(লোকযুদ্ধ পত্রিকার সম্পাদক রামজী রায় কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার। লিবারেশন, জুন ১৯৯৬ থেকে)

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক অতিকথাকেই চূর্ণ করেছে। ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কব্জা করতে গিয়ে বিজেপি তার পরিচিতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইস্যুগুলিকে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে যে দ্রুততার সাথে এবং অবলীলায় জনতা দল ও বামেরা নরসীমা রাও-এর কংগ্রেস ও তার অর্থনৈতিক সংস্কারের দিশার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

একক বৃহত্তম দল হিসাবে বিজেপির আবির্ভাব এবং মধ্যপন্থী, বামপন্থী, আঞ্চলিক দলগুলি ও কংগ্রেসের মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও অর্থনৈতিক সংস্কার’-এর স্বার্থে এক সাধারণ বোঝাপড়া গড়ে ওঠাটা ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করছে। এই সন্ধিক্ষণে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং তৃতীয় শক্তিকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সংসদীয় নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার গড়ার রায় সুনির্দিষ্টভাবে পায়নি, এটা কি শাসক শ্রেণীগুলির কোনো সংকট বা তাদের গণতান্ত্রিক শক্তির কোনো সংকটকে চিহ্নিত করে? আর তা যদি করে থাকে তবে এই সংকটের কারণ কী?

আমরা কমিউনিস্টরা সব সময়ই হিন্দুত্বকে মূল যোগসূত্র ধরে গড়ে ওঠা বিজেপির জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভারতের বহুজাতিক, বহু ভাষাভাষী আর সেই কারণে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কথা বলে থাকি। আদ্যিকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রগতিশীল মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এক নরম ভাবমূর্তিকে সামনে এনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে বিজেপির এই ব্যর্থতা এবং বর্তমানে ভারতীয় সংসদের বিন্যাস, ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিকেই সঠিক প্রতিপন্ন করে।

একটি সংকট অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের ক্ষয়ের পর কেন্দ্রীভূত অন্য সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠনটির সীমাবদ্ধতাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভারতীয় সমাজ একটি ‘মহাসংঘ’ হতেই পারে, কিন্তু তাকে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক জোটে রূপান্তরিত করাটা অত্যন্ত কঠিন কাজ, বিশেষত তার কেন্দ্রে যখন কোনো শক্তিশালী নিউক্লিয়াস নেই।

দ্বৈত চরিত্রের এই সমস্যাটির সমাধানকল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং এটাও দেখার বিষয় যে কতদিন এবং কতটা দূর পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি এটাকে সহ্য করবে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এবং অধিকাংশ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিস্থিতিকে এক নতুন যুগের সূচনা হিসাবেই দেখছেন, যেখানে জোট সরকারগুলিরই প্রাধান্য থাকবে এবং তারা এই পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাদের কৌশলগুলিকেও সাজিয়ে নিচ্ছে। এটার থেকে আপনার কি মনে হয় না যে জোট সরকারের এক দীর্ঘ পর্যায়ের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ এগোবে?

১৯৭৭ এবং ১৯৮৯ সালেও জোট সরকারের পর্যায়ের কথা উঠেছিল, কিন্তু সেগুলি অল্প কিছুদিনই স্থায়ী হয়েছিল। এবারে জোট সরকারে দলের সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু তাদের মধ্যে সবথেকে বড় শরিকটির আসন সংখ্যা মাত্র ৪২। বিজেপি এবং কংগ্রেসই হল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, কিন্তু পরিস্থিতির এমনই পরিহাস, এই দুই দলই রয়েছে সরকারের বাইরে। প্রথমটি বিরোধীপক্ষ হিসাবে এবং দ্বিতীয়টি বাইরে থেকে সরকারের সমর্থক হিসাবে। দুটি দলই যুক্তমোর্চার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও ভাঙ্গনগুলিকে নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগানোর কৌশল নিচ্ছে। কাজেই এই জোট সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই যে ভবিষ্যতের সাধারণ দিশা নির্ধারণ করবে সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সময় এখনও আসেনি।

সিপিআই(এম) জোট সরকারে অংশগ্রহণ না করায় সিপিআই(এমএল) তাকে অভিনন্দিত করেছে। এটা সিপিআই(এম)-এর কাছে নতুন কিছু নয়। তারা পুরোনো নীতিকেই অনুসরণ করেছে মাত্র। কাজেই অভিনন্দিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন? এর মধ্যে কি নতুন কোনো পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে? তা যদি হয় তবে সেটা কী?

সরকারে অংশগ্রহণ করার চাপ এবার সিপিআই(এম)-এর ওপর অনেক বেশি ছিল, আর এটাও সবাই জানে যে নেতৃত্বের একটি অংশ সরকারে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে মনস্থির করেই ফেলেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে পার্টি কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্তরে, সরলরেখা টানলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের’ যুক্তিসঙ্গত পরিণতি সরকারে যোগদান ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এইরকমই অজুহাত দেখিয়ে অতীতে সিপিআই এমনকি কংগ্রেসী সরকারেও যোগদান করে। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত স্রোতে গা ভাসানোর বিরুদ্ধে একটা ব্রেক হিসাবে কাজ করেছে। আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে সিপিআই এই সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলেছে আর আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি।

কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর অনেক প্রশ্নই উঠে আসছে, যেগুলি সম্পর্কে সিপিআই(এম)-কে তার অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এর আগের বার জাতীয় মোর্চার সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় পৌঁছনোর পরও বামফ্রন্ট তার স্বাধীন পরিচিতি বজায় রেখেছিল, কিন্তু এবার সিপিআই(এম) ও অন্যান্য বাম দলগুলি যুক্তফ্রন্টের শরিক হয়েছে। আর এটি যেহেতু যুক্তফ্রন্টেরই সরকার, তাই সরকারে অংশগ্রহণ না করেও সরকারের ভুলত্রুটিগুলির সমান দায়ভার তারও থেকে যাবে। সিপিআই-এর সরকারে অংশগ্রহণ এক ঐক্যবদ্ধ ব্লক হিসাবে বামফ্রন্টের অস্তিত্বকেই আঘাত করেছে। তাছাড়াও, দেবগৌড়া নরসীমা রাও-এর অর্থনৈতিক নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক। একেবারে শুরু থেকেই কংগ্রেস অর্থনৈতিক নীতিকে অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে তার সমর্থনের প্রধান শর্ত করে তুলেছে। দেবগৌড়া ও চিদাম্বরমের যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হওয়াটা কংগ্রেসের শর্তের কাছে আত্মসমর্পণের নামান্তর। পরিহাসের বিষয় হল যে, সরকারে বাইরে থাকলেও কংগ্রেসই সরকারের কলকাঠি নাড়ছে, আর যুক্তফ্রন্টের শরিক হওয়া সত্ত্বেও সিপিআই(এম) সরকারের দিশা নির্ধারণে অক্ষম।

সিপিআই(এম)-এর অবস্থানের এই অসঙ্গতিই সরকারে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাইরে থেকে তার ওপর চাপকে বাড়িয়ে তুলছে এবং অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরে বাইরে থেকে সরকারকে সমালোচনামূলক সমর্থন যোগানোর বিষয়টিও জোরালো হচ্ছে। কংগ্রেস ও বিজেপি থেকে দূরত্ব রক্ষাকারী সিপিআই(এম)-এর ঐ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্তকেই আমরা স্বাগত জানাব।

এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল এবারও সিপিআই(এমএল) কোনো যুক্তফ্রন্টে যোগ দিতে পারেনি। এটা কী পার্টির যুক্তফ্রন্ট নীতির ব্যর্থতা বা ঘাটতিকে দেখিয়ে দেয়, নাকি পরিস্থিতির বিকাশই ঘটেছে তার নীতির সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে? যুক্তফ্রন্টের নীতির বিষয়ে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে কি মনে করেন?

এখনও পর্যন্ত যে স্তরে আমরা কাজ করছি তার মূল অভিঘাতই থাকছে আমাদের শক্তিবৃদ্ধির ওপর। সামাজিক স্তরে, জনগণের বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের সাথে যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা চালাচ্ছি। এটি একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় স্তরে সব সময়েই আমরা কংগ্রেস-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধী তৃতীয় শক্তির শিবিরের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছি এবং যৌথ কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু সাংগঠনিক স্তরে কোনো মোর্চার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে তা বিভিন্ন রাজ্যে আমাদের উদ্যোগকে ভোঁতা করে দেবে এবং পার্টির পক্ষে তা আত্মহত্যার সামিল হয়েও দেখা দিতে পারে। এ সত্ত্বেও আমাদের শত্রুদের মধ্যকার ও তাদের অভ্যন্তরস্থ যে কোনো বিভেদকেই নিজেদের অনুকূলে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কৌশলের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা আমরা সব সময়েই চালিয়ে যাচ্ছি এবং এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে।

কোনো বামশক্তি বা মধ্যপন্থী কোনো শক্তির সঙ্গে ফ্রন্ট গড়া যায়নি। সামাজিক ভিত্তির দিক থেকেও মধ্যবর্তী জাত বা মধ্যবর্তী শ্রেণীর কোনো অংশের সাথে কোনো ফ্রন্ট গড়াও সম্ভব হয়নি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এ সম্পর্কে আপনাদের ভবিষ্যৎ কৌশল কী?
মধ্যবর্তী জাত ও মধ্যবর্তী শ্রেণীর কিছু অংশের সমর্থন আমরা অবশ্যই পেয়েছি। তা যদি না হত তবে বিহারে তিনটি আসনে আমাদের অগ্রগতি – যে তিনটি আসনের প্রত্যেকটিতে আমরা লক্ষাধিক ভোট পেয়েছি – তা সম্ভব হত না। এই নির্বাচনে আমরা আমাদের শ্রেণীভিত্তিকে শক্তিশালী করার ওপরই জোর দিয়েছিলাম। আমাদের সমর্থনভিত্তিতে জনতা দল ঢুকে পড়ছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটা জরুরি ছিল।

জনতা দল ধাক্কা খাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবর্তী জাতগুলির মধ্যে আমাদের প্রভাব বাড়ানোর মতো অনুকূল পরিস্থিতি অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে এবং সুপরিকল্পিতভাবে এই কাজ হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করেছি।

বর্তমান পরিস্থিতি বামফ্রন্টের কাছ থেকে কী ভূমিকা দাবি করছে? বাম শক্তিগুলি কি এই দিশায় ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে পারবে?

বাম নেতৃবৃন্দকে মধ্যপন্থী শক্তিগুলি ও কংগ্রেসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা ত্যাগ করতে হবে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও বিদেশী পুঁজি-নির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের বিরোধিতা করতে হবে। সংসদে যুক্তফ্রন্টের থেকে স্বতন্ত্র পরিচিতি বজায় রেখে বাম বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করতে হবে। বামপন্থী ক্যাডারাও এটা চান। তবে বাম শক্তিগুলির নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে এই দিশায় অগ্রসর হতে পারবে কিনা ভবিষ্যতই তা বলতে পারে।

(১৯৯৬ সালের ১১ মার্চ নতুন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অধিকার ৠালিতে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে)

কমরেডগণ,

আমার যতদূর চোখ যায়, শুধু লাল পতাকা উড়তে দেখছি। বলা হয় যে জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করেন আর আপনারা এখানে সেই ইতিহাসই সৃষ্টি করেছেন।

আমরা ঘোষণা করেছিলাম যে আমাদের ৠালি বামপন্থীদের সবথেকে বড় ৠালি হবে, সমস্ত ৠালির রেকর্ড ভেঙে দেবে। এই সত্যকে আপনারা প্রমাণ করেছেন। এই দশকের ৠালির সমস্ত পুরোনো রেকর্ড ভেঙ্গে আপনারা এই নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন (হর্ষধ্বনি)। আজকের এই ৠালির রেকর্ড নিশ্চয় কোনোদিন ভেঙ্গে যাবে এবং জোরের সাথে বলতে পারি যে সেই রেকর্ডও ভাঙবে সিপিআই(এমএল)-ই (হর্ষধ্বনি)।

বন্ধুগণ, পথের সমস্ত বাধা দূর করে দিল্লী পৌঁছতে আমরা আহ্বান করেছিলাম। আমাদে কর্মীরা এবং অন্য বামপন্থী পার্টির কর্মীরাও আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিল্লী এসেছেন। এই ৠালিকে সফল করার জন্য বহু বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম, গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষের কাছে আমরা সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলাম। আমরা দেখলাম যে অন্যান্য অনেকের সাথে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও সমস্ত দিক থেকে আমাদের সাথে সহযোগিতা করেছেন। সবার সহযোগিতাতেই আজকের এই বিশাল ৠালি সম্ভব হয়েছে।

আমাদের দেশ এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করছে। আজ ১১ মার্চ সম্ভবত বর্তমান লোকসভার শেষ অধিবেশন হচ্ছে এবং আজই সারা দেশ থেকে শ্রমিক-কৃষকেরা লাখে লাখে দিল্লীর রাজপথে জমায়েত হয়েছেন। সংসদের প্রতি তাঁদের একটাই জিজ্ঞাসা আছে – গত পাঁচ বছরে এই সংসদে কী হয়েছে? জনগণের তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে জনগণের জন্য কী করেছেন? এই প্রশ্নে সংসদের কাছে কোনো উত্তর নেই। আমরা দেখেছি যে গত পাঁচ বছরে এক সংখ্যালঘু সরকার অন্য দলের সাংসদ কিনে নিয়ে সংখ্যাগুরু হয়েছে। আমরা দেখেছি যে এই সরকারের মন্ত্রীদের এক বড় অংশ হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, চার্জশীট পেয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমানে জেলের মধ্যে আছে।

তাই বন্ধুগণ, প্রশ্ন উঠেছে, যে প্রধানমন্ত্রীর গোটা বাহিনীটাই দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিতে যুক্ত সেই প্রধানমন্ত্রী কতটা সৎ হতে পারেন? তাই আমাদের পার্টি এই দাবি তুলেছে যে অন্যদের বিরুদ্ধে যে সিবিআই তদন্ত চলছে তার বর্শামুখ মূল পাণ্ডার বিরুদ্ধে চালিত হোক। যখন অন্য সকলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তখন দুর্নীতিগ্রস্ত সমগ্র মন্ত্রীসভার মূল পাণ্ডাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে? এই একই দাবি এই ৠালি থেকে উঠেছে। রাও সাহেবকে একটা বিষয়ে ধন্যবাদ দেব, নিজেকে ডুবতে দেখে তিনি বললেন, ‘আমাকে ডুবতে তো হবেই, কিন্তু তোমাদের সকলকে নিয়েই ডুবব।’ (হর্ষধ্বনি)। এইভাবে আমরা দেখলাম সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পার্টি – শাসক পার্টিগুলি এই জালে ধরা পড়ল। বলা হয় যে স্নানের ঘরে সকলেই নাঙ্গা। আমাদের সামনে এক চ্যালেঞ্জ এসে পড়েছে যে এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ কোন পথে এগোবে? আমি মনে করি আমাদের দেশের এক নতুন পথ, নতুন শক্তি দরকার। এই পুরোনো শক্তিগুলির বোঝাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে হবে এবং নতুন শক্তিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দেশের দায়িত্বভার দুহাতে তুলে নিতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই আমরা এই ৠালির আয়োজন করেছি। এই ৠালির প্রতি যে বিরাট সমর্থন আমরা দেখলাম, আমি অবশ্যই বলব তাতে এটা প্রমাণ করছে যে আমাদের দেশ এক নতুন পথের দিকে এগোতে চাইছে এবং আমাদের দায়িত্ব – বামপন্থীদের দায়িত্ব হল দেশের জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়া।

কমরেড, এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য অনেক রকম কথাই উঠছে। কিছুদিন আগে আমরা লোকেদের বলতে শুনলাম যে কিছু নির্ভরযোগ্য সৎ আমলা ভারতবর্ষে বিপ্লব আনবে। কিন্তু আপনারা দেখলেন যে তা সম্ভব নয়। ইতিহাসে কোনো দেশেই আমলাতন্ত্র বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। বৈপ্লবিক পরিবর্তন চিরদিনই এই আমলাতন্ত্রকে উৎখাত করেই এসেছে। আবার কিছু লোককে বলতে শোনা গেল যে সুপ্রীম কোর্টই সম্ভবত পরিবর্তন আনবে। সুপ্রীম কোর্ট যখন হাওয়ালা বা অন্য কেলেঙ্কারিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এসে পড়ে। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম যে সুপ্রীম কোর্ট হিন্দুত্ব নিয়ে একটা রায় দিয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারাভিযানে খোলাখুলি ঘোষণা করেছিলেন যে তারা সরকার গড়লে মহারাষ্ট্র হবে প্রথম হিন্দু রাজ্য। মামলার শুনানির সময় সবাই ভেবেছিল যে মনোহর যোশীর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাবে এবং বিজেপি-শিবসেনা এমনকি নতুন মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক করেছিল। কিন্তু সারা দেশ অত্যন্ত আশ্চর্যের সঙ্গে দেখল যে সুপ্রীম কোর্ট হিন্দুত্বের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করল এবং যোশীর নির্বাচনকে বজায় রাখল। টেলিকম কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদ অচল হয়ে পড়ল। সুপ্রীম কোর্টে মামলা উঠল। সাধারণভাবে আমরা দেখি যে একটা মামলার নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে আমরা দেখলাম কত তাড়াতাড়ি মামলা শেষ হয়ে গেল। দ্রুত শেষ করা এই মামলায় কেলেঙ্কারি থেকে সুখরামকে মুক্ত করা হল এবং সরকারের টেলিকম নীতির সপক্ষে, বেসরকারিকরণের পক্ষে কতরকম তত্ত্ব ফেরি করা হল। তাই কেউ যদি মনে করেন যে সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে সেটা একটা মধ্যবিত্ত কল্পনা মাত্র, বাস্তব সত্য নয়। দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা কারও যদি থাকে তা হল শ্রমিক-কৃষকের, লাখো জনগণের, যাঁরা দিল্লীর রাজপথে আজ মার্চ করেছেন। এঁরাই সেই একমাত্র শক্তি যাঁরা দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ, শাসকশ্রেণী যে বিরাট সংকটে ফেঁসে গেছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে সমস্ত রকম চেষ্টাই তারা করবে। বিজেপি ঠিক করেছে যে হিন্দুত্বের ইস্যুকেই তারা জোরের সাথে তুলে ধরবে। আমরা দেখছি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা নতুনভাবে তোলা হচ্ছে, উত্তেজনা গড়ে তোলা হচ্ছে। বিজেপিকে আমি বলতে চাই যে দেশপ্রেমের ঠিকা তুমি নাওনি। দেশকে আমরা ভালোবাসি। দেশের স্বাধীনতার জন্য, তার স্বার্বভৌমত্বের জন্য লড়াইয়ে আমরা কমিউনিস্টরা সব থেকে আগে থাকবো। এই লড়াইয়ের অন্যান্য যে কোনো শক্তির থেকে আমরা অনেক বেশি আত্মত্যাগ স্বীকার করব। (হর্ষধ্বনি)। শুরু থেকেই এই জনসংঘের লোকেদের আমরা জানি, সারা দেশ জানে যে তারা আমেরিকার দালাল। কিছুদিন আগেই সিআইএ বলেছে যে ভারতবর্ষ খুব শীঘ্রই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এটা আমেরিকার স্বপ্ন, সিআইএ-র স্বপ্ন। আমরা মনে করি যে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার চক্রান্ত যদি কেউ করে থাকে তারা হল ভারতীয় জনতা পার্টি। কারণ হিন্দুত্বের নামে তারা যেভাবে ভারতবাসীর হৃদয় বিভক্ত করছে, যেভাবে হিন্দু ও মুসমানদের বিভক্ত করছে, তা কোনো না কোনোদিন আবার দেশভাগের দিকে নিয়ে যাবে। আমি বলতে চাই যে দেশপ্রেমের নামে বিজেপির সাম্প্রদায়িক শক্তি সিআইএ-র নির্দেশে আরও একবার ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে এবং সেই চেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই ব্যর্থ করে দিতে হবে।

বন্ধুগণ, বিকল্পের বিষয়ে তৃতীয় মোর্চার কথা উঠেছে। আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি যে সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু একটা কথা আমি বলে দিতে চাই যে ‘মণ্ডল’ থেকে সামাজিক ন্যায়ের যে শক্তি সামনে এসেছিল তাদের সামাজিক প্রগতির সীমানা শেষ হয়ে গেছে। উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং সরকারের আমলে মুজফ্ফরনগরে উত্তরাখণ্ড আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল, মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এই বিষয়ে মুলায়ম সিং প্রথমে বিবৃতি দিলেন – এটা মিথ্যা, পুলিশের মনোবল ভাঙার চক্রান্ত। আমাদের দেশের পুলিশের মনোবল টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি এবং এই মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য বলাৎকারের ছাড় দেওয়া শাসকশ্রেণীরই রাজনীতি। চাপ বাড়াতে তিনি বললেন যে যদি এটা প্রমাণ হয় তাহলে আমি সমগ্র জাতির কাছে ক্ষমা চাইব। প্রমাণ তো হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাননি। কেবল উত্তরাখণ্ডের লোকেদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি বলতে চাইছি বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর আগে মুজফ্ফরনগরের ঘটনা নিয়ে সমগ্র জাতির কাছে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। এটা তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল এবং আমাদেরও ধারাবাহিক দাবি ছিল।

