(লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৮ থেকে)
রোজা লুক্সেমবার্গ (১৮৭৯-১৯১৯) ছিলেন পোল এবং জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বামপন্থী গোষ্ঠীর নেত্রী। রোজা জার্মানিতে আন্তর্জাতিক গ্রুপের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যে গ্রুপ পরে স্পার্টাকাস গ্রুপ এবং তারও পরে স্পার্টাকাস লীগ নামে পরিচিত হয়। ১৯১৮-র নভেম্বর বিপ্লবে তিনি ছিলেন বিপ্লবী জার্মান শ্রমিকদের অন্যতম নেত্রী এবং জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনী কংগ্রেসে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। রোজা ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।
রোজা এবং লেনিনের সম্পর্কটি আমাদের সামনে একটি অতীব জটিল চিত্র তুলে ধরে। রুশ বিপ্লবের নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলিতে তাঁদের নিজেদের মধ্যে ছিল তীব্র বিতর্ক আবার আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী সমাজগণতন্ত্রের সাধারণ মঞ্চে অংশ নিয়েছেন উভয়েই। উভয়েই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে দৃঢ়নিষ্ঠ সংগ্রাম চালিয়েছেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সবচেয়ে ভালো প্রতিনিধিদের একজন বলে লেনিন রোজার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
সম্পর্তি পাশ্চাত্যের মার্কসবাদী চক্রগুলিতে রোজা লুক্সেমবার্গ নিয়ে বেশ ভালোরকম পুনরালোচনা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন চিন্তাধারার প্রতিনিধিরা নিজেদের ধারণার সমর্থনে রোজার লেখা প্রায়শই কাজে লাগাচ্ছেন। চাষি আন্দোলনের নেতা শারদ যোশী রোজার লেখা দি এক্যুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল বা ‘পুঁজির সঞ্চয়’ নামক গ্রন্থের প্রসঙ্গ টেনে একথা প্রমাণ করতে চাইছেন যে শিল্পক্ষেত্রে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্যের উশুল সম্ভব হচ্ছে কেবলমাত্র কৃষিক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশীকরণের মধ্যে দিয়ে।
কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক গ্রন্থকারের মতে সোভিয়েত রাশিয়ার আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির, যা গর্বাচেভ-এর সংস্কারের ফলে খুব স্পষ্টভাবে বেরিয়ে পড়েছে, মূলে রয়েছে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং কেন্দ্রিকতার প্রতি অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপের লেনিনীয় পদ্ধতি। আর এ সম্পর্কে রোজা ১৯১৮ সালে কারাগারে বসে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলিতেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
তাছাড়াও পার্টি গঠনে লেনিনের “অতিকেন্দ্রিক” দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতার জন্য রোজার উচ্চ প্রশংসা করা হচ্ছে।
সংক্ষেপে নতুন করে রোজা লুক্সেমবার্গের উপর এই চর্চার পিছনে লেনিনের বিরুদ্ধে রোজাকে দাঁড় করানোর একটি সচেতন প্রয়াস কাজ করছে বলে মনে হয়। আর সেই কারণেই রোজা ও লেনিনের মধ্যেকার বহুমুখী সম্পর্ক – তাদের মধ্যেকার তীক্ষ্ন মতপার্থক্য আবার সাথে সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী সর্বহারা শ্রেণীর ঐক্য – সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের বিবিধ পর্বে এটা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা দেখাও দরকার।
১। রোজা লুক্সেমবার্গ ১৯১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ডাই এ্যাকুমুলেশন ডাস ক্যাপিটাল-এ মার্কসকে বিরোধিতা করেন এবং এই তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন যে পুঁজিবাদী ক্ষেত্রে যে উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি তা পশ্চাৎপদ অঞ্চল ও দেশগুলির উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে প্রাক পুঁজিবাদী ক্ষেত্রগুলি থেকে উশুল হয়।
এখন দেখা যাক উদ্বৃত্ত মূল্যের উশুলের ব্যাপারটিকে মার্কস কীভাবে দেখেছিলেন। মার্কসের মতে একটি পুঁজিবাদী দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের মধ্যে তিনটি অংশ থাকে – (ক) স্থিরপুঁজি, (খ) পরিবর্তনশীল পুঁজি ও (গ) উদ্বৃত্ত মূল্য। এছাড়া মার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের পৃথকীকরণ করেছিলেন, যেমন – প্রথম বিভাগ যেখানে উৎপাদনের উপকরণগুলির উৎপাদন হয় এবং দ্বিতীয় বিভাগ যেখানে ভোগ্যবস্তু উৎপন্ন হয়।
