। তাঁর নিজের উপজাতি কোয়েরিশের প্রধানরা ও বণিক অভিজাততন্ত্র প্রথমে তাঁর এই মতের তীব্র বিরোধিতা করে। তিনি মক্কা থেকে পালাতে বাধ্য হন। মদিনার মরুদ্যানের কৃষিজীবী জনসাধারণ ছিলেন মক্কার এই অভিজাততন্ত্রের বিরোধী। তাঁরা মহম্মদকে সমর্থন যোগান। এঁদের সাহায্যেই তিনি শেষপর্যন্ত মক্কা দখল করেন। এক প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় কেন্দ্র হিসাবে মক্কার আবির্ভাবের সাথে সাথে কোয়েরিশ অভিজাততন্ত্রও ইসলাম গ্রহণ করে, এমনকি তার নেতায় পরিণত হয়।

এঙ্গেলসের কথায় ইসলাম ধর্ম ছিল একদিকে শহরবাসী বণিক ও শিল্পী সম্প্রদায়ের জন্য, আবার একই সঙ্গে যাযাবর বেদুইনদের জন্যও।

আরবদের জাতীয় ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ইসলাম অল্পদিনের মধ্যেই এক বিশ্বধর্মে পরিণত হয়। অষ্টম ও নবম শতাব্দীর মধ্যে স্পেন থেকে মধ্য এশিয়ার ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূখণ্ডের একমাত্র ধর্ম হয়ে ওঠে ইসলাম। পরবর্তী শতকগুলিতে এই ধর্ম উত্তর ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আরও পরে ইন্দোনেশিয়া, ককেশিয়া তথা বলকান রাষ্ট্রগুলির কিছু কিছু জাতির মধ্যেও এই ধর্মের বিস্তার ঘটে।

নতুন নতুন এলাকা দখল ও তাদের এক করে তুলতে আরবরা যে সব ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ পরিচালনা করেছিল সেগুলি ইসলামের প্রসারে এক প্রধান ভূমিকা নেয়। কিন্তু বাইজানটাইন বা সিসামিড সাম্রাজ্যের মতো দেশের জনসাধারণ যে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তোলেননি তার জন্য দায়ী স্থানীয় সামন্তপ্রভুদের মারাত্মক নিপীড়ন। আরবদের বিজিত দেশগুলিতে কৃষক জনসাধারণের, বিশেষত যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের দেয় খাজনা অনেকাংশে কমানো হয়। ভারতে ইসলামের বিস্তারে সাহায্য করেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিভেদের অমানুষিক নিপীড়ন। প্রাচ্যের পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত রাষ্ট্রগুলিতে কৃষক জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল তার সরল রীতিনীতির দরুণ।

পরবর্তীকালে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ও ধর্মনিরপেক্ষ গবেষকরা জিহাদের নির্দেশাবলীকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এমনকি হিন্দুধর্মকেও এক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ-সম্বলিত ধর্ম হিসাবে, রাম ও কৃষ্ণকে তাঁদের যুগের পয়গম্বর হিসাবে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। পাঠক এ প্রসঙ্গে বিহারের মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক মহলে ওঠা এক সাম্প্রতিক বিতর্কের কথা স্মরণ করতে পারেন। কোনও এক মুসলিম পণ্ডিত হিন্দুদের কাফের বলা উচিত নয় বলে মতপ্রকাশ করলে এই বিতর্কের জন্ম হয়।

ইসলামে ধর্মীয় বিধানের ভিত্তিতে নাগরিক আইন ও দণ্ডবিধি সূত্রবদ্ধ আছে – একেই শরিয়ৎ বলে। পিতৃতান্ত্রিক উপজাতীয় মানসিকতা ইসলামের পারিবারিক মূল্যবোধকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল, আর তাই নারী সেখানে পুরুষের অধীন। কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রায় সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য। বরং তৎকালীন আরবের নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অত্যাচারের নিন্দা করে এবং স্ত্রীলোকের সম্পত্তির অধিকার – পণ ও উত্তরাধিকারের অধিকার – নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে কোরান নারীর মর্যাদাকে কিছুটা বাড়াতেই সমর্থ হয়েছিল।

