(কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লেখা শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের প্রথম সার্কুলার। লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৭৮ থেকে)

সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধি প্রতিক্রিয়াশীল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যাপক ভারতীয় জনতার সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তুলতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আমাদের পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সুদৃঢ় গণভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য পার্টির ভিতরে ও বাইরে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করতে হবে। সংশোধনবাদ আমাদের পার্টির উপর আক্রমণ চালিয়েছে দক্ষিণ ও বাম দুদিক থেকেই। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বছরে সমগ্র পার্টিতে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই অভিযান চালিয়ে আমাদের পার্টিকে এক নতুন চেহারা প্রদান করতে হবে এবং সশস্ত্র সংগ্রামে এই বছরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে হবে এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষের পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে হবে।

এই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে চিন্তার পদ্ধতির ও কাজের রীতির শুদ্ধিকরণ।

দার্শনিক ফ্রন্টে – এই ফ্রন্টে আমাদের কাজ হল অধিবিদ্যা ও ভাববাদের বিরোধিতা করা এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। ‘এক ভেঙ্গে দুই’ চেয়ারম্যানের দ্বান্দ্বিক ধারণা। দুই বিপরীত দিক যেহেতু পরস্পরকে বহিষ্কার করে তাই তাদের মিলিয়ে এক করার চেষ্টা অবশ্যই সুবিধাবাদ, কিন্তু দুই বিপরীত দিক যেহেতু পরস্পর পরিপূরক তাই তাদের ঐক্যকে আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এটাই চেয়ারম্যানের ‘দুটি দিকের তত্ত্ব’ যা আমাদের একপেশেপনার বিরুদ্ধে সতর্ক করে। ‘এক ভেঙ্গে দুই’ এবং ‘দুটি দিকের তত্ত্ব’ – এই দুই হল বিপরীতের ঐক্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ সঠিক লাইন ও বেঠিক লাইনকে মিলিয়ে একটা লাইন হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা সুবিধাবাদ। কিন্তু অন্য দিকে একটি সঠিক লাইনকে আমাদের গোঁড়ামির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে তার আজকের দিক এবং বিকাশমান দিক উভয়কেই মাথায় রাখতে হবে। এই দুটি দিকের ঐক্য একটি সঠিক লাইন গঠন করে।

মতাদর্শগত ফ্রন্টে – মার্কসবাদীরা শ্রেণীসংগ্রামের নামে নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণের বিরোধিতা করে। মার্কসবাদীদের কাছে শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্য হল সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাকে শক্তিশালী করা। পার্টি হল শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী যা জনগণের শ্রেণীসংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে। শ্রেণীসংগ্রামে জনগণকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং পার্টি তাতে নেতৃত্ব প্রদান করবে। যে লাইন জনতাকে সক্রিয় করতে পারে না তা কখনই সঠিক হতে পারে না। আমাদের পার্টি গ্রামাঞ্চলে যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছে সেই গেরিলা যুদ্ধ হল শ্রেণীসংগ্রামের উন্নত রূপ, আর এই শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্যই হল গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক কৃষক জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিপ্লবী কৃষক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাকে সুদৃঢ় করা। কমরেড চারু মজুমদারের এই দৃষ্টিকোণকে আমাদের দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত করতে হবে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বছরেই কমরেড জহরের সংকলিত রচনাবলী প্রকাশ করেছে। এই রচনাবলী গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে আমরা এ সম্পর্কে সংশোধনবাদী মহাদেব চক্রের দৃষ্টিকোণকে খণ্ডন করতে পারব এবং কমরেড চারু মজুমদারের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিকোণকে আয়ত্ত করতে পারব। মতাদর্শগতভাবে পার্টিকে গড়ে তোলার জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন করা ও মার্কসবাদী অবস্থান, দৃষ্টিকোণ এবং পদ্ধতিকে আয়ত্ত করা অবশ্য কর্তব্য। শুদ্ধিকরণ আন্দোলনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক নীতিগুলিকে আয়ত্ত করার জন্য অধ্যয়ন করতে কমরেডদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

কাজের রীতির শুদ্ধিকরণের প্রশ্নে – চেয়ারম্যান মাও-এর কাজের রীতির মূল কথা “তথ্য থেকে সত্যের সন্ধান”। কমরেড চারু মজুমদার সমস্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বদাই অনুসন্ধান ও অনুশীলনের উপর জোর দিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, “জনগণের কাছ থেকে শেখা, এটা খুবই কঠিন কাজ। মনগড়া ধারণা নিয়ে চলাও সংশোধনবাদের দান”। আমাদের এই কাজের রীতিকে আয়ত্ত করে সৃজনশীলভাবে পার্টির লাইনকে প্রয়োগ করতে হবে।

কমরেড চারু মজুমদার আমাদের সর্বদাই গণ-লাইন অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, “পার্টি সভ্যদের প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক প্রচারকে উন্নত করার প্রচেষ্টায় রত থাকতে হবে এবং এ কাজ আমরা করতে চাইব তখনই যখন আমরা দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের চিন্তাভাবনাগুলি বুঝতে শিখব এবং গণ-লাইনের প্রচারের ভিতর দিয়ে তাদের সাথে একাত্ম হতে পারব। প্রতি স্তরে পার্টি নেতৃত্বের দায়িত্ব পার্টির গণ-লাইনকে কতখানি উন্নত করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং পার্টি সভ্যদের এই প্রচারে শিক্ষিত করে তোলা।” কমরেড চারু মজুমদারের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই চাপিয়ে দেওয়া চলবে না, সংগ্রামের জন্য কৃষক জনতার সচেতন উদ্যোগের অপেক্ষা করতে হবে, নির্দিষ্ট এলাকাগুলিতে শ্রেণীবিশ্লেষণ, অনুসন্ধান ও অনুশীলনের সাহায্যে প্রতিটি অংশের মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছাকে যাচাই করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত গণ-লাইনকে উন্নত করতে হবে।

আমাদের পার্টির গণতান্ত্রিক কাজের রীতি ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এ প্রসঙ্গে কমরেড চারু মজুমদারের নির্দেশ হল, “আমরা কোনো কাজই নির্দেশ দিয়ে করি না। আমাদের সমস্ত কাজ হবে নিম্নতর ইউনিটের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং কাজের তাৎপর্য বুঝিয়ে। তাই আমাদের পার্টিতে উচ্চতর ইউনিটের দায়িত্ব হচ্ছে নিম্নতর ইউনিটের সঙ্গে সর্বদা আলাপ-আলোচনা চালানো এবং তাদের মতামত সংগ্রহ করা। এই পথেই পার্টি তার বিপ্লবী কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে ও পার্টি ঐক্য দৃঢ় হয়। চেয়ারম্যান মাও আমাদের শিখিয়েছেন যে প্রত্যেকটি কমিউনিস্টকে সর্বদাই অহমিকা ও দম্ভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কারণ অহমিকা ও দম্ভ সমস্ত কমিউনিস্ট গুণাবলী শেষ করে দেয়।” তিনি আরও বলেছেন, “পার্টি সভ্যদের মতামত দেওয়ার ও সমালোচনা করার পুরো গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে। পার্টির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পার্টি সভ্যদের অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ আছে। এই অভিযোগগুলি প্রকাশ করার ও আলোচনা করার পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে। তাহলেই পার্টির কর্মকর্তারা তাদের দুর্বলতাকে সংশোধন করতে সমর্থ হবেন।” পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সম্পর্কে কমরেড চারু মজুমদার বলেছেন, “অনেক বিপ্লবী বুলির সাথে অনেকে এ প্রশ্নও তুলেছেন যে কেন্দ্রীয় কমিটিকে মানি, কিন্তু অন্য কোনো কমিটিকে মানি না। বামপন্থী বুলির খোলস থাকা সত্ত্বেও এ ঝোঁক বুর্জোয়া স্বতন্ত্রবাদী ঝোঁক, অতএব সংশোধনবাদী ঝোঁক। বিপ্লবী নেতৃত্বে পরিচালিত পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে ক্ষুণ্ণ করার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিক্রিয়াশীলদেরই শক্তিশালী করে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষতিসাধন করে।”

বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটিগুলিকে নিজেদের এলাকায় এই আন্দোলন চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় এবং অন্যান্য স্তরের নেতৃস্থানীয় কমরেডদের নিজেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট ইউনিটগুলিতে এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। এই অভিযানের অগ্রগতির নিয়মিত রিপোর্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে অবশ্যই পাঠাতে হবে এবং মডেল অভিজ্ঞতাগুলিকে সমগ্র এলাকার, অঞ্চলের, রাজ্যের ও দেশের সমস্ত পার্টি সংগঠনগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী চক্রগুলি এই আন্দোলন পরিচালনায় বাধা দিয়ে অতীতে আমাদের পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে, কাজেই এই আন্দোলন পরিচালনা পার্টিকে শক্তিশালী করা ও সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত।

(লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৮ থেকে)

রোজা লুক্সেমবার্গ (১৮৭৯-১৯১৯) ছিলেন পোল এবং জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বামপন্থী গোষ্ঠীর নেত্রী। রোজা জার্মানিতে আন্তর্জাতিক গ্রুপের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যে গ্রুপ পরে স্পার্টাকাস গ্রুপ এবং তারও পরে স্পার্টাকাস লীগ নামে পরিচিত হয়। ১৯১৮-র নভেম্বর বিপ্লবে তিনি ছিলেন বিপ্লবী জার্মান শ্রমিকদের অন্যতম নেত্রী এবং জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনী কংগ্রেসে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। রোজা ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।

রোজা এবং লেনিনের সম্পর্কটি আমাদের সামনে একটি অতীব জটিল চিত্র তুলে ধরে। রুশ বিপ্লবের নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলিতে তাঁদের নিজেদের মধ্যে ছিল তীব্র বিতর্ক আবার আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী সমাজগণতন্ত্রের সাধারণ মঞ্চে অংশ নিয়েছেন উভয়েই। উভয়েই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে দৃঢ়নিষ্ঠ সংগ্রাম চালিয়েছেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সবচেয়ে ভালো প্রতিনিধিদের একজন বলে লেনিন রোজার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।

সম্পর্তি পাশ্চাত্যের মার্কসবাদী চক্রগুলিতে রোজা লুক্সেমবার্গ নিয়ে বেশ ভালোরকম পুনরালোচনা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন চিন্তাধারার প্রতিনিধিরা নিজেদের ধারণার সমর্থনে রোজার লেখা প্রায়শই কাজে লাগাচ্ছেন। চাষি আন্দোলনের নেতা শারদ যোশী রোজার লেখা দি এক্যুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল বা ‘পুঁজির সঞ্চয়’ নামক গ্রন্থের প্রসঙ্গ টেনে একথা প্রমাণ করতে চাইছেন যে শিল্পক্ষেত্রে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের উশুল সম্ভব হচ্ছে কেবলমাত্র কৃষিক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশীকরণের মধ্যে দিয়ে।

কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক গ্রন্থকারের মতে সোভিয়েত রাশিয়ার আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির, যা গর্বাচেভ-এর সংস্কারের ফলে খুব স্পষ্টভাবে বেরিয়ে পড়েছে, মূলে রয়েছে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং কেন্দ্রিকতার প্রতি অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপের লেনিনীয় পদ্ধতি। আর এ সম্পর্কে রোজা ১৯১৮ সালে কারাগারে বসে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলিতেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

তাছাড়াও পার্টি গঠনে লেনিনের “অতিকেন্দ্রিক” দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতার জন্য রোজার উচ্চ প্রশংসা করা হচ্ছে।

সংক্ষেপে নতুন করে রোজা লুক্সেমবার্গের উপর এই চর্চার পিছনে লেনিনের বিরুদ্ধে রোজাকে দাঁড় করানোর একটি সচেতন প্রয়াস কাজ করছে বলে মনে হয়। আর সেই কারণেই রোজা ও লেনিনের মধ্যেকার বহুমুখী সম্পর্ক – তাদের মধ্যেকার তীক্ষ্ন মতপার্থক্য আবার সাথে সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী সর্বহারা শ্রেণীর ঐক্য – সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের বিবিধ পর্বে এটা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা দেখাও দরকার।

১। রোজা লুক্সেমবার্গ ১৯১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ডাই এ্যাকুমুলেশন ডাস ক্যাপিটাল-এ মার্কসকে বিরোধিতা করেন এবং এই তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন যে পুঁজিবাদী ক্ষেত্রে যে উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি তা পশ্চাৎপদ অঞ্চল ও দেশগুলির উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে প্রাক পুঁজিবাদী ক্ষেত্রগুলি থেকে উশুল হয়।

এখন দেখা যাক উদ্বৃত্ত মূল্যের উশুলের ব্যাপারটিকে মার্কস কীভাবে দেখেছিলেন। মার্কসের মতে একটি পুঁজিবাদী দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের মধ্যে তিনটি অংশ থাকে – (ক) স্থিরপুঁজি, (খ) পরিবর্তনশীল পুঁজি ও (গ) উদ্বৃত্ত মূল্য। এছাড়া মার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের পৃথকীকরণ করেছিলেন, যেমন – প্রথম বিভাগ যেখানে উৎপাদনের উপকরণগুলির উৎপাদন হয় এবং দ্বিতীয় বিভাগ যেখানে ভোগ্যবস্তু উৎপন্ন হয়।

এখন উদ্বৃত্তমূল্যের একটি অংশ মাত্র ভোগ্যবস্তুর মধ্যে মূর্ত হয়, বাকি অংশটা উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে নিহিত থাকে। উৎপাদনের উপকরণের মধ্যেকার নিহিত যে উদ্বৃত্ত মূল্য তা পুঁজিপতিরা নিজেরাই ‘ভোগ’ করে এবং এটি বর্ধিত পুনরুৎপাদনের জন্য স্থিরপুঁজির আকারে সংগঠিত হয়। এটাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের ধরনের সারকথা যেখানে প্রতিটি চক্রের শেষে স্থিরপুঁজির বৃদ্ধি ঘটে এবং উৎপাদিকা শক্তির সীমাহীন বিস্তৃতি ঘটে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় দেশীয় বাজার ভোগ্যবস্তুর জন্য ততখানি বিকাশলাভ করে না যতখানি করে উৎপাদনের উপকরণের জন্য। এটাই হল মার্কসের উশুলের তত্ত্ব।

বৈদেশিক বাজারের বিকাশ একটি ঐতিহাসিক অবস্থার ফসল যেটি পুঁজিবাদের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট যুগে দেখা যায়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভূমিকার আলোচনা বলতে একটার বদলে একসাথে কতকগুলি পুঁজিবাদী দেশের ব্যাপার নিয়ে আলোচনার বেশি কিছু বোঝায় না। এটা কোনো প্রকারেই উশুলের আসল প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না।

পুঁজিবাদের বাজার সৃষ্টিতে কৃষক সম্প্রদায়ের ভূমিকার কথা বলতে গেলে তা কেবলমাত্র সেই মাত্রাতেই ঘটে থাকে যে মাত্রায় পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণী হিসাবে তারা নিজেরাই গ্রামীণ বুর্জোয়া ও গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীতে বিভাজিত থাকে। এই শ্রেণীগুলি পুঁজিবাদী সমাজটির একান্ত অঙ্গ হয়ে ওঠে। যদি পুঁজিবাদী চাষের ক্ষেত্রটির শিল্পীয় ক্ষেত্রের চেয়ে ধীর লয়ে বিকাশ ঘটে এবং শিল্পীয় ও কৃষিজ পণ্যের দামে বড় ধরনের বৈষম্য ঘটে তাহলে বিষয়গুলির পুঁজিবাদী সমাজ গঠন তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত, পুঁজিবাদী সমাজের উশুলের তত্ত্বের সাথে এগুলির কোনো সম্পর্ক নেই।

রোজার গ্রন্থের যে সমালোচনা ব্রেমার-বার্গার জেইতুং পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার প্রসঙ্গ টেনে লেনিন সম্পাদককে লিখলেন, “আমার দেখে খুব ভালো লাগছে যে মূল বিষয়গুলিতেই আপনি একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যে সিদ্ধান্তগুলিতে আমি চোদ্দ বছর আগে টিউগণ বার্নোভস্কি এবং ভক্সটুমলার সাথে বিতর্কে উপনীত হয়েছিলাম, অর্থাৎ “বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী” সমাজেও উদ্বৃত্ত মূল্য উশুল করা সম্ভব। আমি এখনও রোজা লুক্সেমবার্গের বইটি দেখিনি কিন্তু তত্ত্বগতভাবে আপনি এই বিষয়ে খুবই সঠিক। যদিও আমার এটা মনে হয় যে মার্কসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচ্ছেদ অর্থাৎ যেখানে মার্কস বলছেন যে বাৎসরিক উৎপন্নের মূল্য বিশ্লেষণে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে, তার উপর আপনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। লুক্সেমবার্গের ‘দ্বন্দ্বতত্ত্ব’ আমার কাছে (লিপজিগার ভক জেইতুং-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটিরও বিচার করে) জগাখিচুড়িবাদ (একলেকটিসিজম) বলে মনে হয় (খণ্ড ৪৩, জানুয়ারি ১৯১৩)। আবার এল বি কামনেভ-কে একটি চিঠিতে লেনিন লিখছেন (খণ্ড ৩৫) “আমি রোজার নতুন বই ‘পুঁজির সঞ্চয়’ পড়েছি। তিনি ওখানে এক দুর্ভাগ্যজনক বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। আমার আনন্দ হচ্ছে যে পান্নেকক, এক্সটেইন এবং ও বাউয়ার সকলেই একইভাবে তার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং ১৮৯৯ সালে নারোদনিকদের বিরুদ্ধে আমি যা বলেছিলাম তাঁরা রোজার বিরুদ্ধে সেই কথাই বলেছেন।”

২। রোজা লুক্সেমবার্গ ১৯০৮-১৯০৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় প্রশ্ন ও স্বায়ত্ত শাসন নামে একটি লেখায় জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকারের বিরোধিতা করেছেন। কাউটস্কির ভাবনা ছিল যে বর্তমান পরিস্থিতির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত রূপ হল জাতীয় রাষ্ট্র এবং বহুজাতিক রাষ্ট্র হল সবসময়েই সেইগুলি যাদের অভ্যন্তরীণ গঠন কোনো না কোনো কারণে অস্বাভাবিক কিংবা অনুন্নত থেকে গেছে। এই ভাবনাকে বিরোধিতা করে রোজা লিখলেন “এই ‘শ্রেষ্ঠ’ জাতীয় রাষ্ট্র হল কেবল একটি বিমূর্তন মাত্র যাকে তত্ত্বগতভাবে সহজেই গড়ে তোলা এবং রক্ষা করা যায় কিন্তু তা বাস্তবের সাথে মেলে না।” তিনি এটি প্রমাণ করতে যুক্তি হাজির করলেন যে বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তিগুলি এবং সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের ফলে ছোটো ছোটো জাতিগুলির “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার” একটি মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে।

রোজার সাথে রাজনৈতিক বিতর্কে লেনিন দেখান যে, “জাতিগুলির রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বুর্জোয়া সমাজে রাষ্ট্র হিসাবে তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নটির বদলে সে জায়গায় রোজা লুক্সেমবার্গ তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটি হাজির করেছেন।” (জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, খণ্ড ২০)

লেনিন এশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে দেখালেন যে যেখানে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সব চেয়ে পরিপূর্ণ বিকাশের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা হল একটি মাত্র দেশ জাপান – যা একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র।

লেনিন বললেন, “জাতীয় রাষ্ট্র হল পুঁজিবাদের নিয়ম ও ‘বিধি’, আর বহুজাতিক রাষ্ট্র বলতে বোঝায় পশ্চাদপদতা অথবা একটি ব্যতিক্রম।” (ঐ)

রোজা রাশিয়া থেকে পোল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিকে বিরোধিতা করেছিলেন এবং যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে পোল্যান্ড দ্রুত শিল্প বিকাশ ঘটাতে পেরেছে একটাই মাত্র কারণে যে এর উৎপাদিত দ্রব্যগুলি রাশিয়ায় বাজার পেয়েছে। এর পরিবর্তে তিনি পোল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেন এবং তাও একটি ব্যতিক্রম হিসাবে।

লেনিন বললেন “যদি স্পষ্টতই প্রাক-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে এমন কোনো দেশে (এক্ষেত্রে রাশিয়ায় – সম্পাদক) এমন একটি জাতিগতভাবে পৃথকীকৃত কোনো অঞ্চল থাকে যেখানে পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশলাভ করছে (এক্ষেত্রে পোল্যান্ড – সম্পাদক) তাহলে যত দ্রুত পুঁজিবাদ বিকশিত হবে ততই বাড়বে প্রাক-পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে এর দ্বন্দ্ব এবং তত বেশি সম্ভাবনাই থাকবে সমগ্র থেকে এগিয়ে থাকা অঞ্চলটির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার; যে সমগ্রের সাথে এটা কোনো ‘আধুনিক পুঁজিবাদী’ নিয়মে সংযুক্ত নয় বরঞ্চ ‘এশিয়াটিক স্বৈরতান্ত্রিক’ বন্ধনে আবদ্ধ।” (ঐ)

রোজা আর এসডিএলপি-র কর্মসূচিতে নবম অনুচ্ছেদের (যাতে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আলোচিত হয়েছে) অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন এই বলে যে “নবম অনুচ্ছেদ সর্বহারার দৈনন্দিন কর্মনীতির ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী নেতৃত্ব দেবে না, দেবে না জাতীয় সমস্যার কোনো কার্যকরী সমাধান।”

‘কার্যকারিতার’ প্রশ্নে লেনিনকে বলতে হল : “বুর্জোয়ারা সর্বদাই তাদের জাতীয় দাবিটিকে সবার আগেই রাখে এবং তা তারা সুনির্দিষ্ট ধারাতেই করে থাকে। অন্যদিকে সর্বহারাদের কাছে এই দাবিগুলি শ্রেণী সংগ্রামের স্বার্থের অধীন। তত্তগতভাবে আপনি একথা আগবাড়িয়ে বলতে পারেন না যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতির অন্য জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পর্যবসিত হবে কিনা বা তার সাথে সমতায় উপনীত হবে কিনা; দুই ক্ষেত্রেই সর্বহারার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল তার শ্রেণীর বিকাশ সুনিশ্চিত করা। এই কারণেই সর্বহারারা বলতে গেলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতির নেতিবাচক দাবিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। কোনো জাতিকে কোনো গ্যারান্টি দেয় না বা অন্য জাতির বিনিময়ে কিছু দেওয়ার অঙ্গীকার করে না। এটা ‘কার্যকরী’ না হতে পারে কিন্তু এটাই হল সমস্ত সম্ভাব্য সমাধানগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক সমাধান অর্জনের জন্য কার্যত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্যারান্টি।” (ঐ)

তাঁর পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রোজা কিছুটা ভেসে গিয়েছিলেন এবং পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের সাহায্য না করতে চাওয়ার উদ্বেগ থেকে তিনি রাশিয়ার মার্কসবাদীদের কর্মসূচি থেকে “বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে” বাতিল করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে বিচ্ছিন্নতার অধিকারকে সমর্থন করা হল নিপীড়িত জাতিগুলির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করার সমতুল্য।

লেনিন দেখালেন যে, কোনো নিপীড়িত জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু থাকে যা নিপীড়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় এবং ঠিক এই বিষয়টিই আমরা নিঃশর্তভাবে সমর্থন করি। সাথে সাথে লেনিন এ কথাও জোরের সাথে বললেন যে জাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী যে কোনো ধরনের ঝোঁকের আমাদের অবশ্যই বিরোধিতা করতে হবে।