তৃতীয় মোর্চার অপর শক্তি লালু যাদব ও তার জনতা দলের নাম এর পরেই এসে পড়ে। সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে যে ছবি দেশের সামনে তুলে ধরা হয়েছে আমি মনে করি তা বিহারের আসল ছবি নয়। বিহারে গেলে দেখবেন সেখানে সবর্ণদের উপরিস্তর এতদিন একচেটিয়াভাবে যে লুটপাট চালাতো সেখানে সামাজিক ন্যায়ের নামে পশ্চাদপদদের উপরিস্তরটিও সামিল হয়েছে। আজ যে পশুপালন কেলেঙ্কারির কথা উঠেছে তাতে প্রধান দুটি নাম জগন্নাথ মিশ্র ও লালু যাদব এবং এরা পরস্পরকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কমরেড, বিহারে আমাদের এক নির্বাচিত বিধায়ক, জনগণের প্রিয় নেতা গত ৬ মাস জেলে বন্দী হয়ে আছেন। যে সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমাদের হাজার হাজার কমরেডদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা চাপানো হয়েছে, আমরা দেখছি সেই জমিদার-সামন্তদের সাথে জোটবদ্ধ রয়েছে সরকারি প্রশাসন। সেখানে অবিরত নরহত্যা হচ্ছে, নানা রকম ঘটনা ঘটছে – কিন্তু প্রশাসন চুপ করে আছে। অন্যদিকে আমাদের হাজার হাজার সাথীদের হয় জেলে বন্দী রাখা হয়েছে না হয় ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। দমন করে ওরা বিহার থেকে সিপিআই(এমএল)-কে উৎখাত করতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবের দিকে তাকান। আমি আগেও বলেছি এবং আজও বলব যে এমন কোনো বন্দুকের গুলি তৈরি হয়নি, এমন কোনো বন্দুক আবিষ্কৃত হয়নি যা সিপিআই(এমএল)-কে মাটি থেকে উৎখাত করতে পারে। (হর্ষধ্বনি)। আজ পর্যন্ত এমন কোনো টাকা তৈরি হয়নি যা দিয়ে সিপিআই(এমএল) নেতাদের কেনা যায়। বন্ধুগণ, আমরা বেঁচে আছি, আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের হাজার হাজার লোক মারা গেছে, হাজার হাজার লোক জেলে বন্দী, আরও বেশি লোকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে – এসত্ত্বেও আমাদের গণআন্দোলন, আমাদের শক্তি বেড়েই চলেছে। আর যারা ভাবতেন যে লালু যাদবের লেজুড়বৃত্তি করলেই তাদের শক্তি বাড়বে বিহারের মাটিতে সেই সব পার্টির কবর হয়ে গেছে। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ তৃতীয় মোর্চা গড়ে উঠুক এটা আমরা অবশ্যই চাই। আমরা চাই সমস্ত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হোক। কিন্তু তার জন্য প্রথমত জনগণের শক্তির প্রতি, শ্রমিক-কৃষকের শক্তির প্রতি নির্ভর করতে হবে। কোনো লালু বা মুলায়ম বা জয়ললিতার শক্তি থাকে না, শক্তি থাকে জনগণের – শ্রমিক-কৃষকের। সেই শক্তির ওপর নির্ভর করেই আমরা সামনে এগোতে পারি। কিন্তু প্রথমে আমাদের অবশ্যই হিম্মত থাকতে হবে। এই হিম্মতের জোরেই আমরা বন্ধু খুঁজতে পারি, ঐ বন্ধুদের নেতৃত্ব দিতে পারি, তাদের লেজুড়বৃত্তি করলে চলবে না। বন্ধুগণ, রাজনীতিতে নানা ধরনের সমঝোতা করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের শক্তির সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে এখানে সেখানে বন্ধুত্ব করতে হতে পারে। রাষ্ট্রীয় স্তরে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কিছু দিনের জন্য মোর্চাও হতে পারে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে আমরা কোনো ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মোর্চা গড়ায় বিশ্বাসী নই। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের ধারণার সঙ্গে আমরা সহমত নই, যে ধারণায় ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো শক্তিগুলির নেতৃত্বে স্থায়ী ধরনের এক তৃতীয় মোর্চা গড়ে তোলা হবে। বামপন্থী শক্তিকে, গণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কারও না কারও সাথে কিছুদিনের জন্য বন্ধুত্ব নিশ্চয় করতে পারি। কিন্তু কোনো স্থায়ী মোর্চার মধ্যে নিজেদের বেঁধে ফেলতে পারি না – এটাই হল বিপ্লবী রাজনীতি। (হর্ষধ্বনি)

বন্ধুগণ, আমাদের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমরা সমগ্র দেশ জুড়ে বামপন্থী বন্ধুদের কাছে আহ্বান রেখেছি যে আসুন আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা একসাথে চলার চেষ্টা করি। একটা কথা আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে যে সুবিধাবাদ জন্ম নিয়েছিল তাকে ধ্বংস করতেই সিপিআই(এমএল)-এর জন্ম হয়েছিল। তাই এই সুবিধাবাদের সঙ্গে সে কোনো সমঝোতা করতে পারে না। এটি এক বুনিয়াদী প্রশ্ন। যদি সিপিআই(এমএল) এই প্রশ্নে সমঝোতা করে, যদি সুবিধাবাদের সাথে সমঝোতা করে তার অর্থ খোদ আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সমঝোতা করা এবং সিপিআই(এমএল)-এর অস্তিত্বের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। কোনো চাপের মাধ্যমে বা বড়দাদাসুলভ হুমকিতে কেউ যদি মনে করে থাকেন, এই বিপ্লবী লক্ষ্য থেকে আমাদের সরানো যাবে তাহলে তিনি মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। (হর্ষধ্বনি)। সমস্ত বুনিয়াদী পার্থক্য সত্ত্বেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। গণসংগঠনগুলির মঞ্চে গত পাঁচ বছর ধরে আমরা একসাথে কাজ করছি এবং যাবতীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাজনীতির ময়দানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলিতে জাতীয় স্তরে আমরা অবশ্যই একসাথে কাজ করতে পারি। এর জন্য আমাদের পার্টি অবশ্যই চেষ্টা চালাবে। গত আট বছর ধরে সেই চেষ্টা চলছে, আগামী আট বা দশ বছর ধরে সেই চেষ্টা অব্যাহতও থাকবে। সিপিআই(এম)-সিপিআই-ই হোক কিংবা নকশালপন্থী ধারাই হোক, বামেদের সমস্ত ধারার সাথেই মিত্রতার কথা আমরা বলেছি। সাধারণ ইস্যুতে একসাথে লড়াই করার কথা আমরা বলেছি। এ প্রশ্নে আমাদের পার্টি কোনো সংকীর্ণতা করে না – গণসংগঠনের মঞ্চে আমাদের অংশগ্রহণের মধ্যে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে।

আমাদের মৌলিক পার্থক্যগুলি আছে ও থাকবে। আমাদের বলা হয়ে থাকে যে ‘আপনারা বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করবেন না।’ আপনাদের সামনে, দিল্লীর সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের সামনে আমি বলতে চাই যে বাংলায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের কংগ্রেসী জমানায় হাজার হাজার যুবককে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল। আমাদের পার্টির নেতা চারু মজুমদার ও সরোজ দত্তকেও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার গর্বভরে বলে থাকে যে তারা ১৮ বছর ধরে সরকারে আছে। ঠিক আছে আপনারা ১৮ বছর ধরে শাসন করেছেন, চান তো আপনারা ৮৮ বছর ধরে শাসন করুন – আমাদের বলার কিছুই নেই। কিন্তু আমাদের একটি প্রশ্ন আছে। ১৯৭০ দশকে এই সমস্ত গণহত্যা হয়েছিল এবং আপনাদের পার্টিও স্বীকার করে যে এই গণহত্যাগুলি ঘটেছিল, সেই সময়কালে ফ্যাসিবাদী শাসন চলছিল। আমি কেবল জানতে চাই যে তার জন্য গত ১৮ বছরে একজন দোষীকে একদিনের জন্যও কি কোনো শাস্তির ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকার করেছে? আমি জানতে চাই যে সরোজ দত্ত, যিনি শুধু আমাদের পার্টির নেতাই ছিলেন না, পশ্চিমবাংলার এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীও ছিলেন. তাঁর মৃত্যুর তদন্ত আজও হল না কেন? তদন্তের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের দশ হাজার বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপিও জ্যোতি বসুর কাছে দেওয়া হল, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই হল না। আমরা এই প্রশ্নগুলি তুলছি সিপিআই(এম) বিরোধিতার জন্য নয়, এই প্রশ্নগুলি সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কারণ কংগ্রেসের সেই কালো শক্তি আবার একবার বাংলায় মাথা তুলতে শুরু করেছে, সিদ্ধার্থশংকর রায় আবার সেখানে দাঁড়াতে চাইছে, মমতা ব্যানার্জী জনগণের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে। তাই আমরা এই প্রশ্ন তুলছি যে আপনারা গত ১৮ বছরে এই দোষী ব্যক্তিদের একজনকেও যে সাজা দিলেন না তারই পরিণতিতে ঐ কালো শক্তি আবার একবার ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আমরা এই দাবি তুলতেই থাকব। কারণ এই দাবি বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বার্থবাহী। এই দাবি কোনো একটি পার্টি বা কোনো একটি সরকারের নিছক বিরোধিতার জন্য নয়। এই দাবি গণতন্ত্রের জন্য এবং সেকারণেই আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলি। গণতন্ত্রের পক্ষে যায় এমন দাবিগুলির মধ্যে আমরা একটিও ছাড়তে পারি না, ছাড়তে পারি না এমন একটিও দাবি যা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাতে আমরা ভোট পাব কিনা, নির্বাচনে জয়লাভ করব কিনা তার পরোয়া আমরা কখনই করি না। (হর্ষধ্বনি)।

বন্ধুগণ, আপনারা এসেছেন লালকেল্লার সামনে। এই লালকেল্লায় লাল নিশান ওড়ানোর স্বপ্ন ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের অনেক পুরোনো স্বপ্ন। এই সেই লালকেল্লা যেখানে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার লড়াই-এর বিউগল বেজে উঠেছিল। আজ একদিকে বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার হাতে আমাদের দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, অপরদিকে দেশের মধ্যে হাওয়ালার শক্তি দেশকে কালো টাকা ও মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আগে যেখানে সাংসদের টাটা ও বিড়লার কাছে বিক্রি হয়ে যেতে শোনা যেত, আজকে সেই সাংসদদের নামগোত্রহীন হর্ষদ মেহেতাদের মতো পাতি ঠগদের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। তাই বন্ধুগণ, আরও একবার স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়তে হবে। দেশপ্রেমের পতাকাকে কমিউনিস্টদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। ১৮৫৭-তে যে লড়াই শুরু হয়েছিল তা এখনও শেষ হয়নি। এই লড়াই জারি আছে এবং এই পতাকাকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটাই আমাদের কর্তব্য। আমি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সমস্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কাছে – যারা বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে যুক্ত আছেন – আবেদন করছি যে দেশের এই সংকটে নিজেদেরকে নিজেদের একক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। আপনারা সকলেই মূল্যবান ও যোগ্যতা রাখেন এবং আজ প্রয়োজন সমস্ত সৎ বুদ্ধিজীবী, দেশের সমস্ত সৎ নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করা : এই দেশ কোনো অর্থশক্তি, মাফিয়া বা পুঁজিপতিদের নয়, এই দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদেরও নয়। এই দেশ শ্রমিকদের, এই দেশ কৃষকদের, এই দেশ যুবকদের, এই দেশ বুদ্ধিজীবীদের। এই দেশ আমাদের। এই দেশের ওপর আমাদের অধিকার। এই দেশ থাকবে আমাদের হাতে।

কমরেড, আপনাদের এই লড়াই লড়তে হবে। আপনারা ক্ষেত থেকে এসেছেন, কারখানা থেকে এসেছেন। ফিরে গিয়ে আবার আপনাদের লড়াইয়ে নামতে হবে। বিশেষ করে ভোজপুরের কমরেডদের আমি বলছি যারা সাহসিকতার সঙ্গে সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখানে এসেছেন। তাদের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল। ভোজপুরের সংগ্রাম খুবই তীব্র। প্রায় এক মাসের মধ্যে সামন্তপ্রভুরা ১২ জনকে হত্যা করে। আপনারা ফিরে গিয়ে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আপনাদের শপথ নিয়ে যেতে হবে যে ফিরে গিয়ে এই সামন্তশক্তিকে, রণবীর সেনাকে আপনারা নিশ্চিহ্ন করে দেবেন (হর্ষধ্বনি)। আমি বলতে চাই বিহারের সংগ্রামী কৃষকদের প্রতি এইটিই হল ৠালির বার্তা। এই সামন্তশক্তিগুলি হল সমগ্র দেশের কাছে কলঙ্ক, সমাজ বিকাশের পথে বাধা এবং তারা নিরীহ গরিব লোকদের হত্যা করে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের হিম্মতের সাথে লড়াই করতে হবে।

বন্ধুগণ, নির্বাচন সামনে এবং তা যে কোনোদিন ঘোষণা হতে পারে। এই নির্বাচন আপনাদের সামনে এক বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক পার্টিগুলির আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। আপনারা জনগণের কাছে যান। তাঁদের কাছে রাজনৈতিক পার্টিগুলির চেহারা তুলে ধরুন; রাজনৈতিক ব্যবস্থার চেহারা তুলে ধরুন। জনগণকে বলুন যে আজ দেশের প্রয়োজন এক নতুন পথের। একমাত্র সিপিআই(এমএল)-ই এই নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে। আমার পুরো বিশ্বাস যে আজ থেকে কয়েক বছর পর আবার একবার আমরা দিল্লীতে মিলিত হব। আরও একবার ৠালির রেকর্ড ভেঙে দেব।

আমরা আবার এখানে মিলিত হব।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!

(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৬ থেকে)

সিপিআই(এম), আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক ছাড়াও এসইউসিআই ও পিডব্লুপি এবং আমাদের পার্টিও সম্প্রতি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সিপিআই-এর ষোড়শ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে এবং প্রতিনিধি অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ভারতবর্ষের বাম শক্তির ব্যাপকতর অংশই রয়েছে এই দলগুলির মধ্যে। একটি মঞ্চে এই দলগুলির মিলন তাই সংবাদমাধ্যমে এই ধারণার সঞ্চার করে যে এই দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশ ঘটেছে এবং কিছু সংবাদপত্রে এমনকি এই দলগুলির মধ্যে ইতিমধ্যেই কিছু বোঝাপড়া হয়ে গেছে – এমন সংবাদও প্রকাশ করে। এই বিষয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এবং অনেক কমরেডেরই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। এঁদের বিভ্রম দূর করতে এবং এটিকে আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হিসাবেই চিত্রিত করতে আমি বাধ্য হই। তাঁদের উৎসাহে জল ঢেলে দিতে আমি একটু দুঃখই পেয়েছিলাম। কিন্তু, বাম ঐক্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয় যেখানে আলোচ্যবস্তু, তখন শব্দ নিয়ে খেলা করার বিলাসিতা একেবারেই চলে না।                                                      

আসুন, সিপিআই-এর কংগ্রেসে বাম ঐক্যের সামগ্রিক বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছে দেখা যাক। ঐক্যের প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মধ্যে যে তিক্ত বিতর্ক বর্তমান এবং যা প্রায়শই বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমে স্থান করে নেয় সে সম্পর্কে পাঠকরা বোধকরি অবগত আছেন। সিপিআই-এর মতে কোনো বুনিয়াদী পার্থক্যের ভিত্তিতে ১৯৬৪-র ভাঙ্গন ঘটেনি, কাজেকাজেই তা এড়ানো সম্ভব ছিল। এই প্রেক্ষিত থেকেই সিপিআই দুটি দলের মিলনের কথা বলে থাকে। অন্যদিকে, সিপিআই(এম) ১৯৬৪-র ভাঙ্গনের পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে মূলত ভারতীয় রাষ্ট্রের ও ভারতীয় বিপ্লবের চরিত্রায়ন সম্পর্কে বুনিয়াদী মতপার্থক্যের উল্লেখ করে থাকে এবং এই পার্থক্য আজও বর্তমান বলেই সে মনে করে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে সে সিপিআই-এর কাছে তার কর্মসূচির আমূল সংস্কারের দাবি রাখে এবং ইতিমধ্যে তার অধিকতর ক্ষমতা ও সংগঠনশক্তির জোরে সিপিআই-এর মধ্যে ভাঙ্গন ঘটিয়ে তার গণভিত্তিকে জয় করে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ইত্যাদির মতো আঞ্চলিক স্বায়ত্ততাবাদী আন্দোলনগুলি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ছাড়াও, বিভিন্ন রাজ্যে জোট বাঁধার জন্য বুর্জোয়া মিত্র বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতপার্থক্য রয়েছে। দুই পার্টির মিলনের ব্যাপারে সিপিআই(এম)-এর অনীহার কথা মাথায় রেখে পার্টি কংগ্রেস দুই দলের মিলনের প্রস্তাবটিকে আপাতত মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিপিআই-এর সাংগঠনিক দলিল বলছে, “ইতিমধ্যে আমাদের কর্মীবাহিনীকে এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হতে দিলে চলবে না, কেননা সিপিআই(এম)-এর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে।” রিপোর্টে “পার্টির স্বাধীন পরিচিতি ও কার্যকলাপের” ওপর এবং সিপিআই(এম)-এর সাপেক্ষে “কর্মসূচিগত ও সাংগঠনিক অবস্থান সম্পর্কে” পার্টির “নীতিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিকে” তুলে ধরার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে। শেষমেষ একটি পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সাধু অভিপ্রায়ের চেয়ে টিকে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিই জোরদার হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাম ঐক্যের প্রশ্নে কংগ্রেস গোটা বিষয়টিকে আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনের প্রয়োজনবাদী পরিপ্রেক্ষিতেই উপস্থাপিত করেছে। ফলে, বাম ঐক্যের প্রশ্নে বাগাড়ম্বর দিয়ে শুরু হয়েছিল যে পার্টি কংগ্রেস, তা শেষ হয় নির্বাচনগত দিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে ঐক্যের অঙ্গীকারের মধ্যে।

এককথায় বলতে গেলে, আগামী সংসদীয় নির্বাচনের জন্য পার্টিকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে এক কসরত ছাড়া এই পার্টি কংগ্রেস আর কিছুই ছিল না। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে কমরেড ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত আলোচনার সুর বেঁধে দিয়ে বলেছেন, “যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, একটি ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি পার্টির মধ্যে একটি জোটের মাধ্যমে কেন্দ্রে একটি বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার শুধু কাম্যই নয়, তা বাস্তবায়িত হওয়াও সম্ভব, তাঁদের সবাইকেই তাঁদের শক্তি সমাবেশিত করতে হবে এবং ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে নির্বাচনী ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যে ঐক্যই কেবলমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। শক্তিগুলির এই বিন্যাস জনগণের, বিশেষত দরিদ্র জনগণের আকাঙ্খার এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে।” কিন্তু কমরেড গুপ্তের পক্ষে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, তাঁর নিজের দল ছাড়া অন্য কোনো বাম দলেরই এই চমকপ্রদ পরিকল্পনায় আস্থা নেই।

অবশ্য এতে নিরস্ত না হয়ে সিপিআই-এর পার্টি কংগ্রেস এগিয়ে গেছে সেই কর্মসূচি সূত্রায়নের কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, যে কর্মসূচি কিনা সমস্ত বর্ণের বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির পক্ষে ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি হয়ে উঠতে পারে।

জোটে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক এবং বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে ব্যাপকতম। কংগ্রেসের তিওয়ারী-অর্জুন শিবির পর্যন্ত তার বিস্তার, যাঁরা কমরেড গুপ্তের ভাষায় “প্রধানমন্ত্রীর নীতিগুলি ও তাঁর কার্যধারার প্রতি একটি নীতিনিষ্ঠ চ্যালেঞ্জ” খাড়া করার কৃতিত্বের অধিকারী। পার্টি কংগ্রেসের দলিলে আত্মসমালোচনামূলক ভঙ্গিতে উত্তরপ্রদেশের বিগত নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টির বিজয়ী জোটের শরিক হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করার জন্য অনুতাপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদের শিকার হয়ে জাতীয় পরিষদের উপদেশকে অবজ্ঞা করা এবং ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরার জন্য উড়িষ্যা ও মণিপুরের রাজ্য কমিটিগুলিকে তিরস্কার করা হয়েছে। বিপরীতে বিহার ও অন্ধ্রের অনুশীলনকে সঠিক নির্বাচনী কৌশলের মডেল হিসেবে উচ্চ প্রশংসায় জর্জরিত করা হয়েছে। অবশ্য, পাটনা লোকসভার উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাবের জন্য বিহার রাজ্য কমিটির সমালোচনা করা হয়েছে।