ইসলাম ব্যাপক সংখ্যায় মানুষকে ধর্মের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হলেও মুসলিম দেশগুলিতে জাতীয় ও শ্রেণীদ্বন্দ্বগুলি বেড়েই চলতে থাকে। এরই প্রতিফলন হিসাবে ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ও গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।

এদের মধ্যে প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গোষ্ঠীটি হল শিয়া। আরবদের আভ্যন্তরীণ লড়াই তথা মহম্মদের উত্তরসূরীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হিসাবে এর শুরু হলেও শীঘ্রই তা আরব বিজেতাদের বিরুদ্ধে পারস্যের জনগণের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের রূপ নেয়। আজও ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম শিয়া। মুসলিম জগতের অধিকাংশই অবশ্য সুন্নি। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে সুন্নিদের একটি গোষ্ঠী, মুজীলাইটরা এক যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম মতবাদকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন যে কোরান ঈশ্বরসৃষ্ট নয়, মানুষেরই রচনা আর মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে। ধর্মীয় বিধানের আক্ষরিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে চলে আসা গোঁড়া ধারার বিপরীতে ইসলামের মধ্য থেকেই এমন কিছু কিছু ধারা উঠে আসে যেগুলি এর অনেক উদার ব্যাখ্যা অনুমোদন করে। মুসলিম জগতের অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলিতে এগুলি যথেষ্ট সমর্থন ভোগ করে।

সুফীবাদের সূচনা শিয়াদের মধ্যে হলেও পরবর্তীকালে সুন্নিদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছিল। সুফীরা বাহ্যিক আচার আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে এক মায়াময় মিলনের কথা বলতেন। তাঁদের অদ্বৈতবাদী ধারণা গোঁড়া অর্থে কোরানের থেকে বিচ্যুতিই ছিল। গোঁড়া মুসলিমদের হাতে তাই প্রথমদিকে তাঁদের অত্যাচারিত হতে হয়েছে। পরে অবশ্য একটা আপোশরফা হয়।

ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুসলিম ঐতিহ্যে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসে। বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রভাব সীমায়িত হয়, আইনব্যবস্থাকে করে তোলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ, আর মুসলিম মোল্লাতন্ত্রের হাত থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করা হয়। তুরস্কে ১৯২০-র দশকে কামাল পাশার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আমূল কিছু সংস্কার প্রবর্তিত হয়।

ভারত এক্ষেত্রে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এখানে হিন্দুধর্মের অসংখ্য দেবদেবী ও মূর্তি পূজার সঙ্গে ইসলাম সহাবস্থান করে এসেছে বহু শতাব্দী ধরে। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে দুটি ধর্মের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। অথচ তৃণমূলস্তরে উভয় ধর্মের সাধারণ মানুষ এক অভিন্ন জীবনযাত্রা, আশা-আকাঙ্খা, এমনকি বহু অভিন্ন বিশ্বাসের অংশীদার। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর যে সমস্ত মুসলিম জনগণ ভারতে থেকে গেলেন তাঁদের যে পাকিস্তানের প্রতি একটা দুর্বলতা থাকবে এটা স্বাভাবিক, ঠিক যেমন পাকিস্তানি বা বাংলাদেশী হিন্দুদের ভারতের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। দেশভাগের পর ভারতীয় মুসলিমদের রাজনীতি মোটামুটিভাবে কংগ্রেসের চারপাশেই ঘোরাফেরা করেছে। নিজের ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে কংগ্রেস মুসিলম মৌলবাদী শক্তিগুলিকে অনেক সময় বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য হিন্দু মৌলবাদকে দেওয়া ছাড়ের সামাল দিতেই এটা তাকে করতে হয়েছে। এই খেলার অবশ্য বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কংগ্রেসের প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মোহভঙ্গ ঘটিয়েছে। জনতা দলের মতো দলগুলি কংগ্রেসের এই দুরবস্থার সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদেরও লক্ষ্য সেই মৌলবাদী অংশটিকেই দলে টানা।

বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র তথা ধর্মীয় তাণ্ডব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসাপে মুসলিমদের মধ্যে মৌলবাদকেই শক্তিশালী করেছে। প্রগতিশীল সমাজসংস্কার হিসাবে বহুবিবাহের বিরোধিতা করা এক জিনিস, কিন্তু একে মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা উদ্ভট ব্যাপার। বহু সন্তানের জন্মদান সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য – কোনও বিশেষ ধর্মের ব্যাপার নয়। ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহের খুব একটা প্রচলন নেই বললেই চলে। তাছাড়া একটু সাধারণ বুদ্ধি খাটালেই বোঝা যায়, নারী-পুরুষের বর্তমান অনুপাতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা কখনই বহুলপ্রচলিত হতে পারে না, জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য দায়ী হওয়া তো দূরের কথা। এক অভিন্ন নাগরিক আইন তথা মুসলিম নারীদের অধিকার নিয়ে বিজেপির দুশ্চিন্তা আসলে বিরাট ভাঁওতাবাজি – মুসলিম সত্তার ওপর এক সামগ্রিক আক্রমণের অংশবিশেষ। শাহবানু মামলায় তার হস্তক্ষেপ কেবল গোঁড়া মুসলমানদের পাল্টা আঘাতকেই ডেকে আনে। ফলে এক প্রগতিশীল সমাজসংস্কারের ব্যাপারে মুসলিম জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তা ধাক্কার মুখে পড়ে।

হিন্দু-ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য করার কথা বলে বিজেপি তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতকেই শক্তিশালী করছে। একইভাবে মুসলিম সত্তাকে হিন্দু ‘সাংস্কৃতিক’ সত্তায় মিলিয়ে দেওয়ার বিজেপির দাবিও ভারতের মিশ্র প্রকৃতিকে সরাসরি নাকচ করারই সমার্থক। বিজেপি হিন্দু সত্তাকেই ভারতীয় সত্তা হিসাবে চালাতে যত চেষ্টা করুক না কেন, সংঘ পরিবারের মতাদর্শগত আক্রমণ ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে মোহকেই জিইয়ে রাখবে ও শক্তিশালী করবে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুস্পষ্ট হিন্দু পক্ষপাতের জন্যই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান সম্বন্ধে এক মোহ। আর আজ সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের আস্ফালনের দরুণই তা টিকে থাকছে, শক্তিশালী হচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি করে আজ আবার তারা নয়া ঔপনিবেশিক বিপদের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের প্রতিরোধে ভাঙ্গন ধরাতে, তাকে দুর্বল করতে উদ্যত। সংঘ পরিবার আজ আবার তার প্রভুদের সেবায় হাজির – ঠিক যখন তার সেবার দরকারও সবচেয়ে বেশি।

যাই হোক, ভারতীয় মুসলিমদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শেষ কথা বিজেপি বলবে না। মুসলিম যুবকদের নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানের প্রতি কোনো আন্তরিক টান নেই, বরং তাঁরা ভারতে ভারতীয় মুসলিম হিসাবেই নিজেদের স্থান করে নিতে আগ্রহী। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক নন। আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাঁদের বামপন্থীদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। মুসলিমদের মধ্যকার প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম সমাজের গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলছেন, জোর দিচ্ছেন আধুনিক শিক্ষার ওপর, বিশেষত নারীর অবস্থার উন্নতির ওপর। সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কর্তব্য ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই বিকাশমান ধারাটিকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করা, যাতে তাঁরা ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সমান অংশীদার হয়ে উঠতে পারেন। কেবল এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাষ্ট্রই পাকিস্তানের অস্তিত্বের যৌক্তিকতাকে অমূলক করে তুলতে পারে। আর তারপরও যদি পাকিস্তান থাকে, তাহলে দেখবেন ভারতীয় মুসলিম যুবকেরা সেদিন ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয়ে তাঁদের হিন্দু ভাইদের সঙ্গে একইভাবে আনন্দে মেতে উঠবেন।

