ইংল্যান্ডে ফ্যাবিয়ান সোসাইটি গঠনের মধ্যে দিয়ে (১৮৮৪ সালে সিডনি ও বিয়াত্রিস ওয়েব, রামসে ম্যাকডোনাল্ড ও বার্নার্ড শ-র মতো অগ্রণী বুদ্ধিজীবীরা যেটা প্রতিষ্ঠা করেন) সংস্কারবাদের সূচনা ঘটে এবং তারপর তা ইউরোপের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলগতভাবে, সংস্কারবাদ বলে যে, কোনো বিস্ফোরণ অর্থাৎ বিপ্লব ছাড়াই পর্যায়ক্রমিক একগুচ্ছ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করা সম্ভব। ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে মার্কসীয় মতবাদের কাছে প্রাক-মার্কসীয় সংস্কারবাদ যখন মোটামুটিভাবে পরাস্ত হল, তখন মার্কসবাদের সংশোধনী রূপে, সংশোধনবাদ হিসাবে মার্কসবাদের মাটিতেই তা পুনরায় মাথাচাড়া দিল। সংশোধনবাদের জনক ছিলেন একদা গোঁড়া মার্কসবাদী বার্নস্টাইন, যাঁর বাঁধাবুলি “আন্দোলনই সব, চূড়ান্ত লক্ষ্য কিছু নয়” ছিল কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এর এই ঘোষণার সম্পূর্ণ বিপরীত – আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যেও কমিউনিস্টরা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি, তার রক্ষক। লেনিন সংশোধনবাদের মর্মবস্তুকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে :
“এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকমভাবে চলা, দৈনন্দিন ঘটনাবলী এবং ক্ষুদ্র অর্থে রাজনীতির রদবদলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, সর্বহারার প্রাথমিক স্বার্থগুলোকে, সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং পুঁজিবাদী বিকাশের সমগ্র ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া, এই সমস্ত প্রাথমিক স্বার্থগুলোকে তাৎক্ষণিক সুবিধার (তা প্রকৃত বা মনগড়া যাই হোক না কেন) জন্য বিসর্জন দেওয়া – এই হল সংশোধনবাদের কার্যনীতি। … প্রতিটি 'নতুন' প্রশ্ন, ঘটনাধারায় প্রতিটি আকস্মিক মোড় … সর্বদা কোনো না কোনো রকম সংশোধনবাদের জন্ম দিতে বাধ্য।”
এর বিপরীতে নৈরাজ্যবাদ বিপ্লবী লক্ষ্য পূরণের শর্ত হিসাবে, ধরা যাক ক্ষমতা দখল বা রাষ্ট্রের বিলোপের জন্য, দীর্ঘস্থায়ী গণরাজনৈতিক কার্যকলাপের ভূমিকাকে নাকচ বা অবহেলা করে। এর প্রথম এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবক্তা ছিলেন রাশিয়ার বাকুনিন, যিনি প্রথম আন্তর্জাতিকে মার্কসের বিরোধী ছিলেন। তাঁর তত্ত্ব ছিল, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিলোপই হল আশু কর্তব্য, যে কাজ শ্রমিকরা সম্পন্ন করতে পারবে শ্রমিকদের পার্টি গঠন না করে, রাজনৈতিক সংগ্রাম না চালিয়ে, 'প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ডের' মধ্যে দিয়ে। নৈরাজ্যবাদীরা এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে, রাষ্ট্রের বিলোপের কাজটা ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক স্তরের জন্য নির্ধারিত, কেবলমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের মধ্যে দিয়েই যেটা সম্পন্ন করা সম্ভব (রাষ্ট্র সম্পর্কে অধ্যায়ে এই বিষয়ে আরও আলোচনা করা হবে)। এই ধারার অন্য একটি রূপ হল সিন্ডিক্যালবাদ বা নৈরাজ্যবাদী-সিন্ডিক্যালবাদ যা এই অভিমত ব্যক্ত করে যে, শ্রমিকরা সুশৃঙ্খল সর্বহারার পার্টি ছাড়াই ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে কারখানাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ও ক্ষমতা দখল করতে পারবে। লেনিন নৈরাজ্যবাদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন এইভাবে :