এখন উদ্বৃত্তমূল্যের একটি অংশ মাত্র ভোগ্যবস্তুর মধ্যে মূর্ত হয়, বাকি অংশটা উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে নিহিত থাকে। উৎপাদনের উপকরণের মধ্যেকার নিহিত যে উদ্বৃত্ত মূল্য তা পুঁজিপতিরা নিজেরাই ‘ভোগ’ করে এবং এটি বর্ধিত পুনরুৎপাদনের জন্য স্থিরপুঁজির আকারে সংগঠিত হয়। এটাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের ধরনের সারকথা যেখানে প্রতিটি চক্রের শেষে স্থিরপুঁজির বৃদ্ধি ঘটে এবং উৎপাদিকা শক্তির সীমাহীন বিস্তৃতি ঘটে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় দেশীয় বাজার ভোগ্যবস্তুর জন্য ততখানি বিকাশলাভ করে না যতখানি করে উৎপাদনের উপকরণের জন্য। এটাই হল মার্কসের উশুলের তত্ত্ব।
বৈদেশিক বাজারের বিকাশ একটি ঐতিহাসিক অবস্থার ফসল যেটি পুঁজিবাদের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট যুগে দেখা যায়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভূমিকার আলোচনা বলতে একটার বদলে একসাথে কতকগুলি পুঁজিবাদী দেশের ব্যাপার নিয়ে আলোচনার বেশি কিছু বোঝায় না। এটা কোনো প্রকারেই উশুলের আসল প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না।
পুঁজিবাদের বাজার সৃষ্টিতে কৃষক সম্প্রদায়ের ভূমিকার কথা বলতে গেলে তা কেবলমাত্র সেই মাত্রাতেই ঘটে থাকে যে মাত্রায় পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণী হিসাবে তারা নিজেরাই গ্রামীণ বুর্জোয়া ও গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীতে বিভাজিত থাকে। এই শ্রেণীগুলি পুঁজিবাদী সমাজটির একান্ত অঙ্গ হয়ে ওঠে। যদি পুঁজিবাদী চাষের ক্ষেত্রটির শিল্পীয় ক্ষেত্রের চেয়ে ধীর লয়ে বিকাশ ঘটে এবং শিল্পীয় ও কৃষিজ পণ্যের দামে বড় ধরনের বৈষম্য ঘটে তাহলে বিষয়গুলির পুঁজিবাদী সমাজ গঠন তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত, পুঁজিবাদী সমাজের উশুলের তত্ত্বের সাথে এগুলির কোনো সম্পর্ক নেই।
রোজার গ্রন্থের যে সমালোচনা ব্রেমার-বার্গার জেইতুং পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার প্রসঙ্গ টেনে লেনিন সম্পাদককে লিখলেন, “আমার দেখে খুব ভালো লাগছে যে মূল বিষয়গুলিতেই আপনি একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যে সিদ্ধান্তগুলিতে আমি চোদ্দ বছর আগে টিউগণ বার্নোভস্কি এবং ভক্সটুমলার সাথে বিতর্কে উপনীত হয়েছিলাম, অর্থাৎ “বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী” সমাজেও উদ্বৃত্ত মূল্য উশুল করা সম্ভব। আমি এখনও রোজা লুক্সেমবার্গের বইটি দেখিনি কিন্তু তত্ত্বগতভাবে আপনি এই বিষয়ে খুবই সঠিক। যদিও আমার এটা মনে হয় যে মার্কসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচ্ছেদ অর্থাৎ যেখানে মার্কস বলছেন যে বাৎসরিক উৎপন্নের মূল্য বিশ্লেষণে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে, তার উপর আপনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। লুক্সেমবার্গের ‘দ্বন্দ্বতত্ত্ব’ আমার কাছে (লিপজিগার ভক জেইতুং-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটিরও বিচার করে) জগাখিচুড়িবাদ (একলেকটিসিজম) বলে মনে হয় (খণ্ড ৪৩, জানুয়ারি ১৯১৩)। আবার এল বি কামনেভ-কে একটি চিঠিতে লেনিন লিখছেন (খণ্ড ৩৫) “আমি রোজার নতুন বই ‘পুঁজির সঞ্চয়’ পড়েছি। তিনি ওখানে এক দুর্ভাগ্যজনক বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। আমার আনন্দ হচ্ছে যে পান্নেকক, এক্সটেইন এবং ও বাউয়ার সকলেই একইভাবে তার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং ১৮৯৯ সালে নারোদনিকদের বিরুদ্ধে আমি যা বলেছিলাম তাঁরা রোজার বিরুদ্ধে সেই কথাই বলেছেন।”