তামিলনাড়ু শাখার যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতায় পার্টি কেন্দ্র অবশ্যই এখনও উদ্বিগ্ন হতে পারে, কেননা ঐ শাখা ডিএমকে-র সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তামিলনাড়ুতে এআইডিএমকে-ই হল শক্তিশালী দল এবং রাজনৈতিক দলিলে ইঙ্গিত রাখা হয়েছে যে পার্টি ঐ দলের পক্ষ থেকে সুবিধাজনক নির্বাচনী কৌশলের প্রতীক্ষা করছে।

এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির বেশ কয়েকটি বিভিন্ন রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে এবং সক্রিয়ভাবেই নয়া অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে চলেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে গণকার্যকলাপ পরিচালনা করার কোনো আগ্রহই তাদের নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার দুর্নীতি-কেলেঙ্কারী, মাফিয়া-রাজনীতিবিদ আঁতাতকে লালন করা, জাতিগত-সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মাখামাখি করা এবং গ্রামীণ দরিদ্র ও দলিত জনসাধারণের ওপর পুলিশী নিপীড়নকে স্থায়ী করার ব্যাপারে যথেষ্ট কুখ্যাতি অর্জন করেছে। সিপিআই-এর দলিলেও এই সমস্ত প্রশ্নে এই দলগুলি ও তাদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনা রাখা হয়েছে।

সিপিআই তাহলে কিসের ভিত্তিতে আশা করে যে ঐ সমস্ত দলগুলিকে এমন এক ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, যে কর্মসূচি অন্যান্য বিষয় ছাড়াও জোর দেবে সমস্ত ধরনের নিপীড়নমূলক আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার, পুলিশবাহিনীর সংস্কার ও তার আমূল পুনর্বিন্যাস, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ, তফশিলী জাতি ও উপজাতিদের অধিকারের সুরক্ষা, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সুরক্ষা, ঊর্ধ্বসীমা আইনকে সক্রিয়ভাবে কার্যকর করা, শিক্ষা ও চাকুরির অধিকারের স্বীকৃতি, কুখ্যাত দুষ্কৃতিদের নির্বাচনে প্রার্থীপদ দিতে অস্বীকার করা, কালো টাকার উদ্ধার, ইত্যাদির ওপর।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সিপিআই যদি এই ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ব্যাপারে যথার্থই আন্তরিক হয়, তবে যে সমস্ত দল, বিশেষত যে শক্তিশালী দলগুলি সিপিআই-কে ভালো সংখ্যক আসনে জিততে সাহায্য করতে পারে তার সংখ্যার বিচারে ঐ ফ্রন্টের পরিসর একেবারেই সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। অবশ্য পার্টি ব্যাপকতম জনগণের কাছে পৌঁছতে পারবে, যাতে কিন্তু আশু নির্বাচনী সাফল্য নাও আসতে পারে। পার্টি কংগ্রেস অবশ্য সিপিআই-এর অগ্রাধিকার সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। আর তাই আমরা একমাত্র এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারি যে, ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির এই কসরত নিছক লোকদেখানো ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। নির্বাচনী ফায়দা এনে দিতে পারবে – এমন শক্তিশালী বু্র্জোয়া মিত্রের সন্ধানের ভিত্তিতেই এখনও ফ্রন্ট ও আঁতাত গড়া চলতেই থাকবে। ক্ষমতার অন্বেষণে পার্টি যে তার নিজের ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচিটিকেও শিকেয় তুলে রাখতে পারে তা তার কথাশেষের বক্তব্য থেকেই সুস্পষ্ট, “ন্যূনতম কর্মসূচিটিকে যখন পরিবর্ধিত, চূড়ান্ত ও সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হবে, তখন সেটিকে নির্দিষ্ট সময়কালের বাস্তব পরিস্থিতি ও সম্ভাবনাগুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।” অন্যভাবে বলতে গেলে, ন্যূনতমটিকেও প্রয়োজনে যত খুশি কাটছাঁট করা চলবে।

এগোনো যাক। দেখা যাক এই মহান পরিকল্পনার মধ্যে আমাদের স্থান কোথায়। দলিলে বলা হয়েছে, “জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ বাম শক্তি নির্বাচনী প্রচারে চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এবং ঐ জোটের মধ্যে সিমেন্ট ও চুন-সুরকির কাজ করতে পারে।”

“কাজেই আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে – যা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ – বামেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলে এসইউসিআই, সিপিআই(এমএল), মার্কসিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি ইত্যাদির মতো দলগুলিকে সিপিআই, সিপিআই(এম), ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি-র সাথে হাত মেলাতে রাজি করানোর জন্য সমস্ত ধরনের প্রয়াস চালানোটা জরুরি। বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি তাদের বিদ্বেষ পরিত্যাগ করতেও তাদের রাজি করাতে হবে।”

কাজেই বাম ঐক্যের গোটা অনুশীলনটাই পর্যবসিত হচ্ছে জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর – স্পষ্টতই সিপিআই নির্ধারিত কাঠামোর – অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করতে এবং বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ‘বিদ্বেষ’ পরিত্যাগ করতে আমাদের ‘রাজি’ করানোর একমুখীন কর্মধারায়।

খুব কম করে বললেও, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই এক বড়দাসুলভ মনোভাব প্রকট, যা তারা তাদের পূর্বতন সোভিয়েত প্রভুদের কাছ থেকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে রপ্ত করেছে। আমাদের অবস্থানের কোনো মূল্যায়ন নেই এবং পার্থক্যগুলিকে স্বীকার করে ঐক্যের জায়গাগুলি অন্বেষণের কোনো প্রয়াসও নেই। অথচ সেটাই ঐক্যের প্রশ্নে একমাত্র মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে। সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এর একমাত্র পার্থক্য হল, ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ বদলে ‘রাজি করানো’। এই উভয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা যথাযোগ্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।

বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ‘বিদ্বেষ’ সম্পর্কিত এই সমস্ত অর্বাচীন কথাবার্তার অর্থ কী? এটা তাঁদের পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি আমাদের একটি নীতিনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভূত বিপ্লবী বাম বিরোধীপক্ষের অবস্থান রয়েছে। এই প্রশ্নে পার্থক্যগুলির সমাধান কেবলমাত্র নীতিনিষ্ঠ বিতর্কের মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়াতেই সম্ভব। কোনো সদাশয় বড়দার কোনো ধরনের সমঝানোতেই ঐ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ‘বিদ্বেষ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা যেখানেই এবং যখনই সম্ভব আমরা সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে সহযোগিতা করতে দ্বিধা করিনি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষেত্রেও কংগ্রেস(ই)-বিজেপির চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাকে সমর্থন করার প্রশ্নে আমরা কখনই দ্বিধান্বিত হইনি। উন্মত্ত বিদ্বেষ আসলে আমাদের প্রতি সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গিরই বৈশিষ্ট্য। সিপিআই বাম ঐক্যের স্বার্থ অনেক ভালোভাবে সিদ্ধ করতে পারবে যদি তার সমঝানোর দক্ষতা সে সিপিআই(এম)-এর ওপরেই কাজে লাগায়।

সিপিআই কংগ্রেসে তাঁর ভাষণে কমরেড নাগভূষণ পট্টানায়ক স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে বাম ঐক্য এবং সংসদসর্বস্বতার সহাবস্থান অসম্ভব।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রথমত ঐক্যবদ্ধ বামেদের জাতীয় মোর্চা-বামফ্রন্ট কাঠামোর অঙ্গীভূত হওয়া উচিত নয়, যা কেন্দ্রে এক জোট সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত। ঐ ধরনের যে কোনো সরকারের থেকেই তাকে দূরে থাকতে হবে, বড় জোর তা এক কংগ্রেস-বিরোধী বিজেপি-বিরোধী জোটের প্রতি সমালোচনামূলক সমর্থন জানাতে পারে। এর অর্থ বামেদের এক সাধারণ কর্মসূচিকে যতদূর সম্ভব রূপায়িত করার জন্য ঐ ধরনের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সমালোচনামূলক দিকটিকে অবশ্য সক্রিয় হতে হবে এবং ১৯৮৯ সালের বামেদের ভূমিকার পুনরাবৃত্তি ঘটলে চলবে না।

বর্তমান পর্যায়ে বাম ঐক্য কেবলমাত্র এক মহাজোটের চরিত্র নিয়েই রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, যেখানে প্রতিটি দলেরই বিভিন্ন রাজ্যে তাদের নিজস্ব কৌশলগত লাইন অনুসরণের স্বাধীনতা থাকবে। সিপিআই যখন জোর দিয়ে বলে যে ১৯৬৪-র ভাঙ্গনকে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এড়াতে পারত, তখন সে খুব একটা ভুল বলে না। ১৯৭৭ সাল থেকে দীর্ঘ ১৮ বছর যেভাবে তারা একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে – প্রতিটি স্তরে তারা সমন্বয়ী কমিটি বানিয়েছে এবং কখনও সখনও রাজ্যবিশেষে মিত্র বেছে নেওয়ার ব্যাপারে মতপার্থক্য বা আসনের বখরা নিয়ে বাদানুবাদ সত্ত্বেও মোটামুটি একই কৌশলগত লাইন অনুসরণ করে চলেছে – তাতে বুনিয়াদী মতপার্থক্যের অনেকটা বনিয়াদই ধ্বসে গেছে। তাছাড়া, মুলায়ম সিং, লালু যাদব বা চন্দ্রবাবুর মতো শক্তিশালী বুর্জোয়া মিত্রদের সমালোচনাহীন সমর্থনের যে ঐতিহ্য সিপিআই-এর ছিল, সিপিআই(এম) তা আত্মসাৎ করে নিয়েছে, উভয়ই একই সুরে জাতীয়তাবাদী বুলি আওড়ায়, গ্রামীণ দরিদ্রদের জঙ্গী সংগ্রামের প্রতি উভয়েরই প্রবল অনীহা এবং উভয়েই একনিষ্ঠভাবে কুলাকদের সঙ্গে সম্পর্কের বিকাশ ঘটায় ও নির্বাচনে বিজয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় জাতিভিত্তিক সমীকরণের আশ্রয় নেয় – এই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে মিলন এক যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব।

সিপিআই(এম) তার ১৯৬৪-র শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অবস্থান থেকে অর্ধেক এগিয়ে বুর্জোয়াদের শক্তিশালী অংশের সাথে যৌথভাবে সংস্কারের পথে চলেছে। অন্যদিকে সিপিআই সোভিয়েতের পতন ও নয়া বিশ্বব্যবস্থার যুগে তার অ-একচেটিয়া বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে জাতীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার অবস্থান থেকে অর্ধেক পথ পিছিয়ে এসেছে। নেহরু ও তার সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে এবং তার ঐ তত্ত্বের আর সমর্থক মিলছে না।

সিপিআই ও সিপিআই(এম) মিলনের দিকে যাক বা না যাক ১৯৬৪-র ভাঙ্গনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কখনই মুছে দেওয়া যাবে না, কেননা কারুরই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে বিপ্লবী কমিউনিস্টরাও ১৯৬৪-র ভাঙ্গনে এক শক্তিশালী অংশ ছিলেন, যে ভাঙ্গন যথাযথ পরিণতি লাভ করে ১৯৬৭ সালে।

এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হল – সিপিআই নিজে কতটা ঐক্যবদ্ধ? পার্টি কংগ্রেসের ঠিক আগেই সিপিআই-এর প্রবীণ তাত্ত্বিক চতুরানন মিশ্র তাঁর অন্যতম বিতর্কিত প্রবন্ধে লেখেন, এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য ভারতবর্ষের বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলির প্রয়োজন ভারতের বাজার। কাজেই, “এটা সাম্রাজ্যবাদের কাছে ভারতের আত্মসমর্পণ নয়, এটা হল সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতবর্ষের মিলন বিন্দু”। তিনি আরও লেখেন, “ভারতীয় রাষ্ট্র এখনও বৈদেশিক চাপের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দিল্লীতে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলনে বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সামাজিক ধারার সংযুক্তির বিরোধিতা করার মধ্যে তা প্রতীয়মান হয়”। “মারাকাংশ বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারত বিরোধীর ভূমিকা রাখে। অস্ত্র সম্বরণ চুক্তি ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রশ্নে ভারত মার্কিনের চাপের প্রতিরোধ করে আসছে”। “এমন একটা মনোভাব গড়ে উঠছে যে বর্তমান সরকারের পরিচালনাধীনে ভারত বিদেশী চাপের কাছে নতিস্বীকার করছে। প্রকৃত ঘটনা হল অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী চাপের বিরোধিতা করা ভারতের পক্ষে কষ্টকর হচ্ছে”।

সিপিআই কংগ্রেস নরসীমা রাও সরকারের এই নির্লজ্জ সমর্থনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটাই পার্টি কংগ্রেসের ইতিবাচক দিক যা পার্টিকে কংগ্রেসের কোলে ফিরে যাওয়া থেকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু কিসের মূল্যে, তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।

১৯৯৩-এ একবার সিপিআই-এর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমাকে বিদ্রুপের সুরে বিহারে আমাদের বিধায়কদের দলত্যাগের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে আমি বলি যে, ব্যক্তিগত লাভের আকাঙ্খা এবং তার সঙ্গে পশ্চাদপদদের জনতা দলের দিকে মেরুকরণ ঘটাই মতাদর্শগত দিক থেকে দুর্বল ব্যক্তিদের দলত্যাগে প্ররোচিত করে থাকবে। আমি জোর দিয়েই বলি যে বিহারে আমাদের পার্টির নেতৃত্ব অটুট রয়েছে এবং ঐ সমস্ত বিধাকদের কেউই গুরুত্বপূর্ণ পার্টি দায়িত্বশীল ছিল না। সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “ব্যক্তিগত লাভের আকাঙ্খায় কমিউনিস্টরা বিচ্যুত হয় কীভাবে, আমাদের বিধায়কদের দেখুন”। তিনি আমাকে গভীর অনুসন্ধানের পরামর্শ দেন। আমি চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করি। পরিহাসের বিষয় হল, পরদিনই সংবাদপত্রে দেখা গেল উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর রাজ্য সম্পাদক তথা বিধায়ক মুলায়ম সিং-এর দলে ভিড়েছেন। আরও একজন বিধায়ক শীঘ্রই একই পথ অনুসরণ করলেন। অতএব আমি সাগ্রহে সিপিআই-এর কংগ্রেসের দলিলে ঐ বিষয়ে এক গভীর অনুসন্ধানের অপেক্ষা করছিলাম। দলিলে বলা হয়েছে যে ব্যক্তিগত লাভের কারণেই তাঁরা দলত্যাগী হয়েছেন। এরপর দলিলে বিষয়টিকে সাধারণীকরণ করে বলা হয়েছে যে দলত্যাগের ঘটনা শুধুমাত্র সিপিআই-এর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ দলও ভাঙ্গনের মুখোমুখি হচ্ছে। “সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার যে ধারা প্রবহমান, সেই প্রেক্ষাপটেই বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে হবে”। তা বেশ, কিন্তু আপনাদের মতো কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তা ঘটে কীভাবে? রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রবণতার পিছনে কি কোনো সামাজিক যৌক্তিকতা নেই? পার্টি কংগ্রেসের দলিলে অবশ্যই পার্টির মধ্যে জাতিগত মতাদর্শের প্রভাব ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই-এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পশ্চাদপদদের মধ্যে সুবিধাভোগী স্তর ও অন্যান্যদের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্যকীকরণ করতে একেবারে অস্বীকার করে পার্টি কি লোহিয়াপন্থীদের জাতিগত মতাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি? আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি। আর ঐ ধরনের দলত্যাগ রোধে পার্টির পরিকল্পনা কী? তা, উত্তরপ্রদেশ থেকে পার্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তা হল, মুলায়ম সিং-এর সঙ্গে জোট বাঁধার ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা। এর থেকে সারকথা যা বেরিয়ে আসে তা হল : অল্প কয়েকজনের দলত্যাগ প্রতিরোধ করতে গোটা পার্টিটাকেই দলত্যাগী করে দাও। বিহারে এই কৌশল যথেষ্ট ফলদায়ক হয়নি কি?

(লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুলাই ১৯৯৫ থেকে)

১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। দ্রুত বিকাশমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তিদের ভূমিকার এবং ঘটনাবলীরও পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিকতা আজ এমনই যে তাদের যেন প্রহসন, এমনকি সস্তা তামাশা বলে মনে হচ্ছে।

হালে সামাজিক ন্যায়ের যে ধারার প্রচলন শুরু হয়েছে তার সাথে সঙ্গতি রেখে আমরা ইতিমধ্যেই কয়েকজন পশ্চাদপদ মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন উপ-রাষ্ট্রপতিরও দেখা পেয়েছি। অবশেষে সেই চরম বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গেল। ভারতবর্ষের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ আমাদের উপহার দিল এক দলিত, তার ওপরে এক মহিলা, মুখ্যমন্ত্রীকে। কুমারী মায়াবতীর ওপর বাজপেয়ী, রাও ও তিওয়ারী – ব্রাহ্মণ্যবাদী লবির এই ত্রিমূর্তির সমান আশীর্বাদ রয়েছে – এটাও কম বিস্ময়কর নয়। কাঁসিরামের সমস্ত হিসাবই উল্টে গেছে। এক নম্বর শত্রু, দুই নম্বর শত্রু, তিন নম্বর শত্রু ও চার নম্বর শত্রু – সম্মিলিত এই চার শত্রুর চেয়ে পয়লা নম্বরের মিত্র আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

মণ্ডল শিরোমণি ভি পি সিং পড়ে গেছেন উভয় সঙ্কটে। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাবোধকে পাশে সরিয়ে রেখে এই সেদিনও তিনি কে আর নারায়ণনের উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়াকে তাঁর – সামাজিক ন্যায়ের – ধারণার বিজয় হিসাবে তুলে ধরেছেন এবং ১৯৯৬-এ অর্থাৎ যে বছর নারায়ণনের রাষ্ট্রপতি পদে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা, সেই বছর এক দলিত রাষ্ট্রপতি পাওয়ার প্রত্যাশায় রোমাঞ্চ বোধ করছেন। সুতরাং মায়াবতীর ক্ষমতায় আসাকে তিনি কখনই নিন্দা করতে পারেন না। পারেন না আরও এই কারণে যে, এতদিন পর্যন্ত তিনি কাঁসিরামের সঙ্গে মাখামাখি করে আসছিলেন।

উদারনীতিবাদী যে চিন্তাকাঠামো দলিত-পশ্চাদপদ জোটের একমুখী বিকাশই শুধু দেখতে পেয়েছিল এবং এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক স্বাভাবিক ও কার্যকরী প্রতিষেধকের বিকাশ দেখে পরম উল্লসিত হয়েছিল, সমগ্র সেই কাঠামোটাই আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আর ঠিক এটাই আসন্ন লড়াইয়ে বিজেপি-কে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে তার উপর্যুপরি বিজয় এবং সাধারণভাবে অন্যান্য রাজ্যেও ভালো ফলাফল ইতিমধ্যেই তাকে প্রয়োজনীয় নৈতিক শক্তি যুগিয়েছে। এখন উত্তরপ্রদেশের ঘটনাবলীর সাথে সাথে স্পষ্টতই সে উদ্যোগ নিজের হাতে ছিনিয়ে নিয়েছে।

খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক যে একসূত্রী এজেন্ডা তার আছে তাকে স্বদেশীয়ানার আবরণে গোপন করতে সে সক্ষম হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার যেখানে বহুজাতিক সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তোষামোদ করতে ব্যস্ত, সেখানে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার এনরন প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বিজেপি প্রাথমিক এক ধাক্কা খেয়েছিল। সেটা কাটিয়ে উঠে, ১৯৯০-এ যেখানে সে থেমে গিয়েছিল ঠিক সেখান থেকেই সে আবার তার যাত্রা শুরু করেছে। কংগ্রেস(ই)-কেও এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন-তিওয়ারী গোষ্ঠী কোনোরকম সাড়া ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। রাও কংগ্রেস ধীরে ধীরে কিন্তু ধাপে ধাপে তাদের সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলছে। সেই সঙ্গে তারা নয়া অর্থনীতি ও শিল্পনীতির ভিত্তিতে ও সরকারে থাকার সুবাদে বেশ কিছু কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচকমণ্ডলীর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাও দাবি করছেন, নয়া আর্থিক ও শিল্পনীতি নিয়ে এক জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে (আর বাস্তবিকই নেপ রূপায়িত করার ব্যাপারে বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে যে রকম পাগলের মতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে তাতে ঐ নীতির বিরোধিতা যথেষ্টই দুর্বল হয়ে গেছে)। তার ওপর বিজেপির ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার বিপদটাই কংগ্রেসের কাছে বাড়তি লাভ। কারণ বামপন্থীদের একটা বড় অংশ সহ বেশ কিছু উদরনীতিবাদী মানুষ কংগ্রেসের ভাঙ্গনের চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন – বিশেষ করে যখন কার্যকরী কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। তথাকথিত “সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ক্ষমতা দখলকে ব্যর্থ করে দিতে” তারা কংগ্রেসের পিছনে সমবেত হন।

সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ক্ষমতা দখলের বিপদ বনাম পুরোনো সরকারকেই টিকিয়ে রাখা – এই রকম এক দ্বিধাময় পরিস্থিতিতেই তৃতীয় ফ্রন্টের বিষয়টি আবার আজকের রাজনৈতিক আলোচ্যসূচিতে প্রধান জায়গা দখল করে নিয়েছে।

ইতিহাসের সূত্র খুঁজলে দেখতে পাই, জরুরি অবস্থার বিরোধিতার প্রক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস বিরোধী এক মহা ঐক্য গড়ে ওঠে এবং তা কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুতও করে। বর্তমানের বিজেপি সেদিনের সেই জোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল আর বৃহৎ বামপন্থী দলগুলি হয় সেই জোটের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, না হয় তার থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখেছিল। ১৯৮৯ সালেও বোফর্স-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে। বামেরা সেবার জাতীয় ফ্রন্টের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল আর বিজেপি এক স্বাধীন শক্তি হিসাবে উঠে এসেছিল। কিন্তু দুবারের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই নিজের ভারে ধ্বসে পড়ে।

এবার সে ধরনের কোনো আন্দোলন নেই, কোনো ঐক্যের জায়গাও দেখা যাচ্ছে না। ‘সামাজিক ন্যায়’-এর মণ্ডলতত্ত্বের দুমুখো চরিত্রের কথা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত ধরনের বিভ্রান্তিকর ও সুবিধাবাদী পথ ধরেই শুরু হয়েছে তৃতীয় ফ্রন্টের সন্ধান। সিপিআই(এম)-এর পার্টি কংগ্রেস ‘বেশি বিপজ্জনক-কম বিপজ্জনক’ প্রেক্ষিত থেকে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে একধরনের বোঝাপড়া। অন্যদিকে জনতা দলের ভিতর থেকেই রামকৃষ্ণ হেগড়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতা দখলের মোকাবিলায় নরসীমা রাও-এর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব রেখেছেন। হেগড়ে খুব ভালোভাবেই জানেন যে বর্তমান মুহূর্তে, কী কংগ্রেস কী জনতা দল, কেউই তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হবে না। তবু, সম্ভবত নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিকে মাথায় রেখেই তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন। জনতা দল সভাপতি বোম্মাই দলের মধ্যে “বিরোধী মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে” বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এপ্রশ্নে দরজা খোলাই রইল।

এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, খ্যাতনামা সমাজতন্ত্রী তাত্ত্বিক শ্রীযুক্ত মধু লিমায়ে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে কংগ্রেসের ক্রম অবলুপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং কংগ্রেস(ই)-র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পক্ষে ওকালতি করেন। কেউ জানে না, মধু লিমায়ের পরামর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজতন্ত্রীদের একটি অংশ ঠিক কী ভাবছেন।

এছাড়া বিজু পট্টনায়েক ভি পি সিং-কে তীব্র আক্রমণ করেন। তাঁর মতে ভি পি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর তাঁবেদার, যাঁকে ইন্দিরা তনয় রাজীব পরে দল থেকে তাড়িয়ে দেন। বিজু আক্ষেপ করেছেন যে, ভি পি-র জাতপাতের রাজনীতি জনতা দলের ধ্বংসের কারণ এবং ভি পি-কে তুলে ধরা জনতা দলের পক্ষে ভুল হয়েছিল। তাঁর মতে, চন্দ্রশেখর ছিলেন যোগ্যতর ব্যক্তি। ভি পি অনুগামীদের তীব্র চাপের মুখে বিজুকে তাঁর বক্তব্য তুলে নিতে হলেও তিনি চারদিকে তাঁর অভিমত জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন এবং ভি পি সিং-এর ভাবমূর্তিকে খর্ব করতে দলে চন্দ্রশেখর ও মুলায়মকে আবার ঢোকানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ঐ একই যুক্তিধারা থেকে ডিএমকে, এমডিএমকে, এআইএডিএমকে ইত্যাদি সবাইকে জাতীয় মোর্চার অন্তর্ভুক্ত করার ও জেতার মতো এক জোট গঠন করার ওকালতি করা হচ্ছে।

জনতা দলের বাঙ্গালোর শিবিরে অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কার্যত নয়া অর্থনৈতিক নীতিকেই অনুমোদন করেছে এবং “কাজের অধিকারের” দাবিকে উপহাস করেছে। অন্যান্য প্রস্তাবগুলিও একেবারেই আনুষ্ঠানিক চরিত্রের। আর প্রধানমন্ত্রী পদের অনেক দাবিদার দাঁড়িয়ে গেছে, যারা ঐ পদের প্রতি তাদের দাবিকে জোরদার করে তুলতে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকেই বেশি করে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কার্যকলাপ সেই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয়, “অধিক সন্ন্যাসীতে ...”।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুকেই জোরের সঙ্গে তুলে ধরা হয়নি, কোনো আন্দোলনের আহ্বানও নেই। ৠাডিকাল কোনো কর্মসূচিও হাজির করা হয়নি। অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বর, পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা, সুবিধাবাদী আঁতাত এবং গোষ্ঠীতান্ত্রিক অন্তর্কলহ ছাড়া জাতীয় স্তরের একমাত্র মধ্যপন্থী দলটির আর কিছুই দেওয়ার নেই।

বিপ্লবী বাম স্পষ্টতই এই সমস্ত কসরতের অংশীদার হতে পারে না। সর্বত্রই বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মীবাহিনীর মোহমুক্তি ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সর্বপ্রধান কর্তব্য হল বিশ্বায়নের মুখোশের আড়ালে নিহিত জাতীয় সার্বভৌমত্ব খোয়ানোর বিপদ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি কর্তৃক ক্ষমতা দখলের বিপদের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে জাতীয় স্তরে এক প্রচার অভিযান সংগঠিত করা। দলিত ও গ্রামীণ গরিবদের অন্যান্য অংশের ওপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের বিষয় এবং শ্রমজীবী মানুষের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার বিষয় ও কাজের দাবির ওপরই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জোর দেব।

বর্তমান সন্ধিক্ষণে এক তৃতীয় ফ্রন্টের সন্ধান খুঁজতে হলে বিস্তৃত আলোচনার জন্য এক আলোচ্যসূচিকে তুলে ধরা প্রয়োজন। নিছক সংখ্যা ও নির্বাচনী জোটের খেলা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে সাধারণভাবে বামেদের ও বিশেষভাবে বিপ্লবী বামেদের উচিত তাঁদের নিজস্ব কর্মসূচির ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা এবং আলোচ্যসূচি নির্ধারণে এক মুখ্য ভূমিকা রাখা। এরপরেই কেবল রাজনৈতিক সমীকরণগুলি গড়ে উঠতে পারে।

[সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসী কর্তৃক সংগঠিত ১৯৯৩ সালের ১৪ অক্টোবর ডাঙ্কেল প্রস্তাব সম্পর্কিত কনভেনশনে প্রদত্ত অভিভাষণ – লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৩ থেকে]

প্রথমেই আমি এই কনভেনশনের উদ্যোক্তাদের এক প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানাই।

প্রায় দু-বছর ধরে ডাঙ্কেল প্রস্তাবকে ঘিরে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে এবং এ বছরের মধ্যেই প্রস্তাবটি গ্যাট কর্তৃক অনুমোদিত হবে বলে মনে হয়।

উরুগুয়ে পর্যায়ের আলোচনাগুলির প্রাথমিক পর্যায়ে ভারত সরকার কট্টর দরকষাকষির এক অবস্থানকে হাজির করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে প্রস্তাবের দুটি-একটি ধারার ক্ষেত্রে ছোটোখাটো কিছু সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে অবস্থানটিকে আরও নরম করে নেওয়া হয়। আর এখন তো মনে হচ্ছে সরকার অবিকল প্রস্তাবটিতেই স্বাক্ষরদানের জন্য প্রস্তুত।

শুরুতে প্রস্তাবের সম্ভাব্য অনুমোদনকে পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এখন ভারত কী কী সুবিধা ভোগ করতে পারে তার ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে।

কেউ কেউ তো এমন কথাও বলছে যে ডাঙ্কেল প্রস্তাবে নাকি পশ্চিমী দেশগুলির বিরুদ্ধেই রসদ ঠাসা আছে। যারাই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন তাঁদের নির্বোধ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং আরও অনেক কিছুই বলা হচ্ছে।

চাষিদের সেই অংশটা যারা বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আশু কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিতে পারে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী এক চাষি সংগঠন ডাঙ্কেল প্রস্তাব মেনে নেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। কিছু কিছু নিকৃষ্ট মার্কসবাদী ‘মুক্ত বাজার’ ও ‘মুক্ত বাণিজ্য’র কথা বলে দু-হাত তুলে ডাঙ্কেলের গুণকীর্তন করছে। কোনো কোনো বুর্জোয়া ভাঁড় ঐ প্রস্তাবের ‘অজ্ঞ’ বিরোধিতাকারীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ডাঙ্কেলের সহজ পাঠ ছেপে বার করে ফেলেছেন।

যাই হোক, ডাঙ্কেল একটা ভালো কাজ করেছে। নয়া বিশ্বব্যবস্থার প্রামাণ্য মুখ্য দলিল হিসেবে এটি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বড় পরিমাপের বিতর্ককে জাগিয়ে তুলেছে। ক্রমে বিতর্কটি গড়াতে গড়াতে কৃষক জনগণের মধ্যে নেমে এসেছে। তাঁরা ডাঙ্কেলের ক্ষতিকারক ফলাফল সম্পর্কে উত্তরোত্তর সচেতন হয়ে উঠছেন। বহুজাতিকদের কাজ-কারবারের বিরুদ্ধে কৃষকদের জঙ্গী প্রতিবাদের মধ্যে সজাগতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে – যার একটি আমরা কর্ণাটকে নানজুন্দাস্বামীর সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। ডাঙ্কেল চাচা মণ্ডল ও কমণ্ডল-এর কবল থেকে মধ্য কৃষক ও সম্পন্ন চাষিদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে।

চাষিদের সংগঠনগুলির সমন্বয়ের (co-ordination) মধ্যে আবশ্যকীয় ও ইতিবাচক ভাঙ্গনের পর তাদের একটি শক্তিশালী অংশ এখন বামদের, বিশেষ করে বিপ্লবী বামদের, স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করছে। এই সমস্ত বিকাশের জন্য আমাদের কি ডাঙ্কেলকে ধন্যবাদ জানানো উচিত নয়?

মাসখানেক আগে আমি সানডে পত্রিকায় মণিশংকর আয়ারের ডাঙ্কেলের সহজ পাঠ পড়ছিলাম – যেখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সরস ও উদ্ধত ভঙ্গিতে ডাঙ্কেলের সমালোচকদের বেশ করে নিন্দামন্দ করেছেন। তা যাই হোক, আমার মনে হল আমাদের মধ্য থেকেও যদি কেউ আমাদের কৃষকদের আরও ভালো উপলব্ধির জন্য জনপ্রিয় ভাষায় এক পুস্তিকা লেখেন তাহলে খুব সুন্দর হয়। আমার জানা নেই হয়তো ইতিমধ্যই এ কাজ হয়ে গিয়ে থাকবে, নতুবা, কেউ না কেউ এই কাজে হাত লাগিয়েছেন।

ডাঙ্কেল প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে এবং এখানে কমরেড যতেন্দ্র ইতিমধ্যেই বিস্তৃত ব্যাখ্যা রেখেছেন। আমি বরং সামান্য কয়েকটি বিষয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব।

১। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি যেহেতু বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির আধিপত্যাধীন, তাই এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সোভিয়েত ব্লকের পতনের পর এই প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হয়েছে। স্বভাবতই, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও গ্যাটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিও এক নতুন ও আক্রমণাত্মক চেহারা নিতে সচেষ্ট। বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির স্বার্থে জাতীয় সীমারেখাগুলি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে। এই লক্ষ্যেই অসম দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের সমশর্তকে বলবৎ করার জন্য ডাঙ্কেল প্রস্তাব মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করছে।

২। ভারতের মতো দেশে উন্নয়নের কর্মসূচি রচনায়, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে দিশা প্রদান করবে উপর থেকে আর নীচের থেকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলি হাতে নিয়ে, কাঙ্খিত আধুনিকতার দিকে জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তোলার কাজটি চালিয়ে যাবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। সরকারের ভূমিকা হয়ে দাঁড়াবে নিছক মধ্যস্থতাকারীর আর শাসক রাজনীতিবিদরা কমিশনভোগী, উৎকোচভাগী ও দালালে পরিণত হবে। এটিই হল নয়া উপনিবেশবাদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা – যা ইতিমধ্যেই আমরা লাতিন আমেরিকায় প্রত্যক্ষ করেছি। সেদিন আর দূরে নয় যখন দেখা যাবে মন্ত্রী আর সরকারি কর্তাব্যক্তিরা চোরাচালান আর মাদক পাচারে যুক্ত হয়ে পড়েছে।

সবশেষে এটি আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই যে ভারতকে যদি Banana Republic-এ পর্যবসিত করার উদ্যোগ-আয়োজন চলতে থাকে তাহলে জনগণের রণাঙ্গনগুলি ও গেরিলাবাহিনীও দূরের বস্তু হয়ে থাকবে না।

(লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ থেকে, সংক্ষেপিত)

সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসী-র ১৫ আগস্ট সংখ্যায় রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান প্রসঙ্গে আমাদের পর্যালোচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে কুৎসিত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। অন্যান্য পার্টি-মুখপত্রেও নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে, আর পাঞ্জাবে – যেখানে তাদের পার্টির কোনো নিজস্ব মুখপত্র নেই, ‘পাঞ্জাবী ট্রিবিউন’-এ লেখাটিকে চালান করে দেওয়া হয়েছে। পিপলস ডেমোক্রেসী সংযুক্ত মঞ্চগুলি সম্পর্কে ‘নকশালপন্থীদের’ মুর্খতাপূর্ণ সংকীর্ণ ও বালখিল্য আচরণ সম্পর্কে বিলাপ করেছে। লেখা শেষ করা হয়েছে আমাদের এই হুঁশিয়ারী দিয়ে যে “মূলস্রোতে থাকবেন নাকি পুরোনো প্রান্তীয় রাজনীতিতে ফিরে যাবেন – সিদ্ধান্ত নিন”।

তাদের যুক্তিগুলিকে একটি একটি করে ধরা যাক। রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান থেকে আমাদের নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল পরিস্থিতির নির্দিষ্ট পরিবর্তন, যেক্ষেত্রে মূল জোর ঘুরিয়ে দেওয়া উচিত কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে। পিপলস ডেমোক্রেসী নিজেও স্বীকার করেছে যে “রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর মতো মঞ্চগুলি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী মাঝে মাঝেই গড়ে উঠবে”। সম্পূর্ণ সঠিক। এখন, নির্দিষ্ট পরিস্থিতি কি সত্যিই পরিবর্তিত হয়নি? যে সিপিআই(এম) এতদিন বিজেপির সাপেক্ষে কংগ্রেস সরকারকে সংসদের অভ্যন্তরে বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল সে-ই, যদিও অনিচ্ছায়, অনাস্থা প্রস্তাব আনতে মুখ্য উদ্যোগী হতে বাধ্য হয়েছে এবং বিজেপির সঙ্গে একসাথে ভোট দিয়েছে! ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে “যখন মূল জোর থাকা উচিত ছিল সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে” (বাঁকা হরফ আমাদের), তখন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-এর অস্বীকৃতির সমর্থনে লিখতে গিয়েও পিপলস ডেমোক্রেসী  অসতর্কভাবে কবুল করে ফেলেছে যে অগ্রাধিকারের বিষয় এখন বদলে গেছে। পিপলস ডেমোক্রেসী -র যুক্তি হল, “নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে সরকারের সাথে সংঘর্ষে যাওয়ার উপর জোর দিলে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সমাবেশ ঘটানোর যে লক্ষ্য তা পথভ্রষ্ট হতে পারত।” এ হল একজন উদারনৈতিকের যুক্তি, মার্কসবাদীর নয়। তথাপি, একথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখানেই যে তাদের স্ব-আরোপিত সীমারেখা আর মোটেই কাজ দিচ্ছে না। ১৯ আগস্ট ও ৯ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচিগুলি এ সত্যকেই যথেষ্টভাবে উদ্ঘাটিত করেছে। পিপলস ডেমোক্রেসী -র শ্রীযুক্ত রাজনৈতিক ভাষ্যকারকে জিজ্ঞাসা করি, মূল জোর দেওয়ার ক্ষেত্র বর্তমানে বদলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর জন্য কোনো ভূমিকা রাখার কথা আপনারা বিবেচনা করছেন? এ প্রশ্নের জবাবে পিপলস ডেমোক্রেসী  নিরুত্তর আর তাই সমগ্র বিতর্কটি এক অর্থহীন কুৎসা অভিযানে পর্যবসিত হয়েছে। নিউ এজ (সিপিআই-এর মুখপত্র) প্রশ্নটির জবাব দিতে চেষ্টা করেছে যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর ঠিক কী ভূমিকা হবে তা নির্দিষ্ট করতে পারেনি। আইপিএফ এক বিকল্প পরামর্শ দিয়ে বলেছে, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বরা রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর পরিচালনায় থাকুন আর রাজনৈতিক দলগুলি পিছন থেকে সাহায্য করুক। এ প্রশ্নে স্বাস্থ্যকর বিতর্ক চলতে পারত। কিন্তু পিপলস ডেমোক্রেসী অতি উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে এবং আমাদের এক হাত নেওয়ার জন্য মূল বিষয় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। যারা প্রায় ভীমরতির সীমানায় পৌঁছে গেছে তাদের এই শিশুসুলভ আচরণের জন্য করুণা হয়।

সংযুক্ত মঞ্চগুলির ভিতরে কাজ করার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর ভূমিকাকে পর্যালোচনা করতে গিয়ে পিপলস ডেমোক্রেসী ‘বিস্তৃত পরিসরের’ শক্তিগুলি ও বামপন্থীদের নিজস্ব মঞ্চসমূহের মধ্যে চীনের প্রাচীর খাড়া করার চেষ্টা করেছে। এসব হল নিতান্তই উদারনৈতিক বুর্জোয়া আবর্জনা। বিস্তৃত পরিসর তাহলে উদারনৈতিক বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা প্রচারের, বুর্জোয়া দলগুলির মাহাত্ম্য প্রচারের এক সংযুক্ত মঞ্চ! তাহলে বামদের অস্তিত্বের পিছনে যুক্তি কী থাকে? কেবল জনসাধারণকে সমাবেশিত করা আর বুর্জোয়া ভাঁড়দের নাটুকেপনায় তাদের করতালি দিতে আদেশ দেওয়া? আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রকৃত কোনো সংগ্রামে গণউদ্যোগকে উন্মুক্ত করা ও বাম মতাদর্শের প্রসার ঘটানোই অগ্নিপরীক্ষার বিষয় এবং বামদের অবশ্যই একটি সংযুক্ত মঞ্চকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালাতে হবে।

উত্তরপ্রদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নির্বাচনে এআইএসএ-র জয় কেবল মাত্র আমাদেরই সাফল্য নয় বরং সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক শক্তিরই জয় এবং এভাবেই দেশজুড়ে সমগ্র ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি স্বীকৃতি জানিয়েছে। এ এক এমনই পরিহাসের ব্যাপার যে সাম্প্রদায়িকতাবাদ বিরোধী একটি জাতীয় মঞ্চ উত্তরপ্রদেশের এই তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশকে উপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করেছে এবং ১৪ এপ্রিলের সমাবেশে এআইএসএ-র কোনো বক্তাকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। “অন্যদের তুলনায় তাদের (আইপিএফ-এর) সীমিত শক্তি সত্ত্বেও তারা অন্যান্য প্রায় সকল দলের থেকে বেশি বক্তা আশা করে” – একথা বলে তারা যে যুক্তির অবতারণা করেছে তার উদ্দেশ্য হল সংশ্লিষ্ট মূল বিষয় থেকে তুচ্ছ কোনো দিকে দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। বেশি বক্তা পাওয়ার মতো সামান্য বিষয় নিয়ে দরকষাকষি করা অথবা ক্যামেরার সামনে আসার মতো অভ্যাস আমাদের নেই – এসব আপনাদেরই একান্ত সংরক্ষিত। উত্তরপ্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নির্বাচনে সাফল্যের মতো বিরাট তাৎপর্যময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত কেবলমাত্র ওই একবারই আমরা এআইএসএ-র একজন বক্তা দাবি করেছিলাম। আমরা মঞ্চকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইছিলাম – এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং উপদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে আমরা আমাদের সাফল্যগুলি সম্পর্কে আমাদের নিজেদের মঞ্চের মাধ্যমেই প্রচার চালাই। চমৎকার! তাহলে একই যুক্তিতে, রাম বিলাস পাশোয়ানের কি নিজস্ব মঞ্চ নেই? তাঁকে কি মঞ্চটিকে আম্বেদকর শতবর্ষ উদযাপনের এক আস্ত প্রদর্শনী হিসেবে রূপান্তরিত করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়নি, মঞ্চটিকে দখলের সচেতনভাবে সুযোগ করে দেওয়া হয়নি? লালুরও নিজস্ব মঞ্চ আছে। সেদিনের সমাবেশের বিচারে তাঁর তো লোক জমায়েতের নিজস্ব কোনো কৃতিত্ব ছিল না। তাহলে তাঁকে রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর সমাবেশের মূল মর্মবস্তুকে বিসর্জন দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি খাড়া করার জন্য মঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হল কেন? কমরেড সুরজিৎ বিহারে লালুর বাইরে কিছু দেখতে সক্ষম না হতে পারেন কিন্তু আমরা অবশ্যই এ সত্যকে স্বীকার করি যে বিহার যদি আপেক্ষিকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে মুক্ত থাকে সেক্ষেত্রে বিহারের জনগণ ও বাম শক্তিগুলির রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিহারে দরিদ্র কৃষক জনগণের ভূমিকা ও উত্তরপ্রদেশের ছাত্রদের উপর গুরুত্ব আরোপ করা কীভাবে যে ‘বিস্তৃত পরিসরের’ অথবা রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর ঘোষণার বিরুদ্ধাচরণ হয় – তা আমাদের বোধগম্য নয়।