লেনিন আরও বললেন “এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সমগ্র রাশিয়ার মার্কসবাদীদের এবং সর্ব প্রথম মহত রুশীয় জাতির দ্বারা জাতিগুলির বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি কোনোভাবেই বিশেষ একটি নিপীড়িত জাতির মার্কসবাদীদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বাতিল করে দেয় না, ঠিক যেমনভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকারের স্বীকৃতি কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের বিরোধিতাকে বাতিল করে না।” (ঐ)

লেনিনের মতে অবশ্য “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেন্দ্রীকরণের সাধারণ প্রেক্ষিতের এক ব্যতিক্রম। “প্রতিক্রিয়াশীল বৃহৎ-রুশীয় জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যতিক্রম একান্তভাবে আবশ্যক এবং এই ব্যতিক্রমকে যে কোনোভাবে বাতিল করা একটি সুবিধাবাদ (যেমনটি ঘটেছে রোজা লুক্সেমবার্গের ক্ষেত্রে)। এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল বৃহৎ-রুশীয় জাতীয়তাবাদের কাছে বোকার মতো নিজেকে সঁপে দেওয়া। কিন্তু এই ব্যতিক্রমকে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই চলে না। এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার অধিকারের চাইতে বেশি কিছু নেই, থাকা উচিতও না।” (এস জি শানমিয়ানকে লেখা চিঠি, খণ্ড ১৯)

লেনিন এবং রোজা দুই জনেই মার্কসবাদী হওয়ায় এই প্রশ্নে একমত ছিলেন যে, কোনো পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলি কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট সমগ্র দেশটির কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বারাই আলোচিত হবে, আলাদা আলাদা অঞ্চলগুলির স্বয়ং-শাসিত সংস্থাগুলির দ্বারা নয়। লেনিন বললেন “মার্কসবাদীরা কখনই কোনো অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা বিকেন্দ্রীকরণের ওকালতি করবে না। বিশাল কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় অনৈক্য থেকে ভবিষ্যতের সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পথে একটি বিরাট ঐতিহাসিক পদক্ষেপ এবং কেবলমাত্র এই রকম একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমেই (অবিচ্ছেদ্যভাবে পুঁজিবাদের সাথে যা সংযুক্ত) সমাজতন্ত্রের পথ গড়ে উঠতে পারে।” (জাতীয় প্রশ্নে সমালোচনামূলক মতবাদ, খণ্ড ২০)

লেনিন জোরের সাথেই বললেন যে মার্কসবাদীরা যখন কেন্দ্রীকতার ওকালতি করেন তখন তারা একান্তভাবেই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ওকালতিই করেন। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা এটা দাবি করে যে প্রত্যেকটি আঞ্চল যাদের স্পষ্টতই পৃথক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য, নির্দিষ্ট জাতীয় গঠনযুক্ত একটি জনগোষ্ঠী ইত্যাদি হয়েছে তাদের জন্য স্বায়ত্তশাসন যুক্ত একটি স্ব-শাসিত সরকার থাকবে।

শানমিয়ানের কাছে লেখা একটি চিঠিতে (খণ্ড ১৯) লেনিন লিখলেন “স্বায়ত্ত-শাসনের অধিকার? আবার একটি ভুল। আমরা সমস্ত অংশের জন্য স্বায়ত্ত-শাসনের পক্ষে; আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের পক্ষে (কিন্তু প্রত্যেকেরই বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে নয়)। স্বায়ত্ত-শাসন হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের পরিকল্পনা। বিচ্ছিন্নতা আদৌ আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে পড়ে না। আমরা বিচ্ছিন্নতার ওকালতি করি না। সাধারণভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে।” লেনিনের মতে “কেন্দ্রীকতার নীতি যা পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষে অবশ্য প্রয়োজনীয় তা এই (স্থানীয় এবং আঞ্চলিক) স্বায়ত্ত-শাসনের দ্বারা লঙ্ঘিত হয় না, বরঞ্চ উল্টে এটি আমলাতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ না হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে হয়। এই ধরনের স্বায়ত্ত-শাসনের অভাবে পুঁজিবাদের অবাধ, মুক্ত এবং দ্রুত বিকাশ অসম্ভব হয় কিংবা অন্তত বড় রকমের বাধাপ্রাপ্ত হয়; কেননা এই স্বায়ত্ত-শাসন পুঁজির কেন্দ্রীকরণ, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, দেশব্যাপী বুর্জোয়াশ্রেণীর এবং সর্বহারার নিজ নিজ ঐক্য সহজ করে তোলে। আর একেবারেই স্থানীয় (আঞ্চলিক, জাতীয় এবং অন্যান্য) প্রশ্নে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক বিষয়গুলিতে কেন্দ্রীকতার ক্ষেত্রে অন্যতম বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করে।” (জাতীয় প্রশ্নে সমালোচনামূলক মতামত, খণ্ড ২০)

এই সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে লেনিন রোজাকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন তাঁর এই গোঁড়ামির জন্য যে স্বায়ত্ত-শাসনের দাবি কেবলমাত্র পোল্যান্ডের জন্যই প্রযুক্ত হতে পারে এবং তাও কেবলমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে। তিনি প্রশ্ন রাখলেন, “শুধুমাত্র পাঁচলাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত নয়, এমনকি পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত জাতীয় অঞ্চলগুলি কেন স্বায়ত্ত-শাসন ভোগ করতে পারে না, কেন সেই এলাকাগুলি অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক কিংবা প্রয়োজনীয় হলে ভিন্ন মাত্রাযুক্ত পাশাপাশি এলাকার সাথে বহু বিচিত্র পদ্ধতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি একক স্বায়ত্ত-শাসিত ‘অঞ্চল’ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে না?” (ঐ)

৩। ১৯০৩ সালে আরএসডিএলপি-র দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর একদিকে যেমন পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হল অন্যদিকে তেমনি পার্টি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (বলশেভিক) এবং ‘সংখ্যালঘিষ্ঠ’ (মেনশেভিক) দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কংগ্রেসের ঠিক পরে পরেই যে নীতির প্রশ্নে এই বিভাজন তা কিন্তু কো-অপশনকে ঘিরে বিবাদের ফলে অস্পষ্ট হয়ে গেল। তিন জন প্রাক্তন সম্পাদককে পুনরায় কো-অপট করা না হলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করতে অস্বীকার করল। দু-মাস স্থায়ী এই লড়াই-এ সংখ্যালঘিষ্ঠরা বয়কটের আশ্রয় নিল এবং পার্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হল। এমনকি তারা পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ইসক্রায় তাদের মতামত প্রকাশ করার জন্য লেনিন ও প্লেখানভের দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং কেন্দ্রীয় সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক, আমলাতান্ত্রিক, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বলে ব্যক্তিগত অপমান এবং গালাগালের আশ্রয় নিল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত উদ্যোগ দমিয়ে রাখা, দাসসুলভ বশ্যতা ও অন্ধ আনুগত্য চালু করা ইত্যাদি অভিযোগ আনল। প্লেখানভ যদিও সংখ্যালঘিষ্ঠের নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণকে নিন্দা করলেন তথাপি তিনি কী করা উচিত নয় বলে একটি লেখায় একথা বললেন যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মানে আবশ্যিকভাবে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। তিনি আরও বললেন যে রুশ বিপ্লবীদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত যে নৈরাজ্যবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বিরাজ করছে তার বিরুদ্ধে লড়াইটি সবসময়ই চালানো উচিত নয় বরং মাঝে মাঝে কিছু ছাড় দিলে এটাকে দমন করা যায় এবং ভাঙ্গনও এড়িয়ে যাওয়া যায়। লেনিন প্লেখানভের এই মতের ভাগীদার হতে পারেননি এবং সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদত্যাগ করলেন। সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্পাদকদের কো-অপট করা হল। লেনিন প্রস্তাব দিলেন যে সংখ্যালঘিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় মুখপত্রের দায়িত্বে থাকুন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকুন এবং এই ভিত্তিতে শান্তি স্থাপিত হোক – কিন্তু এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল। সংখ্যালঘিষ্ঠরা আমলাতন্ত্র, অতি-কেন্দ্রীকতা, আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ‘নীতিনিষ্ঠ’ সংগ্রামের নামে তাদের সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে লেনিন তার বিখ্যাত বই এককদম আগে দুকদম পিছে লিখলেন এবং কংগ্রেসের বিতর্কগুলি বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে এই বিভাজন পার্টিতে সর্বহারা বিপ্লবী ও বুদ্ধিজীবী-সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যকার পুরোনো বিভাজনেরই একটি রকমফের মাত্র।

রোজা লুক্সেমবার্গের সহানুভুতি সম্পূর্ণভাবে মেনশেভিকদের দিকেই ছিল এবং লেনিনের বই-এর সমালোচনা করলেন এই বলে যে এটি ‘অসহিষ্ণু কেন্দ্রীকতা’-র দৃষ্টিকোণের একটি স্পষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিব্যক্তি। রোজা মনে করতেন যে ঐক্যবদ্ধ পার্টির প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে রাশিয়ার সমাজগণতন্ত্রীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই এবং সমগ্র বিতর্কটি চলছে কেন্দ্রীকতার মাত্রার প্রশ্নটি ঘিরেই। তিনি লেনিনকে ‘অতি-কেন্দ্রীকতার’ প্রবক্তা হিসাবে নিন্দা করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন যে কেন্দ্রীকরণকে ঘটাতে হবে ধীরে ধীরে।

রোজা লুক্সেমবার্গের প্রতি উত্তরে লেনিন দেখালেন যে রুশ পার্টিতে বিতর্ক চলছে “কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় মুখপত্র পার্টি কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করবে কী করবে না এই নীতিগত প্রশ্নে। কমরেড কি এটা স্বাভাবিক মনে করেন যে পার্টির এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে যারা সংখ্যালঘিষ্ঠ তাদের প্রাধান্য থাকবে? তিনি কি কখনও কোনো পার্টিতে এটি দেখেছেন?” (খণ্ড ৭)

“একটি বৃহৎ এবং চরম কেন্দ্রীভূত পার্টি গড়ার শর্তগুলিই রাশিয়ায় ইতিমধ্যেই বর্তমান – এই চিন্তার জনক বলে কমরেড লুক্সেমবার্গ আমাকে অভিযুক্ত করেছেন। আমার বই-এর কোথাও আমি এই ধরনের মতামত রাখিনি, প্রবক্তা হওয়া তো দূরের কথা। আমি যে তত্ত্ব পেশ করেছি তাতে অন্য কিছু বলা হয়েছে। আমি দৃঢ়তার সাথে একথা বলেছিলাম যে পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তগুলি পালন করা হবে এটি আশা করার শর্তগুলি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান এবং বলেছিলাম যে সেই সময়ও অতীত হয়ে গেছে যখন ব্যক্তিগত চক্র দিয়ে পার্টি প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে রাখা যেতে পারত। আমি প্রমাণ উপস্থিত করেছিলাম যে আমাদের পার্টিতে বেশ কিছু পুঁথিবিদ নিজেদেরকে অদৃঢ় ও অস্থায়ী হিসাবে প্রমাণ করেছে এবং নিজেদের শৃঙ্খলাবোধের অভাবের দায়িত্বটি রুশ সর্বহারার উপর চাপানোর কোনো অধিকার তাদের নেই। রুশ শ্রমিকশ্রেণী ইতিপূর্বে বারবার এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত পালনের জন্য সোচ্চার হয়েছেন।” (ঐ)

লেনিন রোজার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে তিনি আরএসডিএলপি-র অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের নির্দিষ্ট তথ্যগুলিকে উপেক্ষা করছেন, বিমূর্ততায় ভুগছেন এবং এইভাবে মার্কসীয় দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে বিকৃত করছেন।

পরবর্তীকালে অবশ্য রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল কাউটস্কি দুজনকেই বলশেভিকদের মতের স্বপক্ষে জয় করে আনা গিয়েছিল। ১৯০৯ সালে লেনিন বললেন “তাদের জয় করে আনা গিয়েছিল কারণ বলশেভিকরা তাদের নিজেদের মতামত, নিশ্চিতভাবেই তাদের নিজেদের উপদলীয় তত্ত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেননি বরং ঊর্ধে তুলে ধরেছিলেন বিপ্লবী সমাজগণতান্ত্রিক কৌশলে সাধারণ জীবনশক্তি এবং অর্থকে।” (অটজোভিজম ও ঈশ্বর নির্মাণের সমর্থকদের উপদল, খণ্ড ১৬)

৪। রুশ দেশের ১৯০৫-এর বিপ্লব সোভিয়েত ক্ষমতা এবং সর্বহারার একনায়কত্বের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সামনে নিয়ে এল। মেনশেভিকদের বিপরীতে, রোজা তৎক্ষণাৎই এর তাৎপর্য অনুধাবন করলেন এবং সমস্ত সভাগুলিতে ও সংবাদপত্রে এর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণও রাখেন।

৫। ১৯১৩ সালে রোজা এবং লেনিন আবার বিলোপপন্থীদের প্রতি মনোভাবের প্রশ্নে আলাদা হয়ে গেলেন।

রোজা মনে করতেন যে রুশ পার্টিতে যা চলছিল তা উপদলীয় কোন্দল-জনিত বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাঙ্গন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে সক্রিয় বলে তিনি লেনিনবাদী গোষ্ঠীটিকে দোষারোপ করলেন। রোজা মনে করতেন যে রুশ পার্টিতে এই মতপার্থক্য যৌথ কার্যক্রমের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয় না এবং চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্য পুনরুদ্ধার সম্ভব। তিনি আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরোর কাছে ১৯১৩ সালে অনুরূপ একটি প্রস্তাব পেশ করলেন।

লেনিন তীব্রভাবে এই মতের বিরোধিতা করেন এবং আবারও জোর দিয়ে বলেন যে রুশ পার্টিতে য়া হচ্ছে তা কোনো মতেই উপদলীয় কোন্দলজাত বিশৃঙ্খলা নয়, বরং এটি বিলোপপন্থীদের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। লেনিন দাবি করলেন যে কেবলমাত্র এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণীর প্রকৃত একটি সমাজগণতান্ত্রিক পার্টি গড়ে উঠছে এবং ইতিমধ্যেই শ্রেণী-সচেতন শ্রমিকশ্রেণীর একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ – পাঁচভাগের চারভাগকে পার্টি-অবস্থানের পক্ষে জয় করে আনা গিয়েছে।

ব্রাসেল সম্মেলনে পেশ করা তাঁর রিপোর্টে লেনিন ১৯০৮ সালের পার্টি প্রস্তাব থেকে উদ্ধৃতি দেন যেখানে বিলোপবাদের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে “এটি হল পার্টির কিছু বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা আরএসডিএলপি-র বর্তমান সংগঠনকে বিলোপ ঘটানোর প্রচেষ্টা এবং এর পরিবর্তে এমন এক অবয়বহীন সংগঠন দাঁড় করানো যা যেকোনো মূল্যে, এমনকি পার্টির কর্মসূচি, কৌশল এবং ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে পরিত্যাগ করার মূল্যেও আইনি চৌহদ্দির মধ্যে কাজ করবে।” (খণ্ড ২০)

লেনিন আরও বললেন, “পার্টি সদস্যের পরিচিতি বহন করা অথচ পার্টি ভেঙ্গে দেওয়ার ওকালতি করা, পার্টিকে কোনো কাজের নয় ও অপ্রয়োজনীয় বলা এবং তার জায়গায় অন্য পার্টিকে নিয়ে আসা – এমন বিষয় অনুমোদনযোগ্য কিনা, পশ্চিম ইউরোপে কোথাও কখনও এ প্রশ্ন ওঠেনি এবং উঠতে পারে না। পশ্চিম ইউরোপের কোথাও খোদ পার্টির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই যেমনটি আমাদের মধ্যে আছে অর্থাৎ পার্টি থাকবে কি থাকবে না।

“এটি পার্টি কীভাবে গড়ে উঠবে সেই সংগঠন সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো মতানৈক্য নয় বরং, পার্টির খোদ অস্তিত্ব নিয়েই মতপার্থক্য। এখানে সমঝোতা, চুক্তি বা আপোষের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”

৬। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এবং জার্মান সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী কাউটস্কিপন্থীরা সামাজিক উগ্র জাতিদম্ভী অবস্থান গ্রহণ করল এবং এই লুঠেরা যুদ্ধে নিজ নিজে দেশের বুর্জোয়াদের সমর্থনের জন্য ওকালতি করল। রোজা লুক্সেমবার্গ দৃঢ়তার সাথে এই লাইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং জার্মান সমাজগণতন্ত্রকে ‘দুর্গন্ধময় শব’ বলে অভিহিত করলেন।

যখন রুশ দেশে মেনশেভিকরা কেরেনস্কির আক্রমণকে অনুমোদন করল তখন রুশ বিপ্লবের আন্তর্জাতিক মর্মবস্তুকে লঘু করে দেওয়ার জন্য রোজা তীব্রভাবে তাদের নিন্দা করলেন।

লেনিন রোজাকে একজন মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ভাঙ্গনের পরে নতুন আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করেছিলেন।

৭। ১৯১৭ সালে যখন বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করলেন, সেই নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে রোজার কিছুটা আশঙ্কা ছিল। ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে, যাকে তিনি অগণতান্ত্রিক হিসাবে মনে করেছিলেন, এবং কেন্দ্রীকতার উপর অত্যধিক জোর দেওয়ার লেনিনীয় পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর কিছু আপত্তি ছিল। রোজা মনে করতেন যে, এই পদ্ধতি নীচেরতলা থেকে শ্রমিকশ্রেণীর উদ্যোগকে রুদ্ধ করে দেবে এবং আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির জন্ম দেবে। তাঁর এই মতামত ১৯১৮ সালে কারাগারে লেখা পাণ্ডুলিপিতে আছে।

অবশ্য ক্লারা জেটকিন যিনি রোজাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, বলেছিলেন যে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রোজা লুক্সেমবার্গ বুঝেছিলেন যে, তাঁর মতামতগুলি ভুল ছিল এবং সেগুলি যথেষ্ট তথ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি।

৮। রোজা লুক্সমেবার্গ এবং কার্ল লিবনেখট জার্মানির সমাজগণতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনর্গঠিত করেছিলেন এবং জার্মানিতে ১৯১৮ সালের নভেম্বর বিপ্লবের সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন।

১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি সমাজগণতন্ত্রী সরকারের দ্বারা মদতপুষ্ট হয়ে শ্বেতরক্ষীরা ঠাণ্ডা মাথায় রোজা ও কার্লকে হত্যা করে।

এই হত্যাকাণ্ডের পরে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে লেনিন নীচের এই বক্তৃতাটি রাখেন –

“আজ বুর্জোয়ারা এবং সমাজের বিশ্বাসঘাতকরা বার্লিনে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। তারা আজ কার্ল লিবনেখট ও রোজা লুক্সেমবার্গকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। চার বছর ধরে যে এলবার্ট এবং সাইডেম্যান শ্রমিক শ্রেণীকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বধ্যভূমির দিকে পরিচালিত করেছে তারা এখন সর্বহারার নেতাদের হত্যা করতে কসাইয়ের ভূমিকা নিয়েছে। জার্মান বিপ্লবের উদাহরণ একথা প্রমাণ করল গণতন্ত্র হল বুর্জোয়া-লুণ্ঠনের জন্য এবং সবচেয়ে বিধ্বংসী হিংসার জন্য একটি ছদ্মবেশ মাত্র। কসাইরা নিপাত যাক।”

১৯২২-এ যখন জার্মান মেনশেভিক পল লেভি বিশেষ করে যে সমস্ত লেখাগুলিতে রোজা লুক্সেমবার্গ লেনিনের সাথে তার মতপার্থক্যগুলি রেখেছিলেন সেগুলি আবার প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন তখনই লেনিন এই মন্তব্য করেন যে পল লেভির আসল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াদের এবং দ্বিতীয় ও আড়াই আন্তর্জাতিকের নেতাদের নেকনজরে পড়া।

লেনিন লিখলেন, “আমরা একটি রুশ উপকথার দুটি লাইন উদ্ধৃত করে এর জবাব দেব। ‘ঈগল কখনও কখনও মুরগীর চেয়ে নীচে দিয়ে উড়তে পারে, কিন্তু মুরগী কখনোই ঈগলের উচ্চতায় উড়তে পারে না’। রোজা লুক্সেমবার্গ পোল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল করেছিলেন; ১৯০৩ সালে মেনশেভিকবাদের মূল্যায়নে তিনি ভুল করেছিলেন; পুঁজির সঞ্চয় সংক্রান্ত তত্ত্বে তিনি ভুল করেছিলেন; ১৯১৪-র জুলাইতে তিনি প্লেখানভ, ভাণ্ডারভেল্ড, কাউটস্কি এবং অন্যান্যদের সাথে মিলে বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে ঐক্যের ওকালতি করে ভুল করেছিলেন। তিনি ১৯১৮-তে কারাগারে যা লিখেছিলেন তাতেও ভুল করেছিলেন (১৯১৮-র শেষে এবং ১৯১৯-এর প্রথমে যখন তিনি ছাড়া পান সেই সময় বেশিরভাগ ভুলগুলি শুধরে নিয়েছিলেন)। কিন্তু এসব ভুল সত্ত্বেও তিনি আমাদের কাছে একজন ঈগল ছিলেন এবং এখনও আছেন। আমরা কমিউনিস্টরা সারা দুনিয়া জুড়ে কেবল তার স্মৃতিকে স্মরণ করছি না, তাঁর জীবনী এবং সম্পূর্ণ রচনাবলী সারা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্ট প্রজন্মের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্য হিসাবে থাকবে। ‘১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে জার্মানির সমাজগণতন্ত্র একটি ‘দুর্গন্ধময় শব’-এ পরিণত হয়েছে’ – এই উক্তি রোজা লুক্সেমবার্গকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে বিখ্যাত করে রাখবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক আন্দোলনের পশ্চাদভূমিতে ছাইগাদায় পল লেভি, সাইডম্যান, কাউটস্কির মতো মুরগীরা এবং এদের সাঙ্গাতরা এই মহান কমিউনিস্টের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকবে।” (একজন প্রচারকের নোট, খণ্ড ৩৩)

এটাই রোজা লুক্সেমবার্গের প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ এবং এতেই সব কথা বলা হয়েছে।

(১৯৯৬-এর অক্টোবর মাসে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণ)

স্কুল শেষ হওয়ার মুখে। যদিও স্কুলে আমরা পার্টির নীতি নির্ধারণ করি না, তবুও সেগুলি সূত্রায়নের ক্ষেত্রে এই সমস্ত আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সেই দিক থেকে দেখলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে উত্থাপিত ও আলোচিত হয়েছে। ১৯৯৪-এর পার্টি স্কুলে ‘মার্কসবাদের সংকট’ প্রসঙ্গে আমি কিছু ধারণা প্রকাশ করেছিলাম এবং সে প্রসঙ্গেই আরও কিছু কথা বলতে চাই।

তার প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে মার্কসবাদকে এমন দুই অথবা তিনটি সংকটের পর্যায় পার হতে হয়েছে যেখানে তার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন হাজির করা হয়েছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই মার্কসবাদ সে সব কিছুকে কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছে। আজ বিংশ শতাব্দীর একেবারে অন্তিমলগ্নে তাকে আর একবার মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের সংকট সত্যিই খুব গভীর হয়েছে কারণ তার সঙ্গে যুক্ত প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক দেশ, লেনিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সোভিয়েত মডেল মার্কসবাদের সত্যিকারের মূর্তরূপ বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছে আর সে কারণেই তার পতন পুরোনো বিতর্কগুলিকে আর একবার সামনে হাজির করে দিয়েছে। বিকল্প হিসাবে দাবি জানাত যে চীনা মডেল তাও নানা কারণেই অনেকাংশে তার জৌলুষ হারিয়েছে আর অবশিষ্ট ছোটোখাটো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিও তেমন আস্থা জাগাতে পারছে না।