২। রোজা লুক্সেমবার্গ ১৯০৮-১৯০৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় প্রশ্ন ও স্বায়ত্ত শাসন নামে একটি লেখায় জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকারের বিরোধিতা করেছেন। কাউটস্কির ভাবনা ছিল যে বর্তমান পরিস্থিতির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত রূপ হল জাতীয় রাষ্ট্র এবং বহুজাতিক রাষ্ট্র হল সবসময়েই সেইগুলি যাদের অভ্যন্তরীণ গঠন কোনো না কোনো কারণে অস্বাভাবিক কিংবা অনুন্নত থেকে গেছে। এই ভাবনাকে বিরোধিতা করে রোজা লিখলেন “এই ‘শ্রেষ্ঠ’ জাতীয় রাষ্ট্র হল কেবল একটি বিমূর্তন মাত্র যাকে তত্ত্বগতভাবে সহজেই গড়ে তোলা এবং রক্ষা করা যায় কিন্তু তা বাস্তবের সাথে মেলে না।” তিনি এটি প্রমাণ করতে যুক্তি হাজির করলেন যে বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তিগুলি এবং সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের ফলে ছোটো ছোটো জাতিগুলির “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার” একটি মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে।
রোজার সাথে রাজনৈতিক বিতর্কে লেনিন দেখান যে, “জাতিগুলির রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বুর্জোয়া সমাজে রাষ্ট্র হিসাবে তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নটির বদলে সে জায়গায় রোজা লুক্সেমবার্গ তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটি হাজির করেছেন।” (জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, খণ্ড ২০)
লেনিন এশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে দেখালেন যে যেখানে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সব চেয়ে পরিপূর্ণ বিকাশের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা হল একটি মাত্র দেশ জাপান – যা একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র।
লেনিন বললেন, “জাতীয় রাষ্ট্র হল পুঁজিবাদের নিয়ম ও ‘বিধি’, আর বহুজাতিক রাষ্ট্র বলতে বোঝায় পশ্চাদপদতা অথবা একটি ব্যতিক্রম।” (ঐ)
রোজা রাশিয়া থেকে পোল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিকে বিরোধিতা করেছিলেন এবং যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে পোল্যান্ড দ্রুত শিল্প বিকাশ ঘটাতে পেরেছে একটাই মাত্র কারণে যে এর উৎপাদিত দ্রব্যগুলি রাশিয়ায় বাজার পেয়েছে। এর পরিবর্তে তিনি পোল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেন এবং তাও একটি ব্যতিক্রম হিসাবে।
লেনিন বললেন “যদি স্পষ্টতই প্রাক-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে এমন কোনো দেশে (এক্ষেত্রে রাশিয়ায় – সম্পাদক) এমন একটি জাতিগতভাবে পৃথকীকৃত কোনো অঞ্চল থাকে যেখানে পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশলাভ করছে (এক্ষেত্রে পোল্যান্ড – সম্পাদক) তাহলে যত দ্রুত পুঁজিবাদ বিকশিত হবে ততই বাড়বে প্রাক-পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে এর দ্বন্দ্ব এবং তত বেশি সম্ভাবনাই থাকবে সমগ্র থেকে এগিয়ে থাকা অঞ্চলটির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার; যে সমগ্রের সাথে এটা কোনো ‘আধুনিক পুঁজিবাদী’ নিয়মে সংযুক্ত নয় বরঞ্চ ‘এশিয়াটিক স্বৈরতান্ত্রিক’ বন্ধনে আবদ্ধ।” (ঐ)
রোজা আর এসডিএলপি-র কর্মসূচিতে নবম অনুচ্ছেদের (যাতে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আলোচিত হয়েছে) অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন এই বলে যে “নবম অনুচ্ছেদ সর্বহারার দৈনন্দিন কর্মনীতির ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী নেতৃত্ব দেবে না, দেবে না জাতীয় সমস্যার কোনো কার্যকরী সমাধান।”
‘কার্যকারিতার’ প্রশ্নে লেনিনকে বলতে হল : “বুর্জোয়ারা সর্বদাই তাদের জাতীয় দাবিটিকে সবার আগেই রাখে এবং তা তারা সুনির্দিষ্ট ধারাতেই করে থাকে। অন্যদিকে সর্বহারাদের কাছে এই দাবিগুলি শ্রেণী সংগ্রামের স্বার্থের অধীন। তত্তগতভাবে আপনি একথা আগবাড়িয়ে বলতে পারেন না যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতির অন্য জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পর্যবসিত হবে কিনা বা তার সাথে সমতায় উপনীত হবে কিনা; দুই ক্ষেত্রেই সর্বহারার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল তার শ্রেণীর বিকাশ সুনিশ্চিত করা। এই কারণেই সর্বহারারা বলতে গেলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতির নেতিবাচক দাবিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। কোনো জাতিকে কোনো গ্যারান্টি দেয় না বা অন্য জাতির বিনিময়ে কিছু দেওয়ার অঙ্গীকার করে না। এটা ‘কার্যকরী’ না হতে পারে কিন্তু এটাই হল সমস্ত সম্ভাব্য সমাধানগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক সমাধান অর্জনের জন্য কার্যত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্যারান্টি।” (ঐ)
