(১৩ মে, ১৯৮৬)

এক বিপুল সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু[] যদি সমাজগণতন্ত্রকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে পূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে থাকে, তবে সমাজগণতন্ত্রীদেরও তাদের এই জয়ের জন্য বড় কম মূল্য দিতে হয়নি। কার্যত একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসাবেই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে – সমাজগণতন্ত্রীরা কখনই হিন্দি বলয়ের কেন্দ্রভূমিতে কোনোরকম জায়গা নিতে পারেনি। একাদিক্রমে ন’বছর ধরে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সমাজগণতন্ত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও, সিপিআই(এম) বিহারে কোনো অগ্রগতি ঘটাতে সামগ্রিভাবে ব্যর্থ কেন? এ থেকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়?

“ভারতের সবচেয়ে অনগ্রসর রাজ্যগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে বিহার। জাত-পাতের কঠোর বিভাজনে বিদীর্ণ এই রাজ্যের সঠিক অর্থে কোনো বুর্জোয়া সংস্কারের ইতিহাস নেই।” নাম্বুদিরিপাদ অ্যান্ড কোং[] এই যুক্তি হাজির করে থাকেন। তবে, এই তথ্যের সাথে সাথে এই নিয়মটিও কিন্তু তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত যে, গণতন্ত্রের দৌড় যেখানে শেষ, বিপ্লবী গণতন্ত্রের অভিযান শুরু ঠিক সেখান থেকেই। সেই পিছিয়ে পড়া বিহারই বিপ্লবী গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটি হয়ে উঠেছে যেখানে সমাজের অন্ত্যজ মানুষজনকেও কৃষক সংগ্রামের প্রবল ঘূর্ণিবাত্যায় টেনে আনা গেছে। পিপড়া গণহত্যা থেকে আরওয়ালের বধ্যভূমি, জমিদারদের ভাড়াটে জল্লাদ বাহিনী থেকে খুনে আধা-সামরিক বাহিনী, ‘সর্বাত্মক বিপ্লব’-এর প্রবক্তা থেকে ‘একান্ত অনুগত প্রতিপক্ষ’ – কোনো কিছুই বিহারের বহ্নিমান ক্ষেত খামারে শ্মশানের ‘শান্তি’ চাপিয়ে দিতে পারেনি। এবং কেউই পারবে না বিরল কীর্তির স্রষ্টা এই কুশীলবদের, এই কৌলিন্যহীন ব্রাত্যবীরদের ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চের বাইরে লোকচক্ষুর আড়ালে ঠেলে দিতে।

কিন্তু বিহারের কৃষক শ্রেণীর এই সংগ্রাম সত্যিই কি একটি নতুন পথের দিশা দিতে পথিকৃৎ হয়ে উঠতে পারবে? নাকি আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে কিংবা মাঝামাঝি কোনো আপোশরফার মধ্যে দিয়ে একদিন হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে, যেমনটা ঘটেছে তার পূর্বসূরীদের ক্ষেত্রে? এই প্রশ্ন আজ প্রতিটি সৎ কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী-গণতন্ত্রের দরদীকে পীড়া দেয়। আর এই বিষয়েই এক ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম প্রয়াস হল বর্তমান বইটি। বইটির মূল অংশে ঢোকার আগে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বন্দ্বাকীর্ণ গতিপথটিকে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। তারপর বিহারের কৃষক জনগণের সংগ্রামের বিশেষ ধারাটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

যেসব অনগ্রসর দেশে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষিজীবী, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টিকে দুটি মৌলিক কৌশলগত প্রশ্নের সমাধান করতেই হয় : কৃষকশ্রেণীর সাথে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন। ১৯১৯ সালে লেনিন প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের বলশেভিক বিপ্লবের সাধারণ শিক্ষার ভিত্তিতে তাঁদের নিজ নিজ দেশের রণনীতি নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের এ বিষয়ে সচেতন করে দেন যে তাঁদের সমস্যাগুলোর সমাধানসূত্র সম্ভবত কোনও কমিউনিস্ট পুস্তকে পাওয়া যাবে না।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এ কথার তাৎপর্য একেবারেই ধরতে পারেনি, কিন্তু মাও সে তুঙ ঠিক এই কাজেই অনন্য একাগ্রতায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরে কৃষক সম্প্রদায় ও বুর্জোয়াদের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কগুলি সঠিক সমাধানে সফল হয়েছিল। এইভাবে সে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বকারী শক্তি হয়ে উঠেছিল এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অনগ্রসর দেশগুলির সুনির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতির সাথে মেলাবার ক্ষেত্রে মূল্যবান পথনির্দেশ জুগিয়েছিল। অপরপক্ষে ভারতীয় কমিউনিস্টরা পূর্বোক্ত সমস্যাটির সমাধানে কোনো সুসংবদ্ধ লাইনের বিকাশ ঘটাতে পারেননি। ফলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা সেজে বসে বাহবা কুড়োল আর কমিউনিস্টরা তার লেজুড় বলে গণ্য হলেন। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবেও তাঁদের চিহ্নিত করা হল। অবশ্য এই ব্যর্থতার বেশ কিছু কারণও ছিল। ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিক শাসন তো বটেই, তা বাদে আরও ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্য নিয়ে কংগ্রেসের উত্থান ও বিকাশ, যার বহিরঙ্গে ছিল অতীব উন্নত গণতান্ত্রিক কর্মরীতি (নিয়মিত অধিবেশন, সভাপতি পরিবর্তন, বহুমুখী প্রবণতাগুলির সহাবস্থান ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি) আর অন্তঃস্থলে ছিল প্রায় অন্ধভক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত গান্ধীর সংগঠন-বহির্ভূত কর্তৃত্ব। তাছাড়াও ছিল বহু জটিল জাতীয়, জাত-পাত সম্পর্কিত এবং সম্প্রদায়গত প্রশ্ন এবং কমিন্টার্ন তথা দেশের বাইরে থেকে পার্টি পরিচালনারত কয়েকজন ভারতীয় নেতার পরস্পর বিরোধী উপদেশ। তবে সবচাইতে যেটা আশ্চর্যজনক তা হল, নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে এমন একটি চিন্তাধারা গড়ে উঠেছিল যেখানে সাধারণভাবে রাশিয়া ও চীনের বিপ্লবের অভিজ্ঞতাগুলিকে এবং বিশেষভাবে লেনিন ও মাও-কে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল। আর সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল ভারত ও চীনের অবস্থার পার্থক্য বর্ণনায়! কী সাংঘাতিক সমস্যা! ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এশিয়ার বৃহত্তম দেশের (ঘটনাক্রমে যেটি আমাদের প্রতিবেশীও বটে) মহান বিপ্লব থেকে এবং তার অবিসম্বাদি নেতা মাও সে তুঙ-এর চিন্তাধারা থেকে কোনো শিক্ষা নিতে অস্বীকার করল। এই মহান নেতার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা নয়, সম্ভ্রম নয়, ছিল শুধু বিদ্রুপ।