এখন প্রথম যে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত তা হল, পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বসমূহকে বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াতেই মার্কসবাদ উদ্ভূত হয়েছে এবং একমাত্র মার্কসবাদই পুঁজিবাদের সর্বাঙ্গীন সুগভীর সমালোচনাকে উপস্থাপিত করেছে। শ্রেণীসংগ্রামের এক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদ শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজে অবশ্যই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তা পুঁজিবাদী দুনিয়ার রূপান্তর ঘটানোর জন্য এবং সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে ঘিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে পথ নির্দেশক মতাদর্শ হিসাবেই বিরাজ করবে। একটি বিশেষ অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাস্তবিকই একটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তিকে সূচিত করে কিন্তু একই সাথে প্রতিটি সমাপ্তিই নতুন এক সূচনারও প্রতীক হয়ে ওঠে, আর এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই মার্কসবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ। সেই সঙ্গে আমাদের বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও পরিবর্তন ঘটানোর হাতিয়াগুলিকেও আমরা আরও শাণিত করব।

এই স্কুলে বিশেষত উত্তর আধুনিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু আলোচনা হয়েছে। উত্তর-আধুনিকতা নিছক মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেনি, বরং তা আধুনিকতার সমগ্র যুগকেই প্রত্যাখ্যান করে – যে যুগের উদ্ভব ঘটেছিল বুর্জোয়া ও সর্বহারা, এই দুই আধুনিক শ্রেণীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। আলোকপ্রাপ্তির (Enlightenment) সমগ্র যুগকেই তা খারিজ করে দেয়, খারিজ করে মানব মুক্তির সমস্ত বৃহৎ মতবাদকেই। এই সমস্ত মতবাদকে মস্ত মস্ত আখ্যান বলে তা চিহ্নিত করে থাকে, যেগুলি সমাজকে তাদের পূর্ব-নির্ধারিত লক্ষ্যে চালিত করবার প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে অবশেষে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় পর্যবসিত হয়। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ, জনগোষ্ঠী ইত্যাদি ‘কল্পিত সম্প্রদায়কে’ অতিক্রম করে – এমন কোনো শ্রেণীগত বা মানসিক সংহতির অস্তিত্বকে মেনে নিতে অস্বীকার করে।

এখানে আমাদের আলোচনার সময়ে আমরা সাম্প্রতিককালের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলিকে নিয়েও চর্চা করেছি। কিছু কিছু কমরেডের এগুলিকে বুঝতে ভালোই অসুবিধে হয়েছে। হয়তো খুব বিস্তৃতভাবে না জানলেও চলবে, তবুও মার্কসবাদী হিসেবে সাম্প্রতিকতম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলির গতিবিধি সম্পর্কে আপনাদের অবহিত থাকা প্রয়োজন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী পরমাণু থেকেও ক্ষুদ্রতর কণার (sub-atomic) স্তরে বস্তু আর সাধারণ বলবিদ্যার নিয়ম অনুসরণ করে না এমনকি এই স্তরে তার অস্তিত্বের রূপটিও হয়ে দাঁড়ায় এক ধাঁধার মতো। তার অবস্থান, ভরবেগ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহকে নিরূপণ করাটা কেবল বেশ অনিশ্চিতই নয়, তা এমনকি পর্যবেক্ষণ-ক্রিয়ার প্রভাবে পাল্টে যেতে পারে।

এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির এক ধরনের দার্শনিক ব্যাখ্যা আজকাল পশ্চিমী দুনিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী বস্তুবাদের মূল ভিত্তি অর্থাৎ বস্তুর অস্তিত্ব বা বস্তুজগৎ যে মনের ইচ্ছা নিরপেক্ষ – সে সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলা হয়।  ‘কার্যকরী বাস্তবতার’ (virtual reality) তত্ত্বে বলীয়ান হয়ে পশ্চিমী দুনিয়া প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদ সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে – যে মতবাদ অনুসারে বস্তুজগতকে মায়া অথবা বিভ্রম হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যুগে চার্চের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল আর বিজ্ঞানের অগ্রগতি তথাকথিত দৈব বিধানগুলিকে মোক্ষম আঘাত হেনেছিল। অন্ধকারের যুগ থেকে যখন ইউরোপ জেগে উঠল ও আলোকপ্রাপ্তির যুগের সূচনা হল তখন ২০০০ বছরের প্রাচীন গ্রীক দর্শনের পুনরুদ্ধার ঘটল। গ্রীক দার্শনিকদের দ্বন্দ্বতত্ত্ব আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হেগেল কর্তৃক সমৃদ্ধ হল এবং পরবর্তীকালে মার্কস তাকে বস্তুবাদী ভিত্তির উপর স্থাপন করলেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আবার কিছু মানুষকে প্রাচীনকালের মধ্যে তার দার্শনিক শিকড় খুঁজতে উৎসাহ দিল আর মজার ব্যাপার এই যে তাঁরা প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে পেলেন। স্কুলে আমরা দর্শনের ক্ষেত্রে নয়া-ভাববাদী আক্রমণ ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উত্তর-আধুনিকতার মধ্যকার সম্পর্কগুলিকে খোঁজার চেষ্টা করেছি।

কয়েকজন কমরেড বলেছেন যে ‘নতুন সামাজিক আন্দোলনগুলি’ বা আরও সাধারণ পরিভাষায় বলতে গেলে আংশিক বিষয়গুলিকে নিয়ে আন্দোলন উত্তর-আধুনিকতার উদ্ভবের আগেও বিদ্যমান ছিল। কথাটা ঠিকই। বস্তুতপক্ষে উত্তর আধুনিকতার গুরুত্ব এখানেই যে তা এই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে নতুন অর্থ ও নতুন ভিত্তি সরবরাহ করেছে। উত্তর আধুনিকতা এই সমস্ত আন্দোলনের সায়ত্ততাকে একটা শর্তহীন বা চরম ব্যাপার হিসাবে দেখিয়েছে। তাকে এটা করতে হয়েছে কারণ পুঁজিবাদকে একটা ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্লেষণ করাটাকে নিরর্থক প্রমাণ করাই হল উত্তর আধুনিকতার প্রধান দায়।

মার্কসবাদের প্রথম সংকট

বর্তমান পর্যায়ের ‘মার্কসবাদের সংকট’ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে সংকটের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলির দিকে দৃষ্টিপাত করাটা নিশ্চয় অসঙ্গত হবে না। ১৯ শতকের শেষ আর ২০ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে মার্কসবাদ প্রথম যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল এবং যখন সংশোধনবাদের জন্ম হয়েছিল আমি সেই সময়কার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

১৯ শতকের একেবারে শেষ দিকে পুঁজিবাদ এক তীব্র সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকটের চরিত্র ছিল ধ্রুপদী ধরনের কারণ এই সংকটের প্রতিটি লক্ষণ মার্কসবাদী বীক্ষণের সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে গিয়েছিল। এই সময়কালে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন এবং সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিগুলির (ঐ সময় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এই নামেই অভিহিত হত) বিকাশও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে জার্মানিতে পার্টি দ্রুত অগ্রগতি ঘটায়।

সংকট দীর্ঘায়িত হয় এবং পুঁজিবাদ ক্রমে ক্রমে তা কাটিয়ে ওঠে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সে তার আমূল রূপান্তর ঘটায়। আগে ছিল মুক্ত পুঁজিবাদ যার মূলকথা ছিল অবাধ প্রতিযোগিতা। এর ফল হিসাবে উৎপাদনে নৈরাজ্য দেখা গিয়েছিল। এবার পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হল এবং কার্টেল, ট্রাস্ট ইত্যাদি যা মার্কসের জীবদ্দশায় ছিল নিতান্ত প্রারম্ভিক স্তরে – তা এখন নির্ণায়ক বিধি হয়ে দাঁড়াল। পুঁজিবাদ একটা স্থায়িত্ব লাভ করল, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেল ও সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশলাভ করল। পুঁজিবাদের আসন্ন পতন সম্পর্কে মার্কসবাদীদের আগেকার উচ্ছ্বাস নৈরাশ্যে পরিণত হল। মার্কস সমেত মার্কসবাদীরা পুঁজিবাদী সংকটের প্রতিটি পর্যায়ে অতিরিক্ত আশাবাদ পোষণ করতেন। এটা খুবই স্বাভাবিক এবং ইতিহাসের রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে এর এক গতিময় ভূমিকাও রয়েছে। কিন্তু এক সুগভীর বৈজ্ঞানিক চিন্তন প্রক্রিয়া হিসাবে মার্কসবাদ পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক প্রবণতাকেই কেবলমাত্র চিহ্নিত করেছে। সমাজতন্ত্র বা নৈতিক সমাজের অন্যান্য কাল্পনিক তত্ত্বের বিপরীতে মার্কসবাদ কখনই মনগড়া সমাজতন্ত্রের কোনো মহাপ্রকল্প থেকে শুরু করে না বা এই ধরনের মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সমাজকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করে না।

মার্কসবাদ বরং একথাই বলে যে পুঁজিবাদ তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের গতির ফলেই সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলে কারণ তার ভিতরের দ্বন্দ্বগুলির চূড়ান্ত মীমাংসা হয় একমাত্র সমাজতন্ত্রেই। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটার বস্তুগত শর্তগুলিও – যথা বৃহদায়তন উৎপাদনের ঘনীভূত রূপ, সর্বহারা শ্রেণী ইত্যাদি – পুঁজিবাদ জন্ম দিয়ে থাকে। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে সমাজ আপনা থেকেই, কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণ ঘটাবে। এ কারণেই মার্কস বিখ্যাত সেই মন্তব্যটি করেছিলেন, “প্রশ্ন হল দুনিয়াকে পাল্টানোর”।

মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস প্রভূত কর্তৃত্বের অধিকারী হন। দুই জার্মান কমিউনিস্ট – বার্ণাস্টাইন ও কাউটস্কি তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর শেষ কয়েকটি রচনায় এঙ্গেলস কিছু আত্মসমালোচনা করেন। ১৮৯৫-এর মার্চে, তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে, এঙ্গেলস লেখেন, “ইতিহাস আমাদের এবং আমাদেরই মতো যারা যারা ভাবতেন – প্রত্যেককেই ভুল প্রমাণিত করেছে। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সে সময় মহাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের স্তর অনেকাংশেই পুঁজিবাদী উৎপাদনকে উচ্ছেদের জন্য পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি; ১৮৪৮ সাল থেকে যে অর্থনৈতিক বিপ্লবের শুরু – যা গোটা মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল ... এবং জার্মানিকে নিশ্চিতভাবেই এক প্রথম সারির শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছে – তা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়”। ... “সে সময় আমরা য়ে ভুল ধারণা পোষণ করতাম তা ইতিহাস যে ভেঙ্গে দিয়েছে শুধু তাই নয়, সর্বহারাকে যে পরিস্থিতিতে সংগ্রাম চালাতে হয় তাকেও পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ১৮৪৮-এর সংগ্রামের পদ্ধতিগুলি আজ সবদিক থেকেই অচল আর এটাই হল সেই বিষয় যা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের নিবিড় পরীক্ষার দাবি রাখে”।

এঙ্গেলসের মত অনুযায়ী, আধুনিক সেনাবাহিনীর আয়তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাস্তার লড়াই, অতর্কিত আক্রমণ ইত্যাদি পুরোনো রণকৌশলগুলি সেকেল হয়ে গেছে। জার্মান পার্টির সংসদীয় নির্বাচনে অর্জিত সাফল্যের পরিসংখ্যানকে উদ্ধৃত করে তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারের সুযোগকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগানোর উপর জোর দেন। এঙ্গেলস এই বলে শেষ করেন, “বিশ্ব ইতিহাসের পরিহাস সব কিছুকেই উল্টে দিয়েছে। আমরা ‘বিপ্লববাদীরা’, ‘উৎখাতকারীরা’ যত না বে-আইনি কাজ ও উচ্ছেদের কাজে সফল হয়েছি তার থেকে অনেক বেশি সাফল্য পাচ্ছি আইনি ধারায়। যারা নিজেদের নিয়মশৃঙ্খলার পার্টি বলে থাকে তারাই তাদের নিজেদের সৃষ্টি আইনি বিধানগুলিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে ... অন্যদিকে আমরা এই আইনি ব্যবস্থায় হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছি। আমাদের চেহারা চকচকে হচ্ছে ও মনে হচ্ছে যেন শাশ্বত জীবন লাভ করছি।”

ইউরোপের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে এঙ্গেলস রণকৌশল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। একই পটভূমি থেকে শুরু করে বার্ণস্টাইন কিন্তু খোদ রণনীতিটাকেই সংশোধনের পরামর্শ দেন এবং এ কারণে তাঁকে সংশোধনবাদের জনক বলাটা খুবই সঠিক।

বার্ণস্টাইনের যুক্তি হল এই যে মার্কসের ভবিষ্যৎবাণীর বিপরীতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন এগিয়েছে খুবই ধীর গতিতে। তার থেকেও বড় কথা হল, বৃহদায়তন উৎপাদনের দ্বারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলি উৎখাত হয়ে যায়নি। সর্বোপরি, কার্টেল ও ট্রাস্টসমূহ গঠনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে এবং এভাবেই তীব্র সংকটকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছেন যে দুই চরম শ্রেণীতে সমাজের মেরুকরণ ঘটাটা বাস্তবায়িত হয়নি এবং মধ্যস্তরটা নিঃশেষিত হয়ে যায়নি তো বটেই বরং পুঁজিপতি, সম্পত্তির মালিক ও অংশীদারদের সংখ্যাই উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাঁর মতে, আধুনিক জাতিগুলির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গণতান্ত্রিকীকরণ ঘটেছে – ফলে পুঁজির শোষণমূলক প্রবণতাগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে সব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাধান্যলাভ করেছে সে সব দেশে রাষ্ট্র আর শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসাবে গণ্য হতে পারে না। তাই বার্ণস্টাইনের যুক্তি হল শ্রমিকদের আর বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য উদ্যোগী হওয়া উচিত নয় বরং তাদের রাষ্ট্রের সংস্কার সাধনের উপর জোর দেওয়া উচিত।

১৮৯৫ সালে, ফ্রান্সে শ্রেণী সংগ্রাম গ্রন্থের মুখবন্ধে এঙ্গেলস (সেই) শতাব্দীর শেষে পুঁজিবাদের দ্রুত এক অবনতির আশা ব্যক্ত করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, পুঁজিবাদ তার ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য যে আইনি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তাকে শ্রমিকশ্রেণী সাফল্যের সঙ্গে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।

তার ঠিক এক বছর পরে, ১৮৯৬ সালে বার্ণস্টাইন চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্বন্ধেই সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং কেবল ‘দৈনন্দিন আন্দোলনের’ মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন। মার্কস তাঁর পুঁজি গ্রন্থে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং এঙ্গেলস কার্টেল এবং ট্রাস্ট প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। কার্টেলগুলি এক উচ্চস্তরে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের নিশ্চিত সাক্ষ্য স্বরূপ এবং পুঁজিবাদের বুনিয়াদী নীতি হিসাবে অবাধ প্রতিযোগিতার ‘দেউলিয়াপনা’কে প্রমাণ করে। বার্ণস্টাইন যাকে পুঁজির বিকেন্দ্রীভবন, স্বয়ং-নিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ বলে মনে করেছিলেন তা সর্বোচ্চ পর্যায়ের একচেটিয়া ব্যবস্থা হিসাবে দেখা দেয়, ‘মালিকানা’ এবং ‘পরিচালন ব্যবস্থা’ পৃথক হওয়ার মধ্য দিয়ে পরজীবী বুর্জোয়াদের একটি গোটা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে যারা ফাটকাবাজির মধ্য দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে; এক আগ্রাসী ঔপনিবেশিক নীতির জন্ম হয় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যা ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিঘটনা সৃষ্টি করে। লেনিন এই সমস্ত বিষয়গুলিকে তাঁর সাম্রাজ্যবাদ – পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। ছোটো এবং মাঝারি পুঁজিকে গ্রাস করাটাও হয়ে দাঁড়ায় নিয়মিত ঘটনা। বৃহৎ পুঁজি এগুলিকে সহায়ক শিল্পে পর্যবসিত করে। নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং নতুন নতুন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার আবার সমৃদ্ধি ঘটতে থাকলে যথাসময়ে বৃহৎ পুঁজি সেখানেও হাত বাড়ায়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে বলা যায়, এটাকে নেহাতই শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতারণা করার জন্য, তাদের ফাঁদে ফেলার জন্য একটা ভাঁওতাবাজি বলে দেখাটা হবে নিতান্ত সরলীকরণ। এটা সে ধরনেরই নির্বোধ ধারণা যেখানে মনে করা হয় ধর্ম হল জনগণকে ঠকাবার জন্য পুরোহিতদের চক্রান্ত মাত্র। মানব সভ্যতার অন্যান্য পর্যায়ে কোনো সংসদের অস্তিত্ব ছিল না। শাসনের এই রূপটি কেবল পুঁজিবাদের সময়কালেই উদ্ভব হয় এবং এইভাবে তা বুর্জোয়া শাসনের নির্দিষ্ট রূপ হিসাবে দেখা দেয়। সামন্ততন্ত্রের যুগে শোষণ অর্থনীতি-বহির্ভূত বলপ্রয়োগের রূপ পরিগ্রহ করত এবং তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজনৈতিক উপরিকাঠামোতেও রাজা এবং সামন্ত অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হত। ধনতন্ত্রে শোষণ চলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই উদ্বৃত্ত মূল্যের রূপে। রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসাবে সংসদীয় গণতন্ত্র আদর্শ ধনতন্ত্রের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।

ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম গ্রন্থে মার্কস লিখেছেন, “এই সংবিধানের[] প্রধানতম স্ববিরোধ পরিস্ফুট হয় এইভাবে : সর্বাহারা, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া – এই যে শ্রেণীগুলির সামাজিক দাসত্ব সংবিধানে কায়েম রাখার কথা, সংবিধান সার্বজনীন ভোটাধিকার মারফৎ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী করছে। আর যে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাবেকী সামাজিক শক্তি এতে মঞ্জুর করা হয়েছে সংবিধান তার কাছ থেকে সে ক্ষমতার রাজনৈতিক নিশ্চিতি প্রত্যাহার করছে।” এই হল বুর্জোয়া সাংবিধানিক রাষ্ট্রের মৌলিক দ্বন্দ্ব – সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে সকলকেই রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে নিয়ে আসা হয়, কিন্তু জনগণের এই সার্বভৌমত্ব নেহাতই আনুষ্ঠানিক, প্রকৃত স্বার্থগুলি শ্রেণী বৈরিতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়।

সংশোধনবাদীরা প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বুনিয়াদী বৈরিতাগুলির নিরসন ঘটেছে বলে মনে করে। তাদের বিপরীতে লেনিনের যুক্তি হল, উপরে বর্ণিত স্ববিরোধিতাগুলির কারণেই সেগুলি খোলাখুলি শ্রেণীযুদ্ধের সবথেকে চমৎকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।

এভাবেই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক চালিয়ে মার্কসবাদ নিজের অগ্রগতি ঘটিয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়াতেই মার্কসবাদ আরও প্রাণশক্তি লাভ করেছে লেনিনবাদের মধ্যে।

বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের কৌশল সম্পর্কে

এরপর, এখানে আরও কিছু কিছু প্রশ্নে যে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই। একজন কমরেড বলেছেন যে বিপ্লবী আন্দোলনের ধীর বিকাশের পরিস্থিতিতে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের কৌশলটি ঠিক খাপ খায় না। বরং অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতেই তা যথার্থভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। আমি মনে করি এই যুক্তির ক্ষেত্রে মৌলিক একটা ত্রুটি থাকছে। ‘বিরোধীপক্ষ’ শব্দটি হল একটি সংসদীয় বর্গের পরিভাষা এবং সংসদীয় সংগ্রাম চালায় এমন একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের কৌশলটি হল এক নির্দিষ্ট কৌশল। আর বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় পার্টির কাছে আশু লক্ষ্য হিসাবে বিপ্লব নিজেই এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিপ্লবী বিরোধীপক্ষ আর এজেন্ডা হিসাবে থাকে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় সংসদীয় সংগ্রাম অচল হয়ে পড়তে পারে এবং খুব সম্ভব নির্বাচন বয়কট বা এমনকি বুর্জোয়া সংসদকে বাতিল ঘোষণা করাটাই পার্টির আশু লড়াইয়ের স্লোগান হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজে কাজেই, যখন কোনো সংসদীয় সংগ্রাম থাকবে না বা এমনকি সংসদটাই থাকবে না তখন বিরোধীপক্ষ কথাটিই থাকবে না তা সে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষ হোক বা অন্য যে কোনো প্রকারের বিরোধীপক্ষই হোক। একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কেবলমাত্র আজকের বর্তমান পরিস্থিতিতেই, যখন পার্টির কৌশলের মধ্যে সংসদীয় সংগ্রাম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তখন বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের প্রশ্নটি হাজির হচ্ছে এবং এটাই সংসদীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টির বুনিয়াদী দিশা নির্ধারণ করছে। এ প্রশ্নে কোনো বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। অবশ্য নির্বাচনে বেশি বেশি সমর্থনলাভ ও সংসদে শক্তি বৃদ্ধির অবস্থায় এর প্রয়োগ ঘটানোটা নিশ্চিতভাবেই একটা জটিল বিষয়।

যাই হোক, সংসদকে প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করার কথাটা বহুল প্রচলিত আর এ নিয়ে কোনো বিতর্কেরও অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তব জীবনে আপনাদের বহু ধরনের ব্যবহারিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সেখানে আসন সমঝোতার প্রশ্ন উঠবে। কথা উঠবে ‘সমমনোভাবাপন্ন দলগুলির’ সাথে আঁতাতের। এটাও একটা সংসদীয় পরিভাষা। তারপর আসে সংসদের মধ্যে ব্লক গঠনের প্রশ্ন। আমাদের প্রতিনিধিদের সেখানে নির্দিষ্ট ইস্যুগুলি ও বিলগুলিতে নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং ভোটে অংশ নিতে হবে। আমাদের মিত্র খুঁজতে হবে আর বিভিন্ন বুর্জোয়া সংগঠনের মধ্যে পার্থক্যও করতে হবে। আমাদের প্রতিনিধিরা কি কেবল কিছু মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন বা সংসদ কক্ষে বা ‘ওয়েলে’ মধ্যে ছুটে যাওয়ার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন কিংবা ওয়াক আউট করার মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন? না কী তাঁরা কার্যকরী কিছু আলোচনায় অংশ নেবেন, বিভিন্ন সংশোধনী আনবেন, সংবিধানের নানা সংস্কার দাবি করবেন ও বেসরকারি বিলের রূপে বিকল্প খসড়া হাজির করবেন? বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসাবে তাঁদের ভূমিকা কেমন হবে, বিভিন্ন নির্বাচনী ক্ষেত্রভিত্তিক পরিকল্পনা বা উন্নয়ন সংক্রান্ত সংস্থাতেই বা তাঁদের কাজ কেমন হবে? এ সবই হল সংস্কারকে ঘিরে কর্মকাণ্ডের কথা এবং মোদ্দা কথা হল বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের অবস্থান থেকেই এই সমস্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। এ হল এমন লাখ টাকার প্রশ্ন যার উপর পার্টির সমগ্র ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

বিপ্লবের কি কোনো সংসদীয় পথ আছে?