তাঁর পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রোজা কিছুটা ভেসে গিয়েছিলেন এবং পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের সাহায্য না করতে চাওয়ার উদ্বেগ থেকে তিনি রাশিয়ার মার্কসবাদীদের কর্মসূচি থেকে “বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে” বাতিল করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে বিচ্ছিন্নতার অধিকারকে সমর্থন করা হল নিপীড়িত জাতিগুলির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করার সমতুল্য।
লেনিন দেখালেন যে, কোনো নিপীড়িত জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু থাকে যা নিপীড়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় এবং ঠিক এই বিষয়টিই আমরা নিঃশর্তভাবে সমর্থন করি। সাথে সাথে লেনিন এ কথাও জোরের সাথে বললেন যে জাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী যে কোনো ধরনের ঝোঁকের আমাদের অবশ্যই বিরোধিতা করতে হবে।
লেনিন আরও বললেন “এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সমগ্র রাশিয়ার মার্কসবাদীদের এবং সর্ব প্রথম মহত রুশীয় জাতির দ্বারা জাতিগুলির বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি কোনোভাবেই বিশেষ একটি নিপীড়িত জাতির মার্কসবাদীদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বাতিল করে দেয় না, ঠিক যেমনভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকারের স্বীকৃতি কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের বিরোধিতাকে বাতিল করে না।” (ঐ)
লেনিনের মতে অবশ্য “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেন্দ্রীকরণের সাধারণ প্রেক্ষিতের এক ব্যতিক্রম। “প্রতিক্রিয়াশীল বৃহৎ-রুশীয় জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যতিক্রম একান্তভাবে আবশ্যক এবং এই ব্যতিক্রমকে যে কোনোভাবে বাতিল করা একটি সুবিধাবাদ (যেমনটি ঘটেছে রোজা লুক্সেমবার্গের ক্ষেত্রে)। এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল বৃহৎ-রুশীয় জাতীয়তাবাদের কাছে বোকার মতো নিজেকে সঁপে দেওয়া। কিন্তু এই ব্যতিক্রমকে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই চলে না। এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার অধিকারের চাইতে বেশি কিছু নেই, থাকা উচিতও না।” (এস জি শানমিয়ানকে লেখা চিঠি, খণ্ড ১৯)
লেনিন এবং রোজা দুই জনেই মার্কসবাদী হওয়ায় এই প্রশ্নে একমত ছিলেন যে, কোনো পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলি কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট সমগ্র দেশটির কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বারাই আলোচিত হবে, আলাদা আলাদা অঞ্চলগুলির স্বয়ং-শাসিত সংস্থাগুলির দ্বারা নয়। লেনিন বললেন “মার্কসবাদীরা কখনই কোনো অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা বিকেন্দ্রীকরণের ওকালতি করবে না। বিশাল কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় অনৈক্য থেকে ভবিষ্যতের সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পথে একটি বিরাট ঐতিহাসিক পদক্ষেপ এবং কেবলমাত্র এই রকম একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমেই (অবিচ্ছেদ্যভাবে পুঁজিবাদের সাথে যা সংযুক্ত) সমাজতন্ত্রের পথ গড়ে উঠতে পারে।” (জাতীয় প্রশ্নে সমালোচনামূলক মতবাদ, খণ্ড ২০)
লেনিন জোরের সাথেই বললেন যে মার্কসবাদীরা যখন কেন্দ্রীকতার ওকালতি করেন তখন তারা একান্তভাবেই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ওকালতিই করেন। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা এটা দাবি করে যে প্রত্যেকটি আঞ্চল যাদের স্পষ্টতই পৃথক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য, নির্দিষ্ট জাতীয় গঠনযুক্ত একটি জনগোষ্ঠী ইত্যাদি হয়েছে তাদের জন্য স্বায়ত্তশাসন যুক্ত একটি স্ব-শাসিত সরকার থাকবে।
