শুরুতে দেখা যাক, লেনিন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন : “যদি সাম্রাজ্যবাদের সবচাইতে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা প্রদান করতে হয় তাহলে আমাদের বলতে হবে যে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর”। (সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর)
একচেটিয়া পুঁজি বলতে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে আসে উৎপাদনের কেন্দ্রীভবনের ফলে আবির্ভূত হওয়া বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর কথা, যা লেনিনের সময়ের তুলনায় আজকের যুগে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছ, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তার জাল ছড়িয়েছে। এছাড়াও লেনিন কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের মতো প্রধান প্রধান কাঁচামালের উৎসগুলোর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোর একচেটিয়াকরণ (লগ্নি পুঁজির মোড়লতন্ত্র বা ফিনান্স অলিগার্কি) এবং সেই সঙ্গে উপনিবেশ, আধা/নয়া উপনিবেশ অথবা প্রভাবাধীন এলাকাগুলো দখলে রাখার ক্ষেত্রে একচেটিয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।
অবশ্য, এই সমস্ত ক্ষেত্রে একচেটিয়াকরণ মানেই প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যাওয়া বোঝায় না। প্রতিযোগিতা থেকে একচেটিয়া পুঁজির জন্ম এবং পুনরায় তা আরও বেশি করে প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে তোলে। মার্কস ইতিমধ্যেই দেখিয়েছিলেন যে এটা হচ্ছে বিপরীতের মধ্যকার 'ঐক্য' তথা 'সংশ্লেষণ' তথা 'গতিময়তা'। লেনিন নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে এটাকে আরও পরিপূর্ণতা দান করেছিলেন।
তিনি উদাহরণ হিসাবে দেখিয়েছিলেন যে কেন সাম্রাজ্যবাদের যুগে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ধনতন্ত্রের বিকাশ ছিল (এবং এখনও আছে) খুবই অসম, তাই কিছু পুঁজিবাদী বৃহৎ শক্তি (যেমন জার্মানি) অন্যদের তুলনায় (যেমন গ্রেট ব্রিটেন) অনেক দ্রুত বিকাশলাভ করেছিল এবং স্বাভাবিকবাবেই গোটা পৃথিবীর সম্পদ, বাজার এবং এলাকার বৃহত্তর অংশের দখল নিতে চেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু “বিশ্বের ভৌগলিক বিভাজন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল” (উপনিবেশের ও প্রভাবাধীন এলাকাগুলোর একচেটিয়াকরণের মাধ্যমে) তাই পুনর্বিভাজন সম্ভব ছিল একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই। অর্থাৎ, বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে – অথবা তাদের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে – যুদ্ধ সংঘটিত হয় একচেটিয়া পর্যায়ের পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা থেকেই, কোনও রাষ্ট্রনেতার বদ উদ্দেশ্য থেকে নয়।
কিন্তু লেনিন একচেটিয়া কারবার ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের আরও দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, পরজীবী অথবা ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ এবং মুমূর্ষু পুঁজিবাদ। দেখা যাক লেনিন এই দুটি শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝাতে চেয়েছেন।
“একচেটিয়াকরণ তথা মোড়লতন্ত্র; স্বাধীনতা নয়, আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রচেষ্টা; আরও বেশি সংখ্যায় ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিগুলোর ওপর অল্পসংখ্যক সবচেয়ে ধনী অথবা ক্ষমতাবান জাতিগুলোর শোষণ – এই সমস্ত বিষয়গুলো সাম্রাজ্যবাদের সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছে যার ফলে আমরা বাধ্য হয়েছি তাকে পরজীবী অথবা ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে। … এটা ভেবে নেওয়া ভুল হবে যে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার এই প্রবণতা পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশকে নাকচ করে। এটা একেবারেই ঠিক নয়। সাম্রাজ্যবাদের যুগে শিল্পের কিছু শাখা, বুর্জোযাশ্রেণীর কিছু স্তর এবং কিছু বিশেষ দেশ … এই সমস্ত প্রবণতার কখনও এটি বা কখনও অন্যটি প্রকাশ করে। সামগ্রিক বিচারে, পুঁজিবাদ আগেকার তুলনায় আরও বেশি দ্রুত হারে বেড়ে উঠছে”। (সাম্রাজ্যবাদ)