যে মৌলিক ভ্রান্তিটির জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সংসদসর্বস্বতা বা জনপ্রিয় ভাষায় অধঃপতনের গাড্ডায় গিয়ে পড়ে তা হল সংসদের বুর্জোয়া চরিত্রটিকেই নস্যাৎ করে বসা ও প্রচলিত সংসদ যে বুর্জোয়া সমাজেরই উপরিকাঠামো তা বেমালুম ভুলে যাওয়া। আপনি যদি সংসদকে নিছক একটা ধাপ্পা বলে মনে করেন, মনে করেন যে এটা জনগণকে প্রতারণা করার জন্য শোষকশ্রেণীর একটা কৃত্রিম সৃষ্টি তাহলে আপনি নিজেকেই ঠকাবেন, অন্য কাউকে নয়। কারণ এই সরল ব্যাখ্যার ফলে আপনি বুর্জোয়া সমাজের গতিসূত্রকে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হবেন। এবং এর ফলে আপনি নির্দিষ্ট স্লোগান ও কৌশল উদ্ভাবন করতে পারবেন না। আপনি চোখ চোখা কথায় পার্লামেন্টকে খারিজ করে দেওয়া বা গালমন্দ করতে পারবেন কিন্তু তার শরীরে একটুও চিড় ধরাতে পারবেন না। এ ধরনের বুলি কপচানো সত্যিই শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা।

অন্যদিকে সংসদকে শ্রেণী বিবর্জিত বা শ্রেণীর ঊর্ধ্বে কোনো প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা, যেখানে সর্বহারাকে কেবল ঢুকে পড়তে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে আর তাকে সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে হবে – এভাবে চিন্তা করাটা হল আরও মারাত্মক এক বিচ্যুতি। সংসদ বুর্জোয়া সংবিধানের চৌহদ্দিতেই কাজ করে এবং হাজার একটা উপায়ে তার সুতোটা পুঁজির সাথে বাঁধা। সংসদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সর্বহারার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি সমগ্র ভোটের ব্যবস্থাটাই কীভাবে শক্তিশালী ক্ষমতাগোষ্ঠীর অনুকূলে কাজ করে, কাজ করে টাকার থলির হয়ে এবং এক একটা আসন জয় করাটা বিপ্লবী বামেদের পক্ষে কতটা কঠিন।

তবুও এটাই আমার বক্তব্যের মূল বিষয় নয়। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল সর্বহারাশ্রেণী সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে (খুবই ব্যতিক্রমী কোনো ক্ষেত্রে তা সম্ভব বলেও ধরে নেওয়া যাক) তবুও তাতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বহারার দাসত্বের অবসান ঘটবে কিনা কিংবা বুর্জোয়া সমাজের ভিত্তিটা তাতে কোনোভাবে আমূল বদলানো যাবে কিনা – সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মার্কসবাদ এ প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তরই দিয়ে থাকে। শ্রেষ্ঠ কোনো কমিউনিস্ট সরকারও তার মহত্তম আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও বুর্জোয়া ব্যবস্থার কিছুটা সংস্কার সাধনই করতে পারে মাত্র, তার বেশি কিছুই করতে পারে না। সর্বাহারারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ব্যবহার করতে পারে না। পুরোনো রাষ্ট্রটাকে অবশ্যই চূরমার করে দিতে হবে আর নতুন এক রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তুলতে হবে। কমিউনিস্ট ইস্তাহারের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় (১৮৭২) প্যারি কমিউনের তিক্ত শিক্ষার পর মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক পুনর্বার যা ঘোষিত হয়েছে এবং লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইতে যা সুবিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে সেটাই রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তি হয়ে আছে। বস্তুতপক্ষে সমাজতান্ত্রিক সমাজেও – যেখানে মূলনীতি হল “প্রত্যেকের কাছ হতে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ও প্রত্যেককে তার কাজ অনুযায়ী” – বুর্জোয়া অধিকারের উপাদান বিদ্যমান থাকে। এমনকি লেনিন একবার একথাও বলেছিলেন যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল বুর্জোয়াহীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র। “প্রত্যেকের কাছ হতে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ও প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী” – এই নীতি যখন কার্যকরী হয় কেবল তখনই বুর্জোয়া অধিকারের উপাদান পুরোপুরি নির্মূল হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ হল কমিউনিস্ট সমাজের উন্মেষ, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই বিলীন হয়ে যায়।

সুতরাং বিপ্লবের জন্য সংসদীয় বা অসংসদীয় পথের গোটা বিতর্কটাই সোজাসুজি এই কারণে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় যে সংসদীয় পথ বলে কোনো পথই নেই। সর্বহারা বিপ্লবের প্রকৃত অর্থই হল সংসদ সমেত বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবসান ঘটানো। কাজে কাজেই বিপ্লবের কোনো সংসদীয় পথ থাকতে পারে না। বিপ্লবের অন্তর্বস্তুকে বর্জন করার ভিত্তিতেই কেবলমাত্র এর অস্তিত্ব সম্ভব। সর্বহারা বিপ্লব তার নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ সহ সর্বহারা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে থাকে। এই প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে এবং রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক কাজকে একটি একক সত্তার মধ্যে গ্রথিত করে। সংক্ষেপে, এক নতুন রাজনৈতিক উপরিকাঠামোকে গড়ে তোলে যা নতুন সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

সংসদ সংক্রান্ত সমগ্র কমিউনিস্ট রণকৌশল সংসদকে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করা এবং এই প্রক্রিয়ায় গুণগতভাবে পৃথক এক প্রতিনিধি পরিষদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তাকে ভাঙ্গার শর্ত সৃষ্টি করাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।

শান্তিপূর্ণ বনাম সহিংস বিপ্লব

মার্কসবাদী রণকৌশলে অবশ্য শান্তিপূর্ণ অথবা সহিংস বিপ্লবের প্রশ্নকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এটা একেবারেই পৃথক প্রশ্ন যার সাথে সংসদীয় পথ বা অসংসদীয় পথ নিয়ে তথাকথিত বিতর্কের কোনো সম্পর্ক নেই। মার্কসীয় বিপ্লবের তত্ত্বে একটি ব্যতিক্রমী ও বিরলের মধ্যে বিরলতম সম্ভাবনা হিসাবে এবং শ্রেণীশক্তিসমূহের ভারসাম্যের কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। আমেরিকায় যখন স্থায়ী সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেনি এমন এক সময় এ ধরনের এক সম্ভাবনার কথা মার্কস উল্লেখ করেছেন। লেনিন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় এ ধরনের সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলেন। চীনে জাপ বিরোধী যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পরে এমন এক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং মাও গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো এবং চিয়াং কাই শেকের সাথে এক যুক্ত সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত সম্ভাবনার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। তা সত্ত্বেও, তত্ত্বগতভাবে মার্কসবাদ এই সম্ভাবনার কথা একেবারে নাকচ করে দেয় না।

এখানে এটা অবশ্যই বুঝে নেওয়া দরকার যে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সংসদীয় অভ্যুত্থানের সমার্থক নয়। এর সাথেও বুর্জোয়াদের সমূলে উৎপাটনের প্রশ্নটি সবদিক থেকেই জড়িত। যদি ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে বিপ্লব সমাধা হত, তার তাৎপর্য কি অক্টোবর বিপ্পবের থেকে কিছু কম হত? এছাড়াও, এ সম্ভাবনার আদৌ যদি বাস্তবায়ন ঘটে – তবে তা সর্বহারার সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রস্তুতি তথা প্রতিক্রিয়াশীল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সশস্ত্র শক্তির উপর নির্ভর করেই ঘটবে। এই প্রস্তুতি ছাড়া শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় এবং তা ইন্দোনেশিয়া বা চিলির চাইতেও বেশি মাত্রায় সর্বহারার রক্তস্নানে পরিসমাপ্তি লাভ করবে।

সুতরাং আমাদের পার্টির কর্মসূচিতে যখন এক ব্যতিক্রমী সম্ভাবনা হিসাবে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা বলা হয় তখন সেটাকে সংসদীয় পথের সঙ্গে এক করে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় কিংবা তার অর্থ প্রস্তুতিকে শিথিল করাও নয়। বস্তুত, পার্টি যত অ-শান্তিপূর্ণ রাস্তার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে থাকে ততই তার পক্ষে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য সম্ভাব্য পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো সম্ভব। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব শত্রু কর্তৃক বিনা লড়াই-এ আত্মসমর্পণের সাথে তুলনীয় আর সে জন্যই সহজে অনুমান করা যায় যে সেটা কতটা ব্যতিক্রমী এবং আমাদের প্রস্তুতি কোন স্তরে থাকলে তা ঘটা সম্ভব।

এখন কিছু কিছু ব্যক্তি শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ব্যতিক্রমী সম্ভাবনাকে প্রথম সুযোগেই সাধারণীকরণ করে বসেন। আর তার পরেই তাঁরা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে সংসদীয় পথের সাথে এক করে দিয়ে এভাবে মোহ ছড়াতে থাকেন যে সর্বহারা শ্রেণী সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বুর্জোয়া সমাজের বুনিয়াদী কাঠামোকে বদলে দিতে ও সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম। এসবই জঞ্জাল এবং সংশোধনবাদ ছাড়া কিছু নয়।

সিপিআই(এম) বনাম সিপিআই(এমএল)

তথাকথিত এমএল গোষ্ঠীগুলির সমালোচনা আমাদের শুনতে হয়। তাঁদের অভিযোগ এই যে আমরা নাকি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মূল অবস্থানগুলির প্রায় সমস্তই পরিত্যাগ করছি এবং তাদের ভাষায় নয়া-নয়া সংশোধনবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাদের অভিযোগ, আমাদের পার্টির কর্মসূচিকে আমরা এতখানি সংশোধন করেছি যা নাকি আমাদের প্রায় সিপিআই(এম)-এর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং তাদের জল্পনা-কল্পনা হল যে আমরা সিপিআই(এম)-এর সাথে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। কারো কারো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আমরা নাকি কিছু বখরা পাওয়ার জন্য বামফ্রন্টে যোগদানের জন্য লালায়িত এবং আমাদের তারা সরকারি নকশাল বলে চিহ্নিত করছে। তারা অনেকদিন ধরেই এসব ভবিষ্যতবাণী করে আসছে। কিন্তু বাস্তবে অবস্থাটা কী? না আমরা বামফ্রন্টে যোগ দিয়েছি, না আমরা সিপিআই(এম)-এর সাথে মিশে গেছি। বিপরীতে আমরা জাতীয়স্তরে পার্টির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছি, বাম আন্দোলনে এক প্রধান ধারা হিসাবে তাকে পুনঃস্থাপন করেছি এবং বাম শিবিরে সিপিআই(এম)-এর আধিপত্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছি। আর এসব কিছুই আমরা গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষদের প্রবল আন্দোলনের শক্তিতেই অর্জন করেছি – যেখানে আমাদের সামন্ত শক্তির তীব্র আক্রোশের মুখে পড়তে হচ্ছে, তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, পুলিশ আর বিজেপি থেকে শুরু করে সিপিআই(এম) পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এই প্রতিরোধ সংগ্রাম ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ মারফত জঙ্গী ও সশস্ত্র আকার ধারণ করছে। এটাই হল নকশালবাড়ির সত্যিকার আত্মা এবং আমি আবার ঘোষণা করতে চাই যে আমাদের পার্টি, কেবলমাত্র আমাদের পার্টিই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

যাই হোক, সময়ের পরিবর্তনের সাথে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা বাস্তবিকই আমাদের রণকৌশলে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন ঘটিয়েছি। এটা একেবারে স্বাভাবিক এবং বলতে কী এটা এক জীবন্ত সত্তারই পরিচায়ক। প্রত্যেক সজীব প্রাণীই পরিবেশের পরিবর্তনে সাড়া দেয় এবং বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার তাগিদে তার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। কেবলমাত্র মৃত বস্তুই পরিবেশের পরিবর্তনে সাড়া দেয় না। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, যে প্রাণী অভিযোজনে ব্যর্থ হয় সে ক্রমে ক্রমে অবলুপ্ত হয়।

আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমরা কেবল কয়েকটি স্লোগান এবং রণকৌশলেরই পরিবর্তন ঘটিয়েছি কিন্তু আমাদের রণনীতিগত অবস্থানগুলি অটুট আছে। নকশালবাড়ি আজও আমাদের প্রেরণা, আমাদের পথপ্রদর্শক এবং যা কিছু রণকৌশলগত পরিবর্তনই আমরা ঘটিয়ে থাকি না কেন তা তার বিপ্লবী কাঠামোর মধ্যেই করা হয়েছে। আমাদের পার্টি লাইনের অভ্যন্তরে আমরা কিছু কৌশলগত পরিবর্তন যে ঘটিয়েছি তার প্রথম কারণ বাস্তব পরিস্থিতিই সেগুলিকে আবশ্যকীয় করে তুলেছিল; দ্বিতীয় কারণ সেগুলি সিপিআই(এম)-এর শঠতাগুলিকে উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে আমাদের অনুকূল স্থান গড়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে, কোনো কোনো রাজ্যে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেওয়ার পরিবর্তে, আমরা এই বিতর্ককে এ ধরনের সরকারকে ব্যবহার করার দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার বিতর্কের স্তরে উন্নীত করি। একটি হল, শ্রমিক-কৃষককে সমাবেশিত করার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করা, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করা ও বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার সংকটকে আসন্ন করে তোলা; আর অপরটি হল বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার মধ্যেই ধীরে ধীরে অঙ্গীভূত হয়ে পড়া, যে পথ সমাজগণতন্ত্রী সিপিআই(এম)-এর পথ। আজকের সন্ধিক্ষণে যখন দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে তার জৌলুষ অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং ক্রমাগত তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র উন্মোচিত হচ্ছে, তখন এই বিতর্ক বাম কর্মীবাহিনীর মধ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নকশালবাড়িই বিপ্পবী এবং সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে মৌলিক বিভাজন রেখা টেনে দেয়। কেউই মৌলিক এই বিভাজনকে মুছে দিতে পারে না। কিন্তু একথা বারবার নিছক পুনরাবৃত্তি করাটা আমাদের কোনো উপকারেই লাগবে না, বরং এ থেকে বিমূর্ত বুলি কপচে যাওয়ার মতো অধঃপতন ঘটারই সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের পার্টি প্রয়োজনীয় যেসব কৌশলগত পরিবর্তন সাধন করেছে, দীর্ঘ ব্যবধানের পর, তা আমাদের নীচুতলায় সমাজগণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ ফিরে পেতে সাহায্য করেছে। সিপিআই(এম)-এর সমাজগণতন্ত্রী অনুশীলন এক কানাগলির দিকে ছুটে চলেছে আর তার দ্বন্দ্বগুলি ক্রমাগত সামনে উঠে আসছে। যুক্তমোর্চা সরকারে যোগ দেওয়া নিয়ে বা যুক্তমোর্চার চরিত্রায়ণ নিয়ে, বুর্জোয়া পার্টিগুলির সঙ্গে জোট বাঁধার ক্ষেত্রে পার্টির কৌশলগত প্রশ্নে, সংসদীয় আঙ্গিনায় তাদের স্থিতাবস্থা ও হিন্দি বলয়ে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার প্রশ্নে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে রণকৌশল নিয়ে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে সাম্প্রতিক গুরুতর বিভাজনের কথা ভেবে দেখুন। এ সমস্ত কিছুই তাদের পার্টির মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফাটলকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। এই সমস্ত প্রশ্ন ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্পবী ও সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে চলমান বিতর্ককে নতুন স্তরে উন্নীত করার দাবি জানাচ্ছে এবং এভাবেই বাম কর্মীবাহিনীর মধ্যে নতুন মেরুকরণের পথ সুগম হবে। আমাদের পার্টি ঠিক এই কাজগুলিই করে চলেছে এবং কৌশলগত পরিবর্তনগুলি আমাদের সুবিধাজনক অবস্থানেই পৌঁছে দিয়েছে।

আমি এ কথা বলছি না যে এ কাজ খুব সহজ। সমাজগণতন্ত্রীরাও তাদের ঐক্যকে ধরে রাখার জন্য এবং বিপ্লবী কর্মীবাহিনীকে প্রভাবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটিয়ে থাকে। তাই ১৯৬৭-তে যে সংগ্রামের শুরু তা এভাবেই এগিয়ে চলেছে এবং আগামী দিনগুলিতে তা নতুন ও জটিল রূপ পরিগ্রহ করবে ও সিপিআই(এম)-এর সাথে [বা সিপিআই(এম)-এর বিভিন্ন অংশের সাথে] আমাদের সম্পর্কও নির্ধারণ করবে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক কী রূপ ধারণ করবে আগে হতে বলা মুশকিল, কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত। তা হল এই যে ভারতের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-ই মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থাকবে – প্রত্যেকেই চেষ্টা চালাবে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে। সমাজগণতন্ত্রীদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির, আমি মনে করি, এটিই হল সারকথা।

টীকা

১. ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর ফরাসী সংবিধানসভা যে প্রজাতন্ত্রী সংবিধান তৈরি করেছিল, এখানে তার কথা বলা হয়েছে।

(পার্টি স্কুলের জন্য প্রস্তুত একটি সহজবোধ্য রচনা। লিবারেশন, জুন ১৯৯০ থেকে)

বিগত ৭-৮ বছর ধরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টিতে অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তোলা ও পার্টি স্কুল ব্যবস্থাগুলিকে পার্টি কাঠামোর এক অখণ্ড অংশে পরিণত করার প্রচেষ্টাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলগুলিতে বাছাই করা ক্যাডারদের নথিভুক্ত করা হয়েছে, তেমনি রাজ্য ও অন্যান্য পার্টি কমিটিগুলি নিজ নিজ স্তরে পার্টি স্কুল পরিচালনা করেছে। আশা করা হয়েছিল যে, এই সমস্ত কর্মপদ্ধতিগুলি সমগ্র পার্টির জ্ঞান ও বোঝাপড়ার স্তরকেই শুধু উন্নত করবে এমন নয়, সাথে সাথে অধ্যয়নকেও এক নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করবে। এই লক্ষ্য আমরা কতটা অর্জন করেছি? প্রত্যেকেই বোধহয় স্বীকার করবেন যে সাফল্যের হার আশাব্যঞ্জক নয়। সামান্য কয়েকজন কমরেডই তাঁদের ঝোঁক থেকে অধ্যয়ন চালিয়ে গেছেন আর বাকিরা তাদের পুরোনো জায়গাতেই ফিরে গেছেন।

মার্সবাদের কিছু মৌলিক বিষয়, অ আ ক খ আছে এবং যদি আপনারা তা না জানেন তবে আপনাকে অশিক্ষিত মার্কসবাদীর বর্গে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আমি মনে করি আমাদের পার্টিতে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা যথেষ্টই বেশি। যাদের শিক্ষিতের দলে ফেলা যায়, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আবার প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করতে পারেননি। আমাদের অভিজ্ঞ নেতা ও ক্যাডারদের সংখ্যাগরিষ্ঠই মার্কসবাদী মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলে দাবি করতে পারেন না।

এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এক অবস্থা এবং তা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের এক ভালো সংখ্যক কমরেডই হয় অন্ধের মতো নতুবা নিজের মর্জিতে কাজ করে চলেছেন। আপনি যদি অন্ধভাবে কাজ করেন অর্থাৎ নিষ্ঠার সাথে স্লোগানগুলি আউড়ে যান ও উপর থেকে আসা নির্দেশগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, তাহলে আপনি নির্দেশগুলির প্রাণশক্তি ধরতে ভুল করতে পারেন ও কখনই সৃজনশীল অনুশীলন করতে পারেন না। আর যদি নিজের মর্জি অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনি পার্টির চিন্তা, পরিকল্পনা ও লাইনের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। উভয় অবস্থাই পার্টি ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে সমানভাবে ক্ষতিকর।

আমি কিছু মানুষকে দেখতে পাই যারা বেশ সুখী এই ভেবে যে তাঁদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হচ্ছে ফ্রন্ট সংগঠন, এবং মার্কসবাদ অধ্যয়নের তাঁদের কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমার মনে হয় না ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডাররা বর্তমানে মার্কসবাদ অধ্যয়নে কোনো নজর দেন। এমনকি অনেকের মান বেশ নেমে গেছে। সাম্প্রতিককালে নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডারদের একটা অংশের মধ্যে অবিপ্লবী অনুশীলনের প্রবণতা গড়ে ওঠার এটি অন্যতম এক কারণ। এই কমরেডরা বুঝতে পারেন না যে, এই ফ্রন্টের সমগ্র চিন্তা, কর্মসূচি ও কৌশলগুলি অন্যকিছু নয় মার্কসবাদ থেকেই গড়ে উঠেছে ও আমাদের নির্দিষ্ট অবস্থায় নির্দিষ্ট প্রয়োগ থেকেই তা নির্ধারিত হচ্ছে। তার উদ্দেশ্যের সফলতার জন্য সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ও বিপ্লবী শ্রেণীকে সমগ্র সমাজের নেতা হিসাবে এগিয়ে আসতে হবে। বুর্জোয়াদের সাথে কমিউনিস্টদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে এবং পরিশেষে সমাজের স্বাভাবিক নেতার আকাঙ্খিত অবস্থান থেকে বুর্জোয়াদের অপসারিত করতে হবে। যে কোনো নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে যুক্তফ্রন্ট যে রূপই গ্রহণ করুক না কেন, তা হচ্ছে সংক্ষেপে একটি কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। সুতরাং যুক্তফ্রন্টের নীতি ও কৌশলগুলি অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা অগ্রণী শ্রেণীর লক্ষ্য ও স্লোগানগুলিকে জনগণের সমস্ত শ্রেণীর লক্ষ্য ও শ্লোগানে রূপায়নের দক্ষতা হচ্ছে মার্কসীয় তত্ত্ব ও অনুশীলনের সব থেকে চূড়ান্ত দিক। কমিউনিস্টরা হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের নিউক্লিয়াস ও মেরুদণ্ড শক্তি, যদি তাঁরা অশিক্ষিত মার্কসবাদী থেকে যান তাহলে এই দক্ষতা তাঁরা অর্জন করতে পারেন না।

এক ব্যাপক সংখ্যক নতুন শক্তি ফ্রন্ট ও পার্টিতে যুক্ত হচ্ছেন। মার্কসীয় অর্থে তাঁরা শুধু অশিক্ষিতই নন, এমনকি সিপিআই, সিপিআই(এম) ইত্যাদি থেকে আসা অনেকেই নেতিবাচক শিক্ষা পেয়েছেন।

অন্য একদিন, আমার সাথে একজন কমরেডের দেখা হল যিনি দুই ব্যাগ বই ও তল্পিতল্পা নিয়ে পার্টি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, অবশ্য তাঁর ভাষায় অধ্যয়নের জন্য পার্টি থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটি নিচ্ছেন। একজন তরুণ, সম্ভাবনাময় ও ভালো ব্যবহারিক কর্মী এই কমরেড পার্টিতে অধ্যয়নের কোনো উপযুক্ত পরিবেশ নেই ভেবে বীতশ্রদ্ধ। তিনি এও মনে করেন, পার্টি অন্ধ অনুশীলনকে উৎসাহিত করে, একগুচ্ছ জটিল প্রশ্নের তাত্ত্বিক সমাধান না হওয়ার ফলে বর্তমানের সাফল্যগুলি মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত এক শক্ত দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে। আমি ঐ কমরেডকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ও তাঁকে পার্টিতে থাকবার জন্য বললাম। কমরেড একজন বুদ্ধিমান মানুষ, ফলে অন্যান্য লোকেরা কী কী যুক্তি হাজির করতে পারে অনুমান করে নিজস্ব বিপরীত যুক্তিজাল ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করে ফেলেছেন। এজন্য তাঁকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ হলাম। তাছাড়া পার্টি ছেড়ে দেওয়ার জন্য যাঁরা মনস্থির করে ফেলেন তাঁদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে আমার সাফল্যের হার সত্যিই দুর্বল। যাই হোক, সে অন্য কথা।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই কমরেডের মূল অবস্থান ছিল ভুল। তাঁর আকাঙ্খা ছিল একজন পণ্ডিত হিসাবে গড়ে ওঠার, একজন পার্টি তাত্ত্বিক হিসাবে নয়। আমি অবশ্য পণ্ডিতদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই ছোটো করে দেখছি না। সত্যি বলতে কী, তাঁরা যে সমস্ত প্রয়োজনীয় গবেষণামূলক কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার যে সংঘাত ঘটে, যা এই বিদ্বৎ সমাজেই প্রথম নির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করে, সেগুলি ছাড়া বস্তুত বিপ্লবী তত্ত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব। তথাপি বলব বিদ্বৎজনদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে, তাঁদের সিদ্ধান্তগুলিতে স্বচ্ছতা ও অভিঘাতের অভাব থাকে এবং কখনও কখনও তা বিভ্রান্তিজনক ও ভুল। তাই সর্বাহারার নিজস্ব বিপ্লবী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নেতাদেরই কার্যধারাকে সূত্রবদ্ধ করতে হয়। বুর্জোয়ারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কর্মীদের বিভাজনকে স্বীকার করতে পারে, কিন্তু সর্বহারার নেতারা হচ্ছেন মার্কস, লেনিন, মাও ইত্যাদি ইত্যাদি যাঁরা একাধারে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়।