“নৈরাজ্যবাদ হল বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ-এর উল্টো পিঠ। … নৈরাজ্যবাদ হতাশার ফসল। সর্বহারার বিপরীতে অস্থিরমতি বুদ্ধিজীবী বা ভবঘুরের মনস্তত্ব। … সর্বহারার শ্রেণী সংগ্রামকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতা। বুর্জোয়া সমাজের রাজনীতির হাস্যকর নেতিকরণ। … শ্রমিকদের সংগঠন ও শিক্ষার ভূমিকাকে উপলব্ধির ব্যর্থতা। … কতকগুলো একপেশে, অসংলগ্ন উপায়ের সর্বরোগহর দাওয়াই। … রাজনীতির নেতিকরণের নামে শ্রমিকশ্রেণীকে বুর্জোয়া রাজনীতির অধীনস্থ করে তোলা।” (নৈরাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্র, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩২৭-২৮)
সংস্কারবাদ/সংশোধনবাদ এবং নৈরাজ্যবাদ/বামবুলি সর্বস্বতা বিপরীতগুলোর এক ঐক্য তৈরি করে : বিপ্লবী মার্কসবাদের প্রতি বিরোধিতায় তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একে অপরে রূপান্তরিত হওয়ার দিকে যায়। লেনিন এই যোগসূত্রটিকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন যখন তিনি লেখেন, “... বাস্তবে নৈরাজ্যবাদীদের বুলিসর্বস্ততা তাদের সুবিধাবাদের সবচেয়ে নগ্ন সহযোগিতে, সুবিধাবাদের উল্টো পিঠে পরিণত করে।”
তিনি আরও বলেছেন, “বুর্জোয়া তাত্ত্বিক, উদারবাদী ও গণতন্ত্রীরা, মার্কসবাদকে উপলব্ধি করতে না পেরে … লাগাতার এক ব্যর্থ চরমপন্থী অবস্থান থেকে লাফিয়ে অন্য চরমপন্থী অবস্থানের দিকে যাচ্ছেন। … নৈরাজ্যবাদী-সিন্ডিক্যালবাদ এবং সংস্কারবাদ উভয়কেই এই বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী ও তার প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফসল বলে গণ্য করতে হবে। তাঁরা শ্রমিক আন্দোলনের একটি দিককে আঁকড়ে ধরেন, একপেশেপনাকে তত্ত্বের পর্যায়ে নিয়ে যান, এবং এই আন্দোলনের সেই সমস্ত প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্যগুলোকে পারস্পরিকভাবে বর্জনীয় বলে ঘোষণা করেন যেগুলো একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের, শ্রমিকশ্রেণীর কর্মকাণ্ডের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন এই প্রবণতা বাস্তব জীবন, বাস্তব ইতিহাসেরই, ঠিক যেমন প্রকৃতিতে জীবন ও বিকাশ ধীর বিবর্তন এবং উল্লম্ফন (অর্থাৎ ধারাবাহিকতায় ছেদ) উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে।
সংশোধনবাদীদের কাছে “উল্লম্ফন” এবং শ্রমিক আন্দোলনের সমগ্র পুরনো সমাজের প্রতি নীতিগতভাবে বৈরী হওয়া সম্পর্কিত যে কোনো বক্তব্যই বুলিসর্বস্বতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তারা সংস্কারকে সমাজতন্ত্রের আংশিক রূপায়ণ বলে গণ্য করে। নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালপন্থীরা “ছোটখাটো কাজ” বিশেষভাবে সংসদীয় মঞ্চকে কাজে লাগাতে অস্বীকার করে। উপরোক্ত কৌশলটি আসলে হল “মহান দিনগুলোর” জন্য অপেক্ষা করে থাকা। যে শক্তি মহান ঘটনাবলীর জন্ম দেয় তাদের সমাবেশিত করার অক্ষমতাই এখানে ফুটে ওঠে। এদের উভয়েই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, সবথেকে জরুরি কাজটিকে ব্যাহত করে। সেটা হল সমস্ত পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম, শ্রেণীসংগ্রামের মর্মতেজে সম্পৃক্ত, নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে অবহিত এবং প্রকৃত মার্কসবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীতে প্রশিক্ষিত এমন বৃহৎ, শক্তিশালী এবং যথাযথভাবে সচল সংগঠনগুলোতে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা।”