একদিকে বিস্ময়কর কিন্তু অত্যন্ত অসম, ভারসাম্যহীন বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে সুস্পষ্ট ক্ষয়িষ্ণুতা – দুয়ে মিলে এইভাবে এক বিপরীতের ঐক্য জন্ম দিচ্ছে – যেখানে শেষবিচারে ক্ষয়িষ্ণুতা হচ্ছে দ্বন্দ্বের প্রধান দিক। এই দ্বন্দ্ব সমস্ত স্তরেই প্রতিফলিত হচ্ছে। যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একদিকে পুরনো শিল্পগুলোর গভীর সংকট আর অন্যদিকে নয়া অর্থনীতিতে অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে (উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় উগান্ডা) এবং শ্রেণীগুলোর মধ্যেও (সর্বক্ষেত্রেই একটি সংখ্যালঘু অংশ ফুলেফেঁপে উঠছে আর অন্যদিকে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আপেক্ষিক অথবা চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে ক্রমাগত নিমজ্জিত হচ্ছে) আমরা একই ব্যাপার লক্ষ্য করছি।
কীভাবে আমরা মুমূর্ষু পুঁজিবাদকে ব্যাখ্যা করব ? সাম্রাজ্যবাদ নামক রচনায় লেনিন বলেন যে “এটা হচ্ছে সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণশীল পুঁজিবাদ : পুঁজিবাদের মধ্য থেকে উদ্ভূত একচেটিয়া পুঁজি ইতিমধ্যেই মুমূর্ষু পুঁজিবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং তা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সূচনা। সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা শ্রমের যে সামাজিকীকরণ ঘটে গেছে তা (সাম্রাজ্যবাদের প্রবক্তা বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা যাকে বলছেন আন্তঃসংযুক্তি) একই ফলাফলের জন্ম দেয়”।
লেনিন এখানে যেটা বোঝাতে চাইছেন তা হল যে, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলো এবং একচেটিয়া ব্যবস্থার আবির্ভাবের আগে ধনতন্ত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অপরিকল্পিত উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে ছিল। ব্যক্তি বা পার্টনারশিপ ফার্মের বহু সংখ্যক ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগ এই উৎপাদন চালাতো। উৎপাদনের সামাজিকীকরণ (অনেক শ্রমিক যেখানে একসঙ্গে উৎপাদনে হাত লাগান) সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার তুলনায় উন্নত মাত্রায় গেল বটে, কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। বিংশ শতাব্দীতে উৎপাদনের কেন্দ্রীকরণে এক উল্লম্ফন দেখা গেল। কারখানার দেওয়াল এবং দেশের সীমানা অতিক্রম করে এক একটি জিনিসের যেমন ধরা যাক একটি গাড়ির অংশগুলো বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন করে তারপর একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতে লাগল। একই ব্যাপার দেখা গেল বাজারজাতকরণ আর পরিচালন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। যেমন দেখা গেল, একটি মূল কোম্পানি অসংখ্য অধীনস্থ কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যাদের অনেকগুলোই হয়তো বিদেশে অবস্থিত। এইভাবে উৎপাদন এবং শ্রমের সামাজিকীকরণ অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেল। কিন্তু সেই শ্রমের ফসল অর্থাৎ – উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা – ব্যক্তিগতভাবেই আত্মসাৎ হতে থাকল এবং সেটাও স্বল্পসংখ্যক একচেটিয়া কারবার দ্বারা। সমাজের উৎপাদিকা ভিত্তি সম্প্রসারিত হলেও মুনাফা আত্মসাতের ব্যাপারটা ঘটতে লাগল আরও সীমিত অংশের মধ্যে।
সামাজিক উৎপাদন এবং ব্যক্তিগত আত্মসাতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব – যা হল পুঁজিবাদের মৌলিক দ্বন্দ্ব – এভাবেই মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে চলেছে এবং সমাধানের দাবি জানাচ্ছে। এর একটিই সমাধান সম্ভব এবং তা হল আত্মসাৎ বা বণ্টনেরও সামাজিকীকরণ, যাতে তা ইতিমধ্যেই ঘটা উৎপাদনের সামাজিকীকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর অর্থ হল যৌথ শ্রমের ফসল যৌথভাবে, সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া। জমি, কারখানা এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণগুলোর মালিকানা জনগণের হাতে ন্যস্ত হলেই এটা একমাত্র সম্ভব। আর সেটাই সমাজতন্ত্র। এই অর্থেই লেনিন ঘোষণা করেছিলেন, “সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর সামাজিক বিপ্লবের পূর্বাহ্ন”।
এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ আপনা আপনিই ঘটবে ? কোনোমতেই তা নয়। আগে উল্লিখিত মৌলিক দ্বন্দ্বটি বস্তুগতভাবে পরিপক্ক হয়ে ওঠার মতোই শ্রমিকশ্রেণী এবং তার পার্টির বিষয়ীগত ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই আমরা একটি বড়সড় সমস্যার মুখোমুখি হই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের একচেটিয়া কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র দেশের ভেতর থেকে 'স্বাভাবিক' মুনাফা অর্জন করেই ক্ষান্ত হয় না , পুঁজি রপ্তানির মাধ্যমে বাইরের দেশ থেকেও সে 'অতিরিক্ত মুনাফা' অর্জনে সক্ষম। এই সামগ্রিক মুনাফারর পরিমাণ এতই বিশাল যে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ সে অনায়াসেই ব্যয় করতে পারে শ্রমিকশ্রেণীর নেতাদের এবং সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর উচ্চস্তরকে ঘুষ দেওয়ার জন্য, যাতে বিপ্লবী রাজনীতি থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এইভাবে জন্ম নেয় “শ্রমিক অভিজাততন্ত্র – যারা জীবনযাপন, উপার্জন এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে একেবারেই জঘন্য প্রকৃতির। তারাই হল শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে বুর্জোয়াদের এজেন্ট, পুঁজিপতিদের শ্রমিক সর্দার এবং সেইসঙ্গে সংস্কারবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকৃত বাহক”। (সাম্রাজ্যবাদ – ফরাসি এবং রুশ সংস্করণের ভূমিকা)।
এইভাবে একদিক থেকে একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি বস্তুগতভাবে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবকে নিকটতর করে তোলে, অন্যদিকে বিষয়ীগতভাবে এক গুরুতর বাধার সৃষ্টি করে। এই দ্বৈততা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন থেকেই লেনিন “সাম্রাজ্যবাদ” গ্রন্থের শেষাংশে মন্তব্য করেন : “… ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি-সম্পর্কগুলো একটি খোলস তৈরি করে। (এখানে খোলস বলতে বোঝাচ্ছে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ক, যার মধ্যে ও যার বিরুদ্ধে উৎপাদনের দ্রুত সামাজিকীকরণের “অন্তর্বস্তুটি” বিকশিত হচ্ছে – অরিন্দম সেন) যেটি অন্তর্বস্তুর সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। ফলে খোলসটি অনিবার্যভাবেই ক্ষয়ের দিকে এগোবে, যদি তার অপসারণ কৃত্রিমভাবে বিলম্বিত করা হয়। খোলসটি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে টিকেও থাকতে পারে (খুব খারাপ হলে সুবিধাবাদী ফোড়াটির নিরাময় যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়) কিন্তু শেষপর্যন্ত তার অপসারণ অবধারিত।”
জারের সেন্সরশিপের মধ্যেও যাতে ইস্তেহারটি আইনিভাবে প্রকাশ হতে পারে তার জন্য লেনিন অভিশপ্ত “ঈশপীয় ভাষা” ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও এর রাজনৈতিক অভিমুখ খুবই স্পষ্ট : “সুবিধাবাদী ফোড়াটি” বিদায় কর এবং বিপ্লবের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়। একইসঙ্গে তিনি তত্ত্বগতভাবে সম্ভাবনার এই কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাতেও পুঁজিবাদ (সাম্রাজ্যবাদ) “দীর্ঘকাল” টিকে থাকতে পারে – বিশেষ করে যদি শ্রমিক আন্দোলনে বিরাজমান সুবিধাবাদকে মারণ আঘাত না হানা যায়। এটাই আজ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর অন্য সম্ভাবনাটিকে বাস্তবায়িত করে তুলেছিলেন বলশেভিকদের নেতা লেনিন – সুবিধাবাদকে পরাস্ত করে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় (কমিউনিস্ট) আন্তর্জাতিক স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
একটি দেশে কি সমাজতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব এবং তত্ত্বগতভাবে সঠিক? মার্কসবাদকে যাঁরা তোতাপাখির মতো আউড়ে যান সেই সমস্ত বাক্যবাগীশ বিশারদরা গর্জন করে বলেছিলেন : অবশ্যই নয়। মার্কস-এঙ্গেলস কি আমাদের বলে যাননি যে সমাজতন্ত্রকে একইসাথে সমস্ত দেশে, অন্তত বেশ কয়েকটি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে গড়ে তুলতে হবে? লেনিন এর জবাবে বলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই তাঁরা তা বলেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। তার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পুঁজিবাদ নিজেকে সম্প্রসারিত করেছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার মধ্যে, কিন্তু