আমাদের পার্টি ইতিহাসে কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপকে আমরা লক্ষ্য করেছি যাঁরা তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে যান্ত্রিক বিভাজন করেন। তাঁদের মতে, প্রথমে একটি দীর্ঘ সময় থাকবে অধ্যয়নের জন্য। যার ভেতর দিয়ে ‘সঠিক’ রাজনৈতিক লাইন তৈরি হবে এবং তার পর শুরু হবে ‘সঠিক’ অনুশীলন পর্ব। বস্তুত ইতিহাস প্রমাণ করেছে, এই সমস্ত ব্যক্তিবর্গ বছরের পর বছর অধ্যয়নের পরও কোনো জায়গায় পৌঁছতে পারেননি, বরং তাঁরা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তার থেকেও বেশি বিভ্রান্তির মধ্যে শেষ হয়েছেন। বিপ্লবী তত্ত্ব তাঁরাই সামনে হাজির করতে পারেন যাঁরা অনুশীলনের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় থাকেন এবং ভুল ও ব্যর্থতা থেকে যাঁরা শিক্ষা নেন। তার অর্থ কি এই, ঐ কমরেড যা বলেছেন তার সবকিছুই ভুল ও কেবলমাত্র নিন্দার যোগ্য। আমি তা মনে করি না। আমার মতে, ঐ কমরেড সম্পূর্ণ সঠিক যখন তিনি বলেন একগুচ্ছ জটিল প্রশ্নের তাত্ত্বিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি এবং ঐ প্রশ্নগুলি দ্রুততার সাথে সমাধানের জন্য হাতে না নিলে শেষ পর্যন্ত একটি শক্ত দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আমরা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাব। ঐ কমরেড আমাদের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলিকে আঘাত করতে পেরেছেন যখন তিনি দেখিয়ে দেন যে অধ্যয়নের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব থাকছে।

যদি আপনি একমত হন পার্টিতে উপরোক্ত অবস্থা থাকছে, তাহলে সমস্ত পার্টি সভ্যদের মার্কসবাদের অ, আ, ক, খ শিক্ষার জন্য পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি যে গণশিক্ষার অভিযান শুরু করেছে তাকে আপনি অভিনন্দিত করবেন।

আলোচনার শুরুতেই একটি প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উঠতে পারে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র যখন সংকটাগ্রস্ত ও মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠছে তখন মার্কসবাদের বুনিয়াদী শিক্ষার উপর জোর দেওয়া কি গোঁড়ামিকে আরও শক্তিশালী করবে না?

উত্তম, সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের সংকট ও বিশেষভাবে পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলীর বিকাশ সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে – বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন, সমগ্র ইউরোপে ক্রিয়াশীল জোরালো আর্থ-সামাজিক কারণগুলি, সোভিয়েত পেরেস্ত্রৈকার ভূমিকা, কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি যে সমস্ত ভুলগুলি করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি আজ বিচার্য বিষয়।

কিন্তু আমি মনে করি এসব কিছুই এখনও পর্যন্ত সমস্ত কারণগুলির অন্যতম মৌলিক কারণটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্টরা ধাক্কা খাওয়ার পর অনেকে আশা করেছিলেন ইউরোপে কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতন্ত্রীরা, যাঁরা  ‘একনায়কত্বের’ বিপরীতে, ‘গণতান্ত্রিক নীতিভিত্তিক সমাজতন্ত্রের’ প্রবক্তা, তাঁদের দিকে হাওয়া ঘুরবে। কিন্তু তা হয়নি, এবং পূর্বতন কমিউনিস্টরা সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিজেদের সমাজগণতন্ত্রী পার্টিতে পরিবর্তিত করার সমস্ত প্রচেষ্টার পরও পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধ্য-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক জোটগুলির উত্থান, চার্চের উত্তরোত্তর ভূমিকা এবং ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের সরাসরি আহ্বান এসব কিছু পূর্ব ইউরোপে ঘটছে। সুতরাং মূর্ত বাস্তবতা হল, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই বিভিন্ন রূপের সমাজতন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতন্ত্র, সর্বহারার শাসন কেবলমাত্র ধনতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ও বুর্জোয়াদের শাসনের রাস্তা পরিষ্কার করে তুলেছে। মার্কসাবাদের মৌলিক চিন্তাধারায় নিহিত ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণাই একমাত্র এই ধাঁধার সমাধান করতে পারে। মার্কস বলেছেন, “যদি সর্বহারা শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক শাসনকে ধ্বংসও করে, তা হবে এক সাময়িক বিজয় মাত্র, ১৭৯৪-এর মতো, এটি বুর্জোয়া বিপ্লকে সেবা করার জন্য একটি উপাদান মাত্র, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইতিহাসের গতিধারার ও ‘আন্দোলনের’ মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া উৎপাদন ধরন-এর অবসান ও বুর্জোয়া রাজনৈতিক শাসনের সুনির্দিষ্ট উৎখাতের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত শর্তাবলী সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রান্সের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব তাই প্রচণ্ড আঘাত হেনেই ফ্রান্সের মাটি থেকে সামন্তবাদের অবশেষকে মুছে ফেলতেই কার্যকরী হল। উদ্বিগ্ন ও সহানুভূতিশীল বুর্জোয়ারা যা কয়েক দশকেও সম্পন্ন করতে পারত না। জনগণের রক্তাক্ত কার্যকলাপ কেবল এর রাস্তাই প্রস্তুত করল। একইভাবে, স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পতনও স্বল্পস্থায়ী হত, যদি না বুর্জোয়া শ্রেণী-শাসনের জন্য অর্থনৈতিক অবস্থাগুলি ইতিমধ্যেই পরিপক্ক হত। মানুষ নিজের থেকেই পৃথিবীর ফসলগুলি নিয়ে নতুন জগৎ সৃষ্টি করে না যেমনটি ইতর কুসংস্কার বিশ্বাস করে বরং সেটি হয় তাদের পতনোম্মুখ সভ্যতার ঐতিহাসিক সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। বিকাশের গতিধারায় তাদের নিজেদেরই একটি নতুন সমাজের বস্তুগত শর্তগুলি সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই শুরু করতে হবে এবং মনন বা ইচ্ছাশক্তির কোনো প্রচেষ্টাই এই নিয়তি থেকে তাদের মুক্ত করতে পারে না।” (ডাই মরালিসীরেন্ডোম ক্রিটিক ... ১৮৪৭)। অধিকন্তু, উদারনৈতিক বুর্জোয়া ও মার্কসবাদী প্রচার মাধ্যমে যে সারি সারি বিশ্লেষণ বের হচ্ছে তা মার্কসবাদকে এত স্থূল করে তুলেছে যে মার্কসবাদের মৌলিক বিষয়গুলি পুনরায় স্মরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলীর উপর ইপিডব্লু-র একজন নিয়মিত নিবন্ধকার বুদ্ধিজীবীর লেখা পড়ছিলাম। বস্তুত তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে গণমানসে ধর্মের প্রগাঢ় প্রভাব বুঝতে ওখানকার কমিউনিস্টরা ব্যর্থ হয়েছিলেন ও তাকে কাজেও লাগাতে পারেননি। বলতে বলতে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীর ধর্মকে জনপ্রিয়রূপে ব্যবহার করার প্রশংসায় পৌঁছেছেন। এর থেকে কমিউনিস্টদের শিক্ষা নেওয়ার উপদেশও দিয়েছেন।

মার্কসবাদের খণ্ডিত ও আংশিক অধ্যয়নের ফলে বেশ কিছু মানুষ মনে করেন যে, মার্কস ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং জনগণের জন্য আফিম বল ধর্মকে শুধু নাকচ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মার্কস ধর্মের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁর লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যাক, “ধর্ম হচ্ছে এই বিশ্বের এক সাধারণ তত্ত্ব, এর বিশ্বকোষের সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয়রূপে এর যৌক্তিকতা, এর সৃষ্টির এক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, এর উদ্যম, নৈতিক অনুমোদন ও পবিত্র পরিপূরক, সান্তনা ও সমর্থনের এর সাধারণ ভিত্তি।

“ধর্ম হচ্ছে অত্যাচারিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন দুনিয়ার করুণার কথা ও ভৌতিক জীবনে আত্মার মোহ। মানুষের জীবনে ধর্ম হচ্ছে আফিম” (মার্কস-এঙ্গেলস পত্রাবলী)। বস্তুবাদী চিন্তার সমগ্র ইতিহাসে কোনো বস্তুবাদী ব্যক্তি কি ধর্ম সম্বন্ধে কখনও এই ধরনের সামগ্রিক ধারণা উপস্থিত করতে পেরেছেন? পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীরা তাঁদের সৌখিন চিন্তায় ধর্মকে সরলভাবে নাকচ করেন। সম্প্রতি ‘জনমত’-এ প্রকাশিত একটি কবিতা আমি পড়লাম যেখানে যতটা সম্ভব নিষ্ঠুরভাবে ধর্মের অর্থকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আমি জানি আমাদের বহু কমরেডই এই ব্যাখ্যায় হাততালি দেবেন। কবিতায় আপনি এ ধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করতেই পারেন, কিন্তু যদি তত্ত্বে অনুদিত হয় তবে তা হবে ক্ষতিকর।

ধর্ম হচ্ছে ওল্টানো জাগতিক চেতনা, যা মানুষের প্রাকৃতিক অস্তিত্ব ও প্রকৃতির জৈবিক অস্তিত্বের নেতিকরণের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। মার্কস বলেছেন, “ব্যবহারিক জীবনে একবার যখন মানুষ ও প্রকৃতির তাৎপর্য, মানুষের প্রাকৃতিক সত্তা ও প্রকৃতির মানবিক সত্তা উপলব্ধ হবে, অনুভবে সেগুলি ধরা দেবে, তখন মানুষ ও প্রকৃতির বাইরে কোনো ঐহিক সত্তার অনুসন্ধান, যা মানুষ ও প্রকৃতির অবাস্তবতার প্রকাশ্য ঘোষণা, ব্যবহারিকভাবেই অসম্ভব হবে। এই অবাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য নাস্তিকতা আজ অর্থবহ নয়, কারণ নাস্তিকতা হচ্ছে ঈশ্বরকে অস্বীকৃতি, এই অস্বীকৃতির মাধ্যমেই তা মানুষের অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করে। সমাজতন্ত্রে এ ধরনের ঘুরপথের কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক থেকে সমাজন্ত্র শুরু করে মানুষ এবং প্রকৃতির বাস্তব অস্তিত্বের উপলব্ধি থেকে। এটা হচ্ছে মানুষের ইতিবাচক আত্মসচেতনতা, কখনই ধর্মের নেতিকরণের উপর এ আত্মসচেতনতা অর্জিত নয়, ঠিক যেমন মানুষের বাস্তব জীবন হচ্ছে ইতিবাচক, ব্যক্তি সম্পত্তির নেতিকরণ (কমিউনিজম)-এর মাধ্যমে তা অর্জিত হয় না। কমিউনিজম হল নেতির নেতিকরণ পর্ব এবং ফলত ঐতিহাসিক অগ্রতির পরবর্তী ধাপ, মানুষের স্বাধীনতা ও পুনর্বাসনের জন্য এক বাস্তব ও প্রয়োজনীয় শর্ত। কমিউনিজম হল অদূর ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় রূপ ও সক্রিয় নীতিমালা, কিন্তু কমিউনিজম নিজেই মানব অগ্রগতির লক্ষ্য নয় বা মানব সমাজের চূড়ান্ত রূপও নয়।” (ইকনমিক এন্ড ফিলসফিক্যাল ম্যানসক্রিপ্টস)

নাস্তিকতাবাদীদের মতো নেতিবাচক রূপে ধর্মকে নাকচ করা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানো ভুল। অনুরূপভাবে সমাজের আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য ধর্মকে ব্যবহারের সমস্ত কথাবার্তা প্রতারণা মাত্র। পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজতন্ত্র মানুষকে তার জীবনের অনিশ্চয়তাগুলি থেকে মুক্ত করতে পারেনি, তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হিসাবে সচেতন করতে পারেনি এবং অপরদিকে এক অত্যাচারী ব্যবস্থায় অধঃপতিত হয়েছিল। এটিই হল পূর্ব ইউরোপে চার্চের দীর্ঘ প্রভাব ও সম্ভবত পুনরুত্থানের পেছনে অপরিহার্য কারণ।

আমি একথা বলতে চাইছি না যে পূর্ব ইউরোপের বিকাশগুলিকে শুধু মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলি দিয়ে ব্যাখ্যা করাটাই একমাত্র কাজ এবং এই সমস্ত বছরগুলির অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে মার্কসবাদের উন্নতির কোনো প্রয়োজন নেই। আমার বক্তব্য হল, ঐতিহাসিক অগ্রগতির পথে কখনও কখনও এটা ঘটে যে মানব সভ্যতা বিপ্লবী তত্ত্বের বুনিয়াদী বিষয়গুলি পুনরায় আবিষ্কার করে এবং তারপর তার উন্নতি ঘটায়। আমি স্থির নিশ্চিত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব শীঘ্রই এক নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করবে এবং সেটা হবে মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলির পুনরুজ্জীবনের উপর ভিত্তি করেই।

যখন আমরা মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলির কথা বলি তখন এটা বোঝা ঠিক নয় যে কয়েকটি বই পড়া ও কিছু মৌলিক সূত্রায়নকে আউড়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অধ্যয়নের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এর উপরই আমাদের সমগ্র অভিযানের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে।

আমি প্রায়শই দেখতে পাই কিছু মানুষের কোনো কোনো প্রশ্নে নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে এবং এই চিন্তাভাবনার সমর্থন খোঁজার জন্য তাঁরা মার্কসবাদী বইপত্র অধ্যয়ন করেন। সম্ভবত যে কোনো চিন্তাভাবনার স্বপক্ষে সবসময়ই প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি জোগাড় করা যায়। আমরা বলি মার্কসবাদ আমাদের কাজের পথ প্রদর্শক কিন্তু বাস্তবে তা আমাদের চিন্তা ও কাজের পিছু পিছু চলে। আমি মনে করি, আমরা যখন অধ্যয়ন চালাব তখন আমাদের এই অবস্থান থেকে শুরু করতে হবে যে, আমাদের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাগুলি সাধারণভাবে পেটিবুর্জোয়া চরিত্রের। বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া চিন্তাগুলি সমাজে প্রাধান্যকারী অবস্থানে থাকার জন্যই এটা ঘটে এবং আমাদের এমনকি শ্রমিক কমরেডদেরও বিশ্ববীক্ষা, এই চিন্তাগুলির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে বাধ্য। মার্কসবাদ অধ্যয়নের সময় নিজের চিন্তার প্রতিপক্ষেই অধ্যয়ন চালাতে হবে এবং মানসিক সংগ্রাম চালিয়ে এক সচেতন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের নিজের বিশ্ববীক্ষাকে রূপান্তরিত করতে হবে। চীনের পরিপ্রেক্ষিতে মাও বলেছিলেন, “পার্টিতে এমন বহু কমরেড রয়েছেন যাঁরা সাংগঠনিকভাবে পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন কিন্তু মতাদর্শগতভাবে যুক্ত নন”। আমি দেখছি আমাদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সঠিক। বহু কমরেড আছেন যাঁদের দেহ রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিতে, বিপ্লবের জন্যও তাঁরা উৎসর্গীকৃত প্রাণ, কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে উদারনৈতিক বুর্জোয়া চিন্তাজগতে।

কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে আমি ব্যাপারটা স্পষ্ট করব।

আমি দেখি, কিছু কমরেড বুর্জোয়া প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন ও সরকারের কোনো না কোনো ঘোষণা যেমন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে মোহগ্রস্ত হন। উদারনৈতিকরা প্রচার করে চলে যে এগুলি ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ধরনের সংস্কার করা সম্ভব।

আসুন, আমরা দেখি মার্কসবাদ কীভাবে এই প্রশ্নকে দেখছে। মার্কস বলেছেন, “কনভেনশন সাময়িকভাবে সাহস দেখাল দারিদ্র্য-দূরীকরণের আদেশ দিতে, যদিও তৎক্ষণাৎ নয়, ... কিন্তু কেবল জন নিরাপত্তা কমিটিকে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও প্রস্তাবগুলি পেশ করার জন্য দায়িত্ববদ্ধ করার পর, ... কনভেনশনের অর্ডিন্যান্সটির কী ফল হয়েছিল? পৃথিবীতে আরও একটি অর্ডিন্যান্স যুক্ত হল মাত্র। এক বছর পর কনভেনশন অনাহারক্লিষ্ট তাঁতীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল।

“তথাপি এই কনভেনশন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা, শক্তি ও বোঝাপড়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

“পৃথিবীতে কোনো সরকারই দারিদ্র্যের বিষয়ে তৎক্ষণাৎ আইন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি, তাদের অফিসারদের সাথে আলোচনা ব্যতিরেকে ... দারিদ্র্যের প্রশ্নে রাষ্ট্রগুলি যদিও নিজেদের সংশ্লিষ্ট করেছে, তখনও তারা প্রশাসনিক ও দাতব্য কিছু পদক্ষেপ বা তার থেকেও নীচুস্তরের উদ্যোগে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।

“রাষ্ট্র কি অন্য কোনোভাবে কাজ করতে পারে? রাষ্ট্র কখনই সামাজিক গলদগুলির কারণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে খুঁজবে না! .. যেখানে রাজনৈতিক পার্টিগুলি রয়েছে, প্রত্যেক পার্টিই এই দুর্ভাগ্যের কারণ নিজে নয়, বিরোধী যে পার্টি শাসন ক্ষমতায় আছে তার জন্যই হয়েছে বলে মনে করে। এমনকি প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতিবিদরা এই দুর্ভাগ্যের কারণকে রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্য লক্ষ্য করেন না। এই দুর্ভাগ্যের কারণকে রাষ্ট্রের কোনো একটি নির্দিষ্ট রূপের মধ্যে দেখতে পান, যাকে তারা অন্য একটি রূপ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান।

“রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো দুটি ভিন্ন বিষয় নয়। রাষ্ট্র হল সমাজের কাঠামো। যতদূর রাষ্ট্র এই সামাজিক দুর্ভাগ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে, তখন সে তার জন্য দায়ী করে প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে যাকে কোনো মানুষের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অথবা ব্যক্তিগত জীবনকে দায়ী করে যা রাষ্ট্রের থেকে স্বাধীন অথবা প্রশাসনিক অক্ষমতাকে দায়ী করে যা তার অধীনস্থ। তাই ইংল্যান্ডে দারিদ্র্য প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা এইভাবে ব্যাখ্যা হয়, যে নিয়ম অনুযায়ী জনসংখ্যার বৃদ্ধি বেঁচে থাকার উপকরণ থেকে সর্বদাই অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। অন্য আরেকভাবে ইংল্যান্ডে দারিদ্র্যের ব্যাখ্যা করা হয়, গরিবদের অনীতিনিষ্ঠ স্বভাবের জন্য এটা হচ্ছে। যেমন প্রাশিয়ার রাজা ব্যাখ্যা করেন, বড়লোকদের অখ্রিস্টীয় প্রবণতার জন্য দারিদ্র্য হচ্ছে এবং কনভেনশন মনে করে সম্পত্তিবানদের অবিশ্বাসী, প্রতিবিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই দারিদ্র্য হচ্ছে। ফলত ইংল্যান্ডে দরিদ্রদের উপর শাস্তি ধার্য হয়, প্রাশিয়ার রাজা বড়লোকদের ভর্ৎসনা করেন এবং কনভেনশন সম্পত্তিবানদের শিরচ্ছেদ করে।

“সবশেষে, প্রতিটি রাষ্ট্রেই প্রশাসনের অস্বাভাবিক বা উদ্দেশ্যমূলক দিকগুলির মধ্যেই দারিদ্র্যের কারণ খুঁজতে চায় এবং এই দুর্ভাগ্যের সমাধানের জন্য প্রশাসনের কোনো একটি সংস্কারের কথা ভাবে। কেন? সোজা ভাষায় তার কারণ প্রশাসন হল রাষ্ট্রের নিজেরই সাংগঠনিক সক্রিয়তা।

“একদিকে লক্ষ্য ও মহৎ ইচ্ছা, অন্যদিকে উপায় ও সঙ্গতির মধ্যেকার প্রশাসনের দ্বন্দ্বকে রাষ্ট্র নিজেকে বিলোপ করা ব্যতীত দূর করতে পারে না, কেননা রাষ্ট্রের মধ্যেই এই দ্বন্দ্ব নিহিত আছে। সমষ্টি ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ ও বিশেষ স্বার্থগুলির দ্বন্দ্বের উপরেই রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে। এজন্যই প্রশাসন আনুষ্ঠানিক ও নেতিবাচক সক্রিয়তা পর্যন্তই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে, কারণ প্রশাসনের ক্ষমতা সেই বিন্দুতেই শেষ হয় যেখানে সভ্য জীবন ও তার কাজ শুরু হয়। সভ্য সমাজের অসামাজিক জীবনযাত্রা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বাণিজ্য, শিল্প, সভ্য সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক লুণ্ঠন যে পরিণতি নিয়ে আসে, তার মুখোমুখি হতে গিয়ে নপুংসকতাই প্রশাসনের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দেখা দেয়” (অর্থনৈতিক নোট সমূহ)।

অন্য আর একদিন, আমি একজন কমরেডের সাথে আলোচনা করছিলাম। ঐ কমরেড মনে  করেন মার্কসের সমাজের শ্রেণী বিভাজন তত্ত্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব বোধহয় ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে। মার্কস সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ইত্যাদির কথা বলেছিলেন, কিন্তু দেখুন, শ্রমিকরা দেখা যাচ্ছে সব থেকে গোঁড়া ও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছে না। এই কমরেড এখানেই ভুল করেছেন যে মার্কসই সমাজ বিভাজন তত্ত্ব হাজির করেছিলেন বা শ্রেণী সংগ্রামের কথা আবিষ্কার করেছিলেন। মার্কস নিজে কিন্তু বলেছেন, “বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব বা তাদের মধ্যে সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু পূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা এই শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক গঠনতন্ত্র বর্ণনা করেছেন।” (ভেইডেমায়ার সমীপে মার্কস, মার্চ ১৮৫২)।