বিষযবস্তুটির জটিলতা রয়েছে অন্য কোথাও। উত্তরপ্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নির্বাচনে এআইএসএ-র বিজয়কে সিপিআই(এম) কখনই হজম করতে পারেনি এবং সিপিআই(এম)-এর মুখপত্রগুলিতে এই খবর কাটছাঁট করে প্রকাশ করার যে হাস্যকর প্রয়াস চালানো হয়েছে তা দেখিয়ে দেয় যে এই খবরে বিজেপির থেকেও সিপিআই(এম) বেশি মর্মাহত। এর পরেও তাঁরা আমাদের এ প্রশ্নে সংকীর্ণতাবাদী বলার ধৃষ্টতা দেখিয়ে চলেন।

এটি সাধারণ বোধের ব্যাপার যে রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর প্রধান জোর ছিল সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা অকারণে কেবলমাত্র অ-কংগ্রেসী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির এক মঞ্চ হিসেবে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেনি। সিপিআই(এম) কংগ্রেসকে এই মঞ্চের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রস্তাব রেখেছিল কিন্তু তাদের এই ইচ্ছা মঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ শরিকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। মার্চ ও এপ্রিল মাস ছিল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রচারাভিযানের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সিপিআই(এম) “সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সমাবেশ ঘটানোর লক্ষ্য” বিপথে চলে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে নিজে সমাবেশ থেকে দূরে থেকে যায়। বিজেপি-কে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের উপর বিরাট আশা পোষণ করছিলেন এবং সে জন্য তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সমাবেশগুলির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাও স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছিলেন। এটি একেবারেই মিথ্যা দাবি যে “বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়েছিল এবং সম্ভবত আইপিএফ ছাড়া সকল শক্তিই একমত হয়।” জনতা দল এবং সিপিআই, শেষ সময় পর্যন্ত, রাষ্ট্রীয় একতা অভিযান-এর বারাণসী সমাবেশে অংশগ্রহণে যথেষ্ট ইচ্ছুক ছিল এবং একমাত্র শেষ মুহূর্তে সিপিআই(এম) চক্রান্ত করে তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

পিপলস ডেমোক্রেসী আমাদের এই তথ্যও দিচ্ছে যে, “তারা {অর্থাৎ সিপিআই(এমএল) ও আইপিএফ} গণসংগঠনগুলির কনভেনশনে সাধারণ সনদের বাইরের ইস্যুগুলি ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।” কমরেডগণ, আমাদের কাছে সত্যি এটা একটা খবর বটে। আমাদের গণসংগঠনগুলির বক্তারা অংশগ্রহণকারী মানুষদের কাছ থেকে ভালোমাত্রায় সোচ্চার সমর্থন পেয়েছিলেন আর কেবলমাত্র আপনাদের পার্টির লোকেরাই – যারা সেখানে সভাপতিত্ব করছিলেন – সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আমাদের বক্তাদের জন্য বরাদ্দ সময় কাটছাঁট করার চেষ্টা করতে থাকেন।

আমাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাত্র। আমরা যদি সত্যিসত্যিই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামের প্রশ্নে নিষ্ঠাবান হই, ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের শরিকরাও তাহলে তাদের পারস্পরিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিয়ম উদ্ভাবনে নৈতিকভাবে বাধ্য। যদি একই সময়ে লালু যাদব আইপিএফ বিধায়কদের নিয়ে ঘোড়া কেনা-বেচার কাজে লিপ্ত থাকেন আর আপনারা আইপিএফ-এর সঙ্গে যুক্ত কৃষিমজুরদের গণহত্যা সংগঠিত করেন, তাহলে তা মানুষের কাছে কী বার্তা নিয়ে যাবে? আপনারা ভুল করছেন কমরেড। আমাদের বিধায়ক দলে “ভাঙন ঘটানো”র জন্য আমরা লালু যাদবের উপর ক্ষিপ্ত নই। কারোর মত বদলের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং অবশ্যই তিনি নিজের পছন্দমতো দলে যোগ দিতে পারেন। আমরা কেবলমাত্র দাবি করছি যে মৌলিক সংসদীয় নৈতিকতার স্বার্থে ওই বিধায়কদের ইস্তফা দিতে বলা উচিত এবং তাদের নতুন করে জনগণের রায় নেওয়া উচিত। এটা সম্পূর্ণতই এক গণতান্ত্রিক দাবি আর নেহাত কিছু প্রয়োজনবাদী রাজনৈতিক লাভের আশায় লালুর গণতন্ত্র বিরোধী আচরণকে যুক্তিযুক্ত বলে দেখাতে গিয়ে আপনারা খুবই খারাপ নজির স্থাপন করছেন। ভালো কথা, বিধায়কদের রাজনৈতিক উৎকর্ষকে নিশ্চিত করা ও শিক্ষিত করে তোলার জন্য আপনাদের মূল্যবান উপদেশের জন্য আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা আরও উপকৃত হতাম যদি সাট্টা ডন রশিদ খানের সাথে আপনাদের কোনো কোনো এমএলএ-র আঁতাত ও কলকাতায় কয়েকজন সন্দেহভাজন শিল্পপতির সাথে আপনাদের কিছু মন্ত্রীর যোগসাজশের ব্যাপার আপনারা কীভাবে সামলাচ্ছেন সেই অভিজ্ঞতার কথা যদি আমাদের বিবৃত করতেন। যাই হোক, আমরা প্রকাশ কারাত কথিত সর্বোত্তম বাম সংগঠন বামফ্রন্টের সাতজন এমএলএ-র রাজ্যসভায় প্রণব মুখার্জীর পক্ষে ভোট দেওয়ার মতো অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করা থেকে বিরত রয়েছি। যে পার্টি নিজেকে ভারতে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি বলে দাবি করে তাদের কি ‘চোরেদের মন্ত্রীসভার’ থেকে ভালো কিছু সরকার উপহার দেওয়া উচিত নয়? শব্দগুলি ব্যবহারের জন্য, কমরেডগণ, আমরা দুঃখিত, কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হুবহু এই শব্দগুলিই ব্যবহার করেছিলেন।

পিপলস ডেমোক্রেসী-র অভিমত অনুযায়ী, “সিপিআই(এম)-কে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বানানো চারু মজুমদারের পুরোনো তত্ত্বেরই ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়” এবং “এই গ্রুপ সম্প্রতি যেভাবে ধাক্কা খেয়েছে তার ফলে মনে হয় পুরোনো ধ্বংসাত্মক অবস্থানের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়”। দুটি হিসেবের ক্ষেত্রেই পিপলস ডেমোক্রেসী গোলমাল করে ফেলেছে। কোনো ধাক্কা নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যত্র সাম্প্রতিক মাসগুলিতে আমাদের পার্টির বিস্তার ঘটার ফলেই আমাদের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)-এর রোষের সঞ্চার হয়েছে। তৃণমূলে এর প্রতিফলন ঘটেছে করন্দা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে (পিপলস ডেমোক্রেসী-র আর কীসের সমস্যা! তাদের পার্টির কাছে যা কিছু অস্বস্তিকর তাকে চেপে যাওয়ার তাদের সনাতন ঐতিহ্য অনুযায়ীই তারা করন্দা প্রসঙ্গে কোনো কিছু উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছেন) আর বৃহত্তর ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটছে প্রধান ধারার রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য পুরোদস্তুর এক কুৎসা অভিযান চালানোর মধ্যে। উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন, আইপিএফ-এর সাথে জনতা দলের যৌথ কার্যকলাপ চালানো নিয়ে আলাপ-আলোচনার বিরোধিতা করে এবং সিপিআই(এম)-এর শক্তি ভেঙ্গে আইপিএফ অগ্রগতির পরিকল্পনা করছে – এই অভিযোগ এনেছেন। সিপিআই(এম)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল এমন লোকজন সমেত সমস্ত বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই অস্বাভাবিক বিবৃতির নিন্দা করেছেন এবং সিপিআই-এর রাজ্য পরিষদ এর নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বস্তুতপক্ষে বামফ্রন্টের উপর সিপিআই(এম)-এর কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়া আর বিপরীতে এমনকি পশ্চিমবঙ্গে পর্যন্ত বামফ্রন্টের শরিকদের সাথে আমাদের আন্তঃক্রিয়ার বৃদ্ধিই সিপিআই(এম)-কে আতঙ্কগ্রস্ত ও আমাদের প্রতি অতিরিক্ত ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।

সিপিআই(এম) যদি সমগ্র বাম-মধ্যপন্থী বৃত্তে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক-মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ হয়ে থাকে তার কারণ কিন্তু চারু মজুমদারের কিছু তত্ত্ব অথবা আমাদের পছন্দ-অপছন্দ নয়। এর মূল নিহিত আছে আমাদের পারস্পরিক ইতিহাসের মধ্যে, আমাদের দুই বিপরীত রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনের ভিতরে এবং আমাদের বিচ্ছিন্ন করার, চরিত্র হননের, এমনকি শারীরিকভাবে শেষ করে দেওয়ার আপনাদের উন্মত্ত প্রচেষ্টার মধ্যে। প্রান্তিক রাজনীতিতে পড়ে থাকার আমাদের কোনো ইচ্ছা নেই আর মূলস্রোত থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার আপনাদেরও কোনো সাধ্য নেই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে বিবেকের কণ্ঠস্বরগুলি আছে যারা বামদের স্বাধীন ভূমিকার এক নতুন ভিত্তিতে আমাদের দুই পার্টির মধ্যে কমরেডসুলভ সহযোগিতার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন; এবং ভবিষ্যতে এইসব লাইনগুলির কোনো পুনর্বিন্যাস ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নিশ্চিতভাবেই নতুন এক অধ্যায় খুলে দেবে। হাজার হোক, কোনো নেতার আত্মগত বাসনার চেয়েও পরিস্থিতির ক্ষমতা অনেক বেশি।

(লিবারেশন, মে ১৯৯৩ থেকে)

আমাদের পার্টির কলকাতা কংগ্রেসে আমরা স্থির করেছি ভারতবর্ষে একটি একক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে বামপন্থী ঐক্যের জন্য আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করে তুলব। পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে বিগত তিন মাসে আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমাদের আন্দোলনের শুভাকাঙ্খী এবং সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে বারবার প্রশ্ন এসেছে – আমাদের এই স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বা সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পদক্ষেপই বা কী নেওয়া হচ্ছে? শুনেছি, পশ্চিমবাংলার সিপিআই(এম)-এর একজন বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট ভদ্রলোক নাকি আমাদের এই ধারণাকে নিছক কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্য কেউ কেউ মনে করেন যে প্রবীণ নেতৃত্বের তরফ থেকে বাধা এলেও কমিউনিস্টদের নতুন প্রজন্ম এতে ব্যাপকভাবেই সাড়া দেবেন।

কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিৎ এবং কমরেড ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় আমি যে বিষয়টির উপর বিশেষ জোর দিই তা হল সংঘ পরিবার যেখানে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বামপন্থার ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় আক্রমণ হানছে, বামপন্থীরা কিন্তু সেখানে হিন্দি বলয়ে বিজেপির ঘাঁটিতে কোনো সফলতা পাচ্ছেন না। বামপন্থীদের রণনীতিতেও হিন্দিভাষী এলাকায় বিজেপির মোকাবিলা করার দায়িত্বটা মধ্যপন্থী বিরোধীপক্ষের বা এমনকি কংগ্রেসের উপর ছেড়ে দেওয়া আছে – বামপন্থীদের নিজস্ব ভূমিকাটা সেখানে কেবলই পেছন থেকে সমর্থন যোগানোর। রাজনৈতিক ও সংসদীয় কারসাজির মাধ্যমে বিজেপির ক্ষমতায় আসাটাকে এভাবে যদি আপাতত ঠেকিয়েও রাখা যায় গণমানস থেকে সাম্প্রদায়িকতার জীবাণুকে কখনই নির্মূল করা যাবে না। আজ সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্যাপক মেহনতি মানুষের ওপর এক ফ্যাসিস্ট হিন্দু রাষ্ট্র চাপিয়ে দিতে চাইছে। অথচ এই সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় জনগণকে সমাবেশিত করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্প্রীতির বিমূর্ত স্লোগান ছাড়া আর কিছু নেই – বাস্তব জীবনে সংকটের প্রতিটি মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপোশ ও তোষণ করে চলাটাই কংগ্রেসী ঐতিহ্য।

কংগ্রেসকে দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আর তার ধারাবাহিকতায় কংগ্রেসের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে তোলার কৌশলের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সত্যি বলতে কী, এই কৌশলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাটাই বেশি – জনগণের চেতনাকে ভোঁতা করে ফেলা, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে বিভক্ত করা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণসমাবেশকে দুর্বল করে দেওয়া ছাড়া এর আর কোনো অবদান নেই।

ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার কৌশল

সাম্প্রতিক এআইসিসি অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি নরসীমা রাও-এর একটি বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। রাও-এর মতে “ধর্ম ছাড়া বিজেপির আর বাকি আছেটাই বা কী? এবার সেটাও নিয়ে নিলে বিজেপি-কে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।” অর্থাৎ বিজেপির অর্থনৈতিক কর্মসূচি এবং বৈদেশিক নীতি কংগ্রেস ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে। শুধু ধর্মটাই বাকি আছে আর এবার সেটাই কংগ্রেস কব্জা করে নেবে।

বাবরি মসজিদ ভাঙার আগেই শোনা যাচ্ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে সরিয়ে রেখে কংগ্রেস এবার নিজেই বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির নির্মাণের জন্য আদালত থেকে অনুকূল নির্দেশ আদায়ের আশ্বাস দিয়েসাধু মহন্তদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের ভিতরে রামলালার মূর্তি ঢুকিয়ে দিয়ে মসজিদটিকে বিতর্কিত মুসলিম পরিত্যক্ত ‘ইমারতে’ পরিণত করার ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে তালা খোলা এবং শিলান্যাস অবধি অযোধ্যা বিবাদের ক্রমবিকাশে একের পর এক কংগ্রেস সরকার চিরকালই সন্দেহজনক ষড়যন্ত্রকারীর ভূমিকা পালন করে এসেছে। বস্তুত মন্দির প্রশ্নে যাতে কংগ্রেস উদ্যোগ কেড়ে নিতে না পারে সেই ভয়ে মরিয়া হয়েই বিজেপি শেষ অবধি মসজিদ ভাঙার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়। খেলা তাতেও শেষ হয়নি – ট্রাস্ট বানানোর নাম করে সাধুদের মধ্যে অনুপ্রবেশ বা সমান্তরাল উদ্যোগের মাধ্যমে কংগ্রেসী কারসাজি আজও অব্যাহত রয়েছে। মুসলমানেরা এটা ভালো বোঝেন আর তাই কংগ্রেস আজও তাদের থেকে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন।

এমন একটি পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কোনো প্রকৃত আন্দোলনকে আদৌ কি শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব? কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে বা প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কংগ্রেস-কে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা বানানোটা কি একান্তই অপরিহার্য?

বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ এবং কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক কারসাজির বিরুদ্ধে যুগপৎ বিরোধিতার ভিত্তিতে কোনো ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা গড়ে উঠলে সেই সংগ্রামকে কংগ্রেস ও বিজেপির অভিন্ন ভিত্তির – নয়া আর্থিক ও বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, আর এভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা থেকে ধীরে ধীরে একটি ব্যাপক গণতান্ত্রিক মোর্চায় উপনীত হওয়া সম্ভব। এই প্রশ্নে তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে আর সংযুক্ত মঞ্চে ও যৌথ কার্যকলাপের ক্ষেত্রে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে আমাদের তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই এটা প্রতিফলিত হয়। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির চাপে এবং মুসলিম প্রতিক্রিয়ার ভয়ে তাদের এই লাইনকে তারা এখনও বাস্তবায়িত করার সাহস করে উঠতে পারেননি।

সাম্প্রদায়িকতার বিপদের মোকাবিলায় জনতা দল ও তার বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট বাঁধায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই – কিন্তু মতাদর্শের ক্ষেত্রে যদি মণ্ডলবাদীদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় আর লালু যাদব-মুলায়ম সিং-দের যুগপুরুষ হিসাবে তুলে ধরা হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ব্যাপক ক্ষতিই ডেকে আনবে। এতে এটাই প্রমাণিত হবে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিন্দি বলয়ে বিজেপির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় বামপন্থীদের কাছে নিজস্ব কোনো জবাব নেই। আর এভাবে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে নিজস্ব ভিত্তি সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতির মূলধারায় বামপন্থীরা ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। বিশেষ করে বিজেপি যখন বামপন্থীদের এলাকাগুলিতে ঢুকে পড়ছে।

বামপন্থার স্বাধীন অগ্রগতি

উত্তরপ্রদেশে আমাদের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনগুলিতে আমাদের জয় যদি চারিদিক থেকে প্রশংসা কুড়িয়ে থাকে এবং নতুন আশা জাগিয়ে তোলে তাহলে তার একমাত্র কারণ হল এর মধ্যে দিয়ে আমরা এটা দেখাতে পেরেছি যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে নামলে বিজেপির ঘাঁটিতেও বামপন্থীরা তাকে পরাজিত করতে পারে। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, আমাদের জয়ের অর্থ শুধু বিজেপির মারমুখী সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের পরাজয়ই নয়, মণ্ডলভিত্তিক রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে বর্জন করে উন্নততর রাজনীতিকে গ্রহণ করার একটা প্রবণতাও এতে প্রতিফলিত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরগুলি মণ্ডল-বিরোধী আন্দোলনে ভালোই মেতে উঠেছিল – ছাত্র সমাজের মধ্যে দেখা দিয়েছিল গভীর বিভাজন। জাতভিত্তিক সংরক্ষণের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও নির্বাচনী অভিযানে আমরা বেকারির সমস্যাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরি আর এভাবে ছাত্রদের সমস্ত অংশের সমর্থন আমরা জয় করে নিই।

হিন্দিভাষী এলাকাগুলিতে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে জনতা দলের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপের ওপর জোর দেওয়ার সাথে সাথে বামপন্থীদের সমান্তরাল উদ্যোগকেও আমরা বাড়িয়ে তুলতে চাই। শুরুতে আমরা হয়তো আজ একটি ছোটো শক্তি – কিন্তু বামপন্থার অগ্রগতির প্রশ্নটি একটি রাজনীতিগত প্রশ্ন এবং সেই অগ্রগতির যথেষ্ট সম্ভাবনা আজকের পরিস্থিতিতে নিহিত রয়েছে। তাছাড়া, লোহিয়া এবং জয়প্রকাশের সমাজবাদী আদর্শবাদের অবসানের পর আজ এই সমস্ত এলাকাগুলিতে এক মতাদর্শগত শূন্যতা বিরাজ করছে। মুলায়ম সিং ও লালু যাদবকে সামনে রেখে বিজেপির উত্থানকে আপাতত কোনোরকম ঠেকাতে পারলেও, মতাদর্শের দিক থেকে বিজেপির কোনো পাল্টা জবাব এদের কাছে নেই। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু একটা মতাদর্শগত বিকল্প খুঁজছেন, খুজছেন সৎ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক শক্তিকে। এইভাবে নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব বা শক্তিবিন্যাসের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই পেকে উঠছে আর বামপন্থীদের এতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী রণনীতিগত পরিপ্রেক্ষিত এবং বামপন্থীদের প্রতিটি অগ্রগতির ওপর আমরা যে লাগাতার জোর দিয়ে চলেছি তাকে আমাদের ‘মার্কসবাদী’ সমালোচকেরা প্রায়ই বিচ্ছিন্নতাকামী কর্মনীতি ও কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন আর তাঁদের মতে এর অর্থ হল বুর্জোয়া শিবিরের ভেতরকার বিভাজন ও দ্বন্দ্বগুলিকে কাজে লাগানোর কৌশলের ওপর আমরা যথেষ্ট জোর দিচ্ছি না। আমাদের রণনীতিগত লক্ষ্যের স্বার্থে তথাকথিত কোনো ব্যাপক মোর্চায় নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দেওয়ার পরিবর্তে কখনও কখনও আমরা বিচ্ছিন্নতাকেও বরণ করে নিই ঠিকই, কিন্তু বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে কৌশলগত এমনকি সাময়িক বোঝাপড়া বা জোট বাঁধাটিকে আমরা কখনোই খাটো করে দেখি না। নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে এই দিশায় আমরা ক্রমেই ধাপে ধাপে আমাদের নীতির আরও বিকাশ ঘটিয়ে চলেছি। বুর্জোয়া বিরোধী শিবিরের বিভিন্ন নেতৃত্বকারী শক্তির সঙ্গে আমাদের যৌথ কার্যকলাপের পরিধিও নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিককালে অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