এই ব্যবস্থা বা শৃঙ্খলটি প্রভূত চাপের মধ্যে রয়েছে। তার দুর্বলতম গ্রন্থিতে তাকে ভেঙে দেওয়া এবং সেখানে এক সময়ে একটিমাত্র দেশেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। তবে সাম্রাজ্যবাদের সেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্গতি এবং সহ্যক্ষমতা রয়েছে যার সাহায্যে সে শৃঙ্খলের বাকি অংশ আবার জুড়ে নিয়ে তার কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে – যতদিন না পরবর্তী কোনও আঘাত তার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এ ধরনের কত ভাঙ্গন সাম্রাজ্যবাদ সামাল দিতে পারে এবং তা কতদিনের জন্য? কখন তার চূড়ান্ত পতন ঘটবে এবং কিভাবে? লেনিন কখনও এই ধরনের ছেলেমানুষী প্রশ্ন নিয়ে বিলাসিতায় সময় নষ্ট করেননি। সামনের রাস্তা পরিষ্কার, শত্রুকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে – সম্ভাব্য আঁক-বাঁক নিয়ে জল্পনা কল্পনার বদলে এগিয়ে যাওয়াই এখন সময়ের দাবি। এটাই ছিল লেনিনের বার্তা এবং তারই ফলশ্রুতিতে নভেম্বর বিপ্লব।
সুতরাং এগুলোই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের প্রধান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মাত্রা। এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো সম্বন্ধে আমরা আরও ভালোভাবে অবহিত হতে পারব যদি জার্মানির মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কার্ল কাউটস্কির মতামতের বিপরীতে লেনিনীয় তত্ত্বকে লক্ষ্য করি :
“কার্ল কাউটস্কি ... সাম্রাজ্যবাদকে “পুঁজিবাদের একটি স্তর” হিসাবে দেখতে অস্বীকার করেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদকে দেখেন লগ্নি পুঁজির “পছন্দসই” একটি নীতি হিসাবে, “শিল্পোন্নত” দেশগুলো দ্বারা “কৃষিভিত্তিক” দেশগুলোকে দখল করার একটি প্রবণতা হিসাবে। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে কাউটস্কির সংজ্ঞা পুরোপুরি ভ্রান্ত। সাম্রাজ্যবাদ বলতে যেটা বোঝায় তা শিল্প পুঁজির নয়, লগ্নি পুঁজির শাসন এবং নির্দিষ্টভাবে কৃষিভিত্তিক দেশগুলোই নয়, সমস্ত ধরনের দেশগুলোকেই সে দখল করতে চায়। কাউটস্কি সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির থেকে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, অর্থনীতির একচেটিয়া থেকে রাজনীতির একচেটিয়াকে আলাদা করেছেন, যাতে তাঁর স্থূল বুর্জোয়া সংস্কারবাদের (যেমন “নিরস্ত্রীকরণ”, “অতি সাম্রাজ্যবাদ” ইত্যাদি আবোলতাবোলের) পথ প্রশস্ত হয়। এই সমস্ত ভ্রান্ত তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল সাম্রাজ্যবাদের গভীর দ্বন্দ্বগুলোকে অস্বচ্ছ করে দেওয়া – যাতে সাম্রাজ্যবাদের প্রবক্তাদের সঙ্গে, পুরোদস্তুর সামাজিক উগ্রজাতীয়তাবাদী এবং সুবিধাবাদীদের সঙ্গে ঐক্য স্থাপনকে যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড় করানো যায়।” (লেনিন, সাম্রাজ্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে ভাঙ্গন)
আমরা দেখছি, একই ধরনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাউটস্কি এবং লেনিন একেবারে বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একচেটিয়া পুঁজির মধ্যে কাউটস্কি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকেই দেখেছিলেন এবং তার এক উন্নত ও শান্তিপূর্ণ অতি-সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে উত্তরণের সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলেন, আর লেনিন দেখেছিলেন পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণুতা এবং তার সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সূচনা। এককথায় বলা যায় কাউটস্কি মার্কসের কথাগুলো ব্যবহার করেছেন মার্কসের মূল স্পিরিটকে ধ্বংস করার জন্য। রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী এটাই দেখিয়ে দেয়। সর্বহারা বিপ্লব ও দলত্যাগী কাউটস্কি গ্রন্থে কাউটস্কিবাদের মূল সারবস্তুকে এভাবেই তুলে ধরেছেন লেনিন :
“মার্কসবাদকে তার বিপ্লবী জীবন্ত আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। মার্কসবাদের সমস্ত কিছুই স্বীকার করা হচ্ছে কিন্তু বাদ যাচ্ছে সংগ্রামের বৈপ্লবিক পদ্ধতি, এই পদ্ধতিগুলোর প্রচার ও প্রস্তুতি এবং এই লক্ষ্যে জনগণকে সুশিক্ষিত করার কাজ।”
আমাদের চারপাশে এখনও অনেক কাউটস্কি ঘোরাফেরা করছেন – একথা বললে কি ভুল হবে?