এখানেই মার্কসের কৃতিত্ব যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সেই শ্রেণীকে যে নিজেকে সহ সমস্ত শ্রেণীরই শেষ পর্যন্ত বিলোপ ঘটাবে। এই শ্রেণীই হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী যে বস্তুগতভাবে এই কর্তব্যটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পেয়েছে। মার্কস আরও বলেছেন, “যদি সমাজতান্ত্রিক লেখকবর্গ সর্বহারার এই বিশ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকার উল্লেখ করতেন, মোটেই তা হওয়ার নয় ... কারণ তাঁরা সর্বহারাকে ভগবান হিসাবে দেখিয়ে থাকেন। একেবারে বিপরীতভাবেই পূর্ণ বিকশিত সর্বহারার থেকে যা কিছু মানবিক এমনকি মানবিক অস্তিত্ব পর্যন্ত মুছে দেওয়া হয়েছে। ... এই বা ঐ সর্বহারা বা এমনকি সমগ্র সর্বহারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কী লক্ষ্য পোষণ করে তা জানার বিষয় এটা নয়। সর্বহারা কে এবং তার চরিত্রের সঙ্গতিপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক কর্তব্যটি সে সম্পন্ন করবে এটাই জানার প্রশ্ন”। (পবিত্র পরিবার)

আমি একজন কমরেডকে দেখেছি পার্টি ও বিপ্লব সম্পর্কে যাঁর সততা ও আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি গর্বাচভের ‘শান্তিপূর্ণ ও মার্জিত সাম্রাজ্যবাদ’ কল্পতত্ত্বের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। তিনি যে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের মানুষ এবং জাতি হিসাবে সেই দেশটির প্রধান বাহ্যিক দ্বন্দ্ব যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সে কথাটি বুঝতে কমরেড ভুল করেছেন। যে তত্ত্ব এই দ্বন্দ্বকে লঘু করে দেখতে ওকালতি করে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নতিশীল দেশগুলির সংগ্রামকে কমিয়ে ফেলতে পরামর্শ দেয়, সেই তত্ত্ব আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি, বিভিন্ন জনপ্রিয় আন্দোলন ও জাতীয় নেতারা গর্বাচভের এই নতুন চিন্তা অনুসরণ করতে কেন নারাজ? এটা এই জন্যই যে তাঁরা হলেন তাঁদের জাতীয় স্বার্থের সচেতন প্রতিনিধি। উদারনৈতিক বুর্জোয়া প্রচারে আমাদের এই কমরেড বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় জাতির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যা আমাদের পার্টির কর্মসূচির অন্যতম একটি স্তম্ভ রচনা করেছে, তার কোনো সচেতন প্রতিনিধি তিনি নন।

বেশ কিছু কমরেডকে আমি দেখেছি তারা অগপ, তেলেগু দেশম প্রভৃতি পার্টিগুলি এবং শারদ যোশী ও টিকায়েতের আন্দোলনগুলির গণচরিত্র দেখে ভেসে গেছেন, এমনকি ঐ সমস্ত পার্টি ও আন্দোলনগুলিতে মিশে যাওয়া অথবা তাদের কর্মসূচি নকল করার ওকালতি করেছেন। ঐ সমস্ত কমরেড ওদের প্রভাবাধীন জনগণ ও আন্দোলনগুলির জঙ্গী রূপগুলিই দেখতে পান কিন্তু ঐ পার্টি বা আন্দোলনগুলির শ্রেণী চরিত্র ও উদ্দেশ্য সবকিছুই ভুলে যান। এটা যথেষ্ট পরিতাপের বিষয়, সারা ভারতবর্ষের বাম ও প্রগতিশীল জনগণের একটা অংশ যখন প্রধানত বিহারে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে একটা নতুন আশা দেখতে পাচ্ছেন, তা মূলত এই কারণে যে আন্দোলন গ্রামাঞ্চলের সব থেকে অত্যাচারিত ও বিপ্লবী শ্রেণীগুলির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, এর গণচরিত্র ও জঙ্গীরূপ সচেতনভাবেই বিপ্লবী গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিমুখী, তখন আমাদের কমরেডদের একাংশ নিজেদের আন্দোলনকে পরিহাস করে বিজাতীয় শ্রেণী পরিচালিত আন্দোলন সম্পর্কে মোহ বিস্তার করছেন, যে আন্দোলন অ-পার্টি, অ-রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদের কথা বলে বা এই ব্যবস্থার মধ্যে আংশিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের ওকালতি করে।

এই সমস্ত কমরেডদের কেউ কেউ জনতা সরকারকে সমর্থন করার ওকালতি করেছেন, এমনকি তারা চেয়েছিলেন আমরা এই সরকারে যোগ দিই। জনতা সরকারের গণতান্ত্রিক হাবভাব ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া ইত্যাদিতে এই সমস্ত কমরেডরা ভীষণ প্রভাবান্বিত। এরা মনে করেন, সামন্ততন্ত্রের অবশেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জনতা দল ধরনের সরকার দ্বারাই সম্পন্ন করা যায় এবং আমাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টিকারী গ্রুপ হিসাবে কাজ করলেই চলবে। এই তত্ত্ব নিজে এখানে থামেনি এবং পরবর্তী যৌক্তিক অগ্রগতি হিসাবে গ্রামাঞ্চলে গরিবদের উপর আমাদের জোর দেওয়া ও তাদের জঙ্গী গণআন্দোলনগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। এই তত্ত্ব কমিউনিস্ট পার্টিকে বাতিল করে দেয় এবং এর পরিবর্তে একটা ঢিলেঢালা গণতান্ত্রিক মঞ্চ বানিয়ে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় পথে হাঁটা ও বস্তুত জনতা দল এবং সমাজগণতন্ত্রী বামদের ছোটো শরিক হিসাবে কাজ করার জন্য ওকালতি করে। এ পর্যন্তও তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন যে নকশালবাড়ি আন্দোলনকেই এরা পরিহাস করেন এবং স্বাধীন বাম জাগরণ ও বিপ্লবী গণতন্ত্রের চিন্তাভাবনাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেন।

আসলে, এই সমস্ত কমরেড মার্কসবাদী শ্রেণী অবস্থানে দৃঢ় থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি কমিউনিস্ট পার্টি গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র গ্রামীণ জনগণের উপরই একমাত্র ভিত্তি করতে পারে ও মধ্য কৃষকদের জয় করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে। জনতা দল সরকার ইত্যাদির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একমাত্র এই শ্রেণী অবস্থান থেকেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। গ্রামাঞ্চলে জনতা দলের সামাজিক ভিত্তি মূলত কুলাক পরিচালিত এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ এদের সাথে তীব্র সংঘাতে রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে  গ্রামীণ ভারতবর্ষে এটিই প্রধান বিকাশমান দ্বন্দ্ব। আমরা যেহেতু গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের উপর ভিত্তি করি ও তাদের স্বার্থেরই প্রধানত প্রতিনিধিত্ব করি, তাই জনতা দলের সাথে আমাদের সম্পর্কও প্রধানত সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মধ্য কৃষকরাও এই কুলাক লবিকে অনুসরণ করছে এবং জনতা দল ইত্যাদির সামাজিক ভিত্তি তৈরি করছে। আমাদের যেহেতু এই মধ্য কৃষকদের জয় করতে হবে, ধীরে ধীরে কুলাকদের প্রভাব থেকে এদের সরিয়ে আনতে হবে ও গ্রামীণ দরিদ্রদের মিত্র বাহিনীতে পরিবর্তিত করতে হবে, তাই জনতা দলের সাথে আমাদের কোনো না কোনো ধরনের আন্তঃক্রিয়ায় যেতে হবে। এটিই তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐক্য ও সংগ্রামের এক জটিল বিষয়, যেখানে সন্দেহাতীতভাবে সংগ্রাম প্রধান ভূমিকা পালন করবে। শ্রেণী স্তরে ক্রিয়াশীল এই বাস্তবতাগুলিকেই জনতা দলের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ণয় ও জনতা দলের সরকারের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত করতে আমরা চেষ্টা করছি। সিপিআই, সিপিআই(এম) যেহেতু গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ ও উদীয়মান কুলাক লবির দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে বা ছোটো করে দেখে, যা আমাদের আন্দোলনকে শ্রমিক ও ‘কৃষকের’ মধ্যেকার সংগ্রাম বলে নিন্দিত করার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, ফলে তারা গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী শান্তির ওকালতি করে এবং কুলাক লবির সাথে গা মাখামাখি করে।

জনতা দল থেকে শুরু করে তেলেগু দেশম, ডিএমকে সরকারগুলির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এই দলগুলির শ্রেণী অবস্থানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। সাধারণভাবে বলা যায় বর্তমান বাস্তব অবস্থা হল, মধ্য কৃষকরা কুলাক লবিকে অনুসরণ করছে এবং মধ্যপন্থী রাজনৈতিক পার্টিগুলি বা তাদের ‘স্বাভাবিক নেতা’ টিকায়েত, শারদ যোশীর পেছনে সমাবেশিত হচ্ছে। তাই আমাদের দিকে সরে আসাটা কুলাকদের সাথে তাদের দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির উপরই নির্ভর করছে। বিহারে আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হল যে, মধ্য কৃষকদের মধ্যে আমাদের ভিত্তিকে কিছুটা প্রসারিত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমাদের কর্মনীতিগুলির ও দৃষ্টিভঙ্গির আরও উন্নতি প্রয়োজন কিন্তু সমগ্র প্রক্রিয়াটি ধীর গতি সম্পন্ন হতে বাধ্য। আমাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগুলির সাথে সাথে এদিক ওদিক গড়ে ওঠা কৃষক সংগঠনগুলির সাথে সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলিতে যুক্তমোর্চার কার্যকলাপ চালাতে হবে। মার্কসবাদী শ্রেণী অবস্থান ও নীচুতলার বাস্তব অবস্থা ভুলে গিয়ে যদি কোনো কমিউনিস্ট দ্রুত ও সস্তায় সাফল্য লাভের জন্য টিকায়েত বা শারদ যোশী ধরনের ব্যক্তিদের শুধু নকল করার চেষ্টা করে, তবে আমি আশঙ্কিত যে এই উদ্যোগে তিনি শুধু ব্যর্থ হবেন তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় তিনি এমনকি গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে নিজের সামাজিক ভিত্তিও হারাবেন। রাজনৈতিকভাবেও তিনি বুর্জোয়া ও সমাজগণতন্ত্রী পার্টিগুলির লেজুড়ে পরিণত হয়ে শেষ হবেন। এই পথের ওকালতি করে যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদের পার্টি ছেড়েছেন, তারা ইতিমধ্যেই এভাবে অধঃপতিত হয়েছেন।

যে শ্রেণীস্বার্থকে আমরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি, এই সব কমরেডরা তার সচেতন প্রতিনিধি হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং প্রতারক উদারপন্থী বুর্জোয়া ও সমাজগণতন্ত্রীদের প্রচারে প্রভাবিত হয়েছেন।

আমাদের পার্টিতে ছিলেন এমন একজন মহিলা কমরেডের কথায় আসা যাক, যিনি মহিলা আন্দোলনের ইস্যুগুলিতে সক্রিয় থাকতেন। যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ও আন্তরিক এই কমরেড একজন মহিলা নেত্রী হিসাবে গড়ে উঠবেন এরকম আশা করেছিলাম। কিন্তু চিন্তার জগতে অর্ধেক সময় তিনি প্রেমের স্বাধীনতার সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনায় ব্যয় করতেন। উগ্র নারীবাদী পেটি বুর্জোয়া মহিলা সংগঠনগুলির প্রতি এই কমরেড আকর্ষণ অনুভব করতেন। আমরা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে এই সব নারীবাদী মহিলা আন্দোলনগুলি সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু মহিলার আন্দোলন এবং যাঁরা পুরুষদের বিরুদ্ধে মহিলাদের লড়িয়ে দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বস্তুত বিশৃঙ্খলাকারীর ভূমিকাই পালন করছেন। আমরা তাঁকে এটা দেখার জন্য বলতাম, হাজার হাজার শ্রমজীবী মহিলা যদি আমাদের পার্টি পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল স্রোতে উৎসাহে ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তবে সেটিই তো প্রমাণ করে নারীমুক্তির প্রশ্ন এই আন্দোলনের এক উল্লেখ্যযোগ্য অংশ এবং অপরদিকে এই আন্দোলনগুলি মহিলা সমাজের মুক্তির প্রশ্নে একটা প্রভাব ফেলছে। যখন বিহারের পঞ্চাশ হাজারের দীর্ঘ মিছিলে মহিলারা ৩০ শতাংশ রয়েছেন, তখন বলাবাহুল্য, গণভিত্তিসম্পন্ন কোনো মহিলা আন্দোলনের ভিত্তি এধরনের ব্যাপক বিস্তৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই খুঁজতে হবে। অবশ্য আপনাকেও অনুসন্ধান করতে হবে ঠিক কীভাবে নীচুতলাবাদী আন্দোলনগুলি মহিলা প্রশ্নগুলিকে প্রতিফলিত করছে, তাঁদের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে এবং কীভাবে মহিলাদের মুক্তির প্রশ্নে তা ভূমিকা রাখছে। এগুলি অনুসন্ধান ও সূত্রবদ্ধ করেই আপনাকে স্বশাসিত একটি মহিলা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ‘স্বশাসন’ শব্দটি নিজেই বলছে এই স্বাধীনতা আপেক্ষিক এবং আন্দোলনের এক অবিভাজ্য অংশ হিসাবেই একে উপভোগ করতে হবে। বিপরীতে, উগ্র নারীবাদীরা এ ধরনের ‘স্বশাসিত মহিলা আন্দোলনগুলিকে’ গণতন্ত্রের জন্য বিস্তৃত আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। সংশ্লিষ্ট মহিলা কমরেডকে আমরা এ সবই বুঝিয়ে বলেছিলাম, এই ধরনের উগ্র নারীবাদী অবস্থান থেকে সরে থাকার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, অন্যথা তা ব্যাপক মহিলাদের থেকেই বিচ্ছিন্নতা ঘটাবে। মহিলাদের চেতনা ও তাঁদের সংগঠনগুলির অবস্থা থেকেই তাঁকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে আমরা বলেছিলাম। এটিই কি সমস্ত কমিউনিস্টদের সাধারণ অনুশীলন নয়? জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনে, আর অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে থেকে ধাপে ধাপে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে আমরা কিছু সমঝোতা করি না, যাকে আমরা শেষ বিচারে ভাঙতে চাই? এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ কি এক ধরনের সমঝোতা নয়? আমাদের সমস্ত ব্যাখ্যাই তাঁকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হল এবং বিষয়টি এখানে পৌঁছালো যে, আমরা ঐ মহিলা কমরেডকে পার্টি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হলাম, যেহেতু তাঁর উগ্র নারীবাদী চিন্তা-ভাবনাগুলি কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

আমি এখানে অধ্যয়নের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করার সাথে সাথে মার্কসবাদের বুনিয়াদী বিষয়গুলি অধ্যয়নের উপর জোর দেওয়ার কথা বললাম এবং অধ্যয়ন সম্পর্কে আমাদের সঠিক মনোভাব কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমার বক্তব্য রাখলাম। আমি বেশ কয়েকটি উদাহরণ রাখলাম যার মাধ্যমে দেখিয়েছি কিছু সৎ ও আন্তরিক ব্যবহারিক কর্মী কীভাবে অধ্যয়নকে অবহেলা করার জন্য মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন, যাঁরা নিজেদের বিশ্ববীক্ষাকে পাল্টে নিতে রাজি হননি।

এই রূপান্তর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এজন্য অধ্যয়ন এক নিয়মিত বিষয় হওয়া উচিত। অন্যথায় এই সমস্ত কমরেডের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল ভুল চিন্তাগুলি জমতে জমতে এমন জায়গায় পৌঁছল যখন নিজেদের পাল্টে নেওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।

আমার সহকর্মীদের একজন সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছেন, উন্নতমানের চিন্তা সর্বদাই সরল জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এর সাথে আমি বলব বিনয়ের সঙ্গেও তা যুক্ত।

আমি আশা করব, ব্যবহারিক কর্মীরা যাঁরা কাজের চাপের অজুহাতে অধ্যয়নকে এড়িয়ে চলেন, তাঁরা এই ধরনের নেতিবাচক শিক্ষকদের থেকে কিছু শিক্ষা নেবেন। জনপ্রিয় রূপেই বর্তমান শিক্ষা অভিযান চালাতে চেষ্টা করছি আমরা। পার্টির অভিজ্ঞ নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে জনপ্রিয় রূপে লেখা তৈরি করেছেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিকল্পনা আছে আপনাদের পরামর্শ ও সমালোচনাগুলি পাওয়ার পর এই সমস্ত রচনাগুলির উন্নত সংস্করণ প্রকাশ করবে, যা স্থায়ী পাঠ্য বিষয় হিসাবে কাজে লাগানো যাবে।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসান এক এককেন্দ্রিক বিশ্বের জন্ম দিয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তা প্রতিফলিত হয়েছিল, যখন সব বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারপাশে এক মহাজোটে সামিল হয়েছিল। তবে, এটা সাময়িক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। যখন, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় সংস্করণ ঘটাতে চাইল, মহাজোটে ফাটল দেখা দিল। রাশিয়া প্রকাশ্যে সমালোচনা করল, ফ্রান্স তার প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করালো, চীন সাদ্দামকে অভিনন্দন জানাল, জাপান সংযত হওয়ার উপদেশ দিল, এমনকি আরব মিত্ররা পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ন্যাটোর সম্প্রসারণের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ মতভেদ রীতিমতো প্রকট হল। ১৯৯১-এর পর থেকে, অর্থাৎ ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের সাথে সাথে, ফ্রান্স ও জার্মানি সারা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধারণা তুলে ধরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আশঙ্কা আছে যে, জার্মানি একবার নিজে বা ফ্রান্সের সাথে যুক্ত হয়ে, মধ্য ইউরোপে আধিপত্যকারী শক্তি হয়ে উঠলে, তারা ইউরেশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখতে রাশিয়ার সাথে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে। এক স্বাধীন রণনৈতিক সত্তা হিসাবে ইউরোপীয়দের গড়ে ওঠাকে বাধা দিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণে নেমে পড়ে এবং কোন কোন দেশকে গ্রহণ করা হবে, এব্যাপারে তার একতরফা সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেয়। ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেঁধে রাখতে ও আমেরিকার এককেন্দ্রিক আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। মস্কো ন্যাটোর এই সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্য এবং ভেটো অধিকার ছাড়া তার বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকবে এমন এক ন্যাটো-রাশিয়া স্থায়ী যুক্ত পরিষদের বিনিময়ে রাশিয়াকে তা স্বীকার করে নিতে হয়েছিল।

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে “ইতিবাচক সম্পর্কে”র কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে সে নাছোড়বান্দাভাবে চীনকে রোখার নীতি অনুসরণ করে চলে। চীন ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণে ও পশ্চিমদিকে চীনের সীমান্তবর্তী মধ্য এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রণনৈতিক সক্রিয়তায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ঘেরাও ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য, তাঁদের পারমাণবিক ও প্রথাগত সামর্থ্যকে আরও শক্তিশালী করা ছাড়াও চীনারা দ্রুত রাশিয়ার সাথে তাঁদের রণনৈতিক সহযোগিতাকে জোরদার করেছে। রাশিয়ান ও চীনা নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের পরে প্রচারিত যুক্ত ইস্তাহারে অঙ্গীকার করা হয়েছে যে, তাঁরা একবিংশ শতাব্দীতে রণনৈতিক আন্তঃক্রিয়ার উদ্দেশ্যে এবং এক বহুকেন্দ্রিক দুনিয়া গড়ে তোলার জন্য সমান অংশীদারিত্বের ভাগীদার হবেন। এই ঘটনা হচ্ছে নির্ণায়ক গুরুত্বের, কেননা এই প্রথম দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকান আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ও বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বললেন।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের যে সামরিক চুক্তি হয়েছে, তার আওতা থেকে তাইওয়ানকে বাদ দেওয়ার জন্য চীন জাপানের উপর চাপ দিচ্ছে। চীন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে জোরালো করছে এবং পূর্ব এশিয়ার নেতাদের এক সমাবেশে চীনের প্রধানমন্ত্রী “অযৌক্তিক পাশ্চাত্য ব্যবস্থা”র বিরুদ্ধে এবং এক “নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা”র কথা বলেন। চীনারা ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগাচ্ছে এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ও মুখর ভূমিকা গ্রহণ করছে। হংকং-এর একীকরণ চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও তার জাতীয়তাবাদী ভিত্তি উভয়কেই আরও জোরদার করেছে।

লেনিন বলেছিলেন যে, এটা খুবই সম্ভব যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি কিছু অঞ্চলের “শান্তিপূর্ণ” ভাগাভাগির জন্য কোনো জোট গড়ে তুলছে। “কিন্তু প্রশ্ন হল ঐ ধরনের জোটগুলি স্থায়ী হবে কি এবং সেগুলি সংঘর্ষ, সংঘাত ও সংগ্রামগুলিকে সমস্ত সম্ভাব্য রূপে পরিহার করবে কি?