আমার সাম্প্রতিক একটি বক্তৃতায় বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসীদের উল্লেখ শুনে এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ব্যাপক কোনো মোর্চায় ভবিষ্যতে তাদের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেখে আমাদের কমরেডদের অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, কংগ্রেসের ভেতরে বিক্ষোভ যখন বেড়ে চলেছে এবং বিজেপি সংক্রান্ত কৌশলের প্রশ্নটিকে ঘিরেই যখন সে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে তখন রাষ্ট্রীয় একতা অভিযানের মতো কোনো ব্যাপক সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মঞ্চের পক্ষে কংগ্রেসের এই বিক্ষুব্ধ অংশকে সঙ্গে নেওয়ার প্রশ্নটিকে সরিয়ে রাখা বোধহয় সম্ভব নয়। আমার মনে হয় না এতে এধরনের জোটের কংগ্রেস-বিরোধী চরিত্র কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ হবে, বরং তা আরও মজবুতই হয়ে উঠবে।

সংক্ষেপে সাম্প্রদায়িকতার বিপদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক মোর্চা গড়ে তোলার প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য নেই। তবে এই ধরনের কোনো মঞ্চের স্বাভাবিক বিজেপি-বিরোধী চরিত্রকে অজুহাত বানিয়ে তার সুযোগ নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মোর্চা বানানোর তাদের প্রচেষ্টার আমরা বিরোধী। এই জাতীয় কোনো মঞ্চকে রাজনীতির মারপ্যাঁচের আখড়া বানিয়ে দেওয়ার বিপরীতে আমরা চাই গণসমাবেশের ওপর বেশি বেশি করে জোর দেওয়া হোক। আর মঞ্চের ভেতরে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের হাতে উদ্যোগ ছেড়ে দেওয়া এবং বুর্জোয়া নায়কদের ঢাক পেটানোর যাবতীয় প্রচেষ্টার আমরা বিরোধিতা করি। দিশার প্রশ্নে আমরা মনে করি, কেবলমাত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারে আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম একই সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকীকরণের সংগ্রামও বটে। ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চা বানানোটা তাই আমাদের কাছে দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিত-বিস্মৃত কোনো প্রয়োজনবাদী কৌশল নয়। বরং তা হল ভারতবর্ষে একটি গণতান্ত্রিক মোর্চা নির্মাণের রণনীতিগত দায়িত্বেরই এক অভিন্ন অঙ্গ।

জনস্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন

বিহারে জমির প্রশ্নে বামপন্থী পার্টিগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই হোক অথবা নয়া আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই হোক, আমরা বরাবরই জনস্বার্থে বিভিন্ন প্রশ্নে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার ওপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে এসেছি। সচেষ্ট থেকেছি যৌথ আন্দোলনের পরিধিকে সম্প্রসারিত করে ছাত্র, যুব, মহিলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিকেও এই প্রক্রিয়ায় সামিল করে নিতে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলির সমন্বয় কমিটিকে প্রসারিত করে নয়া আর্থিক নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণসংগঠনগুলির একটি যুক্তমঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে আমরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছি। এই মঞ্চটি মূলত বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণসংগঠনগুলিকে নিয়েই গড়ে উঠেছে। এর মূল লক্ষ্য হল সরকারের আর্থিক ও শিল্প নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করা যা স্বাভাবিকভাবেই ভারত বন্ধ-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। এই সমস্ত কারণে আমরা মনে করি যে আগামীদিনে বামপন্থী দলগুলির এক রাজনৈতিক মহাজোট গড়ে ওঠার বাস্তব ভিত্তি হিসাবেও আজ এধরনের যুক্ত গণমঞ্চের যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

তবে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা আর নয়া আর্থিক নীতির প্রশ্নকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে এই মঞ্চের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যবস্তুগুলিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে আমরা তার বিরোধিতা করি। প্রধান বামপন্থী দলগুলি যেভাবে চিরকাল কংগ্রেস(ই) সরকারকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এসেছে, কঠিন মুহূর্তে কংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে এবং বিজেপি-বিপদকে ঠেকানোর নাম করে সরকার-বিরোধী গণআন্দোলনের লাগাম টেনে ধরেছে তাতে মঞ্চের মূল লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টায় শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

তাছাড়া এই ধরনের কোনো মঞ্চকে অবশ্যই রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান নিপীড়নকারী চরিত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার নাম করে রাষ্ট্র ক্রমেই যে দানবীয় ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে তা সবই শেষ অবধি গণসংগ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। সুসঙ্গত গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে নাগরিক অধিকার, মানব অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হননের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা বামপন্থীদের অবশ্য কর্তব্য। মহিলাদের ওপর নিপীড়নের প্রশ্নে, বিশেষত পুলিশ হাজতে নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে বা শ্রেণী ও সম্প্রদায়গত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধেও এই গণমঞ্চকে অবশ্যই দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। আমরা আরও মনে করি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে গণমুখী উন্নয়নের দাবিতে তৃণমূলে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতিবাচক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক নির্দেশিত আর্থিক নীতি তথা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও এই সংগঠনগুলি ক্রমেই সরব হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত শক্তিকেও প্রস্তাবিত এই গণমঞ্চের আওতায় আনতে হবে। বিগত কয়েক দশকের উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন যে বিতর্কিত প্রশ্নগুলি সামনে উঠে এসেছে সেই প্রশ্নগুলিকে বামপন্থার নিজস্ব এজেন্ডাতেও উপযুক্ত গুরুত্বসহকারে স্থান করে দিতে হবে। আর এই লক্ষ্যে, বামপন্থী শক্তিকে এই সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সঙ্গে বেশি বেশি করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, অবশ্যই নিজস্ব মতাদর্শ ও সাংগঠনিক শক্তির ওপরে সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই। এই সমস্ত এবং অন্যান্য প্রশ্নে মঞ্চের ভেতরে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুক্ত রাজনৈতিক জোট এবং নয়া আর্থিক নীতি বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণমঞ্চের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বামপন্থী শক্তির বিকাশমান ঐক্যের একটা ছবি আমরা দেখতে চাইছি, অন্যদিকে যৌথ আন্দোলনের সমগ্র আঙ্গিনা জুড়ে শুরু হয়ে গেছে বামপন্থার দুই কৌশলের মধ্যে লড়াই।

ঐক্য থেকে শুরু করে সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যেতে চাই উচ্চতর পর্যায়ের ঐক্যে। ভারতবর্ষের বামপন্থী আন্দোলনের ভবিষ্যত আজ এই ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্যের ওপরেই নির্ভর করছে।

(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে)

উচ্ছ্বাসের অবসান হয়েছে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উচ্ছ্বাস সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী। ভারতীয় রাজনীতি বিশেষ করে ‘বিরোধী পক্ষের’ রাজনীতিতে যার তেমন কোনো শিকড় ছিল না, সেই ভি পি সিং-এর মতো ব্যক্তির পক্ষে ১১ মাস ক্ষমতায় টিকে থাকা মোটেই কম সাফল্য নয়। পরিহাস এখানেই, যে ব্যক্তি পদত্যাগ-এর রাজনীতিতে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন, শেষপর্যন্ত তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি সংসদের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে অপসৃত হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন।

ভি পি সিং চলে গেছেন। তিনি কী শীঘ্রই ফিরে আসবেন নাকি প্রান্তীয় রাজনীতির একজন প্রবক্তায় পর্যবসিত হবেন, সে সম্পর্কে এখনই কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা ঠিক হবে না। বরং এখন আমরা পুরোনো প্রবাদ ‘অপেক্ষা করেই দেখুন’-এ নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি।

ভি পি সিং বারংবার দাবি করে চলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শ রক্ষা করতেই তাঁর সরকারকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাঁর যুক্তির ধারা হল, বিজেপির দাবিগুলি মেনে নিলে তিনি সরকারকে রক্ষা করতে পারতেন। ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্চ আদর্শ রক্ষার কারণেই তিনি শহীদ হয়েছেন বলে নিজেকে জাহির করছেন, এবং তিনি বলছেন আস্থা ভোট ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার যুদ্ধরেখা। তিনি এমনকি সাংসদদের কাছে বিবেক অনুযায়ী ভোট দেওয়ার জন্যও আবেদন করেছিলেন।

যদিও ভোটের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধরেখা, বরং বলা ভালো, যুদ্ধরেখাগুলি বিভিন্ন তলে টানা হয়েছিল ও তাঁর নিজের দলের প্রায় অর্ধেক সাংসদই পার্টি হুইপকে অগ্রাহ্য করেছিল। ভি পি সিং-কে যদি বিশ্বাসই করতে হয় তবে বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদই সাম্প্রদায়িকতার পক্ষাবলম্বন করেছিল। তাহলে, জনতা দলের বিভাজন বিশেষ করে মুলায়ম সিং যাদব ও চিমনভাই প্যাটেলও যখন বিজেপির বহ্নির মুখে তখন তাদের চন্দ্রশেখর শিবিরে যোগদানকেই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরও ধর্মনিরপেক্ষতা-সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে একই সুরে কথা বলছেন। বাস্তবিকই ভি পি সিং যদি বিজেপির দাবিগুলি মেনে নিতেন তাহলেও তার সরকার পড়ে যেত, অবশ্য আরও কালিমালিপ্ত হয়ে। কারণ, সেক্ষেত্রে বামপন্থীরা তাদের সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হত, আর চন্দ্রশেখর-দেবীলাল গোষ্ঠীও বিদ্রোহ করতই এবং তা করত আরও নৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে। ঐ সন্ধিক্ষণে সরকারকে রক্ষা করার জন্য তাঁর কাছে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। বস্তুত তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় আসার সবরকম চেষ্টাই করেছেন, বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স জারি করা ছিল এর প্রমাণ। ভি পি সিং কেবল রাজনীতিকের সত্যকেই বলছেন, যা তাঁর পক্ষে গ্রহণযোগ্য। যদিও তাঁর পতনের পিছনের প্রকৃত কারণগুলি ছিল ভিন্ন – সম্পূর্ণ ভিন্ন – গভীরে প্রোথিত সামাজিক বিভাজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাবেকী সংঘাত ও তাঁর নিজের দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কোন্দলের মধ্যেই কারণগুলি নিহিত আছে। সামাজিক শক্তিগুলি ও সংসদের অভ্যন্তরে তার প্রতিফলন হিসাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য তাঁর বিপক্ষে চলে গিয়েছিল ও তাঁর পতন ঘটিয়েছিল।

সমগ্র ঘটনাটিকে বুর্জোয়া রাজনীতিকদের ক্ষমতার লালসা, নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন ও অর্থ-শক্তির ভূমিকাকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেখার মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এগুলি সবই সাদামাটা মানুষের রাজনীতি সম্পর্কে বোঝাপড়া মাত্র এবং উদারপন্থী নৈতিকতাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি, যা এটি বুঝতে অক্ষম যে রাজনৈতিক দলগুলি কিছু পেশাদার ব্যক্তির কৃত্রিম সৃষ্টি নয়, বরং আধুনিক সমাজের অপরিবর্তনীয় ও স্বাভাবিক সৃষ্টি, যার (অর্থাৎ বিভিন্ন দলগুলির) মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তর তাদের স্বার্থগুলি গ্রন্থিবদ্ধ করে ও ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ব্যক্তি রাজনীতিকদের লালসা, পার্থিব লাভ, অর্থ-শক্তি ইত্যাদি সবই সামাজিক শক্তিগুলির বিন্যাস-পুনর্বিন্যাসের সীমানার মধ্যেই কেবল কার্যকরী হয়ে থাকে। এখন আমরা ভারতীয় রাজনীতিতে ভি পি পরিঘটনাটির বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু করব।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে একটি বুর্জোয়া কাঠামো গড়ে তোলার আন্তরিক প্রয়াসের জন্য ভি পি সিং-কে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বিরোধী রাজনীতিতে সরে আসার পর তিনি নির্দয়ভাবে তাঁর কংগ্রেসী অতীতকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে লোহিয়া ও জয়প্রকাশ ঘরানার অ-কংগ্রেসী উত্তরসুরী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন ও এর মধ্য দিয়ে বিরোধীপক্ষের স্বাভাবিক নেতা রূপে নিজেকে তুলে ধরেন। জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় গান্ধীর এক নতুন সংগ্রহ হিসাবে তিনি যাত্রা শুরু করেন, তারপর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরূপে উত্থানের সময় ‘সংঘর্ষ অভিযান’ পর্বে মূলত পশ্চাদপদ জাতির শত শত যুবককে হত্যা (ঘটনাচক্রে মুলায়ম সিং-এর সঙ্গে ভি পি সিং-এর বৈরিতা ঐ সময় থেকেই চলে আসছে), তারপর রাজীব গান্ধীর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী রূপে রাজীবের অর্থনৈতিক উদারনীতিকরণের পদক্ষেপকে অতি উৎসাহে ওকালতি করা এবং শেষপর্যন্ত ভোল পাল্টে বিরোধীপক্ষের মধ্যমণিতে তাঁর রূপান্তর ইত্যাদি এ দেশের রাজনীতিতে নিজে থেকেই এক ক্যারিশমা বহন করে। বামপন্থীদের তিনি তাঁর স্বাভাবিক মিত্র হিসাবে দাঁড় করান ও কংগ্রেসী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধশক্তি হিসাবে ১৯৮০-র দশকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন অ-পার্টি রাজনৈতিক সংগঠন ও তৃণমূলের আন্দোলনের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং এদের সবাইকে মূল রাজনৈতিক স্রোতে নিয়ে আসেন। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কংগ্রেস বিরোধী সমস্ত উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে তিনি সাফল্যের সঙ্গে জাতীয় মোর্চা গঠন করেন। ভি পি সিং এমন একটি রাজনৈতিক সমন্বয়ের উপর জোর দেন যা শুধু সংসদের মধ্যেই কংগ্রেসকে সংখ্যাগতভাবে অপসারিত করবে না, বরং বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসেরও সংকেত জানাবে। কিন্তু বিজাতীয় সৈন্যদলের একজন কমাণ্ডার হওয়ার কারণে জনতা দলের মধ্যে তাঁর অবস্থান সবসময়ই ভঙ্গুর ছিল। সর্বাধিনায়কের পরিবর্তে নিজ নিজ গোষ্ঠীপতিদের প্রতি প্রথম আনুগত্যপূর্ণ বিভিন্ন সাবেকী গোষ্ঠীর এক ঢিলেঢালা সমন্বয় ছিল জনতা দল। তিনি অবশ্য আশা করেছিলেন একটি গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে নিজ দলের গোষ্ঠী বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, নিজ দলের ভিতর থেকে আসা কোনো চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে জাতীয় মোর্চায় তাঁর বশংবদদের কাজে লাগানোর তিনি আশা রেখেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনায় বিজেপির কোনো স্থান ছিল না ও সচেতনভাবেই তিনি নির্বাচনী অভিযানের সময় বিজেপি থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন।

গুজরাট থেকে বিহার অবধি আ জ গ র সূত্রটি ভালোই কাজ দিয়েছিল। পশ্চাদপদ জাতিগুলির কুলাক লবির একটা ভালো সংখ্যক অংশ ও তাঁর নিজস্ব রাজপুত জাতির পুরোনো ও নতুন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত অংশ জনতা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। ভাগলপুর দাঙ্গা ও বিতর্কিত শিলান্যাস সিদ্ধান্তের পর কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে মুসলিমরা জনতা দলের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। উড়িষ্যায় জনতা দলের মতো সংগঠনই বরাবর কংগ্রেসের স্বাভাবিক বিরোধীশক্তি। সেখানে কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া থেকে জনতা দলই সর্বাপেক্ষা লাভবান হয়েছিল। পশ্চিমবাংলায় ১৯৮৪-র নির্বাচনে বামপন্থীরা কংগ্রেসের কাছে যে জমি হারিয়েছিল, তা পুনরুদ্ধার করে এবং এখানে ওখানে হার-জিতের মধ্য দিয়ে সংসদে একটা ভালো প্রতিনিধিত্বও অর্জন করে।

যদিও ভি পি সিং দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের ঢেউ ছিল উত্তর ভারতের ঠিক বিপরীত ও আরও প্রবল মাত্রার।

দক্ষিণ ভারতের ভোটের আচরণ কারো কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না ও আজও তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধাঁধাতেই রেখেছে। এর সাথে যুক্ত হয়ে মহারাষ্ট্রের সন্তোষজনক ফলাফল কংগ্রেসকে সংসদের একক বৃহত্তম দলে পরিণত করে।

অপর অপ্রত্যাশিত বিকাশ হল উল্কার মতো বিজেপির উত্থান। নিজের শক্তির উপর দাঁড়িয়ে বিজেপি সবসময়েই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে একটি শক্তিশালী দল এবং মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপি কংগ্রেসের অন্যতম সাবেকী প্রতিদ্বন্দ্বী। এই রাজ্যগুলিতে প্রতিটি কংগ্রেস বিরোধী ঢেউ-এর অর্থ বিজেপির উত্থান। যদিও ১৯৮৯-এর নির্বাচনে বস্তুত সাংগঠনিক জাল-এর সুবাদে ও রাম তাসকে ব্যবহার করে বিজেপি নেতৃত্ব আশাতিরিক্ত সফলতাই লাভ করেছিল। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথাগত প্রভাবের বাইরে বিভিন্ন স্থানেও বিজেপি সাংগঠনিক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে ও কৃষক, পশ্চাদপদ জাতি, দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যেও বিজেপির শাখা-প্রশাখার বিস্তার হয়েছে। বাম দলগুলি, একমাত্র যারা অবিচল বিজেপি বিরোধী শক্তি তাদের ‘বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন কর’ স্লোগান এই অগ্রগতির মুখে ধরাশায়ী হয়েছে। বিজেপির এই সাফল্য মোটামুটি তার স্বাধীন শক্তি প্রদর্শন এবং রাম তাস তাকে ভালো লভ্যাংশ এনে দিয়েছে।

এইভাবে প্রথমত একক বৃহত্তম দল হিসাবে কংগ্রেসের উত্থান ও যে কোনো পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার ঐ তুরুপের তাসটিকে নিজের দখলে রাখতে পারা এবং দ্বিতীয়ত বিজেপির আশ্চর্যজনক অগ্রগতি যা তাকে তুরুপের তাস ব্যবহার করার আকাঙ্খা জাগিয়েছে, ইত্যাদি প্রতিকূল শর্তগুলি গোড়া থেকে ভি পি সিং-কে প্রতিবন্ধী করে তোলে। এর উপর, সংসদের অভ্যন্তরে জাতীয় মোর্চার আঞ্চলিক সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে জনতা দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে হ্রাস করার তাঁর ক্ষমতা একদম কমে যায়।

এখানে, বিজেপি ও বাম দলগুলির বস্তুগত অবস্থান ও বিষয়ীগত আকাঙ্খার মধ্যেকার এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কথা আমাদের স্মরণ করতে হবে। পশ্চিমবাংলা ও কেরলের মতো বামদলগুলির সাবেকী দুর্গে জনতা দল প্রায় অস্তিত্বহীন, আর জনতা দলের দুর্গগুলিতে বামদেরও কোনো শক্তিশালী উপস্থিতি নেই। জাতীয় রাজনীতিতে বাম দলগুলি বাস্তবিকভাবেই জনতা দলের পোঁ-ধরায় পরিণত হয়েছে। হিন্দিবলয় সহ অন্ধ্র, উড়িষ্যা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যগুলিতে সম্প্রসারণ ঘটানোর যে স্বপ্নই তারা দেখুন না কেন, এটা তাদের করতে হয়েছে জনতা দল ও জাতীয় মোর্চার সহযোগীতার লেজুড়বৃত্তির পথ অনুসরণ করেই, আর এ জন্যই বাম দলগুলি জনতা দলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে।

বিজেপির ক্ষেত্রে অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজেপির কাজের ক্ষেত্রগুলি জনতা দলের কাজের ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে মিশে আছে এবং এর অস্তিত্ব রক্ষা ও বিস্তার একমাত্র জনতা দলের মূল্যেই হতে পারে। এই দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাই অন্তর্নিহিত বস্তুগত ঘটনা। এর উপর আক্রমণাত্মক হিন্দুরাষ্ট্র দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এবং তাত্ত্বিক ও প্রচারকদের এক ব্যাপক বিস্তৃত সাংগঠনিক জাল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এক সুসংগঠিত ক্যাডার বাহিনীর মদতপুষ্ট হয়ে বিজেপি ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চ দখলের আশা রাখে। ইরান ও পাকিস্তানে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নে গুরুতর ধাক্কা ও সেখানে চার্চের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন – এসবই বিজেপি-কে সহায়ক মতাদর্শগত পরিমণ্ডল সরবরাহ করেছে। ভারতের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়ায় বিজেপির উচ্চাকাঙ্খা আরও সাহসী হয়ে উঠেছে।