পি সি যোশীর লাইনের পরাজয় এবং তেলেঙ্গানা (১৯৪৬-১৯৫১)-র উত্থান ও পতনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনটি স্বতন্ত্র লাইন আত্মপ্রকাশ করে। রণদিভে অ্যান্ড কোং-এর ফেরি করা লাইন চীন বিপ্লবের তাৎপর্যকে নস্যাৎ করে মাও-কে আরেকজন টিটো বলে ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণ করা হয়। এই লাইনে শ্রমিকশ্রেণীর শহরভিত্তিক বিদ্রোহগুলিকে ভিত্তি করে যুগপৎ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ওকালতি করা হয়। চীন বিপ্লব এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে স্টালিনের একেবারে গোড়ার দিককার অবিশ্বাস থেকে রসদ সংগ্রহ করে গড়ে ওঠা এই বাম হঠকারী লাইনটি অবশ্য শেষপর্যন্ত চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অন্ধ্র সম্পাদকমণ্ডলীর লাইন তেলেঙ্গানার বীরত্বপূর্ণ লড়াই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীন বিপ্লব ও মাও-এর শিক্ষাকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু অন্ধ্র নেতৃত্ব অন্ধ্র মহাসভার সাথে একযোগে নিজামের সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে লড়লেও নেহরু সরকার ও তার সেনাবাহিনীর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জটিল প্রশ্নটির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য সম্ভবত সেটা করা যায়নি, আর তার ফলে পার্টির মধ্যেকার দুই লাইনের লড়াই কোনো যুক্তিসম্মত পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। এ সত্ত্বেও তেলেঙ্গানা আজ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একটি অংশ যে চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার এবং কৃষি-বিপ্লবকে অক্ষ হিসাবে ধরে ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি সুসংহত লাইনের বিকাশ ঘটানোর ঐকান্তিক প্রয়াস চালিয়েছিল সেকথাও স্মরণ করিয়ে দেয় এই মহান সংগ্রাম।

নেহরু সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরেছিল আর সেই পথকে মুড়ে দিয়েছিল জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মতো চটকদার কিছু সংস্কারের আস্তরণে। তেলেঙ্গানার লড়াইয়ে ধাক্কা আসায়, ইতিমধ্যেই বস্তুগত পরিস্থিতি অজয় ঘোষ ও ডাঙ্গের তুলে ধরা মধ্যপন্থী লাইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল হয়ে উঠেছিল। এই লাইন চীনা ও ভারতীয় পরিস্থিতির ফারাককে বিরাট বাড়িয়ে দেখেছিল এবং পার্টিকে সংসদীয় পথে ঠেলে দিয়েছিল।

১৯৫৭ সালে কমিউনিস্টরা কেরালায় সরকার গঠনে সক্ষম হয়। কিন্তু মৌলিক কৃষিসংস্কারের চেষ্টা শুরু করা মাত্র সরকারকে ফেলে দেওয়া হল। সংসদীয় লড়াইকে কাজে লাগানোর কৌশলের বিবর্তনের পথে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বাস্তব অভিজ্ঞতা কৃষক সংগ্রামের বিকাশের প্রয়োজনীয়তা এবং সমস্ত সংসদীয় লড়াইকে সংসদ বহির্ভূত সংগ্রামের অধীনে পরিচালনার বিষয়টিকে পুনরায় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরল। কিন্তু পার্টি সে শিক্ষা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং পুরোনো পথেই চলতে থাকল। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে, ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের উত্থান এবং ভারত-চীন যুদ্ধের পর পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হল। ডাঙ্গেপন্থী নেতৃত্ব উগ্রজাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়ে তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ পথে অ-পুঁজিবাদী উন্নয়ন’-এর তত্ত্ব ফেরি করতে শুরু করে। সিপিআই-এর জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন কালক্রমে তাকে কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত করে। এই লাইন অনুযায়ী হয় ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের অস্তিত্ব নেই, অথবা যদি থেকেও থাকে, কংগ্রেস সরকার স্বয়ং তার মোকাবিলা করতে সক্ষম।