“পুঁজিবাদের অধীনে প্রভাবাধীন এলাকা, ইত্যাদি ভাগাভাগির একমাত্র বোধগম্য ভিত্তি হচ্ছে শক্তির একটা হিসাব আর শক্তি সমান মাত্রায় পরিবর্তিত হয় না, কারণ বিভিন্ন উদ্যোগ, ট্রাস্ট, ইত্যাদির সম বিকাশ অসম্ভব।

“সুতরাং, সাধারণ জোটগুলি হচ্ছে যুদ্ধের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি কালের মতো। শান্তিপূর্ণ জোটগুলি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং বিপরীতক্রমে তা যুদ্ধ থেকেই উদ্ভূত হয়। একটি অপরটির শর্ত সৃষ্টি করে।”

এভাবে, এককেন্দ্রিক বিশ্ব হচ্ছে সময়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন। বস্তুগত প্রক্রিয়া বহুকেন্দ্রিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া, ইউরোপ এবং চীন-রাশিয়া অক্ষ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে উদ্ভূত হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া জুড়ে তার আধিপত্য খাটাতে বদ্ধপরিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষাটের দশকে শুরু হওয়া কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, ইরাক ও ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং চীন, রাশিয়া ও জাপানকে ভয় দেখানোর মতো নীতিগুলি অনুসরণ করে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য-যুদ্ধে রত। ভারত সহ আরও অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔদ্ধত্য সহকারে হস্তক্ষেপ করছে এবং এসবের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগায়, সেই সাথে রাষ্ট্রপুঞ্জকেও কাজে লাগায়, যা সম্প্রতি মার্কিন নীতি অনুসরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

অতএব, ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলির কাছে এই বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় প্রশ্ন চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণনীতিতে চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য-রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে ভারত খাপ খেয়ে যায়। এই প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি রীতিমতো অস্পষ্ট। যদিও সম্প্রতি, চীন-ভারত সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নতিলাভ করেছে, তথাপি ভারতে এক শক্তিশালী মার্কিনপন্থী মহল রয়েছে, যারা চীনের সম্প্রসারণবাদী মতলবের ধুয়ো তোলে, তিব্বত প্রশ্নে শোরগোল করে, চীনকে ভারতের প্রধান বাণিজ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্থিত করে, ইত্যাদি।

আমরা পরমাণু-বিস্তার বিরোধী চুক্তিতে ও সামগ্রিক পরীক্ষা বন্ধ রাখার চুক্তিতে ভারতের স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম, কারণ এক সার্বভৌম দেশ হিসাবে ভারতের স্বাধীনতা থাকা উচিত তার গতিপথ নির্ধারণ করার ও মার্কিন হুকুমের কাছে নতিস্বীকার না করার। কিন্তু আমাদের সামনে দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি-সম্পন্ন গুজরাল মতবাদ সত্ত্বেও ও পাকিস্তানের সাথে কথাবার্তায় এক সূত্রপাত ঘটানো সত্ত্বেও, নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভূত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। কাশ্মীর সমস্যা সহ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বকেয়া সমস্যাগুলির সমাধান হতে পারে কেবলমাত্র সহযোগিতার এক প্রশস্ততর কাঠামোর মধ্যে, যেখানে এক শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট হিসাবে সার্কভুক্ত বিকাশশীল দেশগুলি থাকবে এবং পাকিস্তানের সাথে এক দ্বিপাক্ষিক পরমাণু প্রসার-বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করার মধ্যে আর বহুকেন্দ্রিতকতার প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতের উচিত চীনের সাথে রণনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখা। কিন্তু, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা, যার সাথে পশ্চিমের রয়েছে অজস্র প্রকাশ্য ও গোপন বন্ধন, তার পক্ষে এই পথে চলা খুবই অসম্ভব।

বিশ্বায়নের ফল ইউরোপে ইতিমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে, সেখানে কর্মহীনতার হার ১১ শতাংশে পৌঁছেছে (স্পষ্ট ভাষায়, দুই কোটি মানুষ সেখানে কর্মহীন), এ সংখ্যাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেকার মহামন্দার সাথেই তুলনীয়। ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে বেকারী ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। এর সাথে সামাজিক কল্যাণে ব্যাপক ব্যয় হ্রাস ফ্রান্সে প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের ঢেউয়ের জন্ম দিয়েছিল।

ফ্রান্সে নির্বাচনে বামপন্থীদের জয় বা অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে নির্বাচনে শাসক পার্টিগুলির পরাজয় ছিল মূলত উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীদের কোয়ালিশনের সাম্প্রতিক জয় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতিকে থ্যাচারপন্থী ধারায় চালিত করা এবং বর্ণবিদ্বেষী বহিরাগত-বিরোধী দক্ষিণপন্থী আইন প্রণয়নের প্রয়াসকে ব্যর্থ করতে ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণী যে নির্ধারক জনপ্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তার পরেই আসে এই জয়। এর বিপরীতে ব্রিটেনে নয়া লেবার দলের জয়ের সঙ্গে সমাজতন্ত্র ও সমাজগণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। যাকে বলা উচিত নয়া রক্ষণশীল, তাকে ঘুরিয়ে নয়া লেবার বললে তার সম্পর্কে ভুল ধারণারই সৃষ্টি হয়। কাজেই ইউরোপের তথাকথিত বাম ঝোঁক সম্পর্কে উচ্ছ্বাস স্পষ্টতই ভিত্তিহীন।

ইউরোপীয় মুদ্রা ইউনিয়ন ও অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর ১৯৯৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে প্রচলন শ্রমিকশ্রেণীর কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি বহন করে না। পক্ষান্তরে, ঐক্যবদ্ধ ইউরোপে এক একটি দেশ প্রতিযোগিতামূলক দিক থেকে সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে শ্রমিকদের ওপর বাঁধনকে আরও তীব্র করছে। ফলে শ্রমিকশ্রেণী একীকরণের সমগ্র প্রয়াসের বিরোধিতা করছে এবং তার বিরুদ্ধে বড় বড় প্রতিবাদ সংগঠিত করছে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের প্রজাতন্ত্রগুলির অর্থনীতি এখনও উত্তরশীল পর্যায়ের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আটকে রয়েছে এবং সেগুলির স্থায়ী পঙ্গুত্বপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত নয়া-উদারনৈতিক সর্বরোগহর দাওয়াই এই সংকট সমাধানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই সমস্ত দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র-পরবর্তী শাসন ব্যবস্থাগুলির প্রতি জন-অসন্তোষের মধ্যে এই অর্থনৈতিক বাস্তবতার রাজনৈতিক প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সোভিয়েত পুতুল সরকারগুলির বদলে বসানো পশ্চিমী পুতুল সরকারগুলি এই সমস্ত দেশগুলিতে শীঘ্রই পতনের মুখে পড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্তন কমিউনিস্টরা, যাঁদের মাটিতে শিকড় বেশি ছিল বলে মনে হয়, তাঁরা কমিউনিস্ট তকমা বাদ দিয়ে ফিরে আসেন।

এই বছরে রাশিয়ায় লক্ষ লক্ষ ক্রূদ্ধ শ্রমিক বকেয়া মজুরি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক পরিষেবা ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পতনের পরে এই প্রথম শ্রেণীগত সক্রিতায় ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছেন।

আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশে দেশেও নয়া উদারনীতির সংকট সুস্পষ্ট। এর ফলে নয়া-উদারনীতিবাদীদের নিষ্ঠাবান বড় বড় পাণ্ডাদের মধ্যেই মতভেদের জন্ম হয়েছে এবং শোনা যায় জাপান অর্থনীতির উপরিস্তরে স্থায়িত্ব ও কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের নয়া উদারনৈতিক নীতিগুচ্ছের বিজ্ঞতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এই বছরের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের মূল বিষয় ছিল অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নির্ণায়ক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বলা হচ্ছে যে, নয়া-উদারনৈতিক তাত্ত্বিক আলোচনায় রাষ্ট্রের এই সাম্প্রতিক পুনরুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যকার মতপার্থক্যেরই পরিণাম। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক মুদ্রাসংক্রান্ত আলোড়নের অব্যবহিত পরে এই মদভেদ তীব্রতর হতে শুরু করেছে এবং তা আরও জোরালোভাবে প্রকাশ্যে এসেছে, যখন জাপান মুদ্রা-সংক্রান্ত ফাটকাবাজির উপর বিধিনিষেধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছে এবং এশিয়ার জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের এক অর্থভাণ্ডারের প্রস্তাব করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার হংকং-এর তার সাম্প্রতিক সভায় জাপানের এই সমস্ত প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেছে এই বলে যে, শর্ত আরোপের উৎস একটিই হওয়া উচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারী ৬ শতাংশ রয়েছে, কিন্তু পরিষেবা ক্ষেত্রে কম বেতনের চাকুরির অনুপাত বেড়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হচ্ছে, কিন্তু অনেকগুলিই অস্থায়ী, নিরাপত্তাহীন ও ভবিষ্যতহীন। যে জাপানকে অতিসম্প্রতি পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রগতির নমুনা হিসাবে দেখনো হত এবং ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাঁদের শ্রমিকদের কাছে যে জাপানী শ্রমিকদের সহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রচার করার কোনো সুযোগই ছাড়ত না এই বলে যে সে সহযোগিতামূলক মনোভাব নাকি জাপানে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে – সেই জাপানের জৌলুস অনেক কমেছে। আশির দশকের সেই উত্তুঙ্গ দিনগুলি বিগত হয়েছে, যে দিনগুলিতে জাপানী কোম্পানিগুলিকে মনে হতো অপ্রতিরোধ্য। স্টক মার্কেটের তেজীর সাত বছর পরে জাপান এখন গভীর সমস্যায় পড়েছে। মন্দাকে জয় করার সমস্ত প্রচেষ্টারই ফল হয়েছে সামান্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে চাপ দিয়ে চলেছে তার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য এবং তার বাজারকে আমেরিকার পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করার জন্য। একদিকে জাপান রাজনৈতিক অস্থায়ীত্বের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, অন্যদিকে ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টি বিগত নির্বাচনে ভালো ফল করেছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে যাদেরকে সোৎসাহে নমুনা হিসাবে তুলে ধরা হত, সেই এশীয় “বাঘ” অর্থনীতিগুলি এখন সংকটের জালে আটকে পড়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বৃদ্ধির হার কমে আসছে এবং বাণিজ্য ভারসাম্য বিপর্যস্ত। ৩৭ হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদে দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যে কেঁপে উঠেছে। এখন শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। নতুন শ্রম আইনের বিরুদ্ধে – যার ফলে মালিকের পক্ষে শ্রমিক ছাঁটাই সহজতর হত – হাজার হাজার শ্রমিক সিওল ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় মিছিল করেছে। থাইল্যান্ডের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে ৯০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, রপ্তানি কমে গেছে, চলতি খাতে ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এর ফলে থাই মুদ্রার মূল্য আবার পড়ে যায়, তার কম্পন শীঘ্রই দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পৌঁছায়। ১৬ বিলিয়ন ডলারের এক ঋণ আইএমএফ বন্দোবস্ত করে – যার ১ বিলিয়ন ডলার, মজার কথা, চীন দেবে বলে কথা দিয়েছিল, যাতে থাইল্যান্ডকে সংকট থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু বর্তমানে ঐ অঞ্চলকে আরেক দফা মুদ্রা-সংক্রান্ত আলোড়ন গ্রাস করেছে। বাঘেরা ক্লান্তির চিহ্ন দেখাতে শুরু করেছে এবং আগামী বছরগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীর জঙ্গী কার্যকলাপ তীব্রতর হতে বাধ্য।

বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মুদ্রার উপর আক্রমণ এবং পুঁজির সহসা অন্তর্ধানের ফলে ঐ অর্থনীতিগুলির দুর্বল হয়ে পড়া – মেক্সিকোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যা সর্বপ্রথম অত্যন্ত তীব্র আকারে দেখা গিয়েছিল – এক ব্যাপকতর পরিঘটনা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বিশ্বায়নের যুগে তৃতীয় বিশ্বের অনেক অর্থনীতিকেই প্রতিরোধহীন করে তুলেছে। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বায়নের সাত বছরে বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধির রেকর্ড অনুজ্জ্বলই রয়েছে – এই সময়ে গড় বৃদ্ধির হার সত্তরের দশকের হারের নীচেই রয়েছে।

চীনা ধাঁধাঁ

পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে কেবলমাত্র চীনা মুদ্রা ইউয়ানই মজবুত হয়ে ছিল। এটা চীনের অর্থনীতির বুনিয়াদী দিকগুলির শক্তি দেখিয়ে দেয়, সাথে সাথে চীনের আর্থিক ব্যবস্থাপনার শক্তিও দেখায়, যে ব্যবস্থাপনা ফাটকাবাজির বিশেষ সুযোগ দেয় না। চীনের অর্থনীতি বছরে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর চীনের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ২০০ বিলিয়ন ডলারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণ খুব কম। চীন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে যার ৮০ শতাংশই আসে প্রবাসী চীনাদের কাছ থেকে।

যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিই এখনো ১৭ কোটি শহুরে কর্মীবাহিনীর ব্যাপক অংশকে নিয়োগ করে, তবে মোট শিল্পীয় উৎপাদনে তাদের অংশ এক-তৃতীয়াংশেরও কমে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৮ সালে যখন সংস্কার শুরু হয়, তখন তা ছিল তিন-চতুর্থাশেরও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলি গভীর সংকটে রয়েছে এবং জানা গেছে যে, শত সহস্র শ্রমিকেরা মাসের পর মাস বেতনহীন অবস্থায় রয়েছেন। রুগ্ন রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলি কর্তৃক দেওয়া ঋণের পরিমাণ গত বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলার। তবে ঋণের অনেকটাই গেছে কেবলমাত্র মজুরি দিতে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদ্য সমাপ্ত কংগ্রেসের সর্বপ্রধান আলোচ্যসূচি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্কার। পুঁজিবাদী ক্ষেত্র বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চলেছে এবং চীন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টি “সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি” কথাটি চালু করেছে। তা এই যুক্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে যে, এক সামগ্রিক সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরে, যথা কমিউনিস্ট পার্টির শাসন, পরিকল্পনা ও লগ্নির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদির ভিতরে সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য বাজারকে পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যবহার করা যেতে পারে। একে তাঁরা বলছেন সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক স্তর এবং মনে করছেন যে আগামী ৫০ বছর ধরে তা চলবে, যতদিন না পর্যন্ত চীন মোটামুটি বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলির সমান মাথাপিছু আয় অর্জন করছে। সমাজতন্ত্রের সম্বন্ধে চিরায়ত মার্কসবাদী তত্ত্বের এই সংশোধনই চীনা বৈশিষ্ট্য সমন্বিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের দেং জিয়াও পিং-এর তত্ত্ব বলে পরিচিত। ১৯৫০ সাল থেকে সিপিসি-র মধ্যকার দুই লাইনের সংগ্রামে ফিরে গিয়ে আমরা এই তত্ত্বের উৎপত্তি সন্ধান করতে পারি।

একটি একক দেশে, তাও আবার পশ্চাদপদ এক এশীয় দেশে, সমাজতন্ত্র নির্মাণের যে বিরাট অসুবিধা আছে, আমরা তা স্বীকার করি।

আমরা সেই পদ্ধতিকেও খণ্ডন করি যা সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নকে বিমূর্তভাবে, এক কাল্পনিক মডেল হিসাবে আলোচনা করে, যেন সমাজতন্ত্রকে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে নিছক ইচ্ছাশক্তির জোরে উঠিয়ে এনে লাগানো যেতে পারে। পরিবর্তে আমরা সমাজতন্ত্রকে দেখি পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বগুলি থেকে বেরিয়ে আসা এক সমাজ হিসাবে, ইতিহাসের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে এবং তাই ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহকারী হিসাবে।

তবুও, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সমগ্র ধারণাটি অত্যন্ত বিতর্কমূলক বলে মনে হয়। চীনা অর্থনীতির ব্যাপক পরিমাণে পুঁজিবাদী হয়ে ওঠা, আঞ্চলিক বৈষম্য ও ধনী-দরিদ্র ফারাক বেড়ে চলা, নব্য ধনীর এক সমগ্র নতুন শ্রেণী উঠে আসা, দুর্নীতি রীতিমতো অবাধ হয়ে ওঠা – ইত্যাদি ঘটনাগুলি বিবেচনা করে আমরা চীনা সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতররূপে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।

(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৭ থেকে)

“বিড়াল যদি ইঁদুর ধরতে পারে তবে তা সাদা না কালো তা দেখার দরকার নেই”। দেং-এর এই বিখ্যাত উক্তি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে যা জানা গেছে তা হল, উল্লিখিত বিড়ালটি হলুদ, সাদা নয়।

চীনের প্রবীণ বিপ্লবীদের মধ্যে সর্বশেষ যোগসূত্র দেং শিয়াও পিং তাঁর সত্তর বছরব্যাপী রাজনৈতিক জীবনে এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসাবেই থেকে গিয়েছিলেন। দেং চীনে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করছিলেন না পুঁজিবাদকে বিকশিত করছিলেন সে বিতর্ক অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে; তবুও একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই তাঁর পরিচালনায় চীন মাত্র দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের গতিকে বিশ্বের ইতিহাসের নিরীখে অতুলনীয় হিসাবে – এক বিস্ময় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা মোটামুটি এক দশক কালের মধ্যে চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অতিবৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার মতো অবস্থায় রয়েছে, যার স্থান হবে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই।

চীনে বিপ্লবোত্তর পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মাও ও দেং-এর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে। দেং মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের পর্যায়ে পশ্চাদপদ উৎপাদিকা শক্তি ও উন্নত উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বই হল চীনা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব। অন্যভাবে বলতে গেলে, উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটানো না গেলে উন্নত উৎপাদন সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা যাবে না, ফলে সমাজতন্ত্র এক কল্পকথা হয়েই থাকবে। আর তাই লিউ শাও চি-র সঙ্গে তিনিও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপরই প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপের কথা বলেন। আর উৎপাদন সম্পর্কের বিষয়টির ধাপে ধাপে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানোর কথা বলেন।

চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে নতুন চীন সমাজতন্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই সেখানে এক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে আন্তঃপার্টি বিতর্ক তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং পরিণামস্বরূপ তা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দেয়। লিউ শাও চি-র পর দেং-কে ‘পুঁজিবাদী পথের দু-নম্বর পথিক’ হিসাবে অভিহিত করা হয় এবং তাঁকে বেজিং থেকে অনেক দূরে এক কারখানায় এক সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পাঠানো হয়। শোনা যায় দেং অন্ততপক্ষে দু-বার আত্মসমালোচনা করেছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন যে তিনি সত্যিই পুঁজিবাদী পথের পথিক ছিলেন।

এসব সত্ত্বেও যে আদর্শবোধগুলি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পিছনে প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল, যেমন পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তনের বিপদকে প্রতিহত করা, উন্নত সমাজতান্ত্রিক সচেতনতার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলা ইত্যাদি কিন্তু সুদূরের স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিল, এবং দীর্ঘ দশ বছর পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সবথেকে বড় প্রবক্তা লিন পিয়াও ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে প্রমাণিত হলেন, যিনি মাও-কে হত্যা করে ক্ষমতা কব্জা করার চক্রান্ত করেছিলেন। লিন পিয়াও-এর চক্রান্ত ব্যর্থ করার কৃতিত্ব কিন্তু ছিল চৌ এন লাই-এর, সাংস্কৃতিক বিপ্লবপন্থীদের তুলনায় যিনি যথেষ্ট নরমপন্থী বলেই পরিচিত। মাও দেং-কে ফিরিয়ে আনেন, কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন এক সংক্ষিপ্ত সময়কালের জন্যই হয়েছিল। চৌ-এর মৃত্যুর পর কুখ্যাত চারচক্রের দুরভিসন্ধি দেং-কে পুনরায় অপসারিত করে। মাও-এর মৃত্যুর পর এবং চারচক্রের স্বরূপ আরও উন্মোচিত হওয়ায় দেং-এর নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে এবং তারপর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন চীনের সর্বময় নেতা।

তিনি প্রাথমিক স্তরের সমাজতন্ত্রের ধারণাকে সামনে আনেন – যা অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী এক স্তর – এবং উৎপাদন সম্পর্কের আমূল পুনর্বিন্যাস ঘটান আর বিদেশী পুঁজি ও প্রযুক্তির ব্যাপক আমদানির জন্য চীনের দরজা খুলে দেন। ‘প্রথমে কিছু অঞ্চল বিকশিত হোক’ – এই প্রেক্ষিতের উপর ভিত্তি করে তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করেন।

পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়া তাঁর আর্থিক সংস্কারের নীতিকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায়। এর থেকে পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক সংস্কারের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে পশ্চিমী দুনিয়ায় ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা যায়, যে সংস্কার চীনে কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়া শাসনের অবসান ঘটাবে এবং বহু-দলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার জন্ম দেবে।

এই ক্ষেত্রে দেং কিন্তু নিজেকে কট্টরপন্থী হিসাবেই প্রমাণিত করলেন। তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিকে তিনি নির্মমভাবে চূর্ণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা দেখাননি। এর জন্য বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যম তাঁকে ঐ ঘটনার খলনায়ক হিসাবেই তুলে ধরে।

মাও-এর প্রবল ভাবমূর্তি সম্পন্ন নেতৃত্বে গঠিত সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামোর উপর ভিত্তি করেই দেং আধুনিক চীনের উপরিকাঠামোকে গড়ে তুলেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির শাসন ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতবদ্ধ মাও এবং দেং উভয়েই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং উভয়েই তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকার চূড়ান্ত স্ফূরণ ঘটিয়েছেন। তবুও মাও যে লাখ টাকার প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন, ‘কে জিতবে, সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ?’ সে প্রশ্নের মীমাংসা যেমন মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারেনি, তেমনি করতে পারেনি দেং-এর সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণের কর্মসূচি। কোন পথে এর মীমাংসা হবে, সে প্রশ্ন একবিংশ শতাব্দীর চীনকেও তাড়িত করবে।

তাঁর জীবনে দু-দুবার পুনর্বাসিত হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন দেং শিয়াও পিং। প্রবাদের বিড়ালের মতোই – সাদা বা হলুদ যাই হোক না কেন তিনি ছিলেন প্রবল জীবনীশক্তির অধিকারী।

যে সমস্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় বিংশ শতাব্দী রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তাদের শেষতম মহান ব্যক্তির প্রতি লিবারেশন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।

(ডিসেম্বর ২৬, ১৯৯৩, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির আয়োজিত মাও জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ থেকে)

মাও সে তুঙের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সারা দেশ জুড়ে অনেক আলোচনা শুরু হয়েছে, অনেক লেখা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাও সে তুঙের প্রতি নতুন করে এই জানা-বোঝার আগ্রহ অনেক আশা জাগায়। এমনকি যাঁরা কাল পর্যন্তও মনে করতেন যে পুঁজিবাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদে ফিরে যেতে পারে না, তা শুধু বিকশিত সমাজতন্ত্র ও তারপরে সাম্যবাদের দিকেই এগোবে এবং যাঁরা মাও-এর দ্বন্দ্ব সম্পর্কে রচনা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন আজ তাঁদেরও দেখছি মাও-এর দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনার প্রশংসা করছেন। এই বিতর্ক, এই আলাপ-আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এটা ঠিকই কেউ কেউ তাঁদের সমাজগণতান্ত্রিক কাঠামোতে মাও-কে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাবেন, কেউ চেষ্টা চালাবেন তাঁদের ভাববাদী-নৈরাজ্যবাদী ধারণাগুলির সঙ্গে মাও এবং তাঁর চিন্তাকে খাপ খাইয়ে নিতে। যাই হোক, মাও নিয়ে এই বিতর্ক, এই আলাপ-আলোচনা মাও এবং তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে এক সর্বাঙ্গীন ও সঠিক উপলব্ধিতে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এটা এই কারণে আরও বেশি প্রয়োজনীয় কারণ ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মাও ও তাঁর চিন্তাধারার প্রশ্ন চিরদিনই এক বিতর্কিত প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নে এক সঠিক ও ঐক্যবদ্ধ ধারণা ছাড়া, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যেতে পারে না। এই সমস্ত কারণে যে বিতর্ক, যে আলোচনা মাও-কে নিয়ে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে শুরু হয়েছে তাকে আমি স্বাগত জানাই।

সত্তরের দশকের শুরুতে অদ্ভুত একটা স্লোগান কলকাতার দেওয়ালে ভরে গিয়েছিল – “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। হাজারে হাজারে যুবকেরা, তরুণেরা একটা বিপ্লবী আহ্বানের প্রতীক হিসাবে এই শ্লোগানে সোচ্চার হয়েছিল। অনেকেই স্লোগানটির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, কেউ কেউ বলেছেন এটা আমাদের জাতীয় ভাবনার, দেশপ্রেমের পরিপন্থী। শোনা যায় এমনকি মাও নিজেও নাকি এই শ্লোগানের বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীকালে আমাদের পার্টিও এই স্লোগান তুলে নেয়। কিন্তু কঠিন প্রশ্ন একটা থেকেই যায় – হঠাৎ ভারতবর্ষের এই হাজার হাজার যুবক কেন তাদের বিপ্লবী উদ্দীপনার ভাবপ্রকাশ এই শ্লোগানের মধ্যে করতে চেয়েছিল? তারা কারোর চেয়ে কম দেশপ্রেমিক ছিল না, তাদের জাতীয় ভাবনা কারোর চেয়ে কম ছিল না। মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি – এই স্বপ্ন নিয়েই তাঁরা হাজারে হাজারে মূল্যবান জীবন বলিদান করেছেন। তবু এই স্লোগান তাঁরা কেন দিয়েছিলেন? অন্যকথায় চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ কীভাবে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের নেতা হয়ে উঠেছিলেন, কেমন করেই বা দেশে দেশে যুবকদের কাছে, বিপ্লবী জনসাধারণের কাছে তাঁদের আপনজন, তাঁদের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন? এর উত্তর পেতে হলে সেসময়কার ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কথা জানা দরকার।