শানমিয়ানের কাছে লেখা একটি চিঠিতে (খণ্ড ১৯) লেনিন লিখলেন “স্বায়ত্ত-শাসনের অধিকার? আবার একটি ভুল। আমরা সমস্ত অংশের জন্য স্বায়ত্ত-শাসনের পক্ষে; আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের পক্ষে (কিন্তু প্রত্যেকেরই বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে নয়)। স্বায়ত্ত-শাসন হল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের পরিকল্পনা। বিচ্ছিন্নতা আদৌ আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে পড়ে না। আমরা বিচ্ছিন্নতার ওকালতি করি না। সাধারণভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে।” লেনিনের মতে “কেন্দ্রীকতার নীতি যা পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষে অবশ্য প্রয়োজনীয় তা এই (স্থানীয় এবং আঞ্চলিক) স্বায়ত্ত-শাসনের দ্বারা লঙ্ঘিত হয় না, বরঞ্চ উল্টে এটি আমলাতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ না হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে হয়। এই ধরনের স্বায়ত্ত-শাসনের অভাবে পুঁজিবাদের অবাধ, মুক্ত এবং দ্রুত বিকাশ অসম্ভব হয় কিংবা অন্তত বড় রকমের বাধাপ্রাপ্ত হয়; কেননা এই স্বায়ত্ত-শাসন পুঁজির কেন্দ্রীকরণ, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, দেশব্যাপী বুর্জোয়াশ্রেণীর এবং সর্বহারার নিজ নিজ ঐক্য সহজ করে তোলে। আর একেবারেই স্থানীয় (আঞ্চলিক, জাতীয় এবং অন্যান্য) প্রশ্নে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক বিষয়গুলিতে কেন্দ্রীকতার ক্ষেত্রে অন্যতম বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করে।” (জাতীয় প্রশ্নে সমালোচনামূলক মতামত, খণ্ড ২০)
এই সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে লেনিন রোজাকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন তাঁর এই গোঁড়ামির জন্য যে স্বায়ত্ত-শাসনের দাবি কেবলমাত্র পোল্যান্ডের জন্যই প্রযুক্ত হতে পারে এবং তাও কেবলমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে। তিনি প্রশ্ন রাখলেন, “শুধুমাত্র পাঁচলাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত নয়, এমনকি পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত জাতীয় অঞ্চলগুলি কেন স্বায়ত্ত-শাসন ভোগ করতে পারে না, কেন সেই এলাকাগুলি অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক কিংবা প্রয়োজনীয় হলে ভিন্ন মাত্রাযুক্ত পাশাপাশি এলাকার সাথে বহু বিচিত্র পদ্ধতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি একক স্বায়ত্ত-শাসিত ‘অঞ্চল’ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে না?” (ঐ)
৩। ১৯০৩ সালে আরএসডিএলপি-র দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর একদিকে যেমন পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হল অন্যদিকে তেমনি পার্টি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (বলশেভিক) এবং ‘সংখ্যালঘিষ্ঠ’ (মেনশেভিক) দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কংগ্রেসের ঠিক পরে পরেই যে নীতির প্রশ্নে এই বিভাজন তা কিন্তু কো-অপশনকে ঘিরে বিবাদের ফলে অস্পষ্ট হয়ে গেল। তিন জন প্রাক্তন সম্পাদককে পুনরায় কো-অপট করা না হলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করতে অস্বীকার করল। দু-মাস স্থায়ী এই লড়াই-এ সংখ্যালঘিষ্ঠরা বয়কটের আশ্রয় নিল এবং পার্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হল। এমনকি তারা পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ইসক্রায় তাদের মতামত প্রকাশ করার জন্য লেনিন ও প্লেখানভের দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং কেন্দ্রীয় সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক, আমলাতান্ত্রিক, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বলে ব্যক্তিগত অপমান এবং গালাগালের আশ্রয় নিল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত উদ্যোগ দমিয়ে রাখা, দাসসুলভ বশ্যতা ও অন্ধ আনুগত্য চালু করা ইত্যাদি অভিযোগ আনল। প্লেখানভ যদিও সংখ্যালঘিষ্ঠের নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণকে নিন্দা করলেন তথাপি তিনি কী করা উচিত নয় বলে একটি লেখায় একথা বললেন যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মানে আবশ্যিকভাবে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। তিনি আরও বললেন যে রুশ বিপ্লবীদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত যে নৈরাজ্যবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বিরাজ করছে তার বিরুদ্ধে লড়াইটি সবসময়ই চালানো