সমস্ত দেশে সর্বহারা আন্দোলনগুলোতে দক্ষিণ এবং বাম সুবিধাবাদী প্রবণতাগুলোর আবির্ভাব এবং পুনরাবির্ভাবের অনিবার্যতা নির্ধারিত হয় পেটিবুর্জোয়া বা ছোট ছোট মালিকদের বৃহত্তর স্তরগুলোর মধ্যে সেগুলোর শ্রেণী-মূলের দ্বারা। এই পেটিবুর্জোয়া বা ছোট মালিকরা সর্বহারাদের আশেপাশে, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে বাস করে এবং তাদের মধ্যে থেকে একটি ধারা অব্যাহতভাবে সর্বহারাদের সঙ্গে ও তাদের পার্টিতে যোগ দেয়। কাজেই, প্রতিটি দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঠিক লাইনের বিকাশ সেটার বিরুদ্ধে লাগাতার মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই হতে পারে যাকে আমরা বলতে পারি “দক্ষিণ দিক থেকে সংশোধনবাদ” এবং “বাম দিক থেকে সংশোধনবাদ”।
১৯২০ সাল পর্যন্ত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে লেনিন বামপন্থী কমিউনিজম একটি শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা গ্রন্থে লিখলেন, বলশেভিকবাদ দুটি “শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে শত্রু”র বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিকাশলাভ করে, শক্তি সঞ্চয় করে এবং ইস্পাতদৃঢ় হয়ে ওঠে। একটি শত্রু ছিল দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ বা মেনশেভিকবাদ – “প্রধান শত্রু” – এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে সারা দুনিয়া যথেষ্ট অবহিত। কিন্তু অনেকেই জানে না “পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ, যার মধ্যে নৈরাজ্যবাদের আভাস থাকে” তার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের কথা। “ক্ষুদ্র মালিক … যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বদাই উৎপীড়নের শিকার এবং প্রায়শই যার জীবনযাত্রায় তীব্র এবং দ্রুত অবনতি ঘটার ফলে এবং এমনকি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে সহজেই চরম বিপ্লবী অবস্থানে পৌঁছে যায়, কিন্তু যে সেই অবস্থান রক্ষা করতে, সংগঠিত হতে, শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তা দেখাতে অক্ষম। পুঁজিবাদের বিভীষিকায় প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া পেটিবুর্জোয়া একটা সামাজিক পরিঘটনা যা নৈরাজ্যবাদের মতো সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেরই বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের বিপ্লববাদের অস্থিরতা, তার বন্ধ্যাত্ব, এবং দ্রুতই অধীনতা, অনীহা, বিভ্রমের দিকে, এবং এমনকি বিভিন্ন বুর্জোয়া ঝোঁকের প্রতি উন্মত্ত মোহগ্রস্ততার দিকে প্রবণতা – এ সবই সকলের জানা আছে”।
চীনেও 'দক্ষিণ' ও 'বাম' বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই করার মধ্যে দিয়ে মাও জে দং-এর সঠিক রাজনৈতিক লাইনের বিকাশ ঘটে। এই দেশে এবং তার সাথে রাশিয়াতেও এই উভয় ব্যাধিই – সামগ্রিক দিক থেকে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতিই ছিল প্রধান বিপদ – বিপ্লবের পরও নতুন নতুন রূপে মাথাচাড়া দিতে থাকে। এটা প্রত্যাশিতই ছিল, কেননা পেটিবুর্জোয়ারা তখনও সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং তার শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গী প্রায়শই পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে। এছাড়াও, পুরনো শাসকশ্রেণীগুলো – ক্ষমতা থেকে বহিষ্কৃত হলেও যাদের পুরোপুরি বিলোপ ঘটেনি – আমলাতন্ত্রের মতো বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে পার্টির নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে থাকে।