ষাটের দশকের সোভিয়েত নেতৃত্ব হঠাৎ করে বলতে শুরু করলেন, আণবিক বোমার আবির্ভাবের পর থেকে সমস্ত কিছু পাল্টে গেছে। এখন সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে আণবিক বোমা আছে এবং নিমেষেই অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলতে পারে ও তা গোটা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কাজেই আর শ্রেণীযুদ্ধ নয়। আর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নয়। এমন কিছু চলবে না যা সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচিত করতে পারে। তাঁরা বললেন আজকের নতুন যুগে, আণবিক যুগে মার্কসবাদের নতুন পরিভাষা সংজ্ঞা বার করতে হবে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আধুনিক সংশোধনবাদের জন্ম হল। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের পক্ষে এর বিরুদ্ধে মাও সেদিন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, যে কোনো অস্ত্রই হোক না কেন, তা সে যতই উন্নত হোক বা তার ধ্বংসের ক্ষমতা যতই বেশি হোক না কেন তা মানব সমাজের মৌলিক বিষয়গুলিকে পাল্টে দিতে পারে না। বিশ্ব ইতিহাসের চালিকাশক্তি জনগণ, শুধুমাত্র জনগণ – কোনও আধুনিক পারমাণবিক বোমা নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা যখন আণবিক বোমার জুজুর ভয় দেখিয়ে বিশ্বজুড়ে বিপ্লবী সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছিল তখন মাও সেই বিখ্যাত ঘোষণা করেছিলেন – আণবিক বোমা একটি কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সন্ধিক্ষণে মাও-এর এই দৃঢ় আত্মঘোষণাই শোষিত নিপীড়িত মানুষকে সর্বত্রই সাহস যুগিয়েছিল, তাঁদের সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় প্রেরণা দিয়েছিল।

মাও আরও বলেছিলেন যে একটি ছোটো শক্তি ক্রমে ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে একটি বড় শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। এভাবে ষাটের দশকে যখন সংশোধনবাদের প্রভাবে মার্কসবাদের অস্তিত্ব বিপদের সম্মুখীন হতে বসেছিল, সেই সময় মাও-এর এই আওয়াজ পৃথিবীর মানুষকে ভরসা জুগিয়েছিল এবং তিনি চীনের সীমান্ত ছাড়িয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার তথা সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত বিপ্লবী মানুষের কাছে তাঁদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।

মাও সে তুঙ চিন্তাধারার উদ্ভবের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। মার্কস-এঙ্গেলস সর্বহারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন এবং তাঁরা মনে করতেন এই বিপ্লব উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে শুরু হবে এবং সেই সব দেশের বিজয়ী সর্বহারা পরবর্তীকালে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিপ্লব এই সোজা পথ নেয়নি। সর্বাহারা বিপ্লব প্রথমে রাশিয়ায় ঘটল। লেনিনের প্রত্যাশা ছিল যে রুশ বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে বিপ্লবের আগুন জ্বালাবে। তাও ঘটেনি। লেনিন তাই রুশ বিপ্লবের সাথে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এক জীবন্ত সম্পর্কের ওপর জোর দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে বিশ্ব বিপ্লবের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হচ্ছে এশিয়ার দিকে। তিনি প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের বললেন তাদের দেশের বিপ্লবের পথের বিষয়ে মার্কসবাদের বইগুলি থেকে বিশেষ কিছুই তাঁরা পাবেন না। কমিউনিজমের সাধারণ নীতিগুলি এবং অবশ্যই অক্টোবর বিপ্লবের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে তাঁদের পথ নিজেদেরই বার করতে হবে।

মাও চিন্তাধারার আবির্ভাব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বিপ্লবের কেন্দ্র যেহেতু স্থানান্তরিত হয়েছিল প্রাচ্যে, এশিয়ায়, তাই সেখান থেকে নতুন এক বিপ্লবী তত্ত্বের আবির্ভাব হওয়া ঐতিহাসিকভাবে অবশ্যম্ভাবী ছিল – যা ভারত থেকে হতে পারত। বাস্তবে সেটা চীন থেকেই হল এবং মাও হলেন সেই ঐতিহাসিক অনিবার্যতারই ফসল।

এক আধা-উপনিবেশিক দেশ চীনের কৃষক জনসাধারণের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে মাও পরীক্ষা চালিয়ে দেখলেন ও তাকে কাজে লাগিয়ে এমনকি বিপ্লব সম্পূর্ণ করতে এক সশস্ত্র লাল সৈন্যবাহিনীও গড়ে তুললেন।  সর্বহারার ইতিহাসে কৃষক জনসাধারণের এই ভূমিকা মার্কসবাদের ভাণ্ডারে এক বিশিষ্ট অবদান। জাতীয় চেতনাকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তমোর্চা গঠন করা হল মার্কবাদের ভাণ্ডারে তাঁর আর একটি বিশেষ অবদান।

নিজের চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাও-কে নিজের পার্টির ভিতরে এবং কমিন্টার্ণের বিরুদ্ধেও তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর লাইন, মতাদর্শ ও তাঁর চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করেন।

স্তালিন সম্পর্কে মাও-এর বিরাট শ্রদ্ধা ছিল, তিনি স্তালিনকে এক মহান বিপ্লবী নেতা হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি, একমাত্র তিনিই স্তালিনের ভুলত্রুটির মতাদর্শগত উৎসকে চিহ্নিত করেছেন। যখন স্তালিনের বিরুদ্ধে চারদিকে ব্যক্তিগত কুৎসা চলছিল, তাঁকে অপরাধী বানানো হচ্ছিল মাও তখন সমাজতন্ত্র গঠনে তাঁর অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। স্তালিনে ভুলগুলির মতাদর্শগত উৎসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় মাও বলেছেন যে স্তালিনের মধ্যে ভালো পরিমাণে অধিবিদ্যা ছিল, একপেশেপনা ছিল।

চীনে সমাজতন্ত্র গঠন করতে গিয়ে মাও অন্ধভাবে সোভিয়েত মডেলের নকল করার বিরোধিতা করেছিলেন। সোভিয়েত পার্টিকে সর্বোচ্চ পার্টি হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতাও তিনি করেছিলেন এবং সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিবৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বারংবার গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যতই শক্তিশালী হয়ে উঠুক না কেন তার কখনই বৃহৎশক্তি হওয়া উচিত নয়, কখনই অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা এবং সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে অন্যান্য দেশ দখল করা উচিত নয়। সোভিয়েত সেনারা যখন সমাজতন্ত্রকে রক্ষার নামে পূর্ব ইউরোপ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছিল, তখন মাও দৃঢ়ভাবে এই অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ আচরণের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যদি বৃহৎশক্তির মতো আচরণ করে তবে তার সমাজতন্ত্র আর প্রকৃত সমাজতন্ত্র থাকে না।

মাও শুধু ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদেরই বিরোধতা করেননি, স্তালিনীয় অধিবিদ্যারও বিরোধিতা করেছিলেন। আমাদের পার্টির মতে, মাও চিন্তাধারাকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে তার এই উভয় দিক সম্বন্ধে অবশ্যই জানাবোঝার প্রয়োজন আছে।

মাও বারবার বলতেন পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের এখনও মীমাংসা হয়নি। তিনি বললেন এই সংগ্রাম বহু বছর ধরে, এমনকি কয়েকশো বছর ধরে চলতে পারে এবং সেই লড়াইয়ে কে জিতবে আর কে হারবে সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়ে যায়নি। সোভিয়েত নেতৃত্বের দাবি ছিল সমাজতন্ত্র কেবলমাত্র বিকশিত সমাজতন্ত্র ও তারপর সাম্যবাদের পথেই এগোতে পারে। মাও বললেন, তা ঠিক নয়, ভুল। এটি ছিল মার্কসবাদী দর্শন ও তত্ত্বের ক্ষেত্রে মাও-এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

তিনি এও বলেছিলেন ঠিক কীভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ রূপান্তরিত হয়ে পুঁজিবাদে ফিরে যেতে পারে। তাঁর মতে সমাজতান্ত্রিক দেশেও শ্রেণীসংগ্রাম থাকে এবং একটি বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকে। এই বুর্জোয়াশ্রেণী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নিজেকে সংগঠিত করে ও পুঁজিবাদের পথিকরা কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর থেকেই জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলীতে এই বিশ্লেষণের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার, পুঁজিবাদের পথিকদের পার্টির ভিতর থেকেই সদর দপ্তর দখল করার কথা তিনি ঠিক যেভাবে বলেছিলেন বাস্তবে রাশিয়ায় সেভাবেই ফলে গেছে। বিশেষত সোভিয়েতের পতনের পর মাও-এর চিন্তাধারার প্রতি মানুষ যে আরও বেশি বেশি করে আকৃষ্ট হচ্ছেন তার মূল কারণ নিহিত রয়েছে এখানেই।

বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে কীভাবে এই বিরাট গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করা যায় মাও সেই চেষ্টা করেছিলেন। এব্যাপারে মাও চীনের ক্ষেত্রে যা প্রয়োগ করেছিলেন তা পরিচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব শেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শেষে দেখা গেল এমন কিছু লোক যারা কমিউনিস্টই ছিল না তারা পার্টিতে ক্ষমতা দখল করল। শেষ পর্যন্ত মাও-কে ১৯৭৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমাপ্তি ঘোষণা করতে হল এবং দেং শিয়াও পিং-কে আবার ফিরিয়ে আনতে হল। প্রাথমিক বিশ্লেষণে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তা পূরণ হয়নি বরং অনেকক্ষেত্রেই বিপরীত ফল দিয়েছে।

যাই হোক, অমীমাংসিত প্রশ্নগুলি মাও-এর চিন্তাধারা আরও বিকাশ সাধনের জন্য শর্তগুলি সৃষ্টি করে। বিপ্লবের ইতিহাসে প্রতিটি পর্বে কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায় এবং এগুলি আবার মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভবিষ্যত বিকাশের জন্য শর্ত হাজির করে। বারবার ব্যর্থতার পরই সফলতা আসে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু সেটা কোনো বড় কথা নয়। বড় কথা হল মাও প্রকৃত প্রশ্নগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন এবং সেগুলি সমাধানের এক চেষ্টা করেছিলেন। বিপদ যে বাস্তব তা প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা এইসব প্রশ্নের সমাধানের যে প্রচেষ্টা চালাবেন তা মাও-এর প্রচেষ্টার অন্তর্বস্তুর ওপর বিরাটভাবে ভিত্তি করেই চলবে।

অনেকেই আজ মাও সে তুঙ-এর মূল্যায়ন করছেন। অবশ্যই সেটা প্রয়োজন। কিন্তু মাও-এর সামগ্রিক মূল্যায়ন সম্পর্কে শেষ কথা বলার মতো পরিস্থিতি এসে গেছে বলে আমি মনে করি না। স্তালিন সম্পর্কে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি মূল্যায়ন করেছিল। কিন্তু দুনিয়ার কমিউনিস্টরা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। কাজেই মাও সম্পর্কে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়নকেই আমি শেষ কথা বলে মনে করি না। অবশ্যই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন মাও-এর সামগ্রিক মূল্যায়নের একটি অংশ। কিন্তু মাও সে তুঙ শুধু চীনের নন। তাঁর মূল্যায়ন করবেন সারা পৃথিবীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা এবং সেই মূল্যায়নের জন্য ইতিহাসকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

আজকের প্রয়োজন বরং মাও চিন্তাধারার আলোকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল্যায়ন করা – কেন ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি তা বিবেচনা করা। আমাদের পার্টির চিন্তাধারা সঠিক, এই অবস্থান থেকে মাও-কে বিচার না করে বরং মাও-এর চিন্তাধারার আলোকে আমাদের পার্টির লাইনকে বিচার করতে হবে।

মাও ভুল করেননি এমন নয়। যাঁরাই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন ও বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য প্রয়াস চালান তাঁরাই ভুল করেন। যারা সংগ্রামে নামে না তারাই কেবল দাবি করে যে তারা কোনো ভুল করেনি। মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনও ভুল করেছিলেন। তবে তাঁদের ভুলগুলি ছিল মহান বিপ্লবীদের ভুল। এমনকি তাঁরা তাঁদের সেই ভুলগুলির মধ্য দিয়েও মানুষের বিপ্লবী সচেতনতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। মাও-এর ভুলগুলিকেও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিচার করতে হবে। যাঁরা সব ঠিক করেছেন বলে দাবি করেছেন ইতিহাস তাঁদের মনে রাখেনি। ইতিহাস মনে রেখেছে মার্কসকেই – লাসাল বা বার্ণস্টাইনকে নয়, ইতিহাস মনে রেখেছে লেনিনকেই – প্লেখানভকে নয়, ইতিহাস মনে রেখেছে মাও-কে – লিউ শাও চি-কে নয়।

১৯৬৮ সালে কলেজে যখন বিপ্লবী রাজনীতি শুরু করি তখন কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয়তে চেয়ারম্যান মাও কথাটি ব্যবহার করা হয়েছিল। সে সময় আমরা ছিলাম মাত্র চার-পাঁচ জন। প্রতিক্রিয়াশীলরা দলবল জুটিয়ে আমাদের সেই ‘ভ্যানগার্ড’ ম্যাগাজিন পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম – ‘বিশ্ববিপ্লবের মহান নেতা মাও সে তুঙ’ স্লোগান দিয়ে। পরবর্তীকালে যখন ধরা পড়লাম তখন সঙ্গে মাও-এর বই থাকার জন্য পুলিশ অফিসারের হাতে নির্মমভাবে মার খেতে হল। পরবর্তীকালে মাও-এর নির্বাচিত রচনাবলী কোনোমতে আমি জেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। জেলে সেটা পড়তাম ও অনুবাদ করে অন্যান্য কমরেডদের পড়ে শোনাতাম। সেই দিনগুলিতে এটি ছিল আমার প্রিয় কাজ।

১৯৭৯ সালে অনেক পাহাড় পর্বত পেরিয়ে যখন চীনে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে মাও-কে বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মোটামুটিভাবে চীন বিপ্লবের সমস্ত স্মরণীয় জায়গাতেই আমরা গিয়েছিলাম এবং সেখানকার প্রবীণ কৃষকদের সাথে তথা বহু মানুষের সাথে আমরা কথা বলেছিলাম। তখন আমারা উপলব্ধি করেছি যে মাও-এর প্রতি চীনের সমস্ত মানুষের, নীচুতলার সমস্ত কর্মীবাহিনীর অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা আছে এবং চীন থেকে মাও-কে কোনো দিন মুছে দেওয়া যাবে না।

মাও-এর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনও মনে হয়েছিল যে, মাও সে তুঙ তুমি আমাদের চেয়ারম্যান চিরকাল থেকেই যাবে – অবশ্য চীনের চেয়ারম্যান বলে নয়, ভারতীয় বিপ্লবের পথের দিশারী হিসাবে।

(কমরেড মদন ভাণ্ডারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্চলি। লিবারেশন, জুন ১৯৯৩ থেকে)

১৭ মে ভোরে আমি ছিলাম পাটনায়। কয়েকজন কমরেড ছুটে এসে আমাকে দেখালেন সংবাদপত্রের একটি ছোটো রিপোর্ট – কমরেড মদন ভাণ্ডারী ও জীবরাজ আশ্রিত জীপ দুর্ঘটনায় পড়েছেন। ফোনে খবর নিয়ে জানলাম, কমরেড ভাণ্ডারীর দেহ তখনও পাওয়া যায়নি। অনেক আশঙ্কা আর একটু আশা বুকে নিয়ে আমি রওনা দিলাম বেনারসে।

কিন্তু ১৯ তারিখে যে খবর পেলাম, সব আশা তাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পার্টির একটি বৈঠক অসমাপ্ত রেখে আমি কাঠমাণ্ডুর বিমান ধরলাম ২০ মে। সেখানে বিমানবন্দরের চত্বরে সিপিএন(ইউএমএল) নেতারা আমাকে দুর্ঘটনার রহস্যজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করান। কাঠমাণ্ডু থেকে আমি সোজা চলে যাই দশরথ রঙ্গশালায় নেপালের সমসাময়িক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই মহান নেতার প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সেখানে তখনও দুচোখে জল নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ প্রয়াত নেতাদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন। দুটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গেও আমি দেখা করি।

মাত্র কয়েক মাস আগেই আমি কাঠমাণ্ডু এসেছিলাম সিপিএন(ইউএমএল)-এর পার্টি কংগ্রেসে যোগ দিতে। কংগ্রেস শেষ হওয়ার মুখে আমি কাঠমাণ্ডু ছেড়ে চলে যাই। কমরেড ভাণ্ডারী স্বভাবতই কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলেন, তবু তার মধ্যেই তিনি বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে আসেন। তাঁর সঙ্গে আমার সেই শেষ সাক্ষাৎ। আমি ভাবতেই পারিনি যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমাকে আবার কাঠমাণ্ডুতে আসতে হবে।

অনেক আগে, কমরেড ভাণ্ডারী সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা পাটনায় বেশ কয়েকদিন ধরে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলাম। তারপরে আমরা দিল্লীতে কয়েকদিনের জন্য মিলিত হয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে পরবর্তী দফা আলোচনার জন্য নেপালে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমাদের দুই পার্টির মধ্যে সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে। তখন থেকেই আমাদের মধ্যে নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় স্তরে কথাবার্তা চলে আসছে। আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক হল আদর্শ ভ্রাতৃপ্রতিম। বহু বিষয়েই আমরা অভিজ্ঞতা ও মতামত বিনিময় করেছি, কিন্তু পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কখনো হস্তক্ষেপ করিনি। আমাদের দুই পার্টি মোটামুটি একই ধারায় গড়ে উঠেছে। তবে গণকাজের কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের চাইতে আগেই এগোতে শুরু করেন।

কমরেড ভাণ্ডারী ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস-পরবর্তী সমাবেশেও তিনি বক্তৃতা দেন। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে তাঁর বক্তব্যে কমরেড ভাণ্ডারী পার্টির ভূমিকাকে পরিপূর্ণভাবে সামনে আনার ওপর জোর দেন। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও আমরা বন্ধু থেকেছি, চিরদিন তাই থাকব – এই কথা বলে তিনি সেখানে বক্তব্য শেষ করেন। তিনি ঠিকই বলেছিলেন।

কমরেড ভাণ্ডারী ছিলেন এক আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। তাঁর মর্যাদা ও সম্মানবোধ ছিল প্রখর।

তাঁদের পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত থাকার পর আমি যখন ফিরে আসছিলাম, তখন তিনি আমাকে একটি খবরের কাগজ দেখান। সেখানে টনকপুর ইস্যুতে জনৈক ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতার উপদেশ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরকম স্থুল হস্তক্ষেপ দেখে কমরেড ভাণ্ডারী খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর, বলিষ্ঠ ও মর্যাদাসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্বের নানান স্মৃতি ২০ মে সারারাত ধরে আমার চোখে ভাসতে থাকে।

পরদিন অর্থাৎ ২১ মে অন্তিম যাত্রার কথা ছিল। প্রয়াত নেতাদের প্রতি জাতীয় সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নেপাল সরকার। সুতরাং শোক মিছিলের একেবারে সামনে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিলিটারী ব্যাণ্ড বাজছিল। আমার জীবনে কোনোদিন আমি এত বড় শোক মিছিল দেখিনি। চারিদিক থেকে সমস্ত ধরনের মানুষের অন্তহীন স্রোত তাঁদের নেতাদের শেষবারের মতো দেখার জন্য আসতেই থাকছিল। মনে হচ্ছিল গোটা কাঠমাণ্ডু শহরই যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। এই বিশাল মানব সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে স্বেচ্ছাসেবকদের খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। এক মানবশৃঙ্খলা তৈরি করে তাঁরা গণতরঙ্গ সুশৃঙ্খল রাখার চেষ্টা করছিলেন।

শোকযাত্রার পুরো পথ জুড়ে দুধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়িগুলির ছাদে ও বারান্দায় তিলধারণের স্থান ছিল না। মহিলারা সেখান থেকে শোক মিছিলে ফুল ও জল ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। শ্মশানে পৌঁছতে শোকযাত্রার পুরো চার ঘণ্টা লেগে গেল। ফিলিপাইনস কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড এমিল, সিপিআই(এম)-এর কমরেড সুরজিৎ, সিপিআই-এর কমরেড ফারুকি, আমি এবং নেপাল পার্টির নেতারা একটি ট্রাকে মিছিলের শেষভাগে চলছিলাম। কমরেড এমিল এবং আমি পায়ে হেঁটে মিছিলে যাওয়ার জন্যই তৈরি ছিলাম। কিন্তু ব্যবস্থাপনা যেমন ছিল তাতে আমাদের ট্রাকেই চড়তে হল। কমরেড এমিল বারবার এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা কমরেড মাধব নেপালকে জানিয়ে ট্রাক থেকে নেমে পড়লাম। যাত্রার শেষ অংশটুকু আমরা দুজন শোকযাত্রীদের সাথে পায়ে হেঁটেই গেলাম।

শ্মশানে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখি। আমি বলি, কয়েক বছর আগে নেপাল যখন এক মহান ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন একজন তাত্ত্বিকের যিনি মার্কসবাদের বিশ্বজনীন সত্যকে নেপালের নির্দিষ্ট অবস্থার সাথে একাত্ম করবেন; নেপালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন এক নেতার যিনি নির্ভীকভাবে সুসঙ্গত গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন এবং নেপালী জাতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন এক জাতীয় ব্যক্তিত্বের যিনি নেপালের জাতীয় স্বার্থ ও আশা আকাঙ্খার জন্য দৃঢ়ভাবে লড়বেন। প্রয়াত কমরেড মদন ভাণ্ডারী এই তিনটি প্রয়োজনই মিটিয়েছিলেন আর এটাই ছিল তাঁর অতুলনীয় অবদান। প্রয়াত কমরেডদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং আমাদের পার্টির পক্ষে থেকে দুটি শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।

অবশেষে চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়, পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল দুই নেতার মৃতদেহ, পরে চিতাভষ্ম ছড়িয়ে দেওয়া হবে গোটা নেপালে। স্মৃতির অরণ্যে হারিয়ে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, চমক ভাঙল একজন কমরেডের কথায় “কমরেড সব শেষ”! ফেরার পথে ফিলিপাইনসের কমরেড তাঁর দেশের এ্যাকুইনো এবং একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতার অনুরূপ শোকমিছিলের কথা স্মরণ করছিলেন। আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, কমরেড ক্রিস হানি ও মদন ভাণ্ডারী তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন তা হল : বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কাছে কমিউনিজমই সবচেয়ে জনপ্রিয় মতাদর্শ।

আমাদের কলকাতা সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় কমরেড ভাণ্ডারী তাঁদের পার্টির খবরাখবর চেপে যাওয়া ও বিকৃত করার জন্য ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিকে সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন। আমাদের কোনো কোনো কমরেডের মনে হয়েছিল, এটা তিনি না করলেই পারতেন। এর কয়েক দিন পরে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, ভারতের সংবাদপত্রগুলি সিপিএন(ইউএমএল)-এর ঐতিহাসিক পার্টি কংগ্রেসের কথা কেমন চেপে গেল। আর এবার দেখলাম স্ব-আরোপিত সেন্সরব্যবস্থার এক চরম নিদর্শন : নেপালে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ শোকযাত্রা সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির সম্পূর্ণ নীরবতা। আমি জানি না, ভারতীয় সংবাদজগতের এ হেন আচরণের কারণ কি কমিউনিস্ট বিদ্বেষ? নাকি যে মানুষটি ভারতীয় উচ্চাকাঙ্খার বিরুদ্ধে নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য লড়ছিলেন তাঁর প্রতি আক্রোশ? আমি এখন বুঝতে পারি, ভারতীয় প্রেসের বিরুদ্ধে কমরেড ভাণ্ডারীর ক্ষোভ প্রকাশ কত সঙ্গত ছিল।

কমরেড মদন ভাণ্ডারীর যাত্রা শেষ হল। তবে শুরু হল তাঁর পার্টি সিপিএন(ইউএমএল)-এর এক নতুন যাত্রা। আমি নিশ্চিত, পার্টি এই আঘাত সামলে উঠবে, মূর্খ কুৎসা রটনাকারীদের আশা ব্যর্থ করে আগামী দিনগুলিতে তাকে পরিণত করবে এক নতুন শক্তিতে। কমরেড মাধব নেপালের সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া তারই ইঙ্গিত।