উপসংহারের পরিবর্তে

গত মার্চ মাসে একজন কমরেড আমার হাতে একটি প্রশ্নমালা তুলে দেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের সময় এই প্রশ্নমালা প্রচার করেছিল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। কমরেডটি অনুরোধ করেছিলেন ঐ প্রশ্নমালার এক ‘মুখের মতো’ প্রত্যুত্তর আমি যেন তৈরি করি। প্রশ্নগুলি ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পুরোনো সব অভিযোগের চর্বিতচর্বন – তাদের মতবাদ নাকি বিদেশী; ভারত ছাড়ো আন্দোলনে, দেশভাগের সময়, এমনকি জরুরি অবস্থার সময় তাদের ভূমিকা ইত্যাদি। বিদ্যার্থী পরিষদ অবাক হয়ে গিয়েছিল – সোভিয়েতের পতনের পর ভারতবর্ষে মার্কসবাদের আর কী প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে। কিন্তু কী অবাককাণ্ড! অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েই বিদ্যার্থী পরিষদ পেয়ে গেল মুখের মতো জবাব!

বিশ্ব বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় এই লড়াই স্পষ্টতই এক মতাদর্শগত মাত্রা অর্জন করে এবং আইসা-র কাছে পর্যুদস্ত হতে হয় বিদ্যার্থী পরিষদ-কে। এই বিজয় ছিল আইসা-র একক কৃতিত্ব, কেননা সিপিআই, সিপিআই(এম), জনতা দল, মুলায়ম এবং এমনকি প্রাক্তন নকশালপন্থীদের ছাত্রসংগঠনগুলিও আইসা-কে হারাতে উঠে পড়ে লেগেছিল। নৈনিতাল ও এলাহাবাদের ধারাবাহিকতাতেই আসে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় এবং তা সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।

এই সেদিনও সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিক বাহিনী মার্কসবাদের ‘মৃত্যুকে’ উল্লাসের সঙ্গে উপভোগ করেছেন এবং পশ্চিমবাংলা ও কেরলে তাঁদের বর্ধমান প্রভাবকে ঐ মৃত্যুর প্রমাণ হিসাবে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন। আজ কিন্তু উত্তর প্রদেশের বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্রগুলিতে মার্কসবাদের এই পুনরুত্থানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হয়। পাল্টা আক্রমণ হানার পক্ষে পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে ওঠে এবং সেখান থেকেই এই ধারাবাহিকের জন্ম।

দুঃখের কথা, সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক দর্শনের বিরুদ্ধে অধিকাংশ রচনাই এক উদারনীতিবাদী হিন্দু কাঠামোর মধ্যে আটকে থেকেছে : রামের মহিমাকীর্তন, হিন্দু সহিষ্ণুতা ও সর্ব ধর্ম সমভাবের বিষয়বস্তু এবং তারই পরিপূরক হিসাবে গান্ধী ও বিবেকানন্দের উদার হিন্দু ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা এবং সাম্প্রদায়িক বিবেকের কাছে আবেদন জানানো – ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের প্রচারের মূল ধারা এই খাতেই রয়েছে। ধর্মের ভূমিকা সম্বন্ধে এক নতুন উপলব্ধির কথা বলে বাম নেতৃবৃন্দও এর সুরে সুর মেলান। সিপিআই ও সিপিআই(এম) পন্থীদের কাছে যিনি খুব কাছের ছিলেন, সেই নেহরুও অপাংক্তেয় হয়ে পড়লেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বামেদের রচনায় নেহরুকে সরিয়ে তার স্থান গ্রহণ করেন গান্ধী। কপট ধর্মনিরপেক্ষতা আর কী হতে পারে!