স্তালিন যেমন বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে “দুই ফ্রন্টে সংগ্রাম – 'বামেদের' বিরুদ্ধে, যারা পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ-এর প্রতিনিধিত্ব করে, এবং দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে যারা পেটিবুর্জোয়া উদারবাদ-এর প্রতিনিধিত্ব করে” (স্তালিন, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৩৭২) – সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের দশকগুলো ধরে চলতে থাকে। স্তালিনের মৃত্যুর পর দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদ পার্টি নেতৃত্বকে কব্জা করে নেয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে আসে। ক্রুশ্চভ সংশোধনবাদী চক্র ঘোষণা করে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বহারার একনায়কত্বের আর কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা তা “সমগ্র জনগণের রাষ্ট্র”-তে পরিণত হয়েছে। এটা ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বুনিয়াদী মতাদর্শগত অবস্থানকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা, যে অবস্থান অনুযায়ী রাষ্ট্র যতদিন থাকবে ততদিন তা অবশ্যই হবে এক শ্রেণীকে বশীভূত করে রাখতে অন্য শ্রেণীর একনায়কত্ব (অর্থাৎ, আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র হবে বুর্জোয়া শ্রেণীর বা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব) এবং যখন এই একনায়কত্বের আর প্রয়োজন থাকবে না তখন রাষ্ট্রেরও আর প্রয়োজন থাকবে না এবং তা বিলুপ্ত হবে (দ্বিতীয় অধ্যায় দেখুন)। রাজনীতিতে সংশোধনবাদীরা “তিনটি শান্তিপূর্ণ” নীতির ওকালতি করল – সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, দুই শিবিরের মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা এবং সংসদীয় পথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ (প্রাক-বিপ্লবী সমাজগুলোতে)। এর অর্থ ছিল সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে পরিত্যাগ করা এবং জাতীয় ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণীগুলোর বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনকে পরিহার করা।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এই আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর এক মতাদর্শগত যুদ্ধ শুরু করল এবং ক্রুশ্চভকে বার্নস্টাইন ও কাউটস্কির অনুগামী বলে অভিহিত করল। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এবং চীনে এই ধরনের দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদীদের দ্বারা ক্ষমতা কব্জা করে নেওয়াকে প্রতিহত করতে মাও জে দং শুরু করলেন এখন যাকে অামরা মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলে জানি। তিনি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করলেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী পুঁজিবাদী পথের পথিকদের দ্বারা পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের বিপদ; তিনি সমাজতন্ত্র নির্মাণের, বিশেষভাবে পশ্চাদপদ দেশগুলোতে, অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মতাদর্শগত সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন; কিন্তু মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এই সমস্যাগুলো সমাধানের পন্থা বিপরীত দিকে, অর্থাৎ 'বাম' বিচ্যুতির দিকে এগিয়ে গেল। উগ্র বাম “চারচক্র” পার্টিতে ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় শেষমেষ তা বিপরীত ফলদায়ী