অনিশ্চিত চরিত্রের নবম লোকসভা ভারতীয় সমাজের প্রধান প্রধান দ্বন্দ্ব ও উঠে আসা প্রবণতাগুলির এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। দক্ষিণ বনাম উত্তর ভারতের দ্বন্দ্ব যদি কংগ্রেসের পক্ষে ও বিপক্ষে ঢেউ হিসাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে, তবে হিন্দু মৌলবাদের উত্থান বিজেপির উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে। আর সাবেকী বামপন্থীরা স্পষ্টতই জনতা দলের পোঁ-ধরার ভূমিকা নিয়েছে। অকালি দল (মান গোষ্ঠী) পাঞ্জাবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে, বহুজন সমাজ পার্টি ও এমনকি আইপিএফ তাদের স্বাধীন ক্ষমতায় সংসদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করেছে।

ভি পি সিং-এর বাছবিচার করার কোনো সুযোগ ছিল না। বিজেপির সমর্থন ছাড়া সরকার গঠনের অন্য কোনো পথ তাঁর কাছে খোলা ছিল না। জনগণের চাপের নামে রাতারাতি সূত্রায়নগুলি পাল্টে গেল।

এটি তিনি উপলব্ধি করলেন মূল্যবোধ-নির্ভর রাজনীতি বলে কিছু নেই, বরং ব্যবহারিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার উপরই মূল্যবোধ নির্ভর করে থাকে। আর রাজনীতি দ্বন্দ্বগুলির সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যে বাম দলগুলির কাছে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে, নাম্বুদিরিপাদের ভাষায় কলেরা ও প্লেগের মধ্যে, পার্থক্য টানার কিছুই ছিল না, তারা অদ্ভুত ডিগবাজি খেয়ে বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন কর শ্লোগানের পরিবর্তে বিজেপির সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার স্লোগান দিল। বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, শিবসেনা প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক সংগঠন এই বলে তাদের মধ্যে পার্থক্য টানার চেষ্টা হল। রাজেশ্বর রাও এমনকি বিজেপির কর্মসূচিতে সদর্থক সামাজিক-অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু আবিষ্কার করলেন। এই আঁতাতকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলার জন্য জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্লোগান হাতে কাছে পাওয়া গেল এবং আদবানী বাস্তবিকই বললেন, জাতীয় ঐক্য, পাকিস্তান ও পাঞ্জাব প্রশ্নে জনতা দলের থেকেও বিজেপির চিন্তাভাবনা বাম দলগুলির চিন্তাভাবনার সঙ্গে অনেক বেশি মিল খুঁজে পায়। পরোক্ষে, বাম নেতারা বিজেপি-কে এই সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ করা ও তার মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা থেকে একে নিবৃত্ত করা ও একইসঙ্গে বিজেপি-কে সরকারের বাইরে রাখতে পারার তাদের রাজনৈতিক সাফল্য সম্পর্কে দাবি করতে থাকেন। ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে বস্তুত এ সবই জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতারণা। বিজেপি সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মোহ সৃষ্টি করে জনগণকে সতর্কতাহীন করে তোলা হয়েছে।

যে তাস বিজেপি-কে প্রভূত লভ্যাংশ এনে দিয়েছে সেই রামকে বিজেপি পরিত্যাগ করবে এটি আশা করা ও বামেদের ঢঙেই জনতা দল সরকারকে বিজেপি সেবা করবে এটি বিশ্বাস করা নিতান্ত ছেলেমানুষী। প্রথম দিন থেকেই জনতা দল সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন করতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বিজেপি তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট তুলে ধরেছিল এবং আদবানী ঘোষণা করেছিলেন যে তারা এই সরকারের ব্রেক ও এ্যাক্সিলেটার হিসাবে কাজ করবেন। ঘটনাগুলি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এগিয়েছে মাত্র। বামরা যদি কোনো ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে অন্য কেউ নয় তাদের নিজেদেরই প্রদর্শিত রাজনৈতিক সারল্য, রাজনৈতিক প্রয়োজনবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে লঘু করে দেওয়ার অপরাধের জন্য নিজেদের দোষারোপ করতে হবে। আমি এখনও মনে করি বামদের পক্ষে সবথেকে ভালো কৌশল হতো জনতা দল ও বিজেপি-কে সরকার গঠনে অনুমতি দেওয়া ও নিজেদের হাতে ‘ব্রেক ও এ্যাক্সিলেটার’-এর ভূমিকাটি রেখে দেওয়া। এটি বামপন্থীদের স্বাধীন চরিত্রকেই আরও উজ্জ্বল করত।

ভি পি সিং তাঁর দ্বিতীয় দফার রাজনৈতিক জীবন রাজনীতি-নির্ভর মূল্যবোধ ও দ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার দক্ষতা নিয়ে শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব অর্জনও ছিল দেবীলালকে চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চতুর কূটকৌশলের ফসল। প্রতিটি সমর্থন তার নিজের মূল্য আদায় করে ছাড়ে ও এক সন্ধিক্ষণে সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অদম্য দেবীলাল ও চৌতালাকে বশে রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। একের পর এক সংকট জনতা দলের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয় ও শেষ পর্যন্ত তাকে দেবীলালের সঙ্গ ছাড়তে হল।

ব্যাপক জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সমস্ত গুরুত্বহীন নির্বাচনী ইস্তাহারের ঘোষণাগুলিকে কার্যকরী করতে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। বোফর্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাঁর সরকার নতুন কোনো প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়, পরিবর্তে তাঁর শাসন বোফর্স মামলায় সন্দেহের কাঁটাকে রাজীব গান্ধীর থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছে মাত্র।

পাঞ্জাব প্রশ্নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে তাঁর সরকারের ব্যর্থতা ও অকালি দল (মান গোষ্ঠী)-এর সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক ভেস্তে যাওয়ায় পাঞ্জাব পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিজেপির নির্ধারক উপস্থিতি ও ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য এর অনমনীয় দাবির প্রতিক্রিয়ায় কাশ্মীরে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। ভি পি সিং সমস্যাটিকে বিজেপি প্রদর্শিত পথে জগমোহনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছিলেন ও এইভাবে কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের সমস্ত বাহ্যিক কথাবার্তাও শেষ হয়ে যায়।

অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে ও মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়। রাজীব আমলের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি আরও জটিল হয় ও উপসাগরীয় সংকট যুক্ত হয়ে ভারতীয় অর্থনীতি চূড়ান্ত পতনের মুখে এসে দাঁড়ায়। সেই ভয়াবহ সম্ভাবনা আজ দেখা দিয়েছে যখন ভারত ঋণ পরিশোধে অক্ষমদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে।

ভি পি সিং-এর সর্বদলীয় ঐকমত্যের কাজের ধরন অচিরেই প্রহসনে পরিণত হয়। একদিকে, চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে কাজ করার বাধ্যতা ও পর্দার পিছনে অপেক্ষমান কংগ্রেসের দ্বারা ঘেরাও ও অন্যদিকে, নির্ধারক ভূমিকা পালনের জন্য বিজেপির মরীয়া প্রচেষ্টা ও দলের ভিতর থেকে চন্দ্রশেখর-দেবীলাল শিবিরের ভীতিপ্রদর্শন এসব থেকে ভি পি সিং-কে হঠাৎ মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করার ঘোষণার দিকে পরিচালিত করে। স্পষ্টতই এটি নিজের জন্য এক রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করে নেওয়া ও জনতা দলের মধ্যে নিজ অবস্থানকে সুরক্ষিত করে সমস্ত প্রতিপক্ষকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। সমস্ত ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে তিনি হিসাবে গুরুতব ভুল করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করাই তাঁর পতনের সংকেত ছিল। নিজের রাজপুত জাতির মধ্যে তাঁর সামাজিক ভিত হ্রাস পেল ও হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের শক্তিশালী জাঠগোষ্ঠী সহ অন্যান্য কিছু উঁচুজাতের মানুষ যারা এতদিন হিন্দি বলয়ে জনতা দলের সামাজিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল তারা আনুগত্য পাল্টে ফেললো এবং চন্দ্রশেখর-দেবীলাল গোষ্ঠী প্রাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলো।

যে ব্যক্তিকে ছাত্র-যুবকরা, বিশেষত দিল্লীর আশপাশ অঞ্চলের, তাঁদের প্রবক্তা হিসাবে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিল ও কাজের অধিকারকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার যার ঘোষণা থেকে আশা করেছিল চাকরির সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি পারে, সেই ব্যক্তির দ্বারা তারা বিশ্রীভাবে প্রতারিত হয়েছে বলে অনুভব করল। ঐ ব্যক্তির মধ্যে তারা এক ফন্দিবাজ রাজনীতিককে দেখতে পেল, যিনি তাদের চাকরির সামান্য সুযোগটুকু পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাদের চূড়ান্ত হতাশার প্রতিফলন ঘটলো বহুসংখ্যক মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীর ‘আত্মাহুতি’র মধ্য দিয়ে, যে রূপটি তাদের দিক থেকে অস্বাভাবিক। মণ্ডল রিপোর্ট কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে বড় বড় ধরনের কিছু পশ্চাদপদ জাতির মধ্যে নিজস্ব অবস্থানকে সংহত করলেও এটি কোনোভাবেই তাঁর পক্ষে নতুন কোনো সংযোজন ঘটাতে পারেনি। অপরদিকে, তিনি সামাজিক সমর্থনের একটি ভালো অংশ হারান। ছাত্র-যুবকদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আত্মাহুতির ঘটনাগুলি সরকারি ক্ষমতায় তাঁর টিকে থাকার প্রশ্নে এক নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করল।

শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমগুলি তাঁর বিপক্ষে দাঁড়াল এবং কংগ্রেস, বিজেপি ও এর সাথে চন্দ্রশেখর-দেবীলাল শিবির ভি পি-র দুরাবস্থাকে সুকৌশলে কাজে লাগাল।

ভি পি সিং-এর যুক্তির ধারা হল সবুজ বিপ্লব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কিছু পশ্চাদপদ জাতি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং তাই আমলাতন্ত্রের উপরের স্তরে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পাওয়ারও তারা অধিকারী। ঐতিহাসিকভাবে, যেহেতু এরা সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রশ্নে পশ্চাদপদ ছিল, তাই দীর্ঘসময় এরা যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। এদের প্রতিনিধিত্ব একমাত্র চাকরি সংরক্ষণের মাধ্যমেই সুনিশ্চিত করা যায়।

তাঁর আরও যুক্তি হল, এটা শুধু সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক সমতারও প্রশ্ন। “পরিবারের মধ্যে বড় ভাই যেভাবে অধিক ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ভোগ করে, ছোটো ভাইকেও তেমনি কিছু অধিকার দিতে হবে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাকে সামিল করতে হবে।”

বুর্জোয়া রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ হওয়ায় তার চিন্তার মূল বিষয় ছিল পশ্চাদপদ জাতিগুলির যে অংশ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে তাদের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে যুক্ত করে নেওয়া, অর্থাৎ কুলাক লবির প্রতিনিধিত্বের স্বার্থ। সাধারণ জনগণ তথা বিপ্লবের নামে নিজেদের সঙ্কীর্ণ শ্রেণীস্বার্থ পূরণ করাটাই সর্বদা বুর্জোয়া রাজনীতির কৌশল। অবশ্য আত্তীকরণের এই প্রক্রিয়া একটি বস্তুগত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং ভি পি সিং থাকুন কী নাই থাকুন এই প্রক্রিয়া চলবেই – কখনও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে, অন্য সময় এদিক ওদিক সমঝোতার মাধ্যমে। জাতিগুলির মধ্যে শ্রেণী গঠন প্রক্রিয়া, শ্রেণী মেরুকরণ ও শ্রেণী সংগ্রামের এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই পদক্ষেপকে সমর্থন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভি পি সিং-এর মুখের কথায় বিশ্বাস করে কেউ যদি মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকরী করাকে কোনো ধরনের বিপ্লব বলে মনে করে ও তার পিছনে সমাবেশিত হয়, তবে তা হবে রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও কমিউনিস্টদের শ্রেণী অবস্থানকে অস্বীকার করার সমতুল।

পার্টি পরিচিতি অস্বীকার করে সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটবে বলে যে আশা ভি পি সিং করেছিলেন তা লোহিয়াপন্থী রাজনীতিকদের ভুল ও সঙ্কীর্ণ বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন। অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে ভি পি সিং বিবেক ভোটের দাবি করে আশা করেছিলেন এই ধারাতেই কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ভাঙন ধরবে। উচ্চবর্ণের-নিম্নবর্ণের জাতিদ্বন্দ্ব নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় সমাজের একটি অন্যতম সামাজিক দ্বন্দ্ব, বিশেষত বিহারের মতো কিছু রাজ্যে এটি মূল স্রোতের রাজনীতিকে নির্ধারণ করে। কিন্তু এটি মোটেই সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব নয়। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে দ্রাবিড় আন্দোলনও উচ্চবর্ণের জাতিগুলির বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের জাতিগুলির উত্থান বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু সেখানেও তামিল জাতিসত্তার পরিচিতি, দক্ষিণ ভারতীয় পরিচিতি আরও বড় ভূমিকা পালন করে। দ্রাবিড় আন্দোলনও ডিএমকে-এআইডিএমকে – এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং সম্প্রতি বানিয়াদের মতো অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতিগুলির উত্থান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

এরপর আবার, পশ্চাদপদ জাতিগুলি সমচরিত্রের একক সত্তা হিসাবে কাজ করে না, তারা নিজেরাই পরস্পরের শত্রুতায় অবতীর্ণ হয়, এমনকি বিহারের মধ্যেই। এর ফলে প্রায়শই দেখা যায় কোনো কোনো উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের আঁতাত ঐ ধরনের অন্য কোনো আঁতাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। পশ্চিমবাংলার মতো কিছু রাজ্যে শক্তিশালী পশ্চাদপদ জাতির কোনো স্পষ্ট বর্গ দেখা যায় না এবং সেখানে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের এই ধরনের সংঘাতও নেই।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদব হচ্ছেন পশ্চাদপদ জাতিগুলির পশ্চাদপদ অংশের প্রতিনিধি ও সম্ভবত জাঠ কুলাক লবির বিরুদ্ধে গরিব ও মধ্য কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন, এবং মণ্ডল কমিশন হোক আর রামজন্মভূমিই হোক সবদিক থেকেই তাঁকে ভি পি সিং-এর দৃঢ় মিত্র হিসাবে মনে করা হয়েছিল। যদিও তাদের মধ্যেকার সাবেকী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই আজ মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে এবং ভি পি সিং-এর প্রচেষ্টাগুলিও ছিল মুলায়ম সিং-এর মূল্যে নিজের জন্য উত্তরপ্রদেশে এক পাকাপোক্ত এলাকা গড়ে তোলা। মুলায়ম-অজিত সিং বিবাদ অতি পরিচিত এক ব্যাপার এবং উত্তরপ্রদেশে বাস্তবিকই জনতা দল এই ধারাতেই বিভক্ত হয়েছে। মুলায়ম সিং-এর এই অভিযোগের মধ্যে কিছু সত্য আছে যে ভি পি সিং বিভিন্ন ফন্দি এঁটে তাঁকে উৎখাত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মুলায়ম সিং-চন্দ্রশেখর-কাঁসিরাম আঁতাত উত্তরপ্রদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই ভি পি-অজিত সিং আঁতাতের বিরুদ্ধে একটা আকার ধারণ করছিল। একনিষ্ঠ কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই ১২ অক্টোবর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সমাবেশে একই মঞ্চে এই তিনের একত্র উপস্থিতিকে অস্বীকার করতে পারেন না। সমাবেশটি একই সঙ্গে ছিল জনতা দলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী সংঘাতের সঙ্কেত। আশ্চর্যজনকভাবে, জ্যোতি বসু-ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো ভদ্র মহোদয়গণ যারা ঐ মঞ্চকে অলঙ্কৃত করে মুলায়মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এই ঢক্কানিনাদের পেছনে প্রকৃত রাজনীতিকে লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আধুনিক রাজনৈতিক পার্টিগুলি শুধু উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের পার্টি নয় বা তা হতে পারে না। বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণীর সমন্বয়ই এই পার্টিগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে এবং এদের সম্মিলিত যোগফলই নির্দিষ্ট জাতি ও শ্রেণীগুলির প্রতি বিশেষ সন্ধিক্ষণে প্রকাশ্যভাবে দলগুলির পক্ষপাতিত্বকে প্রতিফলিত করে এবং এটিই মৌলিক দিক। এরপর আবার তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হিন্দু ও উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোই নিশ্চিতভাবে কংগ্রেসের মৌলিক দিক কিন্তু অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় এটি প্রকাশ পায়।

মণ্ডল কমিশন উত্তর ভারতে বিজেপি-কে কিছু পরিমাণে শঙ্কিত করে তোলে, কেননা এটি বিজেপির হিন্দু ঐক্যের অভিযানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। বিজেপির দিক থেকে রথ যাত্রার পরিকল্পিত উদ্যোগ ও একে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই ছিল প্রত্যাঘাত। আদবানী ঘোষণা করেছিলেন তার গ্রেপ্তার ক্ষতিই ডেকে আনবে। সেই ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেছে। কেন্দ্রে ভি পি সরকারের পতন ও বিভিন্ন গোষ্ঠীতে জনতা দলের বিভাজন হয় এবং একমাত্র বিহারেই ভি পি গোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সংসদে বিজেপি প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলির যোগফল ইতিমধ্যেই ভি পি-র বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে শুরু করেছিল। বিজেপির সমর্থন প্রত্যাহার করা এর কারণ ছিল না বরং এর পরিণতি ছিল। ভি পি সরকারের পতনে এটি প্রয়োজনীয় অনুঘটকের কাজ করেছে। এটি কেবলমাত্র বিজেপি-শিবসেনা আঁতাতের ৯০ জনের মতো সদস্যের সমর্থন প্রত্যাহারের প্রশ্ন নয় বরং একইসঙ্গে এটি ছিল জনতা দলের বিভাজন ও কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন সমীকরণ গড়ে ওঠার প্রশ্ন।

চন্দ্রশেখর-কংগ্রেস(ই)-র আঁতাত বাস্তবিকই খিড়কি পথে কংগ্রেস শাসনের প্রত্যাবর্তন। অনিবার্যভাবেই এটি এক অস্থায়ী আঁতাত, কেননা দেবীলাল ও জনতা দল(এস)-এর একটি অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘদিন এই সহযোগিতা চালিয়ে যেতে পারে না, এমনকি চন্দ্রশেখর যদি কংগ্রেসে মিশেও যান। নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ও জনগণের সংগ্রামগুলি গড়ে তোলার জন্য আমাদের তাই জনগণের কাছে যেতে হবে।

ভি পি সিং-এর জনতা দল ও বাম দলগুলি স্বাভাবিক বিরোধী পক্ষের আসনে ফিরে এসেছে, আমরা তাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমাদের সঙ্গে তাদের যৌথ কার্যকলাপ, সহযোগিতা ও আঁতাতের সম্ভাবনা আরও বড় মাত্রায় সৃষ্টি হয়েছে এবং এ সমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে আমাদের পুরোপুরি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। যদিও এখানে একটা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা ভালো। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও তার পরিচালক বিজেপি ভারতীয় সমাজের বুনোটকে ধ্বংস করে চলেছে। বাম দলগুলি এ বিষয়টিকেই তাদের প্রচার কর্মসূচির একমাত্র করে তুলেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ব্যবহারিক রাজনীতিতে কোনো না কোনো বুর্জোয়া-জমিদার আঁতাতের লেজুড়বৃত্তির কৌশলকে কূট কৌশলে ফেরী করাই এর লক্ষ্য। মৌলিক দাবিগুলিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সমাবেশিত করে গণতান্ত্রিক ও জঙ্গী গণআন্দোলন গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপদকে প্রতিহত করার বামদের সবথেকে কার্যকরী ও বহু পরীক্ষিত চলতি রূপগুলিকে ব্যবহার করার প্রশ্নকে তারা বিদায় জানিয়েছে। এমনকি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এ রূপগুলিকে বিবেচনা করতেও তারা রাজি নয়। সুতরাং বাম দলগুলি যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের সমস্ত আশা-ভরসা বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা মানবশৃঙ্খল, সেমিনার ইত্যাদি লোকদেখানো কর্মসূচিতে ব্যস্ত রয়েছে, তখন মৌলবাদ তৃণমূলে জনগণের মানসজগতে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে।