অপর গোষ্ঠী সিপিআই(এম) তার মধ্যপন্থী লাইন নিয়ে এগিয়ে চলল। অতীতের রণদিভে-উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় স্ট্যালিনকে তাঁরা মাও-এর মুখোমুখি দাঁড় করালেন আর তার ফলে ক্রুশ্চেভকেও পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলেন না। এই সংগঠন ‘জনগণতন্ত্রের’ কথা বলে, কিন্তু তাদের কল্পনায় লালিত জনগণতন্ত্রের ছবিটির সাথে বেশি সাদৃশ্য আছে পূর্ব ইউরোপীয় ধরনের জনগণতন্ত্রের মডেলগুলির। এঁরা চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতার মহতী শিক্ষাগুলিকে কালিমালিপ্ত করেই চলেছেন। মাও সে তুঙ চিন্তাধারা এঁদের কাছে উপহাসের বস্তু। ইদানিংকালে, সিপিআই(এম)-এর মুখ্য তাত্ত্বিক মুখপাত্র বাসবপুন্নাইয়া মাও-এর প্রতি আক্রমণ আরও শাণিত করেছেন[]। দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে মাও-এর দার্শনিক অবস্থান এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্পর্কে তাঁর কৌশল নিয়ে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন তিনি। সিপিআই(এম) আজও প্রচার করে চলেছে যে ভারত ও চীনের পরিস্থিতিগত বৈসাদৃশ্যের কারণে ভারতে পার্টিজান সংগ্রাম অসম্ভব। শুধু তাই নয়, চীন বিপ্লব সম্পর্কে সিপিআই-এর পুরোনো মূল্যায়নটি নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই মূল্যায়ন অনুযায়ী, ঘাঁটি এলাকাগুলি এবং লালফৌজ চীনে এমন কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত সৈন্য সমাবেশই নাকি চীন বিপ্লবের বিজয়ের প্রধান কারণ।

সিপিআই-এর উগ্রজাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে ছিলেন। পার্টি সংসদীয় কার্যকলাপে এগিয়ে চলে এবং তারপর উত্তাল গণআন্দোলনের শীর্ষারূঢ় হয়ে এক সুবিধাবাদী সমঝোতার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। কিন্তু নকশালবাড়ি আন্দোলন দমনে এই সরকারের ভূমিকা অচিরেই নেতৃত্বের সংশোধনবাদী চরিত্র উদ্ঘাটন করে দিল। সমস্ত দিক থেকে পার্টির মধ্যে একটি সর্বাত্মক বিদ্রোহের পরিস্থিতি পেকে উঠছিল এবং অবশেষে সত্যিই এক বিদ্রোহ হল – পশ্চিমবঙ্গে ও কেরালায় সিপিআই(এম)-এর শক্তি প্রভূত পরিমাণে ক্ষয় পেল। কয়েকটি রাজ্যে তো গোটা রাজ্য কমিটিই নকশালবাড়ি সংগ্রামের সমর্থনে পার্টি থেকে বেরিয়ে এল।

নকশালবাড়িতে অভিব্যক্ত হয়েছিল তেলেঙ্গানারই বিপ্লবী ভাবমানস – ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কৃষক সংগ্রামের গুরুত্ব তুলে ধরার এবং চীনের অভিজ্ঞতা ও মাও-এর শিক্ষাকে কাজে লাগানোর এক দুর্জয় আবেগ। সময়টা অবশ্য অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। নকশালবাড়ি দেখা দিল এক নতুন প্রেক্ষাপটে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ততদিনে ঘটে গেছে এক বিভাজন। কংগ্রেসের আপাতগণতান্ত্রিক চেহারার বিভ্রম এবং তথাকথিত ভূমিসংস্কারের চটকদারিত্ব তখন দ্রুত অপসৃয়মান, দেশ গুরুতর কৃষিসংকটের সম্মুখীন, সবুজ বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের মাধ্যমে যা থেকে মুক্তি খোঁজা হচ্ছিল। সর্বোপরি, দেখা দিয়েছিল ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক সংকট, যার প্রতিফলন ঘটেছিল কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রথম পরাজয়ে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নকশালবাড়ি ঘটেছিল এক চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতিতে, যখন শাসকশ্রেণী পুরোনো কায়দায় তার শাসন বজায় রাখতে পারছিল না। নকশালবাড়ি ছিল হতমান ও ক্ষয়িষ্ণু শাসকশক্তির ওপর সরাসরি এক চরম আঘাত। অপরদিকে পুলিশের কৃষক ও বিপ্লবী নিধন অভিযান পরিচালনা করে পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজের অবস্থানটিকে বুঝিয়ে দিল।

যেহেতু পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম তাই ফলশ্রুতিও হল ভিন্নতর। নকশালবাড়ি নকশালবাড়িতেই থেমে থাকেনি। প্রথমে এআইসিসিসিআর এবং তারপর সিপিআই(এমএল) গঠনের পর দাবানল ছড়িয়ে পড়ল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। নতুন বিপ্লবী পার্টি বিশেষ জোর দিয়েছিল লেনিনবাদ এবং মাও সে তুঙ-এর নেতৃত্বে আধা-ঔপনিবেশিক চীনে তার প্রয়োগের গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যে দিয়ে প্রবহমান লোহিতরেখার ওপর। ভারতীয় ধাঁচের সংশোধনবাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পার্টি তার পথনির্দেশক মতাদর্শে কেবল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নয়, মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকেও একাত্ম করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারতীয় ও চীনা পরিস্থিতির মধ্যকার সাদৃশ্যের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে, কিছু ব্যক্তি যাঁরা নিজেদের মাওবাদী কমিউনিস্ট বলে জাহির করেন, তাঁদের মতো কখনই এই পার্টি নিজেকে মাওবাদী পার্টি বলে প্রচার করেনি, বরং ভারতের প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি হিসাবেই নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। সূচনাপর্বে, ভারতীয় বিপ্লবের সম্পূর্ণ নতুন যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপে পার্টির কাছে চীনা মডেলটির অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না, যে মডেল সে সময় ভিয়েতনামে তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও গণমুক্তি সংগ্রামে দিশারী হয়ে উঠেছিল।