হল। এইভাবে দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এক গুরুতর 'বাম' বিচ্যুতি ঘটে গেল। পেটিবুর্জোয়া হঠকারিতা থেকে জন্ম নেওয়া গুরুতর নৈরাজ্যবাদী অপরিণামদর্শিতার আর একটা সুপরিচিত দৃষ্টান্ত হল কাম্পুচিয়ার পলপট জমানা। এখানে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে পুঁজিবাদের সমস্ত অবশেষগুলোকে নির্মূল করতে এবং একটি পশ্চাদপদ সমাজে কমিউনিস্ট অর্থনীতি গড়ে তুলতে গিয়ে এমনকি অর্থ ও পণ্য বিনিময়কেও বিলুপ্ত করার চেষ্টা হয়েছিল, আর সর্বহারা একনায়কত্ব প্রয়োগের নামে সমস্ত বিরোধী পক্ষকেই পাশবিকভাবে চূর্ণ করা হয়েছিল।
ক্রুশ্চভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মাও-এর সংগ্রামের কথায় ফেরা যাক। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় ও মাঝ পথে তা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে “মহা বিতর্ক”-এর এক প্লাবন সৃষ্টি করল, এবং আমাদের দেশেও তার প্রভাব দেখা গেল। যাঁরা সোভিয়েত সংশোধনবাদের বিরোধিতা করলেন তাঁরা সিপিআই(এম) রূপে নিজেদের সংগঠিত করলেন। কিন্তু নতুন পার্টির নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে মাও জে দং চিন্তাধারার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকার করলেন, এবং রুশ ও চীনা লাইনের থেকে “সম দূরত্ব” বজায় রাখার নামে মধ্যপন্থী বা নয়া-সংশোধনবাদী অবস্থানে নিমজ্জিত হলেন। অতএব সিপিআই(এম)-এর মধ্যেকার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের এই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধেও এক তীব্র সংগ্রাম শুরু করতে হল, যে সংশোধনবাদ যুক্তফ্রন্টের শরিক হিসাবে পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসার পর তার প্রতিক্রিয়াশীল মর্মবস্তুকে উন্মোচিত করল। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে – যাঁরা যথাসময়ে সিপিআই(এমএল) রূপে নিজেদের সংগঠিত করলেন – নিপীড়িত কৃষক জনতার সরাসরি বিদ্রোহের পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন সিপিআই(এম) সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলোর পক্ষে দাঁড়াল। এইভাবে সমাজগণতন্ত্রে তার রূপান্তররণ শুরু হল, যে প্রক্রিয়া পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বিপ্লবী চ্যালেঞ্জের পরাজয়ের ফলে বিপুল লাভবান হল এবং ১৯৭৭ সালে শরিকদের সঙ্গে নিয়ে ঐ দল পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতাসীন হল। বামফ্রন্ট সরকারের একাদিক্রমে ৩৪ বছরের শাসন ধারাবাহিক দক্ষিণপন্থী যাত্রার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সরকার উন্নয়নের নামে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষকদের জোরজবরদস্তি উচ্ছেদ করতে গিয়ে ২০১১ সালে ঐ সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে ঐ প্রক্রিয়া তার চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছালো। বামফ্রন্ট শাসনের গোটা অভিজ্ঞতাটা কী? কেন্দ্রে চরম দুর্নীতিপরায়ণ, জনবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদপন্থী প্রথম ইউপিএ সরকারের পরোক্ষ শরিক হিসাবে সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর ঐ সরকারের লেজুড়বৃত্তি; পশ্চিমবাংলার মডেলের আদলে সিপিআই (এম)-এর ১৯৬৪-র কর্মসূচীর ব্যাপক সংশোধন; এবং পশ্চিমবাংলায় ধাক্কার পর পার্টিতে গভীর রাজনৈতিক সংকট। এই সমস্ত কিছুই আমাদের কাছে সমাজগণতন্ত্রে পরিণত সংশোধনবাদের চূড়ান্ত দেউলিয়াপনাকে প্রকট করে তুলেছে। মাত্র একটি রাজ্যে (বা দু-একটি রাজ্যে) রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেই তার এই পরিণতি হয়েছে এবং সে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কাঠামোয় আরও বেশি অংশগ্রহণের আকাঙ্খা পোষণ করছে।
