সাম্রাজ্যবাদ এবং ভুবনীকরণের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কি রকম ?
ভুবনীকরণ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজোড়া আগ্রাসনের অন্য নাম – তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ইদানিং যেটা দেখা যাচ্ছে সামরিক আগ্রাসন – যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক স্তরকে (যা ইতিমধ্যেই একশ বছর অতিক্রম করেছে) যদি কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে (অর্থাৎ উপস্তরে) ভাগ করা যায়, তাহলে আমরা ভুবনীকরণকে তার সর্বশেষ পর্যায় হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করতে পারি।
কিন্তু ভুবনীকরণ ব্যাপারটাই কি পুঁজির অন্তর্নিহিত একটি পুরনো প্রবণতা নয় ? হ্যাঁ, তাই। কমিউনিস্ট ইস্তাহারে পুঁজির বিশ্বায়িত হওয়ার তাড়নার অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চিত্রায়ন আমাদের সবার মনে আছে। আসলে এই তাড়না কয়েক শতাব্দী জুড়ে তিনটি নির্দিষ্ট অথচ আন্তঃপ্রবিষ্ট তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে :
(ক) বাণিজ্য পুঁজির তরঙ্গ – যা চলে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ঔপনিবেশিকীকরণের ক্ষেত্রে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে শুরু করে একেবারে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত।
(খ) শিল্প-পুঁজির তরঙ্গ – শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে (অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে) এর সূচনা যার মূল লক্ষ্য ছিল শিল্পজাত দ্রব্য প্রস্তুত করার কাঁচামালের উৎস তথা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ এবং দখল করা।
(গ) ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে একচেটিয়া শিল্প-পুঁজি এবং ব্যাঙ্ক-পুঁজির মিলনজাত লগ্নি পুঁজির তরঙ্গ , যার ভিত্তি হল বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে (বিশেষভাবে শেষ সিকি শতাব্দী) বৈদ্যুতিন বিপ্লব।
বস্তুত দ্বিতীয় তরঙ্গটি কখনই শেষ হয়নি বরং তৃতীয় তরঙ্গটির সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। এই তৃতীয় তরঙ্গ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় '৯০-এর দশকের প্রথমদিকে – যখন তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটে এবং সরাসরি ভুবনীকরণ নামে চিহ্নিত হয়। ধনতন্ত্রের বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়ের মধ্যে যে ধারাবাহিকতা আছে তা থেকে আমরা কখনই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারি না। কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে যে নতুনতর দিকগুলো দেখা যাচ্ছে তার প্রতি আরও মনোনিবেশ করা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের সময়ে পুঁজি রপ্তানি হত উন্নত দেশগুলো থেকে পশ্চাদপদ দেশগুলোতে (একইসঙ্গে উন্নত দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেও)। সেটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদের তখনকার বিকাশমান বৈশিষ্ট্য। ইদানিংকালে আমরা দেখছি অনুন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে – প্রান্তসীমা থেকে পুঁজিবাদের কেন্দ্রভূমিতে – বিপরীতমুখী পুঁজি রপ্তানি। তা দেখে বিশিষ্ট ফাটকাবাজ জর্জ সোরোস মন্তব্য করেছেন – “সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন হল পুঁজির এই বিপরীতমুখী গতিকে প্রতিহত করা। এটা করতে পারলে বিশ্ব ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রান্তীয় দেশগুলোর ধারাবাহিক আনুগত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে”। (বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট, ১৯৯৮)
হ্যাঁ, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের অনেকগুলো নতুন বৈশিষ্ট্য রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা করার সুযোগ এখানে কম। তাই আমরা সংক্ষেপে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উল্লেখ করছি।