তেলেঙ্গানা যেন তার সমস্ত প্রাণোচ্ছ্বাস আর সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে জেগে উঠল। আকাশ বাতাস মুখরিত হল গেরিলাযুদ্ধ, লালফৌজ আর ইয়েনানের শ্লোগানে, অনুরণিত হল লং-মার্চের গানে গানে। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে উঠল প্রধান ঘাঁটি আর সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল এই আন্দোলন। হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক-যুবতীরা দামাল দিনের উত্তাল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি নতুন ধারা হিসাবে নকশালপন্থা জাতীয় জীবনে যুক্ত হল, নতুন একটি শব্দ হিসাবে সংযোজিত হল রাজনৈতিক অভিধানে।

তবে এই উচ্ছ্বাস বেশি দিন টিকল না। যাকে বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্ত বলে মনে হয়েছিল তা যে আসলে একটি পূর্ণাঙ্গ মহড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সেকথা অচিরেই বোঝা গেল। শত শত বিপ্লবী অকালে ঝরে গেল, হাজার হাজার কর্মীকে জেলে পোরা হল, ঘনিয়ে এল নৈরাশ্য আর বিষাদের অন্ধকার। আর সবসময় যা হয়ে থাকে, এই অন্ধকারের অনুচর হয়ে এল বিভ্রান্তি, ভাঙ্গন আর বিভাজন। বিভিন্ন পার্টি নেতার অবস্থান সম্পর্কে কেউই সুনিশ্চিত হতে পারছিল না। লোকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তাদের অবস্থান পাল্টাতে লাগল। গতকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর কমরেডরা রাত পোহাতেই প্রতিপক্ষ বনে গেল।

অনেকের কাছে মুক্তির স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল দুঃস্বপ্ন। জেল থেকে এল নেতাদের আবেদন, ছিন্নভিন্ন সংগঠনকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলল। কিন্তু কোনো কিছুই এই ভাঙ্গনের স্রোতকে রুখতে পারল না। নির্বিকার ইতিহাস তার নিজের পথে এগিয়ে গেল। এককালে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকের মনে হল আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে চিরতরে, অন্য অনেকে ১৯৭০ দশকের মধুর স্মৃতি সম্বল করে দিন গুণতে লাগলেন এই বৃথা আশায় যে পুরোনো স্লোগানগুলির বলিষ্ঠ পুনরুচ্চারণে হয়তো আবার ফিরিয়ে আনবে পুরোনো দিনগুলি। অপর একটি অংশ এই সাদামাটা অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে রইলেন যে, ছত্রখান হয়ে যাওয়া পুরোনো সমস্ত শক্তিকে যেভাবে হোক ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেই বোধ হয় পরিস্থিতিটা পাল্টানো যেত।

আন্দোলনের এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় উপদল গঠনের সমস্ত সম্ভাব্য প্রবণতা ও প্রচেষ্টাগুলি মাথাচাড়া দিতে থাকল, শুরু হল এক তিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক। বিভিন্ন ধরনের মানুষ, এমনকি যাঁদের ভাবা গিয়েছিল একেবারে শেষ হয়ে গেছেন বা চিরদিনের মতো চুপ করে গেছেন, তাঁরাও বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসতে লাগলেন। আর তাঁদের সাথে ফিরে এল সেই সব প্রশ্ন যেগুলির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে বলে ভাবা হয়েছিল।

বিষয়টা ছিল, কীভাবে আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায়। কেউ কেউ মনে করেছিলেন খতমের লাইন, নির্বাচন ও ট্রেড ইউনিয়ন বয়কটের লাইন ইত্যাদি বাতিল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ সিপিআই(এমএল)-কেই বাতিল করার কথা ভেবে বসে রইলেন। তাঁদের মতে এআইসিসিসিআর-কে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলেই আন্দোলনকে চাঙ্গা করা যাবে।

জরুরি অবস্থা জারির পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গেই চারু মজুমদারকে এক ব্যর্থ বিপ্লবী নায়ক হিসাবে হাজির করার চেষ্টা হল। মঞ্চে তখন জাঁকিয়ে বসেছিলেন এস এন সিং এবং তাঁর পিসিসি। এরপর চরম আঘাতটি এল কানু সান্যালের কাছ থেকে। সবাইকে তিনি জানালেন, নকশালবাড়ির সংগ্রাম আসলে ছিল তারই মস্তিষ্ক প্রসূত, চারুবাবুর বাম-হঠকারী হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করতে তিনিই এ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। আর চারু মজুমদার যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাথে কৌশলগত চুক্তিতে আসার (সম্ভবত ১৯৫১ সালে পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক তেলেঙ্গানা সংগ্রাম প্রত্যাহার করে নেওয়ার পুরোনো ঢঙে) কানুবাবুর প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে আন্দোলনের ধ্বংস ডেকে আনেন!