পরিপূর্ণ রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করা সমাজগণতন্ত্রের একটি সাম্প্রতিক নিদর্শন হল গ্রেট ব্রিটেনে 'নয়া লেবার' দলের সরকার। প্রথমে টনি ব্লেয়ার (১৯৯৭-২০০৭) এবং পরে গর্ডন ব্রাউনের (২০০৭-২০১০) নেতৃত্বে চালিত ঐ সরকার সেই দেশে শ্রমজীবী জনতার সবচেয়ে বড় শত্রু এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বশংবদ সহযোগীদের অন্যতম বলে নিজেকে প্রমাণ করেছে। এখানে এই বিষয়টার উল্লেখ জরুরি যে, এই 'লেবার পার্টি'র মূল রয়েছে ফেবিয়ান সোসাইটির মধ্যে, যা এক সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রবণতা হিসাবে সংস্কারবাদের জন্ম দিয়েছিল। এই দল অতএব সংস্কারবাদের সংশোধনবাদে এবং তার থেকে সমাজগণতন্ত্রে বিকাশলাভ করার গোটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে।
এই অধ্যায় শেষ করতে গিয়ে লেনিনের এই সারগর্ভ পর্যবেক্ষণকে স্মরণ করা যাক যে, নৈরাজ্যবাদ প্রায়শই হল শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে সুবিধাবাদী পাপের দরুণ এক ধরনের খেসারত ('বামপন্থী' কমিউনিজম)। আমাদের দেশে এই নিয়মকে আমরা দুটি ভিন্ন, স্বভাবসিদ্ধ পথে ক্রিয়াশীল হতে দেখেছি। প্রথমত, প্রত্যক্ষভাবে : রণদিভের নেতৃত্বে ১৯৪৮-৫০ সময়কালে পার্টি কেন্দ্রে 'বাম' পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ-এর উত্থান, যা তার আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে ঐক্যের নামে দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবেই উঠে এসেছিল; সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ হিসাবে সিপিআই (এমএল) আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ঢুকে পড়া শিশুসুলভ বামবাদ; কট্টর এবং গভীরে শিকড় চাড়ানো ('শিশু সুলভ' থেকে আলাদা) আজকের মাওবাদী ধারা, সরকারী বামেদের সংসদ সর্বস্বতার সমরবাদী-নৈরাজ্যবাদী সমাধান হিসাবে যার বাড়বাড়ন্ত। দ্বিতীয়ত, এবং যা আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিপরীত ধারায় : অভ্যুত্থান নিয়ে রণদিভের ছেলেখেলার একমাত্র সম্ভবপর বিকল্প হিসাবে ১৯৫২ সাল থেকে সংসদীয় পথে চলা; নকশালবাড়ির পর প্রথম বিপ্লবী অভ্যুত্থানের বিশাল সম্ভাবনার অকাল মৃত্যুর পরিণতিতে সমাজগণতন্ত্রের ফুলে ফেঁপে ওঠা; ধাক্কা পরবর্তী পর্যায়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনের মধ্যে দেখা দেওয়া বিলোপবাদ, যা কিছু 'বাম' বিচ্যুতিকে শুধরে নেওয়ার নামে নিজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে। এই দ্বৈত অভিজ্ঞতা এক দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের প্রক্রিয়ায় আমাদের বিপ্লবী অনুশীলনকে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করে – যে লড়াইটা হবে সাধারণভাবে বাম আন্দোলনে প্রধান বিপদ হিসাবে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের (বিশেষভাবে তার মধ্যপন্থী আবরণে) বিরুদ্ধে এবং বিশেষভাবে নকশালপন্থী বা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনে প্রধান বিচ্যুতি হিসােব 'বাম' হঠকারিতার বিরুদ্ধে।
এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রেখে আসুন আমরা এবার মার্কসীয় তত্ত্বের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করি : (ক) রাষ্ট্র এবং (খ) সাম্রাজ্যবাদ।