উচিত নয় বরং মাঝে মাঝে কিছু ছাড় দিলে এটাকে দমন করা যায় এবং ভাঙ্গনও এড়িয়ে যাওয়া যায়। লেনিন প্লেখানভের এই মতের ভাগীদার হতে পারেননি এবং সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদত্যাগ করলেন। সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্পাদকদের কো-অপট করা হল। লেনিন প্রস্তাব দিলেন যে সংখ্যালঘিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় মুখপত্রের দায়িত্বে থাকুন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকুন এবং এই ভিত্তিতে শান্তি স্থাপিত হোক – কিন্তু এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল। সংখ্যালঘিষ্ঠরা আমলাতন্ত্র, অতি-কেন্দ্রীকতা, আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ‘নীতিনিষ্ঠ’ সংগ্রামের নামে তাদের সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে লেনিন তার বিখ্যাত বই এককদম আগে দুকদম পিছে লিখলেন এবং কংগ্রেসের বিতর্কগুলি বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে এই বিভাজন পার্টিতে সর্বহারা বিপ্লবী ও বুদ্ধিজীবী-সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যকার পুরোনো বিভাজনেরই একটি রকমফের মাত্র।
রোজা লুক্সেমবার্গের সহানুভুতি সম্পূর্ণভাবে মেনশেভিকদের দিকেই ছিল এবং লেনিনের বই-এর সমালোচনা করলেন এই বলে যে এটি ‘অসহিষ্ণু কেন্দ্রীকতা’-র দৃষ্টিকোণের একটি স্পষ্ট ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিব্যক্তি। রোজা মনে করতেন যে ঐক্যবদ্ধ পার্টির প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে রাশিয়ার সমাজগণতন্ত্রীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই এবং সমগ্র বিতর্কটি চলছে কেন্দ্রীকতার মাত্রার প্রশ্নটি ঘিরেই। তিনি লেনিনকে ‘অতি-কেন্দ্রীকতার’ প্রবক্তা হিসাবে নিন্দা করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন যে কেন্দ্রীকরণকে ঘটাতে হবে ধীরে ধীরে।
রোজা লুক্সেমবার্গের প্রতি উত্তরে লেনিন দেখালেন যে রুশ পার্টিতে বিতর্ক চলছে “কেন্দ্রীয় কমিটি এবং কেন্দ্রীয় মুখপত্র পার্টি কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করবে কী করবে না এই নীতিগত প্রশ্নে। কমরেড কি এটা স্বাভাবিক মনে করেন যে পার্টির এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে যারা সংখ্যালঘিষ্ঠ তাদের প্রাধান্য থাকবে? তিনি কি কখনও কোনো পার্টিতে এটি দেখেছেন?” (খণ্ড ৭)
“একটি বৃহৎ এবং চরম কেন্দ্রীভূত পার্টি গড়ার শর্তগুলিই রাশিয়ায় ইতিমধ্যেই বর্তমান – এই চিন্তার জনক বলে কমরেড লুক্সেমবার্গ আমাকে অভিযুক্ত করেছেন। আমার বই-এর কোথাও আমি এই ধরনের মতামত রাখিনি, প্রবক্তা হওয়া তো দূরের কথা। আমি যে তত্ত্ব পেশ করেছি তাতে অন্য কিছু বলা হয়েছে। আমি দৃঢ়তার সাথে একথা বলেছিলাম যে পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তগুলি পালন করা হবে এটি আশা করার শর্তগুলি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান এবং বলেছিলাম যে সেই সময়ও অতীত হয়ে গেছে যখন ব্যক্তিগত চক্র দিয়ে পার্টি প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে রাখা যেতে পারত। আমি প্রমাণ উপস্থিত করেছিলাম যে আমাদের পার্টিতে বেশ কিছু পুঁথিবিদ নিজেদেরকে অদৃঢ় ও অস্থায়ী হিসাবে প্রমাণ করেছে এবং নিজেদের শৃঙ্খলাবোধের অভাবের দায়িত্বটি রুশ সর্বহারার উপর চাপানোর কোনো অধিকার তাদের নেই। রুশ শ্রমিকশ্রেণী ইতিপূর্বে বারবার এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত পালনের জন্য সোচ্চার হয়েছেন।” (ঐ)
লেনিন রোজার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে তিনি আরএসডিএলপি-র অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের নির্দিষ্ট তথ্যগুলিকে উপেক্ষা করছেন, বিমূর্ততায় ভুগছেন এবং এইভাবে মার্কসীয় দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে বিকৃত করছেন।
পরবর্তীকালে অবশ্য রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল কাউটস্কি দুজনকেই বলশেভিকদের মতের স্বপক্ষে জয় করে আনা গিয়েছিল। ১৯০৯ সালে লেনিন বললেন “তাদের জয় করে আনা গিয়েছিল কারণ বলশেভিকরা তাদের নিজেদের মতামত, নিশ্চিতভাবেই তাদের নিজেদের উপদলীয় তত্ত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেননি বরং ঊর্ধে তুলে ধরেছিলেন বিপ্লবী সমাজগণতান্ত্রিক কৌশলে সাধারণ জীবনশক্তি এবং অর্থকে।” (অটজোভিজম ও ঈশ্বর নির্মাণের সমর্থকদের উপদল, খণ্ড ১৬)