(১) শেয়ার বাজার ও মুদ্রা বাজারের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুড়ে লগ্নি পুঁজির ব্যাপক এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন চলাচল এবং এর ভিত্তিতে বিশ্ব অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান সংযুক্তিকরণ। এটা সম্ভব হচ্ছে (ক) তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জনের ফলে এবং (খ) সোভিয়েত ব্লকের পতন এবং চীনের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে, যা একক বিশ্ব-পুঁজিবাদী অর্থনীতির জমি প্রস্তুত করেছে।
(২) বৈদেশিক মুদ্রা, শেয়ার, বণ্ড ইত্যাদির ক্ষেত্রে ফাটকাবাজি উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলোর (যা ইতিমধ্যেই অতি উৎপাদন এবং হ্রাসমান মুনাফ-হারের দ্বারা আক্রান্ত) চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে বিদেশী মুদ্রার বাজারেই ব্যবসার পরিমাণ প্রতিদিন দাঁড়িয়েছিল ১.২ ট্রিলিয়নের ওপর। এটা তিন মাসের পণ্য ও পরিষেবায় সমগ্র বাণিজ্য মূল্যের সমান।
(৩) ফাটকাবাজি কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেওয়ার ফলে প্রায়ই শেয়ারবাজারে বিধ্বংসী পতন এবং মুদ্রাবাজারে বিপর্যয় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০০-২০০১-এর বিখ্যাত ডট কমের পতন ওয়াল স্ট্রীটের বিনিয়োগকারীদের ৪.৬ ট্রিলিয়ন সম্পদ ধুয়ে মুছে দিয়েছিল – এই পরিমাণটা ছিল আমেরিকার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অর্ধেক এবং ১৯৮৭-তে ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদের চারগুণ।
(৪) বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর দ্বারা বিশ্বজোড়া আধিপত্য এবং সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই আরও বেশি বেশি গভীরে প্রবেশ। বিশাল বিশাল কোম্পানিগুলোর একত্রীকরণ (যেমন, মবিল-এক্সন, ডাইমলার বেনজ-ক্রাইসলার-মিৎসুবিশী), বিশাল বিশাল কেলেঙ্কারী (এনরন) এবং অবশ্যই বিশাল বিশাল দেউলিয়াপনার (যেমন ওয়ার্ল্ড কম, ডেউ) মধ্য দিয়ে বিশালতার হিড়িক দেখা যাচ্ছে।
(৫) ডব্লিউটিও-র আবির্ভাব, যার কাজ অনুন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পতাকা বহন করা। এই সংস্থা একদিকে অনুন্নত দেশগুলোতে শুল্কের বাধাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের উৎপাদকদের হাত থেকে ধনী দেশগুলোর বাজারকে সুরক্ষিত করছে। আই এম এফ-এর পরে ডব্লিউটিও হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত হাতিয়ার, যার কাজ দুর্বলতর দেশগুলোর অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে সীমানা অতিক্রম করে বেসরকারী (অপ্রাতিষ্ঠানিক) লগ্নিপুঁজির যাতায়াতের ফলেও এই সার্বভৌমত্ব দুর্বল হচ্ছে।
(৬) নানারকমভাবে এই সমস্ত দেশে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ওপর নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ – এমনকি “ব্যর্থ রাষ্ট্র” ও “দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র”গুলোতে খোলাখুলিভাবে উপনিবেশের পুনঃস্থাপন। মিলোসেভিচের বিচার, আফগানিস্তান এবং ইরাকের ওপর আক্রমণ ইত্যাদি বহু ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
(৭) বিশ্বায়ন বিরোধী (সাম্প্রতিককালে যুদ্ধবিরোধী) আন্দোলনের এবং একধরনের “নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদ”-এর বিকাশ যা পুঁজির বিশ্বজোড়া আক্রমণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবন্ধকতা হিসাবে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একই সঙ্গে ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তনের উপাদানগুলো লক্ষ্য করা যায়। এই দুটি দিকের দ্বান্দ্বিক ঐক্য লক্ষ্য করেই আমরা ভুবনীকরণকে সাম্রাজ্যবাদের সর্বশেষ পর্যায় (এবং অবশ্যই সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল পর্যায়) হিসাবে বর্ণনা করেছি।