পশ্চিমবঙ্গে সমাজগণতন্ত্রীদের জমানায় এবং অন্ধ্রেও যখন এইসব ব্যাপার ঘটছে (সি পি রেড্ডি গোষ্ঠী সহ শ্রীকাকুলামের নেতৃত্বের অবশিষ্টাংশ এস এন সিং-এর সঙ্গে ততদিনে হাত মিলিয়েছেন) তখন বিহারের ইতিহাসটি ছিল একেবারে অন্যরকম, আর নিশ্চিতভাবেই তার এই স্বাতন্ত্র্যের শুরু আরও অনেক আগে থেকেই।

স্বাধীনতা সংগ্রামের গান্ধীবাদী রণকৌশলের বিকল্প হিসাবে এবং তার বিপরীতে, বাংলা যদি সন্ত্রাসবাদ ও সুভাষ-ঘরানার ‘বামপন্থা’র জন্য উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে, এবং বম্বেতে যদি সাড়া জাগানো শ্রমিক ধর্মঘট হয়ে থাকে, বিহার তবে সামনে এসেছিল সেই ৩০-এর দশকেই শক্তিশালী কিষাণসভা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।

গান্ধী বিহারের চম্পারণে কৃষক সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়েই তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে, অথচ ‘স্বদেশী’ জমিদারদের গায়ে যাতে আঁচড়টি না লাগে এমনভাবে, কৃষকদের শান্তিপূর্ণ, অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সামিল করার কৌশল আবিষ্কার করেন। বিহারের কৃষকশ্রেণী কংগ্রেস নেতৃত্বের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আহ্বানে সোৎসাহে সাড়া দিয়েছেন, কিন্তু কখনই তাঁরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনের বেঁধে দেওয়া সীমায় নিজেদের আটকে রাখেননি। বরং তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই জমিদারদের বিরুদ্ধে সক্রিয়, কখনও কখনও সহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সামাজিক স্তম্ভ ছিল এই জমিদাররা। কৃষকরা তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের নিজেদের মতো করে আন্দোলনের এই ডাকগুলিতে সাড়া দিয়েছিলেন। বাস্তব জীবনের এই সংঘাত বিহারের অন্তর্বর্তী কংগ্রেস মন্ত্রীসভাকে (যা ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল) বাধ্য করল জমিদারদের সাথে একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করতে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিপরীতে, কংগ্রেসের একটি শাখা হিসাবে শুরু হওয়া কিষাণসভা ক্রমশ কংগ্রেস থেকে সরে যায় এবং বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের পতাকাতলে আসে। এর একটি বড় অংশ পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কিষাণসভা আন্দোলনের সময়ে জাতভিত্তিক মেরুকরণ পিছনে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন বা আম্বেদকর ধাঁচের দলিত আন্দোলন অথবা জগজীবন রামের হরিজন স্বার্থের বিষয়টি – কোনোটিই বিহারে কখনও বিশেষ আমল পায়নি। সিপিআই এবং সমাজবাদীরা কিন্তু সেখানে সাফল্যের সঙ্গে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এখনও যদি বিহারে সিপিআই-এর মজবুত সংগঠন থেকে থাকে তবে তা প্রধানত কিষাণসভা আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং ১৯৫০-এর দশকে তেলেঙ্গানার সময়কার কিছু ইতিবাচক সাফল্যের জন্যই।

স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে, পাছে তেলেঙ্গানা-ধরনের লড়াই আবার শুরু হয়ে যায়, তাই আগাম প্রতিষেধক হিসাবে বিহারকে আরও একবার বিনোবা ভাবের সর্বোদয় পন্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বেছে নেওয়া হল। এককালের সমাজবাদী এবং কিষাণসভা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী জয়প্রকাশ নারায়ণকে বিহারের সর্বোদয়ের মূল প্রবক্তা ও সংগঠক করা হল। কিন্তু বিহারের কৃষি-বাস্তবতার কাছে তাঁদের সমস্ত বাগাড়ম্বর নস্যাৎ হয়ে গেল। ভূদান পর্যবসিত হল চরম ব্যর্থতায়। ব্যর্থমনোরথ বিনোবা ওয়ার্ধায় ফিরে গেলেন আর জে পি-ও সাময়িকভাবে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন। বিনোবা এবং জে পি-র এই পিছু হটার পর মধ্য-ষাটের বিহারে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। আর এই প্রেক্ষাপটেই নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষ প্রতিধ্বনিত হল উত্তর বিহারের মুজফ্ফরপুর জেলার মুসাহারি ব্লকে। কিন্তু সেখানকার সংগ্রামে খুব শীঘ্রই ধাক্কা এল। জে পি আবার একবার তাঁর নব-সর্বোদয় কৌশলে সজ্জিত হয়ে বিশেষ তৎপরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই ডামাডোলের মধ্যে। পরে এটাই তাঁর ‘সর্বাত্মক বিপ্লবের’ তত্ত্ব হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে।

জে পি যখন নকশালবাদের ‘ভয়াবহ বিপদ’-কে রোখার ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, বিপ্লবী কমিউনিস্টরাও তখন বিহারের বিভিন্ন অংশে কৃষক সংগ্রামের বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শুরুতে তাদের সামান্যই সাফল্য আসে। কিন্তু ১৯৭১-এর শেষে ঠিক যখন বাংলার ধরনে ঘটনাগুলি ঘটছিল, তখন একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে মধ্য বিহারের দুটি জেলা ভোজপুর এবং কিছুটা কম মাত্রায় পাটনা থেকে উৎসাহজনক সংকেত পাওয়া যেতে লাগল। বর্তমান সামাজিক অবস্থার গভীরে সুপ্রোথিত ভোজপুর ও পাটনার এই সংগ্রাম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুরু হয়। আর তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে স্থানীয় নেতৃত্বের এক অ-চিরাচরিত কেন্দ্র।