৪। রুশ দেশের ১৯০৫-এর বিপ্লব সোভিয়েত ক্ষমতা এবং সর্বহারার একনায়কত্বের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সামনে নিয়ে এল। মেনশেভিকদের বিপরীতে, রোজা তৎক্ষণাৎই এর তাৎপর্য অনুধাবন করলেন এবং সমস্ত সভাগুলিতে ও সংবাদপত্রে এর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণও রাখেন।
৫। ১৯১৩ সালে রোজা এবং লেনিন আবার বিলোপপন্থীদের প্রতি মনোভাবের প্রশ্নে আলাদা হয়ে গেলেন।
রোজা মনে করতেন যে রুশ পার্টিতে যা চলছিল তা উপদলীয় কোন্দল-জনিত বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাঙ্গন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে সক্রিয় বলে তিনি লেনিনবাদী গোষ্ঠীটিকে দোষারোপ করলেন। রোজা মনে করতেন যে রুশ পার্টিতে এই মতপার্থক্য যৌথ কার্যক্রমের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয় না এবং চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্য পুনরুদ্ধার সম্ভব। তিনি আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরোর কাছে ১৯১৩ সালে অনুরূপ একটি প্রস্তাব পেশ করলেন।
লেনিন তীব্রভাবে এই মতের বিরোধিতা করেন এবং আবারও জোর দিয়ে বলেন যে রুশ পার্টিতে য়া হচ্ছে তা কোনো মতেই উপদলীয় কোন্দলজাত বিশৃঙ্খলা নয়, বরং এটি বিলোপপন্থীদের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। লেনিন দাবি করলেন যে কেবলমাত্র এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণীর প্রকৃত একটি সমাজগণতান্ত্রিক পার্টি গড়ে উঠছে এবং ইতিমধ্যেই শ্রেণী-সচেতন শ্রমিকশ্রেণীর একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ – পাঁচভাগের চারভাগকে পার্টি-অবস্থানের পক্ষে জয় করে আনা গিয়েছে।
ব্রাসেল সম্মেলনে পেশ করা তাঁর রিপোর্টে লেনিন ১৯০৮ সালের পার্টি প্রস্তাব থেকে উদ্ধৃতি দেন যেখানে বিলোপবাদের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে “এটি হল পার্টির কিছু বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা আরএসডিএলপি-র বর্তমান সংগঠনকে বিলোপ ঘটানোর প্রচেষ্টা এবং এর পরিবর্তে এমন এক অবয়বহীন সংগঠন দাঁড় করানো যা যেকোনো মূল্যে, এমনকি পার্টির কর্মসূচি, কৌশল এবং ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে পরিত্যাগ করার মূল্যেও আইনি চৌহদ্দির মধ্যে কাজ করবে।” (খণ্ড ২০)
লেনিন আরও বললেন, “পার্টি সদস্যের পরিচিতি বহন করা অথচ পার্টি ভেঙ্গে দেওয়ার ওকালতি করা, পার্টিকে কোনো কাজের নয় ও অপ্রয়োজনীয় বলা এবং তার জায়গায় অন্য পার্টিকে নিয়ে আসা – এমন বিষয় অনুমোদনযোগ্য কিনা, পশ্চিম ইউরোপে কোথাও কখনও এ প্রশ্ন ওঠেনি এবং উঠতে পারে না। পশ্চিম ইউরোপের কোথাও খোদ পার্টির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই যেমনটি আমাদের মধ্যে আছে অর্থাৎ পার্টি থাকবে কি থাকবে না।
“এটি পার্টি কীভাবে গড়ে উঠবে সেই সংগঠন সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো মতানৈক্য নয় বরং, পার্টির খোদ অস্তিত্ব নিয়েই মতপার্থক্য। এখানে সমঝোতা, চুক্তি বা আপোষের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
৬। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এবং জার্মান সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী কাউটস্কিপন্থীরা সামাজিক উগ্র জাতিদম্ভী অবস্থান গ্রহণ করল এবং এই লুঠেরা যুদ্ধে নিজ নিজে দেশের বুর্জোয়াদের সমর্থনের জন্য ওকালতি করল। রোজা লুক্সেমবার্গ দৃঢ়তার সাথে এই লাইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং জার্মান সমাজগণতন্ত্রকে ‘দুর্গন্ধময় শব’ বলে অভিহিত করলেন।
যখন রুশ দেশে মেনশেভিকরা কেরেনস্কির আক্রমণকে অনুমোদন করল তখন রুশ বিপ্লবের আন্তর্জাতিক মর্মবস্তুকে লঘু করে দেওয়ার জন্য রোজা তীব্রভাবে তাদের নিন্দা করলেন।
লেনিন রোজাকে একজন মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ভাঙ্গনের পরে নতুন আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করেছিলেন।