হিন্দু রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী অন্তর্বস্তু তথা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির ব্যাপকতম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু একটি বাম কেন্দ্রকে নতুন করে সংহত করে তোলার বিষয়টি অবহেলিত থাকায় তা মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের পথকেই প্রশস্ত করে। একথা বলাই বাহুল্য যে, এক শাণিত প্রতি-আক্রমণ ছাড়া তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে সামগ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রচারই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দায়িত্ব নেবে? সেই দায়িত্ব একমাত্র মার্সবাদী-লেনিনবাদীদের উপরই বর্তায়।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের জনপ্রিয় প্রচার অভিযানে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম :

(ক) স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন হিন্দু প্রতীকের, বিশেষত রামরাজ্যের, ব্যবহার করার গান্ধীবাদী পদ্ধতির বিরুদ্ধে এবং একেই মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করি।

(খ) রাধাকৃষ্ণণ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্ব ধর্ম সমভাব হিসাবে যে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন – এবং যা সরকারি অবস্থান হয়েও দাঁড়ায় – তার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে ধর্মের প্রতি যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের নীতি কেবলমাত্র হতে পারে সর্ব ধর্ম বর্জিত।

(গ) রামের মতো একটি ধর্মীয় চরিত্রকে জাতীয় নায়ক হিসাবে তুলে ধরার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে এই মর্যাদা একমাত্র জননায়ক ভগৎ সিং-এরই প্রাপ্য।

(ঘ) দেশের ঐক্য রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে হিন্দু রাষ্ট্রকে তুলে ধরার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে, ইতিহাসের শিক্ষা যদি সত্যি হয় তবে হিন্দুরাষ্ট্র অবশ্যই ভেঙ্গে গিয়ে অসংখ্য রাজ্যের জন্ম দেবে। শিবসেনার মারাঠা রাষ্ট্রের বিকাশের যে লক্ষণগুলি দেখা যাচ্ছে তা এই বিষয়টিকেই দেখিয়ে দেয়।

(ঙ) ১৯৪২-এ তার ভূমিকা সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের সমগ্র পর্যায়ে আরএসএস-এর ভূমিকা, সমগ্র মুসলিম জনসংখ্যাকে পাকিস্তানে নির্বাসিত করতে হবে এই দাবি তুলে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া ও দেশ বিভাগকে তার সমর্থন এবং জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে তার দহরম-মহরমের বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে আরএসএস তার মতাদর্শগত প্রেরণা লাভ করেছিল এক বিদেশী মতাদর্শ, নাজিবাদ থেকে।

(চ) মুসলিম জুজুর কথা বলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায়ে আরএসএস তার নিজস্ব ধারায় ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত হতে না দিয়ে তাকে যেভাবে বিক্ষিপ্ত করেছিল তার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে, আজ আবার যখন নয়া-উপনিবেশবাদের বিপদ ঘনিয়ে আসছে তখন সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

(ছ) পাক বিরোধিতাকে ভারতবর্ষের বিদেশনীতির অক্ষ করে তোলার বিরুদ্ধে এবং আমরা বলি যে পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার এক ইতিবাচক দ্বিপাক্ষিক সমাধান ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির পক্ষে অপরিহার্য। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ – এই তিন স্বাধীন রাষ্ট্রকে নিয়ে এক মহাজোট গড়ে তোলার প্রস্তাবও আমরা করি।

পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় আমরা দেখাই যে বুর্জোয়াদের সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল অংশ এবং জমিদার শ্রেণী ও উচ্চবর্ণের মধ্যে বিজেপির সামাজিক ভিত্তি, নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনে সাধু ও মহন্তদের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ, সমাজের সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত অংশটিকে নিয়ে করসেবকের রূপে এক জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলা, ইতিহাসকে বিকৃত করে তোলা, সংগঠিত অভিযানের মাধ্যমে ঘৃণা সৃষ্টি এবং বিদ্বৎ সমাজে যে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর ভুঁইফোড় বুদ্ধিজীবীর দল – এই সমস্তই মিলেমিশে তৈরি করেছে নির্ভেজাল ফ্যাসিবাদকে।

পুনশ্চ

বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করা হয়েছে। সমস্ত ধরনের গণতন্ত্রীরা সঠিকভাবেই দাবি করেছেন – ঐতিহাসিক ন্যায়ের স্বার্থে ঐ স্থানেই বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আদৌ সম্ভব বা বাস্তবসম্মত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

সেখানে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা একটা রামমন্দির রয়েছে। এবং যেভাবে রাও সরকার এগোচ্ছেন – ‘রাজনীতি থেকে ধর্মকে যোগচ্ছিন্ন করার’ কংগ্রেসী মার্কা পথ – এবং পিছন থেকে চন্দ্রস্বামী ও শঙ্করাচার্যদের মাধ্যমে কলকাঠি নাড়ছেন, তাতে রামমন্দিরের সম্ভাবনাই জোরালো হচ্ছে। কৃতিত্বটা শেষ পর্যন্ত কার কপালে জুটবে – কংগ্রেস না বিজেপি – সেটাই এখন দেখার।

সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিকেরা বারবার বলে এসেছেন, বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদ কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় বিরোধ নয়। তাঁদের মতে বাবরি মসজিদ যেহেতু এক জাতীয় অবমাননা, মুসলিম আগ্রাসন তথা হিন্দু ভারতবর্ষের উপর তাদের শাসনের প্রতীক, তাই এটি জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন।

তাহলে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের স্বার্থে ঐ স্থানে কেন একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা যাবে না? বাবরি মসজিদও নয়, রাম মন্দিরও নয়, ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের স্মৃতিতে একটা স্মৃতি সৌধ। এটা তো ঠিক অযোধ্যা ছিল ঐ বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র, আর তাই অযোধ্যার এক জাতীয় স্মৃতিসৌধ গড়ে তুললে ঐ ইতিহাসের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা যাবে।

হিন্দুত্ব যদি শুধু একটা ধর্ম না হয়ে তা যদি ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের এক সম্মিলিত সংস্কৃতি হয়, হিন্দুত্ব যদি ভারতীয়ত্বের সমার্থক হয় এবং জাতীয় অবমাননার প্রতীক হওয়ার জন্যই যদি বাবরি মসজিদকে ভাঙ্গা হয়ে থাকে, তবে জাতীয় গৌরবের এক স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলার ব্যাপারে সংঘ পরিবারের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সংঘ পরিবারের মহাজাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকপ্রবরেরা এই প্রস্তাবকে মেনে নিয়েই দেখুন না ‘জাতিদ্রোহী’ মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কী হয়। সর্বশ্রী মালকানি, গোবিন্দাচার্যের দল, আপনারা শুনছেন কি?

তা তাঁরা শুনুন বা না শুনুন, ধর্মনিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক শক্তির তরফে ঐ জায়গায় রামমন্দির গড়ে ওঠা ঠেকানোর জন্যই এই প্রস্তাবটিকে তুলে ধরা দরকার। ঐখানে রামমন্দির গড়ে উঠলে তা হবে ভারতীয় মুসলিমদের অবমাননা ও বিচ্ছিন্নতা বোধের এক চিরন্তন উৎস, আর এই কারণে জাতীয় বিভাজনের প্রতীক। একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের দাবিই আজকের পরিস্থিতিতে একমাত্র নীতিনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত দাবি। একটি জাতীয় বিপর্যয় ঠেকাতে গোটা দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজন হলে নানা রঙের কট্টরপন্থীদের বাধা সবলে অপসারিত করেই এগিয়ে আসতে হবে।