দেশজুড়ে আমাদের বীর শহীদরা কতই না রক্ত ঝরিয়েছেন ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে, নির্যাতন কক্ষে, জেলের কুঠরিতে – চিরভাস্বর তাঁদের সেই আত্মবলিদান গগনচুম্বী হয়ে ভোজপুরের আকাশ উদ্ভাসিত করল অপূর্ব এক রক্তিম আভায়। আর এই দ্যুতি, এই ঔজ্জ্বল্য কোনো ক্ষণপ্রভ উল্কার ছিল না, ছিল এক লাল তারার – যে তারার উদয় হয়েছে দীপ্তিমান হয়ে থাকার জন্যই। পরবর্তী বছরগুলি একথা প্রমাণ করে দিয়েছে।

কৃষক সংগ্রামের স্বতস্ফূর্ত স্বাধীন ধারা এবং সেই স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে সচেতনতা দেওয়ার জন্য পার্টির ঐকান্তিক প্রয়াস – এই জটিল প্রক্রিয়াটি ঐক্য ও সংগ্রামের এক বিচিত্র পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। অগ্রণী কৃষক যোদ্ধাদের মধ্যে থেকে কমিউনিস্ট সংগঠকদের গড়ে তোলার জন্য পার্টি  কঠোর পরিশ্রম করেছে; এই সংগঠকরা আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ত নেতিবাচক প্রবণতাগুলি রোধ করার ও আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার জন্য সদাসচেষ্ট থেকেছেন। তবে কখনও কখনও পার্টির তরফ থেকে সংগ্রাম ও সংগঠন সম্পর্কে তার গোঁড়া ধ্যানধারণাকে আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ভালোরকম চেষ্টাও চলেছে যা অবধারিতভাবে উল্টো ফল দিয়েছে।

পরিশেষে, জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্টি জুড়ে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং বিকাশমান কৃষক সংগ্রামে নতুন গতি সঞ্চার করে। আর এভাবেই আমরা ব্যাপক কৃষক-গণজাগরণের বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছি।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এই গোটা বিকাশ প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন এস এন সিং[] যিনি আবার বিহার তো বটেই খোদ ভোজপুরেরই মানুষ। চারু মজুমদারের ভূত তাঁকে বিহার ছাড়া করল। শুধু তাই নয়, এ রাজ্যের কমিউনিস্ট বিপ্লবী মহলে তিনি হয়ে দাঁড়ালেন সবচেয়ে নিন্দিত ব্যক্তি।

প্রসঙ্গক্রমে, সিপিআই(এমএল)-এর প্রথম এবং এ পর্যন্ত একমাত্র মৌলিক বিভাজনের ‘কৃতিত্ব’টি আর কারও নয়, এস এন সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিহার রাজ্য কমিটিরই প্রাপ্য! অন্য সব বিভাজনগুলি হয় কৃত্রিম, নয়তো সাময়িক অথবা তাৎপর্যহীন। কয়েকটি গোষ্ঠীর তরফ থেকে একটি সুসংহত ‘বাম’ লাইন সূত্রবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল, এখনও তা চলছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সেরকম কোনো লাইনের বিকাশ ঘটেছে বলে কেউ দাবি করতে পারছেন না। আধা-নৈরাজ্যবাদ এখনও পর্যন্ত বড়জোর সংগ্রাম ও সংগঠনের রূপ ও পদ্ধতিগত একটি প্রবণতা মাত্র, যা নিয়ে বিতর্ক এখনও অব্যাহত। এই প্রবণতায় এখনও যাদের বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন রয়েছে তাঁদের একটা বড় অংশই ফিরে আসবেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাতলে, কারণ সময় তাঁদের অভিজ্ঞ করে তুলবে আশা করা যায়। বিপরীতে এস এন সিং-এর ছিল সুনির্দিষ্ট বিকল্প কৌশলগত লাইন যেখানে সুনির্দিষ্ট সামাজিক শক্তিগুলির সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের ওকালতি করা হয়েছে। আর সে কারণেই তাঁকে বারে বারে কবর থেকে তুলে আনা হয়েছে, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও আমাদের আন্দোলনের অন্য একটি মেরুতে তিনি বারবার উঠে আসছেন। ধনী চাষিদের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নেই চারু মজুমদারের সাথে তাঁর মৌলিক মতপার্থক্য শুরু হয়েছিল। তিনি ধনী চাষিদের সাথে ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সি এম জোর দিয়েছিলেন সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের নিষ্ক্রিয় রাখার উপর। ফলত এই লাইন (এস এন-এর লাইন) হয়ে ওঠে জমিদার শ্রেণীর কয়েকটি অংশের সাথে এবং বিরোধীপক্ষের বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য গড়ার লাইন। (ভাস্কর নন্দী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সূত্রের ভিত্তিতে এই ঐক্যকে তত্ত্বায়িত করে এস এন-কে সাময়িকভাবে বোকা বানিয়েছিলেন। তবে এস এন দ্রুতই নিজেকে নন্দীর ভ্রান্ত তত্ত্বচর্চা থেকে সরিয়ে এনেছিলেন)।

পরবর্তীকালে, যুক্তফ্রন্টের প্রশ্নে এসএন এবং আমরা উভয়েই কংগ্রেসী শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক বিকল্পের বিকাশ ঘটানোর একই সূত্র থেকে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সাদৃশ্য এ পর্যন্তই। কারণ এস এন, জে পি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে, জনতা দলের নেতৃবৃন্দ ও বেশ কিছু উদারপন্থীর সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে, কৃষি-বিপ্লবের নির্ধারক ভূমিকাকে খারিজ করে দিলেন। এমনকি তিনি আপোশের রাস্তায় এতটাই এগিয়ে গেলেন যে সর্বাহারা শ্রেণী গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে আবার নাও পারে – অধুনা-খ্যাত এই সূত্রায়নটি পর্যন্ত উদ্ভাবন করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হলেন না। একথা সত্যি যে বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা ও চাপে পড়ে এস এন-কে তাঁর ঘোষিত অভিমত সম্পর্কে বেশ কিছু আপোশ-মীমাংসায় আসতে হয়েছিল। কিন্তু মূলত সেগুলি ছিল কৌশল মাত্র এবং তা তাঁর প্রকৃত অবস্থানকে প্রভাবিত করেনি।

অন্যদিকে, আমরা কৃষক সংগ্রামকে সাহসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে দাঁড়াই। এই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে ধনী কৃষকদের সেইসব প্রতিপত্তিশালী অংশকেও আঘাত হেনেছিল, বিহারে যারা ভালোরকম সামন্ততান্ত্রিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকে। এক কথায়, এইসব সংগ্রামের ভিত্তিতে আমরা শ্রমিক, কৃষক এবং পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবী জোটকে কংগ্রেসী শাসনের বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে থাকি। অবশ্য আমরা বিরোধী বুর্জোয়া দল ও গোষ্ঠীগুলির সাথে কৌশলগত কার্যকলাপের জন্য দরজা খোলা রেখেছিলাম।

দুই কৌশলগত লাইনের লড়াইয়ের এই প্রেক্ষাপটেই বিহারের কৃষক সংগ্রাম বিকশিত ও সম্প্রসারিত হতে থাকে।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক স্বতন্ত্র বিন্যাসের মধ্যে উদ্ভূত বিহারের কৃষক সংগ্রাম চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সমর্থন পায়নি। আর তীব্র গোষ্ঠী বিভাজনের পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনের জন্য ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী গ্রুপের থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দূরে থাক, সহানুভূতিসূচক একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। নকশালবাড়ি এবং শ্রীকাকুলামের সংগ্রাম চলাকালীন পরিস্থিতি থেকে এই পরিস্থিতি ছিল প্রকৃতপক্ষেই বিরাটভাবে আলাদা। তবে বিভিন্ন মহল থেকে এই আন্দোলনকে ব্যাপক সংহতি জানানো হয়েছে। সত্যি বলতে কী, এতগুলি বছর ধরে আন্দোলনকে ধরে রাখা অসম্ভব হতো, যদি না ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব এবং ঐক্যবদ্ধ সিপিআই(এমএল)-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মূল্যবান নির্দেশনা ও বিভিন্ন গ্রুপে থাকা কমিউনিস্ট বিপ্লবী কর্মী, মার্কসবাদী শিক্ষাবিদ, বিপ্লবী গণতন্ত্রী, মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, সত্যান্বেষী সাংবাদিক, প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল প্রবাসী ভারতীয় এবং চীন, নেপাল, ফিলিপিনস, পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বিদেশী বন্ধুদের সমর্থন না পাওয়া যেত।

বিহারের বর্তমান সংগ্রাম সেই জেলাগুলিতেই বিস্তৃতি লাভ করেছে যেখানে অতীতের কিষাণসভা আন্দোলন থেকেই এক লড়াকু ঐতিহ্য রয়েছে। এইসব জেলায় বৃহৎ ভূস্বামীতন্ত্রের নজির কম থাকলেও জমিদারতন্ত্র ব্যাপকতর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ এর মধ্যে শুধু প্রাক্তন মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই নয়, পূর্বতন শক্তিশালী রায়তরা পর্যন্ত রয়েছে। বিহারের অন্যান্য অংশের তুলনায় এসব জেলার কৃষি আধুনিক পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং বাজারমুখী গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য। এইসব জেলায় কৃষি সংক্রান্ত যেসব প্রশ্ন সামনে এসেছে, সেগুলি সারা ভারতেই গ্রামীণ দরিদ্রদের পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেমন ন্যূনতম মজুরি; প্রজাস্বত্বের অধিকার; খাস, বেনামি, সম্প্রদায়গত এবং সরকারি জমির দখল; শস্যের অভাবী বিক্রয় রোধ; বিভিন্ন কৃষি উপকরণের সুলভতা ইত্যাদি। এককথায়, বহুলাংশেই এই অঞ্চল পরিবর্তনশীল ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি।

ভারতীয় কৃষি আজ এক নতুন সংকটের সম্মুখীন যে সংকটের কারণ সবুজ বিপ্লবের রণনীতির সংপৃক্তি এবং ‘অতি-উৎপাদন’। এই সংকটের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে নতুন ধরনের চাষি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছে। বিশেষত মহারাষ্ট্রে এই আন্দোলন পেয়েছে এক উর্বর জমি এবং শারদ যোশীর মতো এক শক্তিশালী প্রবক্তা। যোশী মহাশয় দরিদ্র গ্রামীণ ভারত[] বনাম ধনী শহুরে ‘ইন্ডিয়া’ দ্বন্দ্বের[] ওপর তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন। তিনি দেশের যাবতীয় সমস্যার সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছেন। আর তার জন্য সবকিছু ছেড়ে একমাত্র গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর একদফা দাবি : কৃষিপণ্যের লাভজনক মূল্য। গ্রামীণ জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে কোনো বড় ধরনের সংঘাতের বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে, একথা তিনি বিশ্বাস করেন না। আর না বললেও চলে, তাঁর ধারণার কৃষকরা আসলে ধনী ও মধ্য চাষি ছাড়া আর কেউ নয়। স্বভাবতই সেকারণে তিনি কৃষি শ্রমিকদের ওপর বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেননি। মিঃ যোশী মনে করেন, প্রথমত, কৃষকদের অর্থনৈতিক লাভ হলে তা আপনা-আপনি পূর্বোল্লিখিত শ্রেণীটির (কৃষিশ্রমিক) কাছে উচ্চতর মজুরির আকারে চুঁইয়ে আসবে। দ্বিতীয়ত সামাজিক রূপান্তর সাধনের ইতিহাসে সবচেয়ে নীচুতলার মানুষের কোনো অগ্রণী ভূমিকা কোনোদিন থাকেনি, থাকতে পারেও না।