৭। ১৯১৭ সালে যখন বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করলেন, সেই নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে রোজার কিছুটা আশঙ্কা ছিল। ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে, যাকে তিনি অগণতান্ত্রিক হিসাবে মনে করেছিলেন, এবং কেন্দ্রীকতার উপর অত্যধিক জোর দেওয়ার লেনিনীয় পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর কিছু আপত্তি ছিল। রোজা মনে করতেন যে, এই পদ্ধতি নীচেরতলা থেকে শ্রমিকশ্রেণীর উদ্যোগকে রুদ্ধ করে দেবে এবং আমলাতান্ত্রিক বিকৃতির জন্ম দেবে। তাঁর এই মতামত ১৯১৮ সালে কারাগারে লেখা পাণ্ডুলিপিতে আছে।
অবশ্য ক্লারা জেটকিন যিনি রোজাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, বলেছিলেন যে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রোজা লুক্সেমবার্গ বুঝেছিলেন যে, তাঁর মতামতগুলি ভুল ছিল এবং সেগুলি যথেষ্ট তথ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি।
৮। রোজা লুক্সমেবার্গ এবং কার্ল লিবনেখট জার্মানির সমাজগণতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনর্গঠিত করেছিলেন এবং জার্মানিতে ১৯১৮ সালের নভেম্বর বিপ্লবের সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি সমাজগণতন্ত্রী সরকারের দ্বারা মদতপুষ্ট হয়ে শ্বেতরক্ষীরা ঠাণ্ডা মাথায় রোজা ও কার্লকে হত্যা করে।
এই হত্যাকাণ্ডের পরে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে লেনিন নীচের এই বক্তৃতাটি রাখেন –
“আজ বুর্জোয়ারা এবং সমাজের বিশ্বাসঘাতকরা বার্লিনে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। তারা আজ কার্ল লিবনেখট ও রোজা লুক্সেমবার্গকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। চার বছর ধরে যে এলবার্ট এবং সাইডেম্যান শ্রমিক শ্রেণীকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বধ্যভূমির দিকে পরিচালিত করেছে তারা এখন সর্বহারার নেতাদের হত্যা করতে কসাইয়ের ভূমিকা নিয়েছে। জার্মান বিপ্লবের উদাহরণ একথা প্রমাণ করল গণতন্ত্র হল বুর্জোয়া-লুণ্ঠনের জন্য এবং সবচেয়ে বিধ্বংসী হিংসার জন্য একটি ছদ্মবেশ মাত্র। কসাইরা নিপাত যাক।”
১৯২২-এ যখন জার্মান মেনশেভিক পল লেভি বিশেষ করে যে সমস্ত লেখাগুলিতে রোজা লুক্সেমবার্গ লেনিনের সাথে তার মতপার্থক্যগুলি রেখেছিলেন সেগুলি আবার প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন তখনই লেনিন এই মন্তব্য করেন যে পল লেভির আসল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াদের এবং দ্বিতীয় ও আড়াই আন্তর্জাতিকের নেতাদের নেকনজরে পড়া।
লেনিন লিখলেন, “আমরা একটি রুশ উপকথার দুটি লাইন উদ্ধৃত করে এর জবাব দেব। ‘ঈগল কখনও কখনও মুরগীর চেয়ে নীচে দিয়ে উড়তে পারে, কিন্তু মুরগী কখনোই ঈগলের উচ্চতায় উড়তে পারে না’। রোজা লুক্সেমবার্গ পোল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভুল করেছিলেন; ১৯০৩ সালে মেনশেভিকবাদের মূল্যায়নে তিনি ভুল করেছিলেন; পুঁজির সঞ্চয় সংক্রান্ত তত্ত্বে তিনি ভুল করেছিলেন; ১৯১৪-র জুলাইতে তিনি প্লেখানভ, ভাণ্ডারভেল্ড, কাউটস্কি এবং অন্যান্যদের সাথে মিলে বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে ঐক্যের ওকালতি করে ভুল করেছিলেন। তিনি ১৯১৮-তে কারাগারে যা লিখেছিলেন তাতেও ভুল করেছিলেন (১৯১৮-র শেষে এবং ১৯১৯-এর প্রথমে যখন তিনি ছাড়া পান সেই সময় বেশিরভাগ ভুলগুলি শুধরে নিয়েছিলেন)। কিন্তু এসব ভুল সত্ত্বেও তিনি আমাদের কাছে একজন ঈগল ছিলেন এবং এখনও আছেন। আমরা কমিউনিস্টরা সারা দুনিয়া জুড়ে কেবল তার স্মৃতিকে স্মরণ করছি না, তাঁর জীবনী এবং সম্পূর্ণ রচনাবলী সারা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্ট প্রজন্মের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্য হিসাবে থাকবে। ‘১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে জার্মানির সমাজগণতন্ত্র একটি ‘দুর্গন্ধময় শব’-এ পরিণত হয়েছে’ – এই উক্তি রোজা লুক্সেমবার্গকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে বিখ্যাত করে রাখবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক আন্দোলনের পশ্চাদভূমিতে ছাইগাদায় পল লেভি, সাইডম্যান, কাউটস্কির মতো মুরগীরা এবং এদের সাঙ্গাতরা এই মহান কমিউনিস্টের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকবে।” (একজন প্রচারকের নোট, খণ্ড ৩৩)
এটাই রোজা লুক্সেমবার্গের প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ এবং এতেই সব কথা বলা হয়েছে।