মতাদর্শগত আবহাওয়া, ভয়ানক নিরাশাজনক অর্থনৈতিক সংকট, ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় পরিচিতির অবক্ষয় ধর্মীয় মতাদর্শকে এক শক্তি হিসাবে সংগঠিত হতে উৎসাহ যুগিয়েছে, আর ধর্ম এনে দিয়েছে সান্ত্বনা, হিন্দু পরিচিতি জাতীয় পরিচিতি রক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী, ফ্যাসিবাদী লক্ষ্য পূরণে বিজেপি এক ধাপ এগিয়েই থাকছে। বামপন্থী ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ও তার মতাদর্শগত রাজনৈতিক আক্রমণাত্মক অভিযান, জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক ইস্যুগুলিতে জঙ্গী গণআন্দোলনই একমাত্র সাম্প্রদায়িকতাকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। পশ্চাদপদ সামাজিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ফ্যাসিবাদের উর্বর জমি হিসাবে কাজ করে। এই একই অবস্থা বিপ্লবের অগ্রগতির পথেও সহায়ক হতে পারে যদি কমিউনিস্টরা সমস্ত ধরনের সমাজগণতান্ত্রিক ও সংসদীয় মোহকে ঝেড়ে ফেলে স্বাধীনভাবে ও জনগণের সঙ্গে একত্রে এগিয়ে যেতে সাহসী হয়।

ভি পি সিং, লালু যাদবরা আমাদের সঙ্গে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেন। এরা ও বিজেপি আবার বিরোধী পক্ষে চলে এসেছে এবং কংগ্রেস বিরোধিতার নামে ধাপে ধাপে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলতে পারে। তাত্ত্বিক সূত্রায়ন করে ১৯৬০-এর দশকে লোহিয়াই এটি প্রথম শুরু করেছিলেন, তিনি তৎকালীন জনসংঘীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭৭-এ এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল জনতা পার্টির মধ্যে, আর ১৯৮৯-এ অন্যরূপে তা দেখা গেল। বিরোধীপক্ষে থাকার সময় তারা কাছাকাছি আসে আর ক্ষমতায় পৌঁছে তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। বিষয়টি এভাবেই আছে। চূড়ান্ত কংগ্রেস বিরোধী, বিজেপি বিরোধী বর্তমান আকারের ধর্ম নিরপেক্ষ আঁতাত একইদিকে সরলরেখায় অগ্রসর হবে বলে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই পুনরায় মোহ সৃষ্টি করে চলেছে। যদি বাহ্যিক লক্ষণগুলি দেখে আমরা নিজেদের বিপথে চালিত করি, যদি আমাদের সমস্ত উদ্যোগকে ভি পি সিং ও লালু যাদবের দলবলের করুণার উপর ছেড়ে দিই, তবে এক মর্মান্তিক আঘাত বামদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। বুর্জোয়া ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক শক্তির সঙ্গে কৌশলগত, সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী আঁতাতের জন্য দরজা খোলা রেখেও আমাদের স্বাধীনভাবেই অগ্রসর হতে হবে। বিপ্লবী পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলেই বিকাশলাভ করেছে। শাসকশ্রেণীগুলি গভীর অস্থায়ীত্বের মধ্যে পড়েছে। সংসদবাদ ও আনুষ্ঠানিকতার চৌহদ্দিতে নিজেদের আটকে রাখার পরিবর্তে জনগণকে জাগ্রত করুন ও সাহসের সঙ্গে জঙ্গী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রসর হোন।

আসুন আমরা স্বাধীনতা ও গণসংগ্রামের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।

(লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯০ থেকে)

কমরেড ও বন্ধুগণ,

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।

সারা দেশে আজ আগুন জ্বলছে। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির তথাকথিত রক্ষাকর্তারা সকলেই দেশের ধ্বংসসাধনেই ব্যস্ত। চূড়ান্ত বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সুর তুলে শোনানো হচ্ছে অন্তর-মিলনের কাব্য। পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও আসামের সমস্যাগুলির রাজনৈতিক সমাধানের সমস্ত কথাবার্তা থেমে গেছে। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ফ্যাসিবাদী-সাম্প্রদায়িক ‘রথ’ যাত্রা অব্যাহত। হিন্দি নিয়ে বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলছে এবং উত্তর ও মধ্যভারতের ব্যাপক অংশ তীব্র জাতপাতের লড়াইয়ে দীর্ণ হচ্ছে। সর্বব্যাপী এই হতাশার মাঝে আজকের এই জনসমাবেশ অবশ্যই এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। আপনাদের আকাশ কাঁপানো স্লোগান আর চারদিকে লাল পতাকার আলোড়ন আমাদের অবরুদ্ধ দেশের কাছে এই একক বার্তা পাঠাচ্ছে যে জনগণের যথার্থ ইস্যুগুলি অবশ্যই আলাদা। এ হল সম্মিলিত সংগ্রামের স্থির সংকল্প, যে সংগ্রাম একসাথে চালাতে হবে। আমাদের শাসকদের কাছে এই হুঁশিয়ারী পাঠাচ্ছে যে তারা যখন তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত তখন আমরাও নিজেদের অধিকার কায়েম করতে পণ রাখার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে শুরু করেছি।

ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংরক্ষণ ও মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলির বিরোধিতায় ছাত্ররা উত্তাল। কেউ কেউ আবার আত্মাহুতির মতো চরম পথও বেছে নিচ্ছে। আমরা জানি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার কিছু হোতা ছাত্রদের এই জনপ্রিয় বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিতে উঠে-পড়ে লেগেছে দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে। এই সংরক্ষণ বিরোধী দাঙ্গাহাঙ্গামার পিছনে কংগ্রেস, বিজেপি ও জনতা দলের দেবীলাল গোষ্ঠীর কায়েমী রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কেও আমরা অবহিত। এ সত্ত্বেও আমরা মনে করি যে, বেকারির বিরুদ্ধে তাদের অসীম ঘৃণা এবং ভবিষ্যৎ নিরাশাই তাদের এই সংরক্ষণ বিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই সেদিন পর্যন্ত এই মধ্যবিত্ত যুব সম্প্রদায় ত্রাতা ভি পি সিং-এর নৈতিক আবেদনে সম্মোহিত ছিল, কিন্তু এখন তাদের এই উপলব্ধি হয়েছে যে তিনিও চতুর চাণক্যের ছাঁচে গড়া একজন রাজনীতিবিদ মাত্র, আর তাই তাদের ক্ষোভের সুরাহার কোনো পথ নেই।

বাবরের বর্তমান বংশধরদের উপর প্রতিশোধ নিতে চান এমন রাজনীতিকদের আমরা যেমন স্বীকার করি না, তেমনি তাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধের জন্য মনুর বর্তমান প্রজন্মকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলেন যে সমস্ত তত্ত্ববিদ আমরা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করি। আমরা আবার বলছি, সরকারের উচিত ছিল তাদের নিজেদের নির্বাচন-পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি পালন করে “কাজের অধিকার”কে মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পরিকল্পনাগুলি ঘোষণা করা যা ছাত্র ও যুবকদের মনে আশার সঞ্চার করতে পারত। এই ধরনের এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যদি মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে গ্রহণ করা হত তবে এই যুবকদের সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামে সমাবেশিত করা যেত এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের হোতা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির কবল থেকে তাদের মুক্ত করা যেত। কিন্তু বেকারি সমস্যার মোকাবিলায় বা সামাজিক ন্যায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আস্থা জাগাতে এই সরকার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভি পি সিং-এর মণ্ডল কসরৎ তার সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাজির খেলায় এক চতুর কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয় এবং এভাবেই বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে।

আমরা এটিও বলতে চাই যে ছাত্র-যুব বিক্ষোভ এক নেতিবাচক মোড় নিয়েছে। পশ্চাদপদদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ প্রকল্পের বিরোধিতা করার পরিবর্তে তাদের আন্দোলনের বর্শামুখ রাখা উচিত ছিল কাজের অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। এই জন্যই আমরা ‘কাম দো’ (কাজ দাও) স্লোগানকে কেন্দ্র করেই এই সমাবেশ সংগঠিত করেছি এবং এই মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে যোগদানের জন্য আমরা ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানাই।

দলিত ও পশ্চাদপদ জাতিগুলির জন্য কাজের সংরক্ষণকে আমরা নিশ্চিতভাবে সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের এই সমর্থন ভি পি সিং-এর ধূর্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সমর্থন নয়, আবার লোহিয়াপন্থী তত্ত্বের প্রতি সমর্থনও বলা যাবে না, যে তত্ত্বে সমাজতন্ত্রের ধারণাকে পশ্চাদপদতার রাজনীতিতে অধঃপতিত করা হয়েছে।

সংরক্ষণের প্রতি আমাদের সমর্থন বলতে আমরা আগ্রাসী পশ্চাদপদ জাতিগুলির জাতপাতের লড়াইয়ের পিছনে দলিতদের সমাবেশিত করার কথা বোঝাই না। তা কখনই লাল পতাকাকে সবুজ পতাকার অধীনস্থ করা – কাস্তে-হাতুড়িকে চক্রের অধীনস্থ করাও নয়।

আমরা লাল পতাকার স্বাধীন আত্মঘোষণার পক্ষে, আমরা লাল কেল্লার উপর লাল পতাকা তোলার স্বপ্ন দেখতে চাই। এই স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার জন্যই আমাদের এত আত্মত্যাগ, আর ভবিষ্যতেও ভারতীয় জনগণের এই মহান লক্ষ্যের স্বার্থে আমরা যে কোনো আত্মত্যাগ থেকে বিরত হব না। দলিতদের মধ্যে আমাদের এক দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে, কিন্তু কাঁসিরাম ও তার সম্প্রদায়ের ‘দলিতবাদের’ বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই ভিত্তি বিকাশলাভ করেছে। পশ্চাদপদ জাতিগুলির মধ্যেও আমাদের ভিত্তি বাড়ছে, কিন্তু মুলায়ম সিং ও লালু যাদবের পশ্চাদপদবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভিত্তিতেই তার বিকাশ ঘটছে। দলিতদের মধ্য থেকে উদ্ভূত নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এবং বর্ধিষ্ণু পশ্চাদপদরা – উভয়েই আমাদের আন্দোলনের নিশানা। অপরদিকে আলোকপ্রাপ্ত অংশ এবং উচ্চবর্ণের মধ্যকার দরিদ্র মানুষরাও ব্যাপক সংখ্যায় আমাদের আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন। নেহরুর সংস্কারের কল্যাণে আমাদের সমাজ সামন্ততান্ত্রিক-জাতপাত ভিত্তিক বিভাজন থেকে মুক্ত হয়ে গেছে এবং এক আধুনিক সমাজে পরিণত হয়েছে, আর তাই সংরক্ষণ অগ্রগতির ধারাকে পশ্চাদমুখী করবে – এইসব কথাবার্তা যে সমস্ত তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ বলেন তাদের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি না। এটিই ঠিক ভারতের বাস্তবতা নয়।

আমরা সংরক্ষণকে সমর্থন করি কেননা আমরা বিশ্বাস করি যে, শুরুতে যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত তা উন্নত-পশ্চাদপদদের মধ্যে বিদ্যমান বিভেদকে প্রশমিত করবে, পশ্চাদবর্তীতা ও অগ্রগামিতার মানসিকতায় আঘাত হানবে এবং পশ্চাদপদ ও উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তথা আমলাতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের সমতা নিয়ে আসবে। আর বিভিন্ন জাতির স্বচ্ছলদের মধ্যে সংহতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নীচুতলার মানুষের মধ্যেও অনুরূপ এক শ্রেণী সংহতির বিকাশ ঘটবে।

সামন্ততান্ত্রিক, ধর্মান্ধ যে কোনো ধারার প্রতি আঘাত, বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক উদারিকরণের যে কোনো পদক্ষেপ – তা যতই ওপর ওপর হোক না কেন – সমাজে শ্রেণী মেরুকরণের প্রক্রিয়াকে অবশ্যই ত্বরান্বিত করবে, এবং কমিউনিস্ট হিসাবে, শ্রেণী সংগ্রামের রক্ষক হিসাবে আমরা সমাজের অভ্যন্তরে ঐ ধরনের যে কোনো শ্রেণী বিভাজনকে স্বাগত জানাই।

সংরক্ষণ-সমর্থক সকল বাম শক্তির কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন, ভি পি সিং, রাম বিলাস পাসোয়ান বা শারদ যাদব, মুলায়ম সিং বা লালু যাদবের পিছনে পিছনে না চলে আসুন এক স্বাধীন শক্তি হিসাবে আমরা নিজেদের তুলে ধরি, সংরক্ষণের জন্য সংগ্রামকে কাজের জন্য সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তুলি। এই ধরনের জটিল সন্ধিক্ষণে আমরা কমিউনিস্টরা, বিপ্লবী গণতন্ত্রীরা হিন্দি বলয়ে সবসময়েই নিজেদের পরাজিত হতে দেখেছি। কখনও বাস্তবতার নামে লোহিয়াপন্থী বা বিভিন্ন বর্ণের জাতপাতের শক্তিগুলির সামনে উদ্যোগহীন হয়ে থেকেছি অথবা এই সমস্ত মধ্যপন্থী ধারাগুলির পিছু পিছু চলার মধ্যেই আমাদের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। এই কারণেই দেশের এই অংশে আমরা কমিউনিস্ট, বামপন্থী ধারাকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হতে পারিনি। আমাদের কিছু কিছু বন্ধু এই পুরোনো ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। আইপিএফ-এর মাধ্যমে বিহারে বাম আন্দোলন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং কাঁশিরামদের দলিতবাদ বা লোকদলের মতো দলগুলির পশ্চাদপদবাদ কোনোকিছুই এই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকে রোধ করতে পারেনি। শ্রেণী ঐক্য ও শ্রেণী সংগ্রামের বুনিয়াদী ভিত্তির উপর ভর করে আমরা চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে দলিত ও পশ্চাদপদদের এক নতুন সংগ্রামী জোটেরও বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছি। বিহারে আমরা যে দৃঢ় ভিত্তি অর্জন করেছি সমস্ত বামপন্থী শক্তিগুলিকে তার চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করে নিতে হবে।

পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত ইউনিয়নে যাই-ই ঘটুক না কেন, আমাদের দেশে বাম আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টির সামনে ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেও অবশ্যই বামেদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আমাদের বন্ধুদের আমরা পুনরায় আশ্বস্ত করতে চাই যে আমাদের সংগ্রাম আপনাদের বিরুদ্ধে নয়। রাজনৈতিক লাইন ও কর্মনীতির বিভিন্ন প্রশ্নে আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে এবং এই সমস্ত বিষয়ে আমরা সুস্থ বিতর্ক চালাতে চাই। যে সমস্ত রাজ্যে আপনারা সরকার চালাচ্ছেন সেখানে আমরা আপনাদের জনস্বার্থ-বিরোধী পদক্ষেপগুলির বিরোধিতা না করে পারি না এবং আমরা তা করেও যাব, কেননা কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে জনগণের কাছে এবং আমরা তাদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক-বিরোধী শিল্পনীতি, জনগণের প্রয়োজনীয় সমস্ত ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, ত্রিপুরা বা অন্যত্র আপনাদের শক্তিগুলির উপর নিপীড়নের প্রশ্নে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং এই ধরনের প্রশ্নগুলিতে আমরা আপনাদের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ চালানোর পক্ষে। আমরা বুঝতে পারি না আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ চালাতে আপনাদের বাধা কোথায়। হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও আপনারা কখনও কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাবুঝি গড়ে তুলতে পারেন, জনতা দলের সঙ্গে আঁতাত করতে পারেন এবং এমনকি বিজেপির সঙ্গেও কৌশলে কাজ চালাতে পারেন। আমরা যারা সেই একই কাস্তে-হাতুড়ি খোদাই করা লাল পতাকাকে তুলে ধরি, আমরা যারা গ্রাম ও শহরের দরিদ্রতম শ্রমজীবী মানুষের জন্য লড়াই করছি এবং তাঁদের স্বার্থে যে কোনো ধরনেরই আত্মত্যাগে পিছপা হই না, আমরা যারা বুর্জোয়া জমিদার জোটের যে কোনো রাজনৈতিক গঠনের বিরুদ্ধে – তা সে কংগ্রেস, বিজেপি, জনতা দল বা অগপ-ই হোক – সর্বাপেক্ষা দৃঢ়ভাবে লড়াই চালিয়ে আসছি, তবে পৃথিবীতে শুধুমাত্র আমাদেরই কেন আপনারা প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করবেন? যেভাবে সমস্ত কিছু চলছে তাকে নতুনভাবে বিচার বিবেচনার জন্য আমরা বামপন্থী কর্মীবাহিনী এবং তাদের চিন্তাশীল ও নিষ্ঠাবান নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতের অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। গত বিশ বছরে আমাদের চারদিকে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তনই ঘটে গেছে। অতীত পড়ে থাক, আসুন আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। আজকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের পরিস্থিতিতে সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই(এমএল)-এর যতদূর সম্ভব একসাথে চলার জন্য পথ খুঁজে বার করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের তিন দলের মধ্যে যে কোনো ঐক্য জনগণকে এক নতুন আশায় উজ্জীবিত করবে এবং এই সংকট জর্জরিত দেশে, যেখানে সমস্ত ধরনের বুর্জোয়া বিকল্প সম্পর্কে জনগণের ক্রমশই মোহভঙ্গ ঘটছে, তা এক শক্তিশালী বাম আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটাবে। ইতিহাসের এই দাবিতে সাড়া দিতে নাম্বুদিরিপাদ বা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত কি প্রয়োজনীয় সাহস দেখাবেন?

পশ্চিমবাংলায় সম্প্রতি আমরা এক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের বিকাশ ঘটানোর জন্য সহযাত্রী বিপ্লবী বামশক্তিগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েছি। পশ্চিমবাংলায় আমাদের আন্দোলন শুধু বামফ্রন্ট সরকারের নিপীড়নমূলক, জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধেই নয়, তা একই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী বিরোধীপক্ষ, বিশেষত ক্রমবর্ধমান গণঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস(ই)-র পুনরুত্থানের মরিয়া প্রয়াসের বিরুদ্ধেও এক প্রতিরোধের সুদৃঢ় প্রাচীর খাড়া করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা মনে করি পশ্চিমবাংলায় পূর্ব ইউরোপের পুনরাবৃত্তিকে ঠেকাতে এটিই একমাত্র কার্যকরী পথ।

ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভারতবর্ষে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্তরাধিকার একমাত্র আমাদের পার্টির হাতেই সবচেয়ে সুরক্ষিত। কিছু বিমূর্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে যে সমস্ত কমরেড আমাদের ছেড়ে গেছেন, আমাদের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ব্যর্থ আশা পোষণ করে যাঁরা ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, চটজলদি বিপ্লবের দুঃসাহসিক স্বপ্ন যাঁদের বিপথগামী করেছে বা ধাক্কায় হতাশগ্রস্ত হয়ে যাঁরা কোনো না কোনো ধরনের উদারনীতিবাদী কর্মনীতির কবলে চলে গেছেন, তাঁদের কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন বাস্তবের মুখোমুখি হোন, আমাদের পার্টির লাল পতাকাতলে সমাবেশিত হোন, আমাদের প্রিয় কমরেড যাঁরা আমাদের ছেড়ে গেছেন তাঁদের জন্য আমাদের দরজা সব সময়েই খোলা থাকবে।

আইপিএফ হল বিপ্লবী গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা দৃঢ় আন্দোলনের অপর নাম, যা শুধু প্রথাগত বামপন্থীদের শক্তি ও সংগ্রামকে, শ্রমিক ও কৃষকদের সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতেই প্রয়াসী হয়নি, ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের সমস্ত ধারাকেই – তা জাতীয় সংখ্যালঘু, মহিলা বা পরিবেশ ইস্যুতে আন্দোলনই হোক অথবা ধর্মীয় সংস্কার বা নাগরিক স্বাধীনতার অভিযানই হোক – এই সবকিছুকেই সমন্বিত করতে সচেষ্ট। আইপিএফ-কে স্বাধীন করে তুলতে আমাদের পার্টি আইপিএফ-এর এই দিশার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গোঁড়া কমিউনিস্ট বিরোধী নন এমন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন – এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সফল করে তুলতে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।

অতীতে আমরা কিছু ভুল করেছি, আর আজ যা করছি তার মধ্যেও কিছু দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। আমরা সবসময়েই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত এবং ইতিহাস প্রমাণ করেছে আমরা কোনো গোঁড়ামির দাস নই।

এই সমাবেশ থেকে আপনারা যখন নিজেদের এলাকায় ফিরে যাবেন, ব্যাপক জনগণের কাছে আপনাদের এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। লাল পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা এবং সর্বশক্তি দিয়ে বিপ্লবী গণতন্ত্রের এক নতুন জোয়ার নিয়ে আসার দায়িত্ব আপনাদের কাঁধে। এটি এমন এক জোয়ার যা ভারতবর্ষের প্রকৃত ঐক্য নিয়ে আসবে, যা ভাষা বা জাতিসত্তা, জাতি বা ধর্ম নির্বিশেষে শ্রমজীবী জনতার সমস্ত অংশের আকাঙ্খাকে ঐক্যবদ্ধ করবে।

ভারতীয় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
জনগণের ক্ষমতা দীর্ঘজীবী হোক!