তাঁর কর্মধারায় আলোড়নমুখী দিক থাকা সত্ত্বেও দলবিহীন রাজনীতির জন্য তাঁর নাছোড়বান্দা মনোভাব, কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রবণতা এবং গ্রামীণ উন্নতির উপর এই জোর মিঃ যোশীকে সর্বোদয়ীদের কাছের মানুষ করে তুলেছে, যাঁরা সম্ভবত বিনোবা এবং জে পি-র মৃত্যুর পর নতুন কোনো ত্রাণকর্তার সন্ধানে ছিলেন।

এইভাবেই আজ কৃষক আন্দোলনের আঙ্গিনায় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে একদিকে বিহার ও অন্যদিকে মহারাষ্ট্র থেকে বয়ে আসা পূবালী ও পশ্চিমা বাতাসের মধ্যে এক জবরদস্ত সংগ্রাম। মহারাষ্ট্রের চাষি আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যাচ্ছে বিহারে। সেখানে কৃষক সংগ্রামের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেন কৃষি-শ্রমিকরা, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর তাঁদের সাথে রয়েছেন দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্য কৃষকরা। অন্যদিকে, আক্রমণের একটি লক্ষ্যবস্তু হিসাবে অন্তত বর্তমান পর্যায়ে  রয়েছে কুলাকদের এক বিরাট অংশ, কোনো কোনো অঞ্চলে যাদের মধ্যে আছে কিছু কিছু অনগ্রসর জাতির কুলাকরাও। কিন্তু বিহারের কৃষক আন্দোলন আমূল ভূমিসংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও, সবুজ বিপ্লবের সংকট থেকে উদ্ভূত যেসব ইস্যু মধ্য ও উচ্চ-মধ্য কৃষকদের একটা বিশাল অংশকে প্রভাবিত করে সেগুলিকেও ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এই দুটি হাওয়ার মধ্যেকার যুদ্ধের পরিণতি এখনও নির্ধারিত হয়ে যায়নি। ভারতের ইতিহাসে যা হয়তো সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মহাকাব্য হয়ে উঠবে তার চূড়ান্ত দৃশ্যগুলি এখনো আমরা দেখতে পাইনি। তবুও যখন অজানা, অচেনা, ধূলিধূসর মেঠোপথের ছোট্ট মফঃস্বল শহর আরওয়ালে[] দরিদ্রতম কৃষকদের মামুলি মৃত্যু বিহারে ক্ষমতাসীন শক্তির রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে তোলে, তখন গভীর প্রত্যয়ে ঘোষণা করাই যায় : নায়করা অবশেষে মঞ্চে এসে গেছেন।

টীকা

  • (১) পাশবিক অত্যাচারের মুখে নকশালবাড়ি থেকে উদ্ভূত প্রথম বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ধাক্কার কথা এখানে বলা হচ্ছে।
  • (২) সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বিহারে তাঁদের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই যুক্তিটিই দিয়েছিলেন।
  • (৩) সোসাল সায়েন্টিস্ট পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সংখ্যা প্রকাশিত “বৈরী ও অবৈরী দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে” দেখুন।
  • (৪) লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এস এন একসময় ভোজপুরের সংগ্রামকে জগজীবন রামের টাকায় ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বলে অপবাদ দিয়েছিলেন। পরে পিসিসি নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশও ভোজপুরের সংগ্রামকে সম্পূর্ণভাবে জাত-পাতের লড়াই বলে খারিজ করে দেয়। প্রয়াত কমরেড সি পি (কমরেড চন্দ্রপোল্লা রেড্ডী – সম্পাদক) আমার (কমরেড ভি এম-এর – সম্পাদক) সাথে সাক্ষাতকারে জানান যে কীভাবে চীনা কমরেডদের ভোজপুর সম্পর্কে বারংবার অনুসন্ধানের জবাবে ভাস্কর নন্দী বারে বারে একই অপবাদ দিয়েছিলেন। সি পি অবশ্য তাঁদের সাথে ভিন্নমত ছিলেন এবং ভোজপুরে যেভাবে খতম অভিযান চালানো হয়েছে তার ব্যবহারিক যৌক্তিকতা মেনে নিতেও তিনি অনেকটা প্রস্তুত ছিলেন।
  • (৫) মজার ব্যাপার হল, মিঃ যোশী তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে লেনিনের বিরোধিতায় রোজা লুক্সেমবার্গের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। স্ট্যালিন যেভাবে কুলাকদের বিষয়টি দেখেছেন তারও তিনি বিশেষ বিরোধী। অবশ্য মাও সে তুঙ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানা যায়নি।
  • (৬) এটা স্বীকার না করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে যে, শহরের দরিদ্রদের কয়েকটি অংশও তাঁর গ্রামীণ ভারতের অন্তর্ভুক্ত; যেমন বস্তিবাসীরা। এদের তিনি দারিদ্র্যের তাড়নায় গাঁ-ছাড়া কৃষক বলেই বিবেচনা করেছেন।
  • (৭) ১৯৮৬ সালের কুখ্যাত আরওয়াল